আল্লাহ কে, কি তার পরিচয় ঃ-
মুসলিম ধর্ম অনুযায়ী আল্লাহ হচ্ছে তাদের সৃষ্টিকর্তা। যিনি আঠারো হাজার মাখলুকাত সৃষ্টি করছে ।তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব হিসাবে মানুষকে ঘোষণা করেন।তিনি হচ্ছে সমগ্র পৃথিবী এবং মাখলুকের স্রষ্টা ।যে প্রকৃতি সম্পন্ন হওয়ার জন্য কোন সত্তাকে আল্লাহ্ বলে গণ্য করতে হবে তাঁর প্রথম পরিচয় হল সেই সত্তার অবশ্যই সৃষ্টি করার যোগ্যতা থাকতে হবে। “সূরা ৯৬, আয়াত ১”।
তবে একজন মানুষ যখন প্রকৃতির কোন জিনিসের সহযোগিতায় কোন যন্ত্র তৈরি করেন তখন তাঁকে স্রষ্টা (Creator) বলা যায় না। বরং তিনি একজন আবিস্কারক (Inventor)। স্রষ্টার গুণসম্পন্ন তাঁকেই বলা যাবে যিনি কোন কিছুর সাহায্য ছাড়া যখন খুশী, যেমন খুশী, যেভাবে খুশী, যা খুশী, তা সৃষ্টি করতে পারবেন। সেদিক থেকে আল্লাহ্ই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা।আল্লাহ্ কুরআনে বলেন, 57:1
Whatever is in the heavens and earth exalts Allah, and He is the Exalted in Might, the Wise.
57:2
His is the dominion of the heavens and earth. He gives life and causes death, and He is over all things competent.
57:3
He is the First and the Last, the Ascendant and the Intimate, and He is, of all things, Knowing.
তিনি আরও বলেন “নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ্। নভোমন্ডল ও ভূম-লকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। “... শুনে রেখ, তাঁরই কাজ সৃষ্টি করা ও আদেশ দান করা।” “সূরা ৭, আয়াত ৫৮”।
কুরআন অন্যত্র বলা হচ্ছে, “আল্লাহ্ সব কিছুরই স্রষ্টা এবং তিনি সবকিছুর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।” “সূরা ৩৯, আয়াত ৬২”।
বলা বাহুল্য, সৃষ্টিকর্মে আল্লাহ্ কোন সহযোগিতা নেওয়ার প্রয়োজন নেই। শুধু ইচ্ছা হলেই তিনি তৎক্ষণাৎ কোন কিছু সৃষ্টি করতে সক্ষম।” “সূরা ১৬, আয়াত ৪০”।
যিনি স্রষ্টা হবে তিনি সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হবেন না। তিনি সৃষ্টির জণ্য নির্ভূল বিধান প্রণয়ন করার ক্ষমতা রাখবেন। তাইত কুরআনে বলা হচ্ছে, “আমি বললাম, তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও। এরপর যখন আমার পক্ষ থেকে কোন হিদায়াতের বিধান তোমাদের কাছে পৌছাবে তখন যারা সেই বিধানের অণুসরণ করবে তাদের জন্য থাকবে না কোন ভয়, দুঃখ বেদনা।” “সূরা ২, আয়াত ৩৮”।
আল্লাহ্কে অবশ্যই স্বয়ম্ভূ ও চিরন্তর হতে হবে। অর্থাৎ তাকে অবশ্যই তার নিজের অস্তিত্বের কারণ হতে হবে। তাঁর অস্তিত্ব কারও উপর নির্ভর করবে না। “সূরা ১১২,; সূরা ৫৭, আয়াত ৩”।
আল্লাহ্ অবশ্যই এই জগতের উপর আধিপত্য থাকতে হবে, তাঁকে সর্বস্থানে বিদ্যমান থাকতে হবে এবং প্রত্যেক পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষয় সম্পর্কে তাঁকে অবশ্যই অবগত থাকতে হবে। “সূরা ৩, আয়াত ১৮৯; সূরা ৮৫, আয়াত ১৬; সূরা ৪, আয়াত ২৬; সূরা ২, আয়াত ১১৫; সূরা ৪, আয়াত ১১”।
তাঁকে অবশ্যই পূর্ণাঙ্গ বিচক্ষণতা তথা প্রজ্ঞার অধিকারী হতে হবে যাতে তিনি মানুষের সব ধরণের কর্মকা- বিশেষ করে নৈতিক কর্মের নির্ভূল পথ প্রদর্শন করতে সক্ষম হন। “সূরা ৪৫, আয়াত ৩৭; সূরা ৭৬, আয়াত ৩০”।
তাকে হতে হবে সকল দোষত্রুটি, দুর্বলতা ও অক্ষমতা থেকে মুক্ত। “সূরা ১২, আয়াত ১০৮; সূরা ৩৭, আয়াত ৮০”।
জীবন ও মৃত্যু থাকবে তাঁরই করায়ত্বে। “সূরা ৭, আয়াত ১৫৮; সূরা ৯, আয়াত ১১৬”।
وْ أَرَادَ اللَّهُ أَنْ يَتَّخِذَ وَلَدًا لَاصْطَفَى مِمَّا يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ سُبْحَانَهُ هُوَ اللَّهُ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ39.4 আরবি উচ্চারণ ৩৯.৪। লাও আর-দাল্লা-হু আইঁ ইয়াত্তাখিযা অলাদাল্ লাছ্ত্বোয়াফা- মিম্মা-ইয়াখ্লুকু মা-ইয়াশা-য়ু সুব্হা-নাহ্; হুওয়া ল্লা-হুল্ ওয়া-হিদুল্ ক্বহ্হার্-। বাংলা অনুবাদ ৩৯.৪ আল্লাহ যদি সন্তান গ্রহণ করতে চাইতেন, তাহলে তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তা থেকে যাকে ইচ্ছা বেছে নিতেন; কিন্তু তিনি পবিত্র মহান। তিনিই আল্লাহ, তিনি এক, প্রবল পরাক্রান্ত।
যদি কোন স্রষ্টাকে অন্য কেউ সৃষ্টি করার দরকার হয় তবে ঐ স্রষ্টা আর স্রষ্টা থাকেনা তা সৃষ্টিতে রুপান্তরিত হয়, কেননা স্রষ্টা সৃষ্টি করে তাই তাঁকে স্রষ্টা বলা। তাই স্রষ্টার যদি কোন সৃষ্টিকর্তার দরকার হয় তবে তা মূলত ‘স্রষ্টার ডেফিনেশন’ এর সাথেই সাংঘর্ষিক।
যেমন কোন ‘পুরুষকে’ যদি প্রশ্ন করা হয় সে কতগুলো সন্তান প্রসব করেছে তবে তা অযৌক্তিক হবে। এবং কেউ যদি এই প্রশ্ন করে তবে তাকে পাগল বলা হবে কিংবা ব্রেইনলেস বলা হবে, কারণ পুরুষের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে কখনো সন্তান প্রসব করেনা। যে সন্তান প্রসব করে সে পুরুষ নয়। সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য নারীর দরকার হয়। স্রষ্টারও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে স্রষ্টা (creator) এমন কেউ যে নিজে সৃষ্ট নয় (uncreated)। তাই স্রষ্টার ক্ষেত্রে তাঁর সৃষ্টিকর্তা কে এই প্রশ্ন করাটাই অযৌক্তিক কারণ এই প্রশ্ন স্রষ্টার ডেফিনেশন এর সাথেই সাংঘর্ষিক।সুরা আল- জ্বিন এর আয়াত : ৩ এ বলা হয়েছে, "And exalted be the Majesty of our Lord, He has taken neither a wife, nor a son (or offspring or children)" অর্থাত "এবং আরও বিশ্বাস করি যে, আমাদের পালনকর্তার মহান মর্যাদা সবার উর্ধে। তিনি কোন পত্নী গ্রহণ করেননি এবং তার কোন সন্তান নেই।" এখন প্রশ্ন হলো, "আল্লাহ কি পুরুষ?"
আল্লাহ পুরুষ নন, আবার নারীও নন- সকল লিঙ্গের ঊর্ধ্বে তিনি; কিন্তু , আমরা ইংরেজীতে তাঁকে লিখতে হলে সর্বনামের স্থানে HIS ব্যাবহার করি কেননা তাকে ক্ষমতাধর এবং শক্তিশালী হিসেবে গণ্য করা হয় আর সকল শক্তিশালী শব্দকেই HIS দ্বারা সম্বোধন করা হয়ে থাকে। আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়- কোনো প্রোটোটাইপ পাবেন না; ইংরেজী অনুবাদের কারণে কিছুটা সমস্যা হয়- কারণ অদ্বৈত কোনো সত্বাকে উনি বা তিনি সম্বোধনে বোঝানো যায়- ইংরেজিতে His বা Her লাগে; আরবিতে সেটা শুধুই আল্লাহ।
ঐ আয়াতের আগে-পিছের কথা দেখলে অনেক কিছু পরিস্কার হবে, ঐ আয়াতটি আল্লাহর উক্তি নয়, বরং তা জ্বিনদের কথোপকথন। আসলে বাংলায় কোরানের যেসব অনুবাদ সহজলভ্য তার বেশিরভাগই অজস্র ভুলে ভরা।
'পত্নী' যেই শব্দটার অনুবাদ, সেটা আরবীতে পুরুষ এবং মহিলা দুজনকেই বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। সত্যি যদি কোরান বুঝতে চান, তাহলে অনুরোধ করব আগে শুদ্ধ এরাবিক ল্যাংগুয়েজ জানুন, তারপর পড়ুন এবং তারপর প্রশ্ন করুন।]উপদেশ মেনে, আরবী ভাষা নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করছিলাম। কিন্তু, এতে আরো প্যাঁচের মধ্যে পড়লাম!! আশা করি, আপনারা যারা অনেক পড়েছেন, শুদ্ধ আরবী ভাষা সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন- তাঁরা হয়তো এই প্যাঁচ কাটাতে পারবেন।শুদ্ধ অনুবাদ নিয়ে যেহেতু প্রশ্ন উঠেছে, সেহেতু- বাজারে পাওয়া যায় এমন প্রায় ৭/৮ টি অনুবাদ পাশাপাশি দেখলাম, নেটে প্রাপ্ত অনুবাদও দেখলাম; সবকটিতেই পেলাম- তিনি স্ত্রী/পত্নী/সহচরী গ্রহণ করেননি বা He has taken neither a wife.....। বুঝলাম না, ভাবলাম শব্দটি সম্পর্কে একটু অনুসন্ধান চালাই। যে শব্দের বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে স্ত্রী/পত্নী- সেটি হচ্ছে আরবী সাহিবাত, তিনটি ডিকশনারি (আরবী-বাংলা, আরবী-ইংরেজী) ঘেটে পেলাম- স্ত্রী, বান্ধবী, কর্ত্রী, ওয়ালী, অধিকারিণী, wife প্রভৃতি স্ত্রীবাচক শব্দ। আরো কনফিউজড হয়ে গেলাম।
ভাবলাম- আরবী ব্যকরণটি দেখি। এ শাখাটি আলোচিত হয়, ইলমুস সরফ বা মিজানুস সরফ ও মুনশায়িব গ্রন্থে। সেটি ঘেটে দেখলাম আরবী ভাষায়- ক্রিয়াটি(ফি'ল) শুধু কালের উপর নির্ভরশীল নয়, বরং তা কর্তার পুরুষ(নাম, মধ্যম, ও উত্তম), লিঙ্গ(পুং ও স্ত্রী), বচন(এক, দ্বি ও বহু)- এসবের উপরও নির্ভরশীল। এসব ভেদে ফি'ল এর বিভিন্ন রূপকে বলে সীগা। নামপুরুষ, একবচন পুং লিঙ্গ ও স্ত্রী লিঙ্গের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। একটি উদাহরণ দেই, অতীত কাল(ফি'লে মাজি), নামপুরুষ, একবচন, পুং লিঙ্গ একটি শব্দ নাসারা (সে (পুং) সাহায্য করলো), স্ত্রীলিঙ্গ হলে হয়ে যাবে, নাসারাত (সে (স্ত্রী) সাহায্য করলো)। অতীত কালে না বোধক বোঝাতে সামনে চলে আসবে মা। মা নাসারা বা মা নাসারাত মানে সে সাহায্য করেনি, যথাক্রমে পুং ও স্ত্রী লিঙ্গ বুঝাবে।
আলোচ্য সুরা আল-জ্বিন সুরা ৩ নং আয়াতের ক্রিয়াটি হচ্ছে, গ্রহণ করেননি। আরবীতে মা'ত্তাখাজা। এটির ক্রিয়া পদটি অতীত কালের একবচন, নাম পুরুষ, পুং লিঙ্গ না-বোধক এর সীগার অনুরূপ। স্ত্রীবাচক সীগাটি হবে, মা'ত্তাখাজাত।
তিনি আমাদের সব ধারণা-কল্পনার উর্ধ্বে। তাঁকে আমাদের পরিচিত কোন কিছু দিয়ে তুলনা করতে গিয়েই ভুল করে কিছু মানুষ। "অথচ তিনিই তাদের সৃষ্টিকর্তা। আর না জেনে না বুঝে তারা তাঁর জন্য পুত্র-কন্যা নির্দিষ্ট করে। তিনি তাঁর সম্পর্কে এরা যা বর্ণনা করে তা থেকে পবিত্র।" [আন'আম, ৬/১০০] "আল্লাহ্ কাউকে তাঁর সন্তান বানাননি আর দ্বীতিয় কোন খোদাও তাঁর সাথে শরীক নেই। যদি তা-ই হতো তবে এরা প্রত্যেকেই নিজের সৃষ্টি নিয়ে আলাদা হয়ে যেত এবং তারপর একে অন্যের উপর চড়াও হতো। মহান আল্লাহ পবিত্র এসব কথা থেকে যা এই লোকেরা তাঁর সম্পর্কে বলে।" (মু'মিনুন, ২৩/৯১)। "তোমার রব্ব, যিনি ইজ্জত-সম্মানের মালিক, পবিত্র সে সব বর্ণনা থেকে যা এরা তাঁর সম্পর্কে করে থাকে।" [আস-সাফফাত, ৩৭/১৮০]
তিনি মানুষের পরিচিত কোন কিছুর মত নন। তাঁর সত্ত্বা তাঁর সমস্ত সৃষ্টি থেকে আলাদা। আমরা তাঁর সত্ত্বা সম্পর্কে কোন ধারণা করতে পারিনা। লিঙ্গের ধারণা তাঁর সৃষ্টির জন্যই প্রযোজ্য, তাঁর জন্য নয়। আর তিনিই এই লিঙ্গভেদ সৃষ্টি করেছেন তাঁর সৃষ্টির মাঝে নিজের অসীম প্রজ্ঞা বলে। এজন্য তিনি তাঁর রসূলকে (সঃ) বলতে নির্দেশ দিচ্ছেন একথা বলার জন্য যে, "তোমাদের মাঝে যে ব্যাপারে মতভেদের সৃষ্টি হয়, তার ফয়সালা করা আল্লাহ্রই কাজ। সে আল্লাহ্ই আমার রব্ব, আমি তাঁর উপরই ভরসা করেছি এবং তাঁর দিকেই মনোনিবেশ করছি। [তিনি] আকাশমন্ডল ও জ়মীন সৃষ্টিকারী; তিনি তোমাদের নিজস্ব প্রজাতির মধ্য থেকে তোমাদের জন্য জুড়ি (স্ত্রী-পুরুষ) বানিয়েছেন এবং জন্তু-জানোয়ারের মাঝেও (তাদেরই নিজস্ব প্রজাতির) জুড়ি বানিয়ে দিয়েছেন; আর এভাবেই তিনি তোমাদের বংশবৃদ্ধি ও বিস্তার ঘটান। বিশ্বলোকের কোন কিছুতেই তাঁর সাযুজ্য নেই; আর তিনি সব কিছু শুনেন এবং দেখেন।" [আস-শূরা, ৪২/১০-১১]
কোরআনের অন্যান্য আয়াতসমূহেও (সব এখনও দেখতে পারিনি) দেখলাম, আল্লাহকে কেন্দ্র করে যত ক্রিয়া আছে - তাতে পুং লিঙ্গ এর সীগা অনুসরণ করা হয়েছে।
“আল্লাহই হচ্ছেন সব কিছুর (একক) স্রষ্টা” (আল-কোরআন ৩৯:৬২)
“আল্লাহ তা’আলাই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন” (আল-কোরআন ৩৭:৯৬)
এখানে স্রষ্টা আর সৃষ্টির ক্ষেত্রে পার্থক্য নির্ণয় জরুরি। স্রষ্টা ‘সৃষ্ট’ নন এবং সৃষ্টি ‘স্রষ্টা’ নয়। কোরআন বলছে, আল্লাহ ‘সবকিছু’র সৃষ্টি কর্তা, মানে সকল সৃষ্ট বস্তুর, সৃষ্ট মানে যার সৃষ্টির দরকার, যেমন-মানুষ, পাহাড়-পর্বত। আর আল্লাহ সৃষ্ট নয় তিনি স্রষ্টা, তাই তাঁর সম্পর্কে ‘সৃষ্ট’ শব্দটাই প্রযোজ্য নয়।
আল্লাহ্ নিজেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন কুর'আনের বিভিন্ন জায়গায়। এখানে আমি কয়েকটা উদ্ধৃত করছি।
"[হে রসূল] আপনি বলুন, "আল্লাহ্ এক ও অদ্বীতিয়। আল্লাহ্ সব ধরণের অভাব মুক্ত। তিনি [সন্তান] জন্ম দেননা এবং [সন্তান হয়ে] জন্মও নেননি। তাঁর সাথে তুলনা করার মতও কেউ নেই"। [কুরআন, ১১২/১-৪]
"আল্লাহ্ হচ্ছেন সেই সত্ত্বা যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ্ নেই। তিনি চিরঞ্জীব ও শাশ্বত-সুপ্রতিষ্ঠিত সত্ত্বা। তন্দ্রা ও নিদ্রা তাঁকে স্পর্শ করেনা। আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা সবই তাঁর। কে আছে এমন যে তাঁর দরবারে তাঁর অনুমতি ব্যতীত সুপারিশ করতে পারে? তাদের [তাঁর বান্দাহদের] সামনে এবং পেছনে যা আছে তা সবই তাঁর জানা। তাঁর জ্ঞাত বিষয়সমূহের মধ্য হতে কোন বিষয়ই তারা [তাঁর বান্দারা] আয়ত্ত্বাধীন করতে পারেনা, শধু তা ছাড়া যা তিনি নিজেই ইচ্ছে করে জানান। তার কুরসী [সাম্রাজ্য] সমগ্র আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীকে বেস্টন করে আছে। আর এসবের রক্ষণাবেক্ষণ করতে গিয়ে তিনি কখনো ক্লান্ত হয়ে পড়েন না। বস্তুতঃ তিনি এক মহান-সুউচ্চ শ্রেষ্ঠতম সত্ত্বা।" (বাকারা, ২/২৫৫)
"বরকতময় হচ্ছেন সেই সত্ত্বা যার হাতে রয়েছে সমস্ত রাজত্ব-কর্তৃত্ব। আর তিনি প্রতিটি বিষয়ের উপরই কর্তৃত্ববান। তিনিই মৃত্যু এবং জীবন সৃষ্টি করেছেন যাতে করে তিনি তোমাদের মধ্যে কারা সৎকর্মশীল তা যাচাই করে দেখতে পারেন। তিনি সর্বজয়ী-শক্তিমান এবং অত্যন্ত ক্ষমাশীল।" [মুল্ক, ৬৭/১-২]
"আল্লাহ্ আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর নূর"। [আন-নূর, ২৪/৩৫]
"তিনি-ই প্রথম, তিনি-ই শেষ। তিনি প্রকাশমান আবার তিনি গুপ্তও। আর তিনি প্রতিটি বিষয়ে অবহিত।" [আল-হাদীদ, ৫৭/৩]
"পূর্ব ও পশ্চিম সবই আল্লাহ্র। তুমি যেদিকেই মুখ ফিরাবে সেদিকেই রয়েছে আল্লাহ্র চেহরা। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ বিশালতার অধিকারী ও সর্বজ্ঞ।" [আল-বাকারা, ২/১১৫]
"আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা সবই আল্লাহ্র। আর আল্লাহ্ সব কিছুকে বেস্টন করে আছেন।" [আন-নিসা, ৪/১২৬]
"তিনি-ই আল্লাহ্; তিনি ছাড়া আর কোন মা'বূদ নেই; গোপন ও প্রকাশ্য সব কিছুই তিনি জানেন; তিনি রহমান ও রহীম। তিনি-ই আল্লাহ্ যিনি ছাড়া আর কোন মা'বূদ নেই; তিনি সব ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে থাকা সার্বভৌমত্বের অধিকারী [বাদশাহ্]; পুরোপুরি শান্তি-নিরাপত্তা; শান্তি-নিরাপত্তা দাতা; সংরক্ষক; সর্বজয়ী, নিজের নির্দেশ বিধান শক্তি প্রয়োগে কার্যকরকারী এবং স্বয়ং বড়ত্ব গ্রহনকারী। লোকেরা তার সাথে আর যে সমস্ত সত্ত্বাকে অংশীদার করে তিনি তা থেকে মুক্ত ও পবিত্র। তিনি আল্লাহ্ই যিনি সৃষ্টি পরিকল্পনাকারী ও এর বাস্তব রূপদানকারী এবং সে অনুযায়ী আকার-আকৃতি রচনাকারী। তাঁর জন্যই উত্তম নামসমূহ্। আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সব কিছুই তাঁর প্রশংসা করে; আর তিনি মহা পরাক্রান্ত ও অতীব প্রজ্ঞাময়।" [আল-হাশর, ৫৯/২২-২৪]
"তাঁর অসংখ্য নিদর্শনের মধ্যে এও রয়েছে যে, আকাশ এবং পৃথিবী তাঁরই হুকুমে সুপ্রতিষ্ঠিত রয়েছে। পরে যখনই তিনি তোমাদেরকে মাটি হতে আহবান করবেন, তখন শুধুমাত্র একটি আহবানেই তোমরা বের হয়ে আসবে। আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা সবই তাঁর বান্দাহ্। সবকিছুই তাঁর নির্দেশের অধীন। তিনিই সৃষ্টির সূচনা করেন আবার তিনিই এর পূনারাবৃত্তি করবেন। আর এটা করা তাঁর পক্ষে সহজতর। আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীতে তাঁর জন্যই রয়েছে সর্বোত্তম গুনাবলী। তিনি মহাপরাক্রমশালী ও সুবিজ্ঞ।" [আর-রূম, ৩০/২৫-২৭]
মহান আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর প্রজ্ঞাময় কিতাবে নিজের সম্পর্কে আরো বিবৃত করেছেন অনেকভাবে। আল্লাহ্ র বর্ণনা করা এ গুণগুলো তাঁর বিরাটত্ব ও মহানত্বেরই দিক নির্দেশনা দেয়। মানুষের ক্ষুদ্র জ্ঞান ও বুদ্ধিতে তাঁর বিরাট সত্ত্বা সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা তৈরী করা সম্ভব নয়। তিনি মহাবিশ্ব এবং এর মাঝে যা আছে তাঁর স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রনকারী।
প্রভুকে চেনার কষ্টিপাথরঃ-
কষ্টিপাথর হচ্ছে এমন একটি পাথর যার দ্বারা সোনা চিহ্নিত করা যায় । তেমনি আল্লাহ কে যাচাই করার কষ্টিপাথর হচ্ছে সূরাতুল ইখলাস ।قُلۡ هُوَ اللّٰہُ اَحَدٌ
اَللّٰہُ الصَّمَدُ
لَمۡ یَلِدۡۙ وَ لَمۡ یُوۡلَدۡ
وَ لَمۡ یَکُنۡ لَّہٗ کُفُوًا اَحَدٌ
কু’ল হুয়া ল্লা-হু আহাদ ৷
আল্লা-হু স্সামাদ ৷
লাম ইয়ালিদ ওয়া লাম ইয়ুলাদ ৷
ওয়া লাম ইয়াকু ল-লাহু কুফুওয়ান আহাদ!
বলো, তিনিই আল্লাহ্, অদ্বিতীয়!
আল্লাহ অমুখাপেক্ষী ।
তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি।
তাঁর সমকক্ষ আর কিছুই নেই!
তাছাড়া তিনি তার সম্পর্কে সুরাতুল বাকারা 255 নাম্বার আয়াতে বর্ণনা করেন ঃاللّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ لاَ تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلاَ نَوْمٌ لَّهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الأَرْضِ مَن ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلاَّ بِإِذْنِهِ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلاَ يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِّنْ عِلْمِهِ إِلاَّ بِمَا شَاء وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ وَلاَ يَؤُودُهُ حِفْظُهُمَا وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيم
আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল ক্বইয়্যুম লা তা’খুজুহু সিনাত্যু ওয়ালা নাউম। লাহু মা ফিসসামা ওয়াতি ওয়ামা ফিল আরদ্। মান যাল্লাযী ইয়াস ফায়ু ইন দাহু ইল্লা বি ইজনিহি ইয়া লামু মা বাইনা আইদিহিম ওয়ামা খল ফাহুম ওয়ালা ইউ হিতুনা বিশাই ইম্ মিন ইল্ মিহি ইল্লা বিমা সাআ ওয়াসিয়া কুরসি ইউহুস সামা ওয়াতি ওয়াল আরদ্ ওয়ালা ইয়া উদুহু হিফজুহুমা ওয়াহুয়াল আলিয়্যূল আজীম।
আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই, তিনি জীবিত, সবকিছুর ধারক। তাঁকে তন্দ্রাও স্পর্শ করতে পারে না এবং নিদ্রাও নয়। আসমান ও যমীনে যা কিছু রয়েছে, সবই তাঁর। কে আছ এমন, যে সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া? দৃষ্টির সামনে কিংবা পিছনে যা কিছু রয়েছে সে সবই তিনি জানেন। তাঁর জ্ঞানসীমা থেকে তারা কোনো কিছুকেই পরিবেষ্টিত করতে পারে না, কিন্তু যতটুকু তিনি ইচ্ছা করেন। তাঁর সিংহাসন সমস্ত আসমান ও যমীনকে পরিবেষ্টিত করে আছে। আর সেগুলোকে ধারণ করা তাঁর পক্ষে কঠিন নয়। তিনিই সর্বোচ্চ এবং সর্বাপেক্ষা মহান।[২৫৫]সুরাতুল বাকারা
হিন্দু ধর্মের বেদে ঈশ্বরের পরিচয় ঃ
হিন্দু ধর্মগ্রন্থে সবখানেই আছে স্রষ্টার একেশ্বরবাদের কথা। জাকির নায়েকের দেয়া রেফারেন্স ছাড়াও আরো অনেক পাওয়া যাবে যেমন,
যজুর্বেদ ৪০.১: এই সমস্ত বিশ্ব শুধু মাত্র একজন ঈশ্বর দ্বারা সৃষ্টি ও পরিচালিত হচ্ছে।
যজুর্বেদ ১৩.৪: সমগ্র বিশ্বে শুধু একজনই হর্তাকর্তা রয়েছেন। শুধুমাত্র তিনিই পৃথিবী, আকাশ, এবং অন্যান্য সত্ত্বাকে ধারণ করেন। তিনি নিজেই পরম সুখী! তিনিই শুধু মাত্র! তিনিই আমাদের দ্বারা উপাসিত হবেন।
অথর্ববেদ ১৩.৪.১৬-২১: তিনি না দুই, না তিন, না চার, না পাঁচ, না ছয়, এমনকি না সাত, না আট, না নয়, না দশ। তিনি একজন এবং শুধুই একজন। তিনি ছাড়া অন্য কেউ ঈশ্বর নন।
কিন্তু এখন সেই একজন কে? তার নাম কি? তাকে আমরা কি বলে ডাকবো ? তার নামও রয়েছে বেদে,
Yajur veda 40:17, সেই সর্বব্যাপি সৃষ্টিকর্তার নাম 'ॐ;(ওম)
MANDUK UPANISHAD 1:1. সকল বেদ ও শাস্ত্রেই তার নাম 'ॐ;(ওম)
গীতা ১৭/২৪-২৫, "পরমাত্তাই 'ॐ;(ওম) ও তার নাম জপ কর"
KATH UPANISHAD 7:15 যার কাছে সমস্ত জ্ঞান ও সৎ কর্ম পরিচালিত, সেই স্রষ্টার নাম ॐ (ওম) এরকম আরো বহু রেফারেন্স আছে যে 'ॐ;(ওম) ই সৃষ্টিকর্তা।
এবার আসুন দেখি এই ॐ;(ওম) কি এবং কেন? বেদ বিশেষজ্ঞরাও এই নামকে Proper Noun হিসেবেই ব্যাখ্যা করেন অর্থাৎ যার কোন অনুবাদ হয় না। বেদে ব্রক্ষ্মা, শীব, বিষ্ণু নামে যে ঈশ্বরের ত্রিত্তবাদ পাওয়া যায় তা মূলত এই ঈশ্বরেরই তিনটি গুণ যথাক্রমে ব্রক্ষ্মা= সৃষ্টিকর্তা, বিষ্ণু= পালনকর্তা, শিব= ধ্বংসকর্তা। এগুলো প্রপার নাম নয় বরং এগুলো অর্থ ও গুনবাচক নাম। কিন্তু সেই একজনের মূল নাম লেখা হয়েছে ॐ;(ওম) যার কোন অর্থ নেই ও যার অনুবাদও সম্ভব নয়।
বাইবেল ঈশ্বরের পরিচয় ঃ
সেখানে কত দেবতা আছে?
হিব্রু শাস্ত্রগুলি কখনও কখনও দাবি করে যে কেবল এক ঈশ্বর আছে, এবং কখনও কখনও প্রভু অনেক দেবতাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। নিউ টেস্টামেন্টে বিষয়গুলো আরও বিভ্রান্তিকর হয়ে পড়ে, যেখানে যিশু এবং পবিত্র আত্মাকে ঈশ্বর হিসাবেও উল্লেখ করা হয়। "পার্থক্য ট্রিনিটি" ধারণাটি এই দ্বন্দ্বটির সমাধান করার জন্য তৈরি হয়েছিল, কিন্তু পিতার, পুত্র এবং পবিত্র আত্মা আজ খ্রিস্টানদের বিভক্ত করতে থাকেন।
কেবল এক ঈশ্বর আছে.
তোমার কাছে এটা প্রকাশিত হয়েছিল, যেন তুমি জানতে পার যে, তিনিই আল্লাহ্। তার পাশে অন্য কেউ নেই। দ্বিতীয় বিবরণ 4:35
তিনি স্বর্গের উপরে ও নীচে পৃথিবীতে ঈশ্বর, তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। দ্বিতীয় বিবরণ 4:39
হে ইস্রায়েল, হে আমাদের ঈশ্বর সদাপ্রভু! দ্বিতীয় বিবরণ 6: 4
এখন দেখো যে, আমিও তিনি, আর আমার কোন উপাস্য নেই। দ্বিতীয় বিবরণ 3২:39
প্রভু, তিনি ঈশ্বর হয়; প্রভু, তিনি ঈশ্বর। 1 রাজাবলি 18:39
আমিই তিনি, আমার আগে কোন ঈশ্বরই ছিলেন না, আমার পরেও সেখানে থাকবে না। যিশাইয় 43:10
আমিই সদাপ্রভু, আর আর কেউ নেই ... আমার পাশে কেউ নেই। আমিই সদাপ্রভু, আর অন্য কেউ নেই। ইশাইয়া 44: 8
আমিই প্রভু, আর অন্য কেউ নেই, আমার পাশে কোন ঈশ্বর নেই। যিশাইয় 45: 5-6
আমার পাশে আর কোন ঈশ্বর নেই ... আমার পাশে কেউ নেই। যিশাইয় 45:২1
আমিই আল্লাহ্, আর অন্য কেউ নেই; আমিই আল্লাহ্, আর আমার মত আর কেউ নেই। যিশাইয় 46: 9
প্রভু আমাদের ঈশ্বর এক পালনকর্তা। মার্ক 12:29
এক ঈশ্বর আছে; এবং তিনি ছাড়া অন্য কেউ নেই। মার্ক 12:32
যাতে তারা আপনাকে একমাত্র সত্য ঈশ্বর জানতে পারে। জন 17: 3
কিন্তু আমাদের কাছে কেবল এক ঈশ্বর, পিতা, যাঁর মধ্যে সব কিছু, এবং আমরা তাঁর মধ্যে। 1 করিন্থীয় 8: 6
Deuteronomy 6:4 Or The Lord our God is one Lord; or The Lord is our God, the Lord is one; or The Lord is our God, the Lord alone
Friday, 14 June 2019
Wednesday, 8 May 2019
নারীর পর্দা বা হিজাব।
ইসলামের পর্দা বিধান শুধু নারীর জন্য নয়, নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য। তেমনি পর্দা-বিধান শুধু ব্যক্তিজীবনের বিষয় নয়। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেরও বিষয়।
ইসলামের পর্দা-ব্যবস্থা যদি পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়িত হয় তাহলে মুসলিম নর-নারীর ব্যক্তি জীবনের সাথে সাথে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনও সুস্থ ও পবিত্র হবে। পক্ষান্তরে পর্দা-বিধান কার্যকর না থাকলে যেখানে যেখানে তা অনুপস্থিত সেখানে সেখানেই পঙ্কিলতা ও অস্থিরতার অনুপ্রবেশ ঘটবে। এ কারণে ইসলামের পর্দা বিধান হল ব্যক্তি ও সমাজের রক্ষাকবচ। এই সত্য আমরা যত দ্রুত উপলব্ধি করব তত দ্রুত কল্যাণ লাভ করব। এ কারণেই ইসলামের পর্দা-ব্যবস্থার যারা বিরোধী তারা শুধু দ্বীন-ধর্মেরই বিরোধী নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রেরও বিরোধী; তারা মানব ও মানবতার মুক্তি ও কল্যাণেরও বিরোধী। সঙ্গত কারণেই পর্দা-বিধানকে বলা যায় বর্তমান মুসলিমসমাজের জন্য আসমানী ফুরকান তথা এমন এক ঐশী মানদন্ড, যা মুমিন-মুনাফিকের মাঝে টেনে দেয় পরিষ্কার পার্থক্যরেখা।
মাহরাম ছাড়া সবার সাথেই পর্দা করতে হবে আল্লাহ তাআলা মুসলিম নারীর সম্মানার্থে এবং দুষ্ট লোকের অশিষ্ট আচরণ থেকে তার মর্যাদা রক্ষার্থে পর্দা ফরজ করেছেন। পর্দা যেমন পুরুষদের রক্ষা করে নারীর ফিতনা থেকে তেমনি নারীকেও নানা কষ্টদায়ক ব্যাপার থেকে রক্ষা করে । ইসলামে প্রতিটি মুসলিম নারীর জন্য বেগানা পুরুষের সামনে পূর্ণ পর্দা রক্ষা করা জরুরী। তারা হলেন মাহরাম ব্যতীত বাকি সবাই। আর মাহরামগণ হলেন : ১. পিতা। ২. দাদা। ৩. স্বামীর পিতা তথা শ্বশুর। ৪. স্বামীর সন্তান তথা বৈমাত্রেয় পুত্র। ৫. নিজের পুত্র। ৬. ভাই। ৮. ভাইপো। ৯. বোনপো। ১০ চাচা-জ্যাঠা। ১১. মামা। দুধ পানজনিত মাহরামগণ যেমন পবিত্র কোরানে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, وَقُل لِّلۡمُؤۡمِنَٰتِ يَغۡضُضۡنَ مِنۡ أَبۡصَٰرِهِنَّ وَيَحۡفَظۡنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبۡدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنۡهَاۖ وَلۡيَضۡرِبۡنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّۖ وَلَا يُبۡدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوۡ ءَابَآئِهِنَّ أَوۡ ءَابَآءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوۡ أَبۡنَآئِهِنَّ أَوۡ أَبۡنَآءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوۡ إِخۡوَٰنِهِنَّ أَوۡ بَنِيٓ إِخۡوَٰنِهِنَّ أَوۡ بَنِيٓ أَخَوَٰتِهِنَّ أَوۡ نِسَآئِهِنَّ أَوۡ مَا مَلَكَتۡ أَيۡمَٰنُهُنَّ أَوِ ٱلتَّٰبِعِينَ غَيۡرِ أُوْلِي ٱلۡإِرۡبَةِ مِنَ ٱلرِّجَالِ أَوِ ٱلطِّفۡلِ ٱلَّذِينَ لَمۡ يَظۡهَرُواْ عَلَىٰ عَوۡرَٰتِ ٱلنِّسَآءِۖ وَلَا يَضۡرِبۡنَ بِأَرۡجُلِهِنَّ لِيُعۡلَمَ مَا يُخۡفِينَ مِن زِينَتِهِنَّۚ وَتُوبُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ٣١ #النور: ٣١ ‘আর মুমিন নারীদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করবে। আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না। তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশকে আবৃত করে রাখে। আর তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজদের ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাই এর ছেলে, বোনের ছেলে, আপন নারীগণ, তাদের ডান হাত যার মালিক হয়েছে, অধীনস্থ যৌনকামনামুক্ত পুরুষ অথবা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ছাড়া কারো কাছে নিজদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। আর তারা যেন নিজদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য সজোরে পদচারণা না করে। হে মুমিনগণ, তোমরা সকলেই আল্লাহর নিকট তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার’। {সূরা আন-নূর, আয়াত : ৩১} যেখানেই কোনো বেগানা পুরুষ থাকবে সেখানে শরিয়ত সম্মত হিজাবের আটটি শর্তের কোনোটি লঙ্ঘন করা হারাম। কেননা অনেক মহিলা ঘরের বাইরে হিজাব পরেন ঠিকই কিন্তু তারা নিজেদের নিকটাত্মীয় গাইরে মাহরামের এর সামনে কোনো কোনো শর্ত লঙ্ঘন করেন। যেমন চাচাতো বা মামাতো ভাইদের সামনে মাথা ঢাকেন ঠিক কিন্তু তাদের সামনে অন্যদের মতো পুরোপুরি পর্দা করেন না। এতে করে তারা সুস্পষ্ট গুনাহ ও হারামে লিপ্ত হন। শরিয়ত সম্মত হিজাব কী এবং এর শর্তাবলি কী? আর এ ব্যাপারে আপনার অজ্ঞতায় ক্ষতিই বা কী? আপনি কি হিজাব নিয়ে ভেবে দেখেছন, কে একে ফরজ করেছেন আল্লাহ মহান? কি পরিমান পর্দা ফরজ করেছেন? হজরত আবূ উযাইনা ছাদফী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «خَيْرُ نِسَائِكُمُ الْوَدُودُ الْوَلُودُ الْمُوَاتِيَةُ الْمُوَاسِيَةُ، إِذَا اتَّقَيْنَ اللهَ، وَشَرُّ نِسَائِكُمُ الْمُتَبَرِّجَاتُ الْمُتَخَيِلَّاتُ وَهُنَّ الْمُنَافِقَاتُ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مِنْهُنَّ، إِلَّا مِثْلُ الْغُرَابِ الْأَعْصَمِ» ‘তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে তারাই সর্বোত্তম যারা আল্লাহকে ভয় করার পাশাপাশি স্বামীকে ভক্তি করে, অধিক সন্তান জন্ম দেয় এবং (স্বামীর দুঃখে তার প্রতি) সমব্যথী ও সহানুভূতিশীল হয়। পক্ষান্তরে তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে সবচে মন্দ তারাই, যারা বেপর্দা হয়ে দম্ভ ভরে চলে। এরাই হলো মুনাফিক। এরা জান্নাতে প্রবেশ করবে কেবল লাল ঠোঁট ও পা বিশিষ্ট কাকদের মতো। (অর্থাৎ এমন বৈশিষ্ট্যের কাক যেমন সংখ্যায় অনেক কম তেমনি তারা কম সংখ্যক জান্নাতে প্রবেশ করবে।) [বাইহাকি : ১৩৪৭৮]
পবিত্র কুরআনে পর্দার নির্দেশ
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন : “(হে নারীগণ!) তোমরা তোমাদের ঘরের (বাড়ীর চতুর্সীমানার) ভিতর অবস্থান কর এবং বাইরে বের হয়োনা – যেমন ইসলামপূর্ব জাহিলী যুগের মেয়েরা বের হত।” (সূরাহ আহযাব, আয়াত : ৪৩)
আল্লাহ তা‘আলা আরো ইরশাদ করেন : “(হে নবী!) আপনি আপনার পত্মীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, যখন কোন প্রয়োজনে বাইরে বের হতে হয়, তখন তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দাংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। (যেন পর্দার ফরজ লংঘন না করে। এমনকি চেহারাও যেন খোলা না রাখে। তারা যেন বড় চাদরের ঘোমটা দ্বারা নিজেদের চেহারাকে আবৃত করে রাখে।) ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। (সূরাহ আহযাব, আয়াত : ৬০)
হজরত আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «صِنْفَانِ مِنْأَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا، قَوْمٌ مَعَهُمْমাহরাম ছাড়া সবার সাথেই পর্দা করতে হবে আল্লাহ তাআলা মুসলিম নারীর সম্মানার্থে এবং দুষ্ট লোকের অশিষ্ট আচরণ থেকে তার মর্যাদা রক্ষার্থে পর্দা ফরজ করেছেন। পর্দা যেমন পুরুষদের রক্ষা করে নারীর ফিতনা থেকে তেমনি নারীকেও নানা কষ্টদায়ক ব্যাপার থেকে রক্ষা করে । ইসলামে প্রতিটি মুসলিম নারীর জন্য বেগানা পুরুষের সামনে পূর্ণ পর্দা রক্ষা করা জরুরী। তারা হলেন মাহরাম ব্যতীত বাকি সবাই। আর মাহরামগণ হলেন : ১. পিতা। ২. দাদা। ৩. স্বামীর পিতা তথা শ্বশুর। ৪. স্বামীর সন্তান তথা বৈমাত্রেয় পুত্র। ৫. নিজের পুত্র। ৬. ভাই। ৮. ভাইপো। ৯. বোনপো। ১০ চাচা-জ্যাঠা। ১১. মামা। দুধ পানজনিত মাহরামগণ যেমন পবিত্র কোরানে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, وَقُل لِّلۡمُؤۡمِنَٰتِ يَغۡضُضۡنَ مِنۡ أَبۡصَٰرِهِنَّ وَيَحۡفَظۡنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبۡدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنۡهَاۖ وَلۡيَضۡرِبۡنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّۖ وَلَا يُبۡدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوۡ ءَابَآئِهِنَّ أَوۡ ءَابَآءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوۡ أَبۡنَآئِهِنَّ أَوۡ أَبۡنَآءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوۡ إِخۡوَٰنِهِنَّ أَوۡ بَنِيٓ إِخۡوَٰنِهِنَّ أَوۡ بَنِيٓ أَخَوَٰتِهِنَّ أَوۡ نِسَآئِهِنَّ أَوۡ مَا مَلَكَتۡ أَيۡمَٰنُهُنَّ أَوِ ٱلتَّٰبِعِينَ غَيۡرِ أُوْلِي ٱلۡإِرۡبَةِ مِنَ ٱلرِّجَالِ أَوِ ٱلطِّفۡلِ ٱلَّذِينَ لَمۡ يَظۡهَرُواْ عَلَىٰ عَوۡرَٰتِ ٱلنِّسَآءِۖ وَلَا يَضۡرِبۡنَ بِأَرۡجُلِهِنَّ لِيُعۡلَمَ مَا يُخۡفِينَ مِن زِينَتِهِنَّۚ وَتُوبُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ٣١ #النور: ٣١ ‘আর মুমিন নারীদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করবে। আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না। তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশকে আবৃত করে রাখে। আর তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজদের ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাই এর ছেলে, বোনের ছেলে, আপন নারীগণ, তাদের ডান হাত যার মালিক হয়েছে, অধীনস্থ যৌনকামনামুক্ত পুরুষ অথবা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ছাড়া কারো কাছে নিজদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। আর তারা যেন নিজদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য সজোরে পদচারণা না করে। হে মুমিনগণ, তোমরা সকলেই আল্লাহর নিকট তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার’। {সূরা আন-নূর, আয়াত : ৩১} যেখানেই কোনো বেগানা পুরুষ থাকবে সেখানে শরিয়ত সম্মত হিজাবের আটটি শর্তের কোনোটি লঙ্ঘন করা হারাম। কেননা অনেক মহিলা ঘরের বাইরে হিজাব পরেন ঠিকই কিন্তু তারা নিজেদের নিকটাত্মীয় গাইরে মাহরামের এর সামনে কোনো কোনো শর্ত লঙ্ঘন করেন। যেমন চাচাতো বা মামাতো ভাইদের সামনে মাথা ঢাকেন ঠিক কিন্তু তাদের সামনে অন্যদের মতো পুরোপুরি পর্দা করেন না। এতে করে তারা সুস্পষ্ট গুনাহ ও হারামে লিপ্ত হন। শরিয়ত সম্মত হিজাব কী এবং এর শর্তাবলি কী? কে একে ফরজ করেছেন আল্লাহ মহান? হজরত আবূ উযাইনা ছাদফী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «خَيْرُ نِسَائِكُمُ الْوَدُودُ الْوَلُودُ الْمُوَاتِيَةُ الْمُوَاسِيَةُ، إِذَا اتَّقَيْنَ اللهَ، وَشَرُّ نِسَائِكُمُ الْمُتَبَرِّجَاتُ الْمُتَخَيِلَّاتُ وَهُنَّ الْمُنَافِقَاتُ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مِنْهُنَّ، إِلَّا مِثْلُ الْغُرَابِ الْأَعْصَمِ» ‘তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে তারাই সর্বোত্তম যারা আল্লাহকে ভয় করার পাশাপাশি স্বামীকে ভক্তি করে, অধিক সন্তান জন্ম দেয় এবং (স্বামীর দুঃখে তার প্রতি) সমব্যথী ও সহানুভূতিশীল হয়। পক্ষান্তরে তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে সবচে মন্দ তারাই, যারা বেপর্দা হয়ে দম্ভ ভরে চলে। এরাই হলো মুনাফিক। এরা জান্নাতে প্রবেশ করবে কেবল লাল ঠোঁট ও পা বিশিষ্ট কাকদের মতো। (অর্থাৎ এমন বৈশিষ্ট্যের কাক যেমন সংখ্যায় অনেক কম তেমনি তারা কম সংখ্যক জান্নাতে প্রবেশ করবে।) [বাইহাকি : ১৩৪৭৮] হজরত আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «صِنْفَانِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا، قَوْمٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ كَأَذْنَابِ الْبَقَرِ يَضْرِبُونَ بِهَا النَّاسَ، وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ مُمِيلَاتٌ مَائِلَاتٌ، رُءُوسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ الْمَائِلَةِ، لَا يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ، وَلَا يَجِدْنَ رِيحَهَا، وَإِنَّ رِيحَهَا لَيُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ كَذَا وَكَذَا» ‘জাহান্নামবাসী দুটি দল রয়েছে। যাদেরকে আমি এখনো দেখিনি। একদল এমন লোক যাদের হাতে গরুর লেজের মত লাঠি থাকবে যা দিয়ে তারা লোকদেরকে প্রহার করবে। আর অন্য দল এমন নারী যারা পোশাক পরেও উলঙ্গ থাকে। তারা অন্যদের তাদের প্রতি আকৃষ্ট করবে নিজেরাও অন্যদের প্রতি ঝুঁকবে। তাদের মস্তক উটের পিঠের কুঁজের মত হবে। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এমনকি জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ এর ঘ্রাণ এত এত দূর থেকেও পাওয়া যায়।’ [মুসলিম : ২১২৮] হাদিসে উল্লেখিত ‘পোশাক পরেও উলঙ্গ’–এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, এমন সংক্ষিপ্ত পোশাক যা নারীর আবরণীয় অংশ ঢাকতে যথেষ্ট নয়। এমন পাতলা পোশাক যা ভেদ করে সহজেই নারীর ত্বক দেখা যায়। এমনকি টাইট কাপড় যা ভেদ করে ত্বক দেখা যায় না বটে তবে তা নারীর আকর্ষণীয় অবয়বকে পরিস্ফূট করে দেয়। এসব পোশাক নারীরা কেবল তার সামনেই পরতে পারেন যার সামনে নিজের গোপন সৌন্দর্য তুলে ধরার অনুমতি রয়েছে। বলাবাহুল্য তিনি হলেন একমাত্র স্বামী। কেননা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো পর্দা নেই। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, وَٱلَّذِينَ هُمۡ لِفُرُوجِهِمۡ حَٰفِظُونَ ٥ إِلَّا عَلَىٰٓ أَزۡوَٰجِهِمۡ أَوۡ مَا مَلَكَتۡ أَيۡمَٰنُهُمۡ فَإِنَّهُمۡ غَيۡرُ مَلُومِينَ ٦ فَمَنِ ٱبۡتَغَىٰ وَرَآءَ ذَٰلِكَ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡعَادُونَ ٧ #المؤمنون: ٥، ٧ ‘আর যারা তাদের নিজদের লজ্জাস্থানের হিফাজতকারী। তবে তাদের স্ত্রী ও তাদের ডান হাত যার মালিক হয়েছে তারা ছাড়া, নিশ্চয় এতে তারা নিন্দিত হবে না। অতঃপর যারা এদের ছাড়া অন্যকে কামনা করে তারাই সীমালঙ্ঘনকারী।(সূরা আল-মু’মিনূন, আয়াত : ৫-৭)
পর্দা না করার কিছু শাস্তি হাদীসে উল্লেখ আছে ,
(১)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“দু’ শ্রেণীর মানুষ জাহান্নামী হবেঃ-
যারা গরুর লেজ সদৃশ বেত দ্বারা মানুষকে প্রহার করে এবং যে সব নারী এত পাতলা পোশাক পরিধান করে যে তার ভেতর দিয়ে শরীরের অংশ দেখা যায় এবং উটের কুঁজের মতন কেশ বিন্যাস করবে।
এ নারী জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না, যা বহুদূর থেকে পাওয়া যায়।”
[সহীহ মুসলিম হাদিস ২১২৭,
মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮৬৬৫]
.
(২)
রাসুল (সাঃ) বলেছেন,
“তিন শ্রেণীর মানুষের উপর জান্নাত হারাম অর্থাৎ এই তিন শ্রেণীর মানুষ কখনোই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।
প্রথম শ্রেণী হলোঃ- যারা কোনো প্রকার নেশাদারদ্রব্য পান বা গ্রহণ করে।
দ্বিতীয় শ্রেণী হলোঃ- যে বা যারা পিতা-মাতার অবাধ্য, এই শ্রেণীভূক্ত মানুষরাও জান্নাতে যাবে না।
তৃতীয় শ্রেণী হলোঃ- দাইউস।
ঐ দাইউস ব্যক্তি, যে তার পরিবারে পর্দা প্রথা চালু রাখেনি।
পরিবারের সদ্যসের মাঝে বেপর্দা ছিলো, বেহায়াপনা ছিলো কিন্তু সে বাধা প্রদান করেনি।
পরিবারের কর্তা হিসেবে বেপর্দা-বেহায়াপনা বন্ধ না করার জন্য এই শাস্তি পাবে সে।”
(মুসনাদে আহমাদ ২/৬৯)
.
(৩)
আর সুগন্ধি আকর্ষণের এমন একটি মাধ্যম যা দৃষ্টি-অবনত ব্যাক্তিকেও আকৃষ্ট করে।
সুতরাং এ বিষয়ে কতটা সতর্ক থাকা দরকার তা নিজেরাই ভেবে দেখি।
হাদীস শরীফে এসেছে, ‘‘প্রত্যেক চোখ যিনা করে।
আর কোন নারী যদি সুগন্ধি ব্যবহার করে কোন মজলিশের পাশ দিয়ে যায় তাহলে সেও নযরের যিনা বা সরাসরি যিনার প্রতি প্রলব্ধুকারী হিসেবে গণ্য হবে।”
(জামে তিরমিযী, হাদীস ২৭৮৬)
.
(৪)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“কোনো পুরুষ কোনো নারীর সাথে নির্জনে মিলিত হলে নিঃসন্দেহে তাদের তৃতীয়জন হয় শয়তান।
(অর্থাৎ তখন শয়তান তাদের মনে কুমন্ত্রণা দেয়)।”
(জামে তিরমিযী হাদীস ১১৭১)
.
(৫)
রাসুল (সঃ) ইরশাদ করেন,
“খবরদার তোমার বেগানা স্ত্রীলোকের ঘরে প্রবেশ করো না।
জনৈক সাহাবী জিজ্ঞাসা করেন ইয়া রাসুলুল্লাহ (সঃ) স্বামীর ভাইদের (ভাসুর, দেবর, বেয়াই ইত্যাদি) সম্পর্কে কি নির্দেশ?
রাসুল (সঃ) ইরশাদ করেন তারা তো স্ত্রীর জন্য মৃত্যুতুল্য।
অর্থাৎ মহাবিপদতুল্য।”
(তিরমিজিঃ ১/২২০)
.
(৬)
উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা (রাঃ) বর্ণনা করেন, “আমি এবং মাইমুনা (রাঃ) রাসুল (সঃ) এর কাছে উপস্থিত ছিলাম। এমন সময় অন্ধ সাহাবী ইবনে উম্মে মাখতুম (রাঃ) সেখানে আসতে লাগলেন। তখন রাসুল (সাঃ) বললেন তোমরা তার থেকে পর্দা করো, আড়ালে চলে যাও। আমি বললাম ইয়া রাসুলুল্লাহ তিনি তো অন্ধ।
তিনি তো আমাদের দেখতে পাচ্ছেন না।
তখন রাসুল (সাঃ) বললেন তোমরাও কি অন্ধ?
তোমরা কি তাকে দেখতে পাচ্ছো না?”
(আবু দাউদ ২/৫৬৮)
.
(৭)
রাসুল (সঃ) বলেন, “নারী হল গোপনীয় সত্ত্বা। যখন সে ঘর থেকে বের হয় তখন শয়তান তার দিকে দৃষ্টি উচু করে তাকাতে থাকে।”
(তিরমিযি ১/২২২)
.
(৮)
রাসুল (সঃ) বলেন, “আমার পরে নারী ফিতনা (পরীক্ষা) পুরুষদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ করবে।”
(বুখারি ও মুসলিম)
ফিকহের আলোকে পর্দার হুকুম
ফিকহের মাসআলা হল, মেয়েদের জন্য পর্দা করা ফরজ। গাইরে মাহরাম পুরুষের সামনে সে পর হোক বা আপন হোক, মেয়েদের একটি চুলও উন্মুক্ত রাখা জায়িয নয়। তেমনিভাবে মেয়েলোকদের জন্য কোন মেয়েলোকের সামনে হাটু হতে নাভী পর্যন্ত উন্মুক্ত করা জায়িয নয়।
গর্ভকালে বা প্রসবকালে অথবা অন্য কোন কারণে যদি ধাত্রী দ্বারা পেট মালিশ করার দরকার পড়ে, তবে নাভীর নীচের কোন অংশ খোলা যাবে না। কোন কাপড় রেখে তার উপর দিয়ে মালিশ করবে। বিনা প্রয়োজনে সতর ধাত্রীকে দেখানোও জায়িয নয়। সাধারণত কোন মেয়ের পেট মলবার সময় মা, বোন, খালা, ফুফু, দাদী, নানী, ননদ এবং বাড়ীর অন্যান্য লোকেরাও দেখে থাকে, এটা জায়িয নয়।
প্রত্যেক গাইরে মাহরাম পুরুষের প্রত্যেক গাইরে মাহরাম স্ত্রীলোকের সামনে যে পরিমাণ পর্দা করা ফরজ, কাফির-ফাসিক মেয়েলোক হতেও মুমিন মেয়েদের সে পরিমাণ পর্দা করা ওয়াজিব।
সুতরাং হিন্দু বা খৃষ্টান মেয়েলোক বা যেকোন বেদ্বীন বা বেপর্দা মেয়ে হতেও পর্দানেশীন নারীর পর্দা করা ওয়াজিব। তাদের সামনে কেবলমাত্র মুখম-ল, হাতের পাতা ও পায়ের পাতা ব্যতীত শরীরের কোন অংশ খোলা রাখা জায়িয নয়।
ধাত্রী যদি অমুসলিম মহিলা হয়, তবে শুধু জরুরী স্থান ব্যতীত হাতের বাজু, পায়ের নলা, মাথা বা গলা তাকে দেখালে গুনাহগার হবে।
মেয়েদের জন্য নতুন বর বা ভিন্ পুরুষদেরকে সামনাসামনি অথবা বেড়ার ফাঁক দিয়ে কিংবা ছাদে উঠে বা জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখা জায়িয নয়। তেমনিভাবে পুরুষদের জন্য বেগানা মেয়ে বা নতুন বউ দেখা জায়িয নয়।
স্ত্রীলোকদের নিজের পীরকেও দেখা দেয়া জায়িয নয়। তেমনি ধর্মবাপ, ধর্মভাই, উকিল বাপ, খালু, দুলাভাই, দেবর, ভাসুর, বেয়াই, নন্দাই, চাচাতো ভাই, মামাতো ভাই, খালাতো ভাই, খালাশ্বশুর, চাচাশ্বশুর ইত্যাদি গাইরে মাহরাম আত্মীয়দের সাথে দেখা দেয়া জায়িয নয়।
চুড়ি বিক্রেতা পুরুষতো দূরের কথা, বেদ্বীন স্ত্রীলোকের হাতে, এমনকি যে সকল মুসলিম মহিলা বেপর্দায় চলে, তাদের হাতেও চুড়ি পরা জায়িয নয়।
তেমনিভাবে বেগানা পুরুষের সাথে কখনো কোথাও আসা-যাওয়া করা বা দেখা দেয়া দুরস্ত নয়।
(ফাতাওয়া আলমগীরী)
পর্দার অন্যান্য বিধান
অনুমতি ছাড়া কারো ঘরে প্রবেশ নিষেধ
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন – “হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অন্যান্য গৃহে প্রবেশ করো না – যে পর্যন্ত আলাপ-পরিচয় না কর এবং গৃহবাসীদেরকে (অনুমতির জন্য) সালাম না দাও। এটাই তোমাদের জন্যে উত্তম, যাতে তোমরা স্মরণ রাখ।” (সূরাহ আন-নূর, আয়াত : ২৭)।উক্ত আয়াতের নির্দেশ অনুযায়ী, যে কারো গৃহে প্রবেশ করতে হলে, আগে অনুমতি নিতে হবে। এমনকি নিজের মায়ের ঘরে প্রবেশেও এ হুকুম।
বিনানুমতিতে কারো গৃহে প্রবেশ করলে, মাহরাম নয় এমন নারীর উপর দৃষ্টি পড়তে পারে কিংবা মাহরাম কেউ নিজ ঘরে কখনো বেহাল অবস্থায় থাকতে পারে, তখন অনুমতি ছাড়া ঢুকলে, তাদের সেই অনাকাক্সিক্ষত অবস্থা চোখে পড়ে যাবে – যা বড়ই লজ্জাকর বিষয়। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে – পর্দা ও সতর রক্ষার জন্যই অপরের ঘরে বিনানুমতিতে প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়েছে।
দৃষ্টি নত রাখতে হবে
দৃষ্টি নত রাখা পর্দার একটি বিধান। আল্লাহ তা‘আলা নর-নারীদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন দৃষ্টি নত রাখতে।
দৃষ্টি নত রাখার অর্থ – দৃষ্টিকে এমন বস্তু থেকে ফিরিয়ে রাখা, যার প্রতি দেখা শরীয়তে নিষিদ্ধ ও অবৈধ।
বেগানা নারীর প্রতি বদ নিয়তে দেখা হারাম ও কবীরা গুনাহ এবং বিনা নিয়তে বা ফ্রিমাইন্ড নিয়ে দেখাও নাজায়িয। কোন নারী অথবা পুরুষের গোপনীয় অঙ্গের প্রতি দেখা মারাত্মক গুনাহর কাজ। এছাড়া কারো গোপন বিষয় দেখার জন্য তার গৃহে উঁকি মেরে বা বেড়ার ফাঁক দিয়ে গোপনে দেখা জঘন্য পাপ। গাইরে মাহরামদের সংশ্রব থেকে দূরে থাকতে হবে
নারীদের পর্দা রক্ষার জন্য বিশেষভাবে জরুরী হল – সকল বেগানা পুরুষের সংশ্্র্র ব থেকে দূরে থাকতে হবে। এ জন্য মাহরাম ও গাইরে মাহরামদের সম্পর্কে পূর্ণরূপে অবগত হওয়া তাদের কর্তব্য।
যেসব পুরুষদেরকে দেখা দেয়া নারীদের জন্য জায়িয নয়, তারা হচ্ছে বেগানা বা গাইরে মাহরাম। নিম্নে তাদের কিছু ফিরিস্তি তুলে ধরা হল -
১। হুরমতের রক্তের সম্পর্কহীন যে কোন বেগানা পুরুষ – নিজ গ্রামের লোক হোক বা ভিন্ন গ্রামের এবং চাই একই স্কুল বা কলেজ বা ভার্সিটির হোক না কেন, কিংবা কাসমেট বা সহপাঠি হোক না কেন বা একই অফিসে চাকুরী করুক না কেন, তারা গাইরে মাহরাম।
২। ধর্মবাপ, ধর্মভাই, উকিল বাপ, মুখডাকা বাপ-ভাই বা মামা-চাচা, শিক্ষক, পীর প্রমুখ গাইরে মাহরাম।
৩। দুলাভাই।
৪। খালু, ভাসুর ও ভাসুরের ছেলে।
৫। দেবর ও দেবরের ছেলে।
৬। ননদের স্বামী ও তার ছেলে।
৭। চাচার ছেলে/চাচাতো ভাই।
৮। জেঠাতো ভাই।
৯। মামার ছেলে/মামাতো ভাই।
১০। স্বামীর অন্য যত প্রকারের ভাই বা দুলাভাই আছে।
উল্লিখিত তারা সকলেই বেগানা। তাদের সাথে পর্দা করা ফরজ। এক কথায়, যাদের সাথে বিবাহ বৈধ, তারা সবাই গাইরে মাহরাম। তাই তাদের সাথে দেখা দেয়া জায়িয নয়।
যৌনাঙ্গকে হিফাজত করতে হবে
যৌনাঙ্গকে হিফাজত করা ও সংযত রাখা পর্দার বড় বিধান। আল্লাহ তা‘আলা নারী-পুরুষ উভয়কে যৌনাঙ্গ হিফাজত করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন।
যৌনাঙ্গকে হিফাজত করার অর্থ হল – কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার যত পন্থা প্রক্রিয়া আছে, সবগুলো থেকে যৌনাঙ্গকে দূরে রাখা। এতে ব্যভিচার, সমমৈথুন, হস্তমৈথুন, ঘর্ষণ ইত্যাদি সব কাম চরিতার্থমূলক কর্ম নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
কাম প্রবৃত্তির প্রথম ও প্রারম্ভিক কারণ হচ্ছে দৃষ্টিপাত করা ও দেখা এবং সর্বশেষ পরিণতি হচ্ছে ব্যভিচার। সূরাহ নূরের ৩১ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা এসব বিষয় জোড়ালোভাবে নিষিদ্ধ করে হারাম করে দিয়েছেন। সেই সাথে এতদুভয়ের অন্তর্বতী ভূমিকাসমূহ যেমন – পরস্পর কথাবার্তা বলা, শোনা, স্পর্শ করা, চিঠিপত্র বা এসএমএস আদান-প্রদান করা ইত্যাদি সবই নিষিদ্ধ ও হারাম পরিগণিত হয়েছে।
ইসলামের পর্দা-ব্যবস্থা যদি পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়িত হয় তাহলে মুসলিম নর-নারীর ব্যক্তি জীবনের সাথে সাথে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনও সুস্থ ও পবিত্র হবে। পক্ষান্তরে পর্দা-বিধান কার্যকর না থাকলে যেখানে যেখানে তা অনুপস্থিত সেখানে সেখানেই পঙ্কিলতা ও অস্থিরতার অনুপ্রবেশ ঘটবে। এ কারণে ইসলামের পর্দা বিধান হল ব্যক্তি ও সমাজের রক্ষাকবচ। এই সত্য আমরা যত দ্রুত উপলব্ধি করব তত দ্রুত কল্যাণ লাভ করব। এ কারণেই ইসলামের পর্দা-ব্যবস্থার যারা বিরোধী তারা শুধু দ্বীন-ধর্মেরই বিরোধী নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রেরও বিরোধী; তারা মানব ও মানবতার মুক্তি ও কল্যাণেরও বিরোধী। সঙ্গত কারণেই পর্দা-বিধানকে বলা যায় বর্তমান মুসলিমসমাজের জন্য আসমানী ফুরকান তথা এমন এক ঐশী মানদন্ড, যা মুমিন-মুনাফিকের মাঝে টেনে দেয় পরিষ্কার পার্থক্যরেখা।
মাহরাম ছাড়া সবার সাথেই পর্দা করতে হবে আল্লাহ তাআলা মুসলিম নারীর সম্মানার্থে এবং দুষ্ট লোকের অশিষ্ট আচরণ থেকে তার মর্যাদা রক্ষার্থে পর্দা ফরজ করেছেন। পর্দা যেমন পুরুষদের রক্ষা করে নারীর ফিতনা থেকে তেমনি নারীকেও নানা কষ্টদায়ক ব্যাপার থেকে রক্ষা করে । ইসলামে প্রতিটি মুসলিম নারীর জন্য বেগানা পুরুষের সামনে পূর্ণ পর্দা রক্ষা করা জরুরী। তারা হলেন মাহরাম ব্যতীত বাকি সবাই। আর মাহরামগণ হলেন : ১. পিতা। ২. দাদা। ৩. স্বামীর পিতা তথা শ্বশুর। ৪. স্বামীর সন্তান তথা বৈমাত্রেয় পুত্র। ৫. নিজের পুত্র। ৬. ভাই। ৮. ভাইপো। ৯. বোনপো। ১০ চাচা-জ্যাঠা। ১১. মামা। দুধ পানজনিত মাহরামগণ যেমন পবিত্র কোরানে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, وَقُل لِّلۡمُؤۡمِنَٰتِ يَغۡضُضۡنَ مِنۡ أَبۡصَٰرِهِنَّ وَيَحۡفَظۡنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبۡدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنۡهَاۖ وَلۡيَضۡرِبۡنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّۖ وَلَا يُبۡدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوۡ ءَابَآئِهِنَّ أَوۡ ءَابَآءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوۡ أَبۡنَآئِهِنَّ أَوۡ أَبۡنَآءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوۡ إِخۡوَٰنِهِنَّ أَوۡ بَنِيٓ إِخۡوَٰنِهِنَّ أَوۡ بَنِيٓ أَخَوَٰتِهِنَّ أَوۡ نِسَآئِهِنَّ أَوۡ مَا مَلَكَتۡ أَيۡمَٰنُهُنَّ أَوِ ٱلتَّٰبِعِينَ غَيۡرِ أُوْلِي ٱلۡإِرۡبَةِ مِنَ ٱلرِّجَالِ أَوِ ٱلطِّفۡلِ ٱلَّذِينَ لَمۡ يَظۡهَرُواْ عَلَىٰ عَوۡرَٰتِ ٱلنِّسَآءِۖ وَلَا يَضۡرِبۡنَ بِأَرۡجُلِهِنَّ لِيُعۡلَمَ مَا يُخۡفِينَ مِن زِينَتِهِنَّۚ وَتُوبُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ٣١ #النور: ٣١ ‘আর মুমিন নারীদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করবে। আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না। তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশকে আবৃত করে রাখে। আর তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজদের ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাই এর ছেলে, বোনের ছেলে, আপন নারীগণ, তাদের ডান হাত যার মালিক হয়েছে, অধীনস্থ যৌনকামনামুক্ত পুরুষ অথবা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ছাড়া কারো কাছে নিজদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। আর তারা যেন নিজদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য সজোরে পদচারণা না করে। হে মুমিনগণ, তোমরা সকলেই আল্লাহর নিকট তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার’। {সূরা আন-নূর, আয়াত : ৩১} যেখানেই কোনো বেগানা পুরুষ থাকবে সেখানে শরিয়ত সম্মত হিজাবের আটটি শর্তের কোনোটি লঙ্ঘন করা হারাম। কেননা অনেক মহিলা ঘরের বাইরে হিজাব পরেন ঠিকই কিন্তু তারা নিজেদের নিকটাত্মীয় গাইরে মাহরামের এর সামনে কোনো কোনো শর্ত লঙ্ঘন করেন। যেমন চাচাতো বা মামাতো ভাইদের সামনে মাথা ঢাকেন ঠিক কিন্তু তাদের সামনে অন্যদের মতো পুরোপুরি পর্দা করেন না। এতে করে তারা সুস্পষ্ট গুনাহ ও হারামে লিপ্ত হন। শরিয়ত সম্মত হিজাব কী এবং এর শর্তাবলি কী? আর এ ব্যাপারে আপনার অজ্ঞতায় ক্ষতিই বা কী? আপনি কি হিজাব নিয়ে ভেবে দেখেছন, কে একে ফরজ করেছেন আল্লাহ মহান? কি পরিমান পর্দা ফরজ করেছেন? হজরত আবূ উযাইনা ছাদফী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «خَيْرُ نِسَائِكُمُ الْوَدُودُ الْوَلُودُ الْمُوَاتِيَةُ الْمُوَاسِيَةُ، إِذَا اتَّقَيْنَ اللهَ، وَشَرُّ نِسَائِكُمُ الْمُتَبَرِّجَاتُ الْمُتَخَيِلَّاتُ وَهُنَّ الْمُنَافِقَاتُ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مِنْهُنَّ، إِلَّا مِثْلُ الْغُرَابِ الْأَعْصَمِ» ‘তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে তারাই সর্বোত্তম যারা আল্লাহকে ভয় করার পাশাপাশি স্বামীকে ভক্তি করে, অধিক সন্তান জন্ম দেয় এবং (স্বামীর দুঃখে তার প্রতি) সমব্যথী ও সহানুভূতিশীল হয়। পক্ষান্তরে তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে সবচে মন্দ তারাই, যারা বেপর্দা হয়ে দম্ভ ভরে চলে। এরাই হলো মুনাফিক। এরা জান্নাতে প্রবেশ করবে কেবল লাল ঠোঁট ও পা বিশিষ্ট কাকদের মতো। (অর্থাৎ এমন বৈশিষ্ট্যের কাক যেমন সংখ্যায় অনেক কম তেমনি তারা কম সংখ্যক জান্নাতে প্রবেশ করবে।) [বাইহাকি : ১৩৪৭৮]
পবিত্র কুরআনে পর্দার নির্দেশ
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন : “(হে নারীগণ!) তোমরা তোমাদের ঘরের (বাড়ীর চতুর্সীমানার) ভিতর অবস্থান কর এবং বাইরে বের হয়োনা – যেমন ইসলামপূর্ব জাহিলী যুগের মেয়েরা বের হত।” (সূরাহ আহযাব, আয়াত : ৪৩)
আল্লাহ তা‘আলা আরো ইরশাদ করেন : “(হে নবী!) আপনি আপনার পত্মীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, যখন কোন প্রয়োজনে বাইরে বের হতে হয়, তখন তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দাংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। (যেন পর্দার ফরজ লংঘন না করে। এমনকি চেহারাও যেন খোলা না রাখে। তারা যেন বড় চাদরের ঘোমটা দ্বারা নিজেদের চেহারাকে আবৃত করে রাখে।) ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। (সূরাহ আহযাব, আয়াত : ৬০)
পর্দা না করার কিছু শাস্তি হাদীসে উল্লেখ আছে ,
(১)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“দু’ শ্রেণীর মানুষ জাহান্নামী হবেঃ-
যারা গরুর লেজ সদৃশ বেত দ্বারা মানুষকে প্রহার করে এবং যে সব নারী এত পাতলা পোশাক পরিধান করে যে তার ভেতর দিয়ে শরীরের অংশ দেখা যায় এবং উটের কুঁজের মতন কেশ বিন্যাস করবে।
এ নারী জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না, যা বহুদূর থেকে পাওয়া যায়।”
[সহীহ মুসলিম হাদিস ২১২৭,
মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮৬৬৫]
.
(২)
রাসুল (সাঃ) বলেছেন,
“তিন শ্রেণীর মানুষের উপর জান্নাত হারাম অর্থাৎ এই তিন শ্রেণীর মানুষ কখনোই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।
প্রথম শ্রেণী হলোঃ- যারা কোনো প্রকার নেশাদারদ্রব্য পান বা গ্রহণ করে।
দ্বিতীয় শ্রেণী হলোঃ- যে বা যারা পিতা-মাতার অবাধ্য, এই শ্রেণীভূক্ত মানুষরাও জান্নাতে যাবে না।
তৃতীয় শ্রেণী হলোঃ- দাইউস।
ঐ দাইউস ব্যক্তি, যে তার পরিবারে পর্দা প্রথা চালু রাখেনি।
পরিবারের সদ্যসের মাঝে বেপর্দা ছিলো, বেহায়াপনা ছিলো কিন্তু সে বাধা প্রদান করেনি।
পরিবারের কর্তা হিসেবে বেপর্দা-বেহায়াপনা বন্ধ না করার জন্য এই শাস্তি পাবে সে।”
(মুসনাদে আহমাদ ২/৬৯)
.
(৩)
আর সুগন্ধি আকর্ষণের এমন একটি মাধ্যম যা দৃষ্টি-অবনত ব্যাক্তিকেও আকৃষ্ট করে।
সুতরাং এ বিষয়ে কতটা সতর্ক থাকা দরকার তা নিজেরাই ভেবে দেখি।
হাদীস শরীফে এসেছে, ‘‘প্রত্যেক চোখ যিনা করে।
আর কোন নারী যদি সুগন্ধি ব্যবহার করে কোন মজলিশের পাশ দিয়ে যায় তাহলে সেও নযরের যিনা বা সরাসরি যিনার প্রতি প্রলব্ধুকারী হিসেবে গণ্য হবে।”
(জামে তিরমিযী, হাদীস ২৭৮৬)
.
(৪)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“কোনো পুরুষ কোনো নারীর সাথে নির্জনে মিলিত হলে নিঃসন্দেহে তাদের তৃতীয়জন হয় শয়তান।
(অর্থাৎ তখন শয়তান তাদের মনে কুমন্ত্রণা দেয়)।”
(জামে তিরমিযী হাদীস ১১৭১)
.
(৫)
রাসুল (সঃ) ইরশাদ করেন,
“খবরদার তোমার বেগানা স্ত্রীলোকের ঘরে প্রবেশ করো না।
জনৈক সাহাবী জিজ্ঞাসা করেন ইয়া রাসুলুল্লাহ (সঃ) স্বামীর ভাইদের (ভাসুর, দেবর, বেয়াই ইত্যাদি) সম্পর্কে কি নির্দেশ?
রাসুল (সঃ) ইরশাদ করেন তারা তো স্ত্রীর জন্য মৃত্যুতুল্য।
অর্থাৎ মহাবিপদতুল্য।”
(তিরমিজিঃ ১/২২০)
.
(৬)
উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা (রাঃ) বর্ণনা করেন, “আমি এবং মাইমুনা (রাঃ) রাসুল (সঃ) এর কাছে উপস্থিত ছিলাম। এমন সময় অন্ধ সাহাবী ইবনে উম্মে মাখতুম (রাঃ) সেখানে আসতে লাগলেন। তখন রাসুল (সাঃ) বললেন তোমরা তার থেকে পর্দা করো, আড়ালে চলে যাও। আমি বললাম ইয়া রাসুলুল্লাহ তিনি তো অন্ধ।
তিনি তো আমাদের দেখতে পাচ্ছেন না।
তখন রাসুল (সাঃ) বললেন তোমরাও কি অন্ধ?
তোমরা কি তাকে দেখতে পাচ্ছো না?”
(আবু দাউদ ২/৫৬৮)
.
(৭)
রাসুল (সঃ) বলেন, “নারী হল গোপনীয় সত্ত্বা। যখন সে ঘর থেকে বের হয় তখন শয়তান তার দিকে দৃষ্টি উচু করে তাকাতে থাকে।”
(তিরমিযি ১/২২২)
.
(৮)
রাসুল (সঃ) বলেন, “আমার পরে নারী ফিতনা (পরীক্ষা) পুরুষদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ করবে।”
(বুখারি ও মুসলিম)
ফিকহের আলোকে পর্দার হুকুম
ফিকহের মাসআলা হল, মেয়েদের জন্য পর্দা করা ফরজ। গাইরে মাহরাম পুরুষের সামনে সে পর হোক বা আপন হোক, মেয়েদের একটি চুলও উন্মুক্ত রাখা জায়িয নয়। তেমনিভাবে মেয়েলোকদের জন্য কোন মেয়েলোকের সামনে হাটু হতে নাভী পর্যন্ত উন্মুক্ত করা জায়িয নয়।
গর্ভকালে বা প্রসবকালে অথবা অন্য কোন কারণে যদি ধাত্রী দ্বারা পেট মালিশ করার দরকার পড়ে, তবে নাভীর নীচের কোন অংশ খোলা যাবে না। কোন কাপড় রেখে তার উপর দিয়ে মালিশ করবে। বিনা প্রয়োজনে সতর ধাত্রীকে দেখানোও জায়িয নয়। সাধারণত কোন মেয়ের পেট মলবার সময় মা, বোন, খালা, ফুফু, দাদী, নানী, ননদ এবং বাড়ীর অন্যান্য লোকেরাও দেখে থাকে, এটা জায়িয নয়।
প্রত্যেক গাইরে মাহরাম পুরুষের প্রত্যেক গাইরে মাহরাম স্ত্রীলোকের সামনে যে পরিমাণ পর্দা করা ফরজ, কাফির-ফাসিক মেয়েলোক হতেও মুমিন মেয়েদের সে পরিমাণ পর্দা করা ওয়াজিব।
সুতরাং হিন্দু বা খৃষ্টান মেয়েলোক বা যেকোন বেদ্বীন বা বেপর্দা মেয়ে হতেও পর্দানেশীন নারীর পর্দা করা ওয়াজিব। তাদের সামনে কেবলমাত্র মুখম-ল, হাতের পাতা ও পায়ের পাতা ব্যতীত শরীরের কোন অংশ খোলা রাখা জায়িয নয়।
ধাত্রী যদি অমুসলিম মহিলা হয়, তবে শুধু জরুরী স্থান ব্যতীত হাতের বাজু, পায়ের নলা, মাথা বা গলা তাকে দেখালে গুনাহগার হবে।
মেয়েদের জন্য নতুন বর বা ভিন্ পুরুষদেরকে সামনাসামনি অথবা বেড়ার ফাঁক দিয়ে কিংবা ছাদে উঠে বা জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখা জায়িয নয়। তেমনিভাবে পুরুষদের জন্য বেগানা মেয়ে বা নতুন বউ দেখা জায়িয নয়।
স্ত্রীলোকদের নিজের পীরকেও দেখা দেয়া জায়িয নয়। তেমনি ধর্মবাপ, ধর্মভাই, উকিল বাপ, খালু, দুলাভাই, দেবর, ভাসুর, বেয়াই, নন্দাই, চাচাতো ভাই, মামাতো ভাই, খালাতো ভাই, খালাশ্বশুর, চাচাশ্বশুর ইত্যাদি গাইরে মাহরাম আত্মীয়দের সাথে দেখা দেয়া জায়িয নয়।
চুড়ি বিক্রেতা পুরুষতো দূরের কথা, বেদ্বীন স্ত্রীলোকের হাতে, এমনকি যে সকল মুসলিম মহিলা বেপর্দায় চলে, তাদের হাতেও চুড়ি পরা জায়িয নয়।
তেমনিভাবে বেগানা পুরুষের সাথে কখনো কোথাও আসা-যাওয়া করা বা দেখা দেয়া দুরস্ত নয়।
(ফাতাওয়া আলমগীরী)
পর্দার অন্যান্য বিধান
অনুমতি ছাড়া কারো ঘরে প্রবেশ নিষেধ
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন – “হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অন্যান্য গৃহে প্রবেশ করো না – যে পর্যন্ত আলাপ-পরিচয় না কর এবং গৃহবাসীদেরকে (অনুমতির জন্য) সালাম না দাও। এটাই তোমাদের জন্যে উত্তম, যাতে তোমরা স্মরণ রাখ।” (সূরাহ আন-নূর, আয়াত : ২৭)।উক্ত আয়াতের নির্দেশ অনুযায়ী, যে কারো গৃহে প্রবেশ করতে হলে, আগে অনুমতি নিতে হবে। এমনকি নিজের মায়ের ঘরে প্রবেশেও এ হুকুম।
বিনানুমতিতে কারো গৃহে প্রবেশ করলে, মাহরাম নয় এমন নারীর উপর দৃষ্টি পড়তে পারে কিংবা মাহরাম কেউ নিজ ঘরে কখনো বেহাল অবস্থায় থাকতে পারে, তখন অনুমতি ছাড়া ঢুকলে, তাদের সেই অনাকাক্সিক্ষত অবস্থা চোখে পড়ে যাবে – যা বড়ই লজ্জাকর বিষয়। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে – পর্দা ও সতর রক্ষার জন্যই অপরের ঘরে বিনানুমতিতে প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়েছে।
দৃষ্টি নত রাখতে হবে
দৃষ্টি নত রাখা পর্দার একটি বিধান। আল্লাহ তা‘আলা নর-নারীদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন দৃষ্টি নত রাখতে।
দৃষ্টি নত রাখার অর্থ – দৃষ্টিকে এমন বস্তু থেকে ফিরিয়ে রাখা, যার প্রতি দেখা শরীয়তে নিষিদ্ধ ও অবৈধ।
বেগানা নারীর প্রতি বদ নিয়তে দেখা হারাম ও কবীরা গুনাহ এবং বিনা নিয়তে বা ফ্রিমাইন্ড নিয়ে দেখাও নাজায়িয। কোন নারী অথবা পুরুষের গোপনীয় অঙ্গের প্রতি দেখা মারাত্মক গুনাহর কাজ। এছাড়া কারো গোপন বিষয় দেখার জন্য তার গৃহে উঁকি মেরে বা বেড়ার ফাঁক দিয়ে গোপনে দেখা জঘন্য পাপ। গাইরে মাহরামদের সংশ্রব থেকে দূরে থাকতে হবে
নারীদের পর্দা রক্ষার জন্য বিশেষভাবে জরুরী হল – সকল বেগানা পুরুষের সংশ্্র্র ব থেকে দূরে থাকতে হবে। এ জন্য মাহরাম ও গাইরে মাহরামদের সম্পর্কে পূর্ণরূপে অবগত হওয়া তাদের কর্তব্য।
যেসব পুরুষদেরকে দেখা দেয়া নারীদের জন্য জায়িয নয়, তারা হচ্ছে বেগানা বা গাইরে মাহরাম। নিম্নে তাদের কিছু ফিরিস্তি তুলে ধরা হল -
১। হুরমতের রক্তের সম্পর্কহীন যে কোন বেগানা পুরুষ – নিজ গ্রামের লোক হোক বা ভিন্ন গ্রামের এবং চাই একই স্কুল বা কলেজ বা ভার্সিটির হোক না কেন, কিংবা কাসমেট বা সহপাঠি হোক না কেন বা একই অফিসে চাকুরী করুক না কেন, তারা গাইরে মাহরাম।
২। ধর্মবাপ, ধর্মভাই, উকিল বাপ, মুখডাকা বাপ-ভাই বা মামা-চাচা, শিক্ষক, পীর প্রমুখ গাইরে মাহরাম।
৩। দুলাভাই।
৪। খালু, ভাসুর ও ভাসুরের ছেলে।
৫। দেবর ও দেবরের ছেলে।
৬। ননদের স্বামী ও তার ছেলে।
৭। চাচার ছেলে/চাচাতো ভাই।
৮। জেঠাতো ভাই।
৯। মামার ছেলে/মামাতো ভাই।
১০। স্বামীর অন্য যত প্রকারের ভাই বা দুলাভাই আছে।
উল্লিখিত তারা সকলেই বেগানা। তাদের সাথে পর্দা করা ফরজ। এক কথায়, যাদের সাথে বিবাহ বৈধ, তারা সবাই গাইরে মাহরাম। তাই তাদের সাথে দেখা দেয়া জায়িয নয়।
যৌনাঙ্গকে হিফাজত করতে হবে
যৌনাঙ্গকে হিফাজত করা ও সংযত রাখা পর্দার বড় বিধান। আল্লাহ তা‘আলা নারী-পুরুষ উভয়কে যৌনাঙ্গ হিফাজত করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন।
যৌনাঙ্গকে হিফাজত করার অর্থ হল – কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার যত পন্থা প্রক্রিয়া আছে, সবগুলো থেকে যৌনাঙ্গকে দূরে রাখা। এতে ব্যভিচার, সমমৈথুন, হস্তমৈথুন, ঘর্ষণ ইত্যাদি সব কাম চরিতার্থমূলক কর্ম নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
কাম প্রবৃত্তির প্রথম ও প্রারম্ভিক কারণ হচ্ছে দৃষ্টিপাত করা ও দেখা এবং সর্বশেষ পরিণতি হচ্ছে ব্যভিচার। সূরাহ নূরের ৩১ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা এসব বিষয় জোড়ালোভাবে নিষিদ্ধ করে হারাম করে দিয়েছেন। সেই সাথে এতদুভয়ের অন্তর্বতী ভূমিকাসমূহ যেমন – পরস্পর কথাবার্তা বলা, শোনা, স্পর্শ করা, চিঠিপত্র বা এসএমএস আদান-প্রদান করা ইত্যাদি সবই নিষিদ্ধ ও হারাম পরিগণিত হয়েছে।
Monday, 6 May 2019
মাছআলা ওয়া মাছায়েল।
বিবাহ অধ্যায় ঃ
নিকাহ এমন একটি চুক্তি যার মাধ্যমে নারী পুরুষ মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপন বৈধ হয় ।
★বিবাহ সুন্নতে মুয়াক্কাদা,যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলে বিবাহ করা ওয়াজিব।
★জুলুমের আশঙ্কা থাকলে বিবাহ করা মাকরুহ ।
★বিবাহের রুকন হল ইজাব ও কবুল ।
বিবাহের শর্ত ঃ
১.জ্ঞান বান হওয়া ,বালিক ও আজাদ হওয়া ।
২.পাত্রী বিবাহ যোগ্য হওয়া ।
৩.পাত্র পাত্রী উভয় উভয়ের কথা শ্রবণ করা ।
৪.সাক্ষী থাকা এবং সাক্ষী মুসলমান হওয়া ।
বর কনে অমুসলিম হলে সাক্ষী মুসলমান হওয়া শর্ত নয় ।
বিবাহের সাক্ষী একাধিক হওয়া শর্ত।
★নসব বা রক্তের সম্পর্কের দরুন যে যে মহিলাকে বিবাহ করা হারামঃব্যক্তির মা,বোন,মেয়ে,খালা, ফুফু,ভাগ্নি ও ভাতুষ্পুত্রী ইত্যাদি।
★যদি স্ত্রীর কামোদ্দীপনার সাথে লজ্জাস্থান চুম্বন করে তাহলে পুরো হুরমাত মুসাহারা বলে গণ্য হবে।একইভাবে যদি স্ত্রী স্বামীর লজ্জাস্থানের চুম্বন করে হুরমাত মুসাহারা বলে গন্য হবে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,
হে মানব, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিতি হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক পরহেযগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন। [সূরা আল-হুজুরাতঃ ১৩]
মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গর হেফাযত করে। এতে তাদেরজন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন। [সূরা আন-নুরঃ৩০]
ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারাযেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদেরসৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে এবংতারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ, ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরেপদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাইআল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরাসফলকাম হও। [সূরা আন-নুরঃ ৩১]
আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। [সূরাবনী-ইসরাইলঃ ৩২]
নির্লজ্জতার কাছেও যেয়ো না, প্রকাশ্য হোক কিংবা অপ্রকাশ্য [সূরা আল আন’আমঃ ১৫১]
যারা চায় যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রচার ঘটুক তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না। [সূরাআন-নুরঃ ১৯]
মোহরের বিবরণ ঃ
★মহরের সর্বনিম্ন সীমা হচ্ছে স্ত্রীকে কিছু কোরআনের আয়াত শিক্ষা দেওওয়া
রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর মেয়ে ফাতেমা রাযি.-এর মহর ছিল পাঁচশত দেরহাম। যেমন, মুহাম্মদ ইবন ইবরাহিম রহ. বর্ণনা করেন,
كان صداق بنات رسول اللهﷺ ونساءه خمس مائة درهم ثِنْتَيْ عَشْرَةَ أُوقِيَّةً و نصف
রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর মেয়ে ও স্ত্রীগণের মহর ছিল পাঁচশত দেরহাম অর্থাৎ সাড়ে বার উকিয়া। ( তাবাকাতে ইবনে সাদ ৮/২২)
ইমাম নববী রহ. মাজমু’-গ্রন্থে বলেন,
والمستحب ألا يزيد على خمسمائة درهم، وهو صداق أزواج النبي ﷺ وبناته
মহর পাঁচশত দেরহামের বেশি না হওয়া মুস্তাহাব। এটা রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর স্ত্রীদের ও কন্যাদের মহর ছিল।
তবে মোহরের কোন নির্্দিষ্ট পরিমান নেই।
তালাকের বিবরনঃ
অর্থাৎ ‘হে নবী! (উম্মতকে বলুন) তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দিতে চাও, তখন তাদেরকে তালাক দিয়ো ইদ্দতের প্রতি
লক্ষ্য রেখে এবং ইদ্দত গণনা করো। তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাাহকে ভয় করো। তাদেরকে তাদের গৃহ থেকে
বহিষ্কার করো না এবং তারাও যেন বের না হয় যদি না তারা কোন সুস্পষ্ট নির্লজ্জ কাজে লিপ্ত হয়। এগুলো আল্লাহরনির্ধারিত সীমা।
যে ব্যক্তি আল্লাহর সীমালংঘন করে, সে নিজেরই অনিষ্ট করে। তুমি জান না, হয়তো আল্লাহ এর পর কোননতুন উপায়
করে দেবেন। (সূরা তালাক, আয়াত নং-১)
উল্লেখিত আয়াতে দেখা যাচ্ছে যে,
স্ত্রীকে তালাক দিলে ইদ্দতের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে (ইদ্দত হলো মহিলাদের রজঃস্রাব বা মাসিক চক্র)
ইদ্দত গননা করতে হবে (কয়টি ইদ্দত গণনা করতে হবে সে সম্পর্কে কিছুক্ষন পরে আয়াত পেশ করছি)
কোন সুস্পষ্ট নির্লজ্জ কাজে (যিনা/ব্যভিাচার) লিপ্ত না হলে স্ত্রীকে ঘর থেকে বের করো না অর্থাৎ তালাক দেয়া যাবে না
এ তিনটি বিষয় হলো আল্লাহ কর্তৃক তালাকের নির্ধারিত সীমা, যা লংঘন করলে নিজের অর্থাৎ তালাক প্রদানকারীরঅনিষ্ট হবে
উল্লেখিত তিনটি সীমা তালাকের জন্য নির্দিষ্ট। এর হেরফের হলে তালাক হবে না।
আল্লাহ কোন নতুন উপায় করে দেবেন’ এর ব্যাখ্যায় তাফসীরে মারেফুল কুরআনে বলা হয়েছে ‘
স্বামীর অন্তরেতালাকের ব্যাপারে অনুতপ্ত সৃষ্টি হবে’। ফলে হয়তো তারা আবার সংসার করতে পারবে।
এবার সূরাতালাকের ২নং আয়াতের দিকে লক্ষ্য করি। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন,
তালাক
অর্থাৎ ‘অতঃপর তারা যখন তাদের ইদ্দতকালে পৌঁছে, তখন তাদেরকে যথোপযুক্ত পন্থায় রেখে দেবে অথবা যথোপযুক্তপন্থায় ছেড়ে দেবে
এবং তোমাদের মধ্য থেকে দু’জন নির্ভরযোগ্য লোককে সাক্ষী রাখবে।’ (সূরা তালাক-২)
উল্লেখিত আয়াতে দেখা যাচ্ছে যে,
ইদ্দতকালে পৌছলে স্ত্রীকে রাখাও যাবে অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর মিল হলে রাখা যাবে অথবা মনের অমিল হলে তালাক দিবে
তালাকের ক্ষেত্রে দুই জন সাক্ষী রাখতে হবে। অর্থাৎ একা একা তালাক তালাক উচ্চারণ করলে তালাক হবে না। আবারপুনরায় সংসার করতে হলেও দুই জন সাক্ষী রাখতে হবে। যদি কেউ বলে তালাকের জন্য কোন স্বাক্ষীর দরকার নেই,পুরুষ তালাক উচ্চারণ করলেই তালাক হবে। তবে তা সম্পূর্ণ কুরআন বিরোধী অর্থাৎ কুফুরী আকিদা।
এবার সূরা তালাকের ৪নং আয়াতের দিকে লক্ষ্য করি। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন,
তালাক
অর্থাৎ ‘তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যাদের ঋতুবর্তী হওয়ার আশা নেই, তাদের ব্যাপারে সন্দেহ হলে তাদের ইদ্দত হবে তিনমাস। আর যারা এখনও ঋতুর বয়সে পৌঁছেনি, তাদেরও অনুরূপ ইদ্দতকাল হবে। গর্ভবতী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসবপর্যন্ত। যে আল্লাকে ভয় করে, আল্লাহ তার কাজ সহজ করে দেন।’ (সূরা তালাক-৪)
উল্লেখিত আয়াতে দেখা যাচ্ছে যে,
বালেগা নারীদের ক্ষেত্রে ইদ্দত কাল হবে তিন মাসিক বা তিন রজস্রাব
নাবালেগা নারীদের ক্ষেত্রে ইদ্দত কাল হবে তিন মাস
গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে ইদ্দতকাল হবে সন্তান প্রসব পর্যন্ত।
উপরোক্ত সূরা তালাকের তিনটি আয়াত বিশ্লেষণ করলে আমরা পাই যে, স্পষ্ট নির্লজ্জ কাজ পরিলক্ষিত না হলে স্ত্রীকেতালাক
দেয়া যাবে না। আর তালাক দিলে সেক্ষেত্রে তিনটি ইদ্দত তথা মাসিক অপেক্ষা করতে হবে। প্রথম মাসে তালাকদিবে, যদি এর মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মিল হয়ে যায় তবে তারা পুনরায় সংসার করবে। আর যদি মিল না হয় তবে দ্বিতীয় মাসেতালাক দিবে এবং অপেক্ষা করবে। যদি এবার মিল হয়ে যায় তবে সংসার করবে অথবা তৃতীয় মাসে পুনরায় তালাক দিবে।তৃতীয় মাস পূর্ণ হলে তারা যদি মনে করে সংসার করবে অথবা বিচ্ছিন্ন হবে তাহলে দুজন স্বাক্ষী রেখে চূড়ান্ত ফয়সালাকরবে। অর্থাৎ সংসার করলেও দুজন স্বাক্ষী রাখবে এবং বিচ্ছেদ ঘটালেও স্বাক্ষী রাখবে। তিন ইদ্দতকাল সময় অপেক্ষাকরার মধ্যে হেকমত লুকিয়ে আছে। কেননা নারী যদি গর্ভবতী হয়ে যায় তবে এ তিন মাসের মধ্যেই বোঝা যাবে। আরগর্ভবর্তী নারীদের ক্ষেত্রে ইদ্দতকাল হবে সন্তান প্রসব পর্যন্ত। অর্থাৎ তিন মাস অতিবাহিত হওয়ার পর যদি সন্তান প্রসব নাহয়, তবে সন্তান প্রসব পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সুবহানআল্লাহ! আল্লাহর কি অপার করুনা। সন্তান প্রসবের পরে যদিসন্তানের মুখের দিকে চেয়ে স্বামী-স্ত্রীর মিল হয়ে যায় তাই গর্ভবতীদের জন্য আল্লাহ প্রসব পর্যন্ত ইদ্দতকাল নির্দিষ্ট করেদিয়েছেন।
এখন সূরা বাকারা ২২৮নং আয়াত লক্ষ্য করি। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন-
তালাক
অর্থাৎ ‘আর তালাকপ্রাপ্তা নারী নিজেকে অপেক্ষায় রাখবে তিন হায়েয পর্যন্ত। আর যদি সে আল্লাহ প্রতি এবং আখেরাতদিবসের ওপর ঈমানদার হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহ যা তার জরায়ুতে
সৃষ্টি করেছেন তা লুকিয়ে রাখা জায়েয নয়। আর যদিসদ্ভাব রেখে চলতে চায়, তাহলে তাদেরকে ফিরিয়ে নেবার অধিকার তাদের স্বামীরা সংরক্ষণ করে। আর পুরুষদের যেমনস্ত্রীদের ওপর অধিকার রয়েছে, তেমনিভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে পুরুষদের ওপর নিয়ম অনুযায়ী। আর নারীদের ওপরপুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। আর আল্লাহ হচ্ছে পরাক্রমশালী,বিজ্ঞ। ।(সূরা বাকারা-২২৮)
উল্লেখিত আয়াতে দেখা যাচ্ছে যে,
এ আয়াতে তালাকের জন্য নারী তিন হায়েজ বা রজঃস্রাব পর্যন্ত অপেক্ষা করবে তা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
তালাকপ্রাপ্তা নারী তিন মাস অপেক্ষা করে অর্থাৎ চূড়ান্ত তালাকের পরে অন্য কোথাও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে
তাৎক্ষনিক তালাক ও তাৎক্ষনিক বিবাহ সম্পুর্ণ কুরআন বিরোধী
তিন মাসের মধ্যে জরায়ুতে যা সৃষ্টি হয়েছে তথা গর্ভবতী হলে তা প্রকাশ পাবে
তিন মাসের মধ্যে যদি সদ্ভাব রেখে চলতে চায় তবে পুনরায় সংসার করতে পারে
তালাকের ব্যাপারে পুরুষদের যেমন অধিকার আছে নারীদের ক্ষেত্রেও অধিকার আছে
খন সূরা বাকারা ২২৯নং আয়াত লক্ষ্য করি। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন-
তালাক
অর্থাৎ “তালাকে- ‘রজঈ’ হলে দুবার পর্যন্ত- তারপর হয় নিয়মানুযায়ী রাখবে, না হয় সহৃদয়তার সঙ্গে বর্জন করবে।
আরনিজের দেয়া সম্পদ থেকে কিছু ফিরিয়ে নেয়া তোমাদের জন্য জায়েয নয় তাদের কাছ থেকে। কিন্তু যে ক্ষেত্রে স্বামী ও স্ত্রীউভয়েই এ ব্যাপারে ভয় করে যে, তারা আল্লাহর নির্দেশ বজায় রাখতে পারবে না, অতঃপর যদি
তোমাদের ভয় হয় যে, তারাউভয়েই আল্লাহর নির্দেশ বজায় রাখতে পারবে না, তাহলে সেক্ষেত্রে স্ত্রী যদি বিনিময় দিয়ে অব্যাহতি নিয়ে নেয়, তবেউভয়ের মধ্যে কারোরই কোন পাপ নেই। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা। কাজেই একে অতিক্রম করো না। বস্তুতযারা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করবে, তারাই হলো জালিম।” (সূরা বাকারা-২২৯)
উল্লেখিত আয়াতে দেখা যাচ্ছে যে,
নিময় অনুযায়ী তালাক সম্পূর্ণ করতে হবে অর্থাৎ তিন ইদ্দত শেষ করে তালাক চূড়ান্ত করতে হবে (তাফসীরেজালালাইন শরীফে
উক্ত আয়াতের ব্যখ্যায় তিন হায়েজে তালাক সম্পূর্ণের কথা বলা আছে)
তালাকে রজঈ অর্থাৎ দুই তালাক তথা দুই ইদ্দত পালনের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসবে
স্ত্রীকে দেয়া সম্পদ (দেন মোহর) ফিরিয়ে নেয়া নাজায়েজ
কোন ক্ষেত্রে স্ত্রী যদি ধন-সম্পদের বিনিময়ে তালাক নেয়, সেটাও জায়েজ। স্ত্রী যদি ধন-সম্পদের বিনিময়ে স্বামীর নিকটথেকে তালাক নেয়, তবে তাকে খুলআ তালাক বলে।
এখন সূরা বাকারা ২৩১নং আয়াত লক্ষ্য করি। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন-
তালাক
অর্থাৎ “আর যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দিয়ে দাও, অতঃপর তারা নির্ধারিত ইদ্দত সমাপ্ত করে নেয়,
তখন তোমরানিয়ম অনুযায়ী তাদেরকে রেখে দাও, অথবা সহানুভূতির সাথে তাদেরকে মুক্ত করে দাও। আর তোমরা তাদেরকে জ্বালাতনও বাড়াবাড়ি করার উদ্দেশ্যে আটকে রেখো না। আর যারা এমন করবে,
নিশ্চয়ই তারা নিজেদেরই ক্ষতি করবে।” (সূরাবাকারা-২৩১)
প্রাক ইসলামী যুগে আরবে তালাকের প্রথাও ছিল। তবে সেই প্রথা ছিল সম্পূর্ণ পুরুষের দয়ার উপর। নারী চাইলেও
তালাকনিতে পারতো না। এমন কি সে সময়ে স্বামী স্বৈরাচারের মত স্ত্রীর সাথে তালাক নামক অস্ত্র নিয়ে নারীর বিড়ম্বনা বাড়িয়েদিত। যেমন যদি কোন স্বামী তার স্ত্রীকে বলতো আমি তোমাকে তালাক দিলাম, সে সময়েও আরবে
তালাক বলার সাথেসাথে তালাক কার্যকর হতো না। স্ত্রীকে তার মাসিকের পর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। এমন অবস্থায় কোন অবিবেচক স্বামীস্ত্রীর মাসিক চলাকালে তার তালাক প্রত্যাহার করে নিত। এবং ঐ স্ত্রীকে ভোগ করে আবার তালাক দিত। আর এইভাবেএকের পর এক নাটক করে যেত, যার কারণে ঐ নারী তার অত্যাচারী স্বামীর হাত থেকে কখনও মুক্তি পেতে পারতো না।তাই নারীর প্রতি এই অমানবিক জুলুমকে প্রতিহত করে নারীকে মুক্তি দিতে বাধ্য করতে উপরোক্ত আয়াতে কারীমা নাজিলহয়। উপরোক্ত আয়াত দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, নারীদের সম্মতিতে তাদেরকে তালাক দেয়া যাবে, তাদেরকে
আটকেরাখা যাবে না এবং জ্বালাতন করা যাবে না। উক্ত আয়াতের দ্বারা ইসলাম পুরুষকে সর্বমোট ৩ দফা তালাক দেয়াবাধ্যবাধকতার মধ্যে নিয়ে আসে,
যাতে কেউ আর নারীকে নিয়ে তালাক তালাক খেলা খেলতে না পারে।
আবার কোন নারীকে স্পর্শ করার পূর্বেই (বাসর রাতের পূর্বে) তালাক দেয়া হলে তার কোন ইদ্দতপালনের প্রয়োজন নেই। যেমন আল্লাহ এরশাদ করেন-
তালাক
অর্থাৎ ‘হে আমানুগণ! তোমরা যখন মুমিন নারীদেরকে বিবাহ কর, অতঃপর তাদেরকে স্পর্শ করার পূর্বে তালাক দিয়ে দাও,
তখন তাদের ইদ্দত পালনে বাধ্য করার অধিকার তোমাদের নেই। অতঃপর তোমারা তাদেরকে কিছু দেবে এবং উত্তম
পন্থায়বিদায় দেবে।” (সূরা আহযাব-৪৯)
যাহোক, সূরা বাকারার আয়াতেও তালাকের ব্যাপারে স্পষ্টতা ফুটে উঠেছে। তা সূরা তালাকের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেখানেকুরআন শরীফে তালাকের ব্যাপারে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, সেখানে হাদিস শরীফ অনুসন্ধান না করলেও চলে। কেননাহাদিস দিয়ে কুরআনের আয়াত বাতিল করা যায় না। বরং কুরআনের আয়াত দিয়ে হাদিস বাতিল করা যায়। তবে আরওঅধিক বোঝার স্বার্থে হাদিস শরীফ অনুসন্ধান করা যায়, যদি তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সহায়ক হয়।
এবার দেখি তালাক সম্পর্কে হাদিস শরীফ কি বলে।
১. হাদিস শরীফে উলেখ আছে, রাগের বশবর্তী হয়ে অর্থাৎ রাগের মাথায় তালাক দিলে তা তালাক বলে গণ্য হবে না।যেমন আবু দাউদ শরীফের কিতাবুত তালাক অধ্যায়ের ‘বাবু ফিত তালাক্বি আ’লা গাইজী’ অর্থাৎ ‘রাগান্বিত অবস্থায়
তালাকদেয়া’ অনুচ্ছেদে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হাদিস শরীফটি নিম্নরুপঃ
অর্থাৎ মুহাম্মাদ ইবনে উবায়দ ইবনে আবু সালিহ (র) হতে বর্ণিত, যিনি (সিরিয়ার) ইলিয়া নামক স্থানে বসবাস করতেন।তিনি বলেন, আমি সিরিয়া হতে আদী ইবনে আলী আল কিন্দীর সাথে বের হই। এরপর আমরা মক্কায় উপনীত হলে,আমাকে সাফিয়্যা বিনতে শায়বার নিকট তিনি প্রেরণ করেন।
যিনি আয়শা (রা) হতে এ হাদিসটি সংগ্রহ করেন। রাবী বলেন,আমি আয়শা (রাঃ) কে বলতে শুনেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেনঃ গিলাক অবস্থায়
কোন তালাক হয় না বা দাসমুক্ত করা যায় না। ইমাম আবু দাউদ (র) বলেন, গিলাক অর্থ রাগান্বিত অবস্থায় তালাক প্রদান করা। (আবু দাউদ শরীফ,৩য় খন্ড, ২১৯১ নং হাদিস)
২. এছাড়া নিদ্রিত ও উন্মাদ (নেশাগ্রস্থ বা রোগগ্রস্থ) অবস্থায় তালাক হয় না। (সুনানু নাসাই শরীফ-৩য় খন্ড,-৩৪৩৩ নংহাদিস এবং সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফ-২য় খন্ড-২০৪১, ২০৪২ নং হাদিস)
৩. তালাক হায়েজ তথা রজঃস্রাবের সাথে সম্পর্কিত। এ সম্পর্কে আবু দাউদ শরীফের কিতাবুত তালাক অধ্যায়ের ‘
সুন্নততরিকায় তালাক’ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, “আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)
এর যুগে তাঁরস্ত্রীকে হায়েজ (রজঃস্রাব) অবস্থায় তালাক প্রদান করেন। তখন উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) এ ব্যাপার রাসূলুল্লাহ (সাঃ)
কেজিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, তুমি তাকে তার স্ত্রীকে
ফিরিয়ে আনতে বল এবং হায়েজ হতে পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাকেনিজের কাছে রাখতে বল। এরপর সে
পুনরায় হায়েজ এবং পুনরায় হায়েজ হতে পবিত্র হলে সে তাকে চাইলে রাখতেও
পারেএবং যদি চায় তাকে তালাক দিতে পারে, এই তালাক অবশ্য তার সাথে সহবাসের পূর্বে পবিত্রাবস্থায়
দিতে হবে। আর এইদ্দত আল্লাহ তায়ালা নারীদের তালাক প্রদানের জন্য নির্ধারিত করেছেন।” (
আবু দাউদ শরীফ, ৩য় খন্ড, ২১৭৬ নং হাদিস)
৪. আবু দাউদ শরীফের কিতাবুত তালাক অধ্যায়ে ‘আলবাত্তাতা’ অর্থাৎ এক শব্দে তিন তালাক
প্রদান করা বিষয়ে উল্লেখিতআছে, “নাফি ইবনে উজায়র ইবনে আবদ ইয়াযীদ ইবনে রুকানা
(রা) হতে বর্ণিত। রুকানা ইবনে আবদ ইয়ায়ীদ তাঁর স্ত্রীসুহায়মাকে ‘আলবাত্তাতা’ (এক শব্দে তিন তালাক)
শব্দের দ্বারা তালাক প্রদান করে। তখন এতদসম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)অবহিত করা হয়। তখন তিনি বলেন,
আল্লাাহর শপথ! আমি এর দ্বারা এক তালাকের ইচ্ছা করি। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন,
আল্লাহর শপথ, তুমি কি এর দ্বারা এক তালাকের ইচ্ছা করেছ? তখন জবাবে রুকানা বলেন,আল্লাহর শপথ!
আমি এর দ্বারা এক তালাকের ইচ্ছা করি। এতদশ্রবণে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে স্বীয় স্ত্রী পুনরায় গ্রহণেরনির্দেশ
প্রদান করেন। অতঃপর তিনি উমার (রা) এর খিলাফতকালে তাকে দ্বিতীয় তালাক দেন এবং তৃতীয়
তালাক প্রদানকরেন উসমান (রাঃ) এর খিলাফত কালে।” (আবু দাউদ শরীফ, ৩য় খন্ড, ২২০৩ নং হাদিস)
একসাথে তিন তালাক উচ্চারণকে ইসলামী শরিয়ার পরিভাষায় তালাকে বিদা বলে। একসাথে
তিন তালাক উচ্চারণেতালাক হবে এ ধরণের কোন আইন নবীজি (সাঃ) এর সময়ে ছিল না।
আসলে শারিয়ার এ আইন বানানো হয়েছে নবীজীরঅনেক পরে। এ কথা বলেছেন কিছু বিশ্ববিখ্যাত শারিয়া-সমর্থকরাই।
যেমন, “নবীজীর ওফাতের বহু পরে তালাকের একনূতন নিয়ম দেখা যায়। স্বামী একসাথে তিন-তালাক উচ্চারণ
করে বা লিখিয়া দেয়। এই তালাকে অনুতাপ বা পুনর্বিবেচনারসুযোগ নাই। অজ্ঞ মুসলমানেরা এইভাবে গুনাহ্ করে।
নবীজী তীব্রভাবে ইহাতে বাধা দিয়াছেন”
“নবীজীর সময় থেকে শুরু করে হজরত আবু বকর ও হজরত ওমরের সময় পর্যন্ত একসাথে তিন-তালাক
উচ্চারণকেএক-তালাক ধরা হত। কিন্তু যেহেতু লোকে তাড়াতাড়ি ব্যাপারটার ফয়সালা চাইত তাই হজরত ওমর
একসাথে তিন-তালাককে বৈধ করেন এবং এই আইন চালু করেন” (সূত্রঃ আবু দাউদ শরীফ, ৩য় খন্ড, ২১৯৬নং হাদিস, মুসলিম শরীফ, ৫ম খন্ড, ৩৫৩৮ নং হাদিস)।
তালাক দেওয়া স্ত্রীকে পুনরায় বিয়ে
তালাকের নোটিশের পর পুনরায় বিয়ের ক্ষেত্রে দুই ধরনের অবস্থা হতে পারে। এক, তালাকের নোটিশ দেওয়া হয়েছে কিন্তু তালাক কার্যকর হয়নি। অথবা দুই, তালাক কার্যকর হয়েছে।
তালাকের নোটিশ দেওয়ার পর যে, ৯০ দিন সময় থাকে সেই সময়ের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী যদি চান যে তারা আবার সংসার জীবন (conjugal life) শুরু করবেন তাহলে কোন আইনী বাঁধা নেই।
শুধু একটা আনুষ্ঠানিকতা অনুসরণ করতে হবে। স্বামী একটি আবেদনপত্রে বিয়ে রেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে নিজের ভুল স্বীকার করে নিলে পুনরায় তালাক দেয়া স্ত্রীকে গ্রহণ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না। আগের মতো সংসার করতে পারবেন।
আর যদি তালাক কার্যকরের পর স্বামী-স্ত্রী আবার বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হতে চান তাহলে তারা নতুন করে বিয়ে করে নিলেই হবে। একটি নতুন সাধারণ বিয়ে যেভাবে হয় সেভাবে বিয়ে করে নিলেই হবে।
হিল্লা বিয়ে
অনেক মুসলিম সমাজেই হিল্লা বিয়ে নামক এক পদ্ধতির কথা বলা আছে। এ পদ্ধতি অনুযায়ী, তালাক প্রাপ্ত স্ত্রীকে যদি স্বামী আবার বিয়ে করতে চান তাহলে ঐ স্ত্রীকে স্বামী ব্যতীত অন্য আরেকজন ব্যক্তির সাথে আগে বিয়ে দিতে হবে। সেই বিয়ে কার্যকর করা হবে অর্থ্যাত স্বামী-স্ত্রী ‘কনজুগাল লাইফে’ প্রবেশ করবেন। তারপর পূর্বের ডিভোর্স দেওয়া স্বামীকে বিয়ে করতে পারবেন।
তবে ইসলাম ধর্ম মতেও, হিল্লা বিয়েকে সমর্থন করা হয় না। অনেক ইসলামিক মনীষী এর বিপক্ষে মত দিয়েছেন। মূলত, তালাক দেওয়া স্ত্রীকে পুনরায় বিয়ে করতে ঐ স্বামীর কোন আইনী বাঁধা নেই।
মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশের ৭ (৫) ধারায় বলা আছে, কোন আইনই স্ত্রীকে একই স্বামীকে, যার সাথে তালাক হয়েছে, বিয়ে করা থেকে বিরত করবে না। তবে তিনবার এমন কাজ করা যাবে। অর্থ্যাত সর্বোচ্চ তিনবার তালাক দেওয়া স্ত্রীকে একই স্বামী বিয়ে করতে পারবেন।
নিকাহ এমন একটি চুক্তি যার মাধ্যমে নারী পুরুষ মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপন বৈধ হয় ।
★বিবাহ সুন্নতে মুয়াক্কাদা,যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলে বিবাহ করা ওয়াজিব।
★জুলুমের আশঙ্কা থাকলে বিবাহ করা মাকরুহ ।
★বিবাহের রুকন হল ইজাব ও কবুল ।
বিবাহের শর্ত ঃ
১.জ্ঞান বান হওয়া ,বালিক ও আজাদ হওয়া ।
২.পাত্রী বিবাহ যোগ্য হওয়া ।
৩.পাত্র পাত্রী উভয় উভয়ের কথা শ্রবণ করা ।
৪.সাক্ষী থাকা এবং সাক্ষী মুসলমান হওয়া ।
বর কনে অমুসলিম হলে সাক্ষী মুসলমান হওয়া শর্ত নয় ।
বিবাহের সাক্ষী একাধিক হওয়া শর্ত।
★নসব বা রক্তের সম্পর্কের দরুন যে যে মহিলাকে বিবাহ করা হারামঃব্যক্তির মা,বোন,মেয়ে,খালা, ফুফু,ভাগ্নি ও ভাতুষ্পুত্রী ইত্যাদি।
★যদি স্ত্রীর কামোদ্দীপনার সাথে লজ্জাস্থান চুম্বন করে তাহলে পুরো হুরমাত মুসাহারা বলে গণ্য হবে।একইভাবে যদি স্ত্রী স্বামীর লজ্জাস্থানের চুম্বন করে হুরমাত মুসাহারা বলে গন্য হবে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,
হে মানব, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিতি হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক পরহেযগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন। [সূরা আল-হুজুরাতঃ ১৩]
মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গর হেফাযত করে। এতে তাদেরজন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন। [সূরা আন-নুরঃ৩০]
ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারাযেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদেরসৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে এবংতারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ, ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরেপদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাইআল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরাসফলকাম হও। [সূরা আন-নুরঃ ৩১]
আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। [সূরাবনী-ইসরাইলঃ ৩২]
নির্লজ্জতার কাছেও যেয়ো না, প্রকাশ্য হোক কিংবা অপ্রকাশ্য [সূরা আল আন’আমঃ ১৫১]
যারা চায় যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রচার ঘটুক তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না। [সূরাআন-নুরঃ ১৯]
মোহরের বিবরণ ঃ
★মহরের সর্বনিম্ন সীমা হচ্ছে স্ত্রীকে কিছু কোরআনের আয়াত শিক্ষা দেওওয়া
রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর মেয়ে ফাতেমা রাযি.-এর মহর ছিল পাঁচশত দেরহাম। যেমন, মুহাম্মদ ইবন ইবরাহিম রহ. বর্ণনা করেন,
كان صداق بنات رسول اللهﷺ ونساءه خمس مائة درهم ثِنْتَيْ عَشْرَةَ أُوقِيَّةً و نصف
রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর মেয়ে ও স্ত্রীগণের মহর ছিল পাঁচশত দেরহাম অর্থাৎ সাড়ে বার উকিয়া। ( তাবাকাতে ইবনে সাদ ৮/২২)
ইমাম নববী রহ. মাজমু’-গ্রন্থে বলেন,
والمستحب ألا يزيد على خمسمائة درهم، وهو صداق أزواج النبي ﷺ وبناته
মহর পাঁচশত দেরহামের বেশি না হওয়া মুস্তাহাব। এটা রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর স্ত্রীদের ও কন্যাদের মহর ছিল।
তবে মোহরের কোন নির্্দিষ্ট পরিমান নেই।
তালাকের বিবরনঃ
অর্থাৎ ‘হে নবী! (উম্মতকে বলুন) তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দিতে চাও, তখন তাদেরকে তালাক দিয়ো ইদ্দতের প্রতি
লক্ষ্য রেখে এবং ইদ্দত গণনা করো। তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাাহকে ভয় করো। তাদেরকে তাদের গৃহ থেকে
বহিষ্কার করো না এবং তারাও যেন বের না হয় যদি না তারা কোন সুস্পষ্ট নির্লজ্জ কাজে লিপ্ত হয়। এগুলো আল্লাহরনির্ধারিত সীমা।
যে ব্যক্তি আল্লাহর সীমালংঘন করে, সে নিজেরই অনিষ্ট করে। তুমি জান না, হয়তো আল্লাহ এর পর কোননতুন উপায়
করে দেবেন। (সূরা তালাক, আয়াত নং-১)
উল্লেখিত আয়াতে দেখা যাচ্ছে যে,
স্ত্রীকে তালাক দিলে ইদ্দতের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে (ইদ্দত হলো মহিলাদের রজঃস্রাব বা মাসিক চক্র)
ইদ্দত গননা করতে হবে (কয়টি ইদ্দত গণনা করতে হবে সে সম্পর্কে কিছুক্ষন পরে আয়াত পেশ করছি)
কোন সুস্পষ্ট নির্লজ্জ কাজে (যিনা/ব্যভিাচার) লিপ্ত না হলে স্ত্রীকে ঘর থেকে বের করো না অর্থাৎ তালাক দেয়া যাবে না
এ তিনটি বিষয় হলো আল্লাহ কর্তৃক তালাকের নির্ধারিত সীমা, যা লংঘন করলে নিজের অর্থাৎ তালাক প্রদানকারীরঅনিষ্ট হবে
উল্লেখিত তিনটি সীমা তালাকের জন্য নির্দিষ্ট। এর হেরফের হলে তালাক হবে না।
আল্লাহ কোন নতুন উপায় করে দেবেন’ এর ব্যাখ্যায় তাফসীরে মারেফুল কুরআনে বলা হয়েছে ‘
স্বামীর অন্তরেতালাকের ব্যাপারে অনুতপ্ত সৃষ্টি হবে’। ফলে হয়তো তারা আবার সংসার করতে পারবে।
এবার সূরাতালাকের ২নং আয়াতের দিকে লক্ষ্য করি। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন,
তালাক
অর্থাৎ ‘অতঃপর তারা যখন তাদের ইদ্দতকালে পৌঁছে, তখন তাদেরকে যথোপযুক্ত পন্থায় রেখে দেবে অথবা যথোপযুক্তপন্থায় ছেড়ে দেবে
এবং তোমাদের মধ্য থেকে দু’জন নির্ভরযোগ্য লোককে সাক্ষী রাখবে।’ (সূরা তালাক-২)
উল্লেখিত আয়াতে দেখা যাচ্ছে যে,
ইদ্দতকালে পৌছলে স্ত্রীকে রাখাও যাবে অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর মিল হলে রাখা যাবে অথবা মনের অমিল হলে তালাক দিবে
তালাকের ক্ষেত্রে দুই জন সাক্ষী রাখতে হবে। অর্থাৎ একা একা তালাক তালাক উচ্চারণ করলে তালাক হবে না। আবারপুনরায় সংসার করতে হলেও দুই জন সাক্ষী রাখতে হবে। যদি কেউ বলে তালাকের জন্য কোন স্বাক্ষীর দরকার নেই,পুরুষ তালাক উচ্চারণ করলেই তালাক হবে। তবে তা সম্পূর্ণ কুরআন বিরোধী অর্থাৎ কুফুরী আকিদা।
এবার সূরা তালাকের ৪নং আয়াতের দিকে লক্ষ্য করি। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন,
তালাক
অর্থাৎ ‘তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যাদের ঋতুবর্তী হওয়ার আশা নেই, তাদের ব্যাপারে সন্দেহ হলে তাদের ইদ্দত হবে তিনমাস। আর যারা এখনও ঋতুর বয়সে পৌঁছেনি, তাদেরও অনুরূপ ইদ্দতকাল হবে। গর্ভবতী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসবপর্যন্ত। যে আল্লাকে ভয় করে, আল্লাহ তার কাজ সহজ করে দেন।’ (সূরা তালাক-৪)
উল্লেখিত আয়াতে দেখা যাচ্ছে যে,
বালেগা নারীদের ক্ষেত্রে ইদ্দত কাল হবে তিন মাসিক বা তিন রজস্রাব
নাবালেগা নারীদের ক্ষেত্রে ইদ্দত কাল হবে তিন মাস
গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে ইদ্দতকাল হবে সন্তান প্রসব পর্যন্ত।
উপরোক্ত সূরা তালাকের তিনটি আয়াত বিশ্লেষণ করলে আমরা পাই যে, স্পষ্ট নির্লজ্জ কাজ পরিলক্ষিত না হলে স্ত্রীকেতালাক
দেয়া যাবে না। আর তালাক দিলে সেক্ষেত্রে তিনটি ইদ্দত তথা মাসিক অপেক্ষা করতে হবে। প্রথম মাসে তালাকদিবে, যদি এর মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মিল হয়ে যায় তবে তারা পুনরায় সংসার করবে। আর যদি মিল না হয় তবে দ্বিতীয় মাসেতালাক দিবে এবং অপেক্ষা করবে। যদি এবার মিল হয়ে যায় তবে সংসার করবে অথবা তৃতীয় মাসে পুনরায় তালাক দিবে।তৃতীয় মাস পূর্ণ হলে তারা যদি মনে করে সংসার করবে অথবা বিচ্ছিন্ন হবে তাহলে দুজন স্বাক্ষী রেখে চূড়ান্ত ফয়সালাকরবে। অর্থাৎ সংসার করলেও দুজন স্বাক্ষী রাখবে এবং বিচ্ছেদ ঘটালেও স্বাক্ষী রাখবে। তিন ইদ্দতকাল সময় অপেক্ষাকরার মধ্যে হেকমত লুকিয়ে আছে। কেননা নারী যদি গর্ভবতী হয়ে যায় তবে এ তিন মাসের মধ্যেই বোঝা যাবে। আরগর্ভবর্তী নারীদের ক্ষেত্রে ইদ্দতকাল হবে সন্তান প্রসব পর্যন্ত। অর্থাৎ তিন মাস অতিবাহিত হওয়ার পর যদি সন্তান প্রসব নাহয়, তবে সন্তান প্রসব পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সুবহানআল্লাহ! আল্লাহর কি অপার করুনা। সন্তান প্রসবের পরে যদিসন্তানের মুখের দিকে চেয়ে স্বামী-স্ত্রীর মিল হয়ে যায় তাই গর্ভবতীদের জন্য আল্লাহ প্রসব পর্যন্ত ইদ্দতকাল নির্দিষ্ট করেদিয়েছেন।
এখন সূরা বাকারা ২২৮নং আয়াত লক্ষ্য করি। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন-
তালাক
অর্থাৎ ‘আর তালাকপ্রাপ্তা নারী নিজেকে অপেক্ষায় রাখবে তিন হায়েয পর্যন্ত। আর যদি সে আল্লাহ প্রতি এবং আখেরাতদিবসের ওপর ঈমানদার হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহ যা তার জরায়ুতে
সৃষ্টি করেছেন তা লুকিয়ে রাখা জায়েয নয়। আর যদিসদ্ভাব রেখে চলতে চায়, তাহলে তাদেরকে ফিরিয়ে নেবার অধিকার তাদের স্বামীরা সংরক্ষণ করে। আর পুরুষদের যেমনস্ত্রীদের ওপর অধিকার রয়েছে, তেমনিভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে পুরুষদের ওপর নিয়ম অনুযায়ী। আর নারীদের ওপরপুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। আর আল্লাহ হচ্ছে পরাক্রমশালী,বিজ্ঞ। ।(সূরা বাকারা-২২৮)
উল্লেখিত আয়াতে দেখা যাচ্ছে যে,
এ আয়াতে তালাকের জন্য নারী তিন হায়েজ বা রজঃস্রাব পর্যন্ত অপেক্ষা করবে তা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
তালাকপ্রাপ্তা নারী তিন মাস অপেক্ষা করে অর্থাৎ চূড়ান্ত তালাকের পরে অন্য কোথাও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে
তাৎক্ষনিক তালাক ও তাৎক্ষনিক বিবাহ সম্পুর্ণ কুরআন বিরোধী
তিন মাসের মধ্যে জরায়ুতে যা সৃষ্টি হয়েছে তথা গর্ভবতী হলে তা প্রকাশ পাবে
তিন মাসের মধ্যে যদি সদ্ভাব রেখে চলতে চায় তবে পুনরায় সংসার করতে পারে
তালাকের ব্যাপারে পুরুষদের যেমন অধিকার আছে নারীদের ক্ষেত্রেও অধিকার আছে
খন সূরা বাকারা ২২৯নং আয়াত লক্ষ্য করি। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন-
তালাক
অর্থাৎ “তালাকে- ‘রজঈ’ হলে দুবার পর্যন্ত- তারপর হয় নিয়মানুযায়ী রাখবে, না হয় সহৃদয়তার সঙ্গে বর্জন করবে।
আরনিজের দেয়া সম্পদ থেকে কিছু ফিরিয়ে নেয়া তোমাদের জন্য জায়েয নয় তাদের কাছ থেকে। কিন্তু যে ক্ষেত্রে স্বামী ও স্ত্রীউভয়েই এ ব্যাপারে ভয় করে যে, তারা আল্লাহর নির্দেশ বজায় রাখতে পারবে না, অতঃপর যদি
তোমাদের ভয় হয় যে, তারাউভয়েই আল্লাহর নির্দেশ বজায় রাখতে পারবে না, তাহলে সেক্ষেত্রে স্ত্রী যদি বিনিময় দিয়ে অব্যাহতি নিয়ে নেয়, তবেউভয়ের মধ্যে কারোরই কোন পাপ নেই। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা। কাজেই একে অতিক্রম করো না। বস্তুতযারা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করবে, তারাই হলো জালিম।” (সূরা বাকারা-২২৯)
উল্লেখিত আয়াতে দেখা যাচ্ছে যে,
নিময় অনুযায়ী তালাক সম্পূর্ণ করতে হবে অর্থাৎ তিন ইদ্দত শেষ করে তালাক চূড়ান্ত করতে হবে (তাফসীরেজালালাইন শরীফে
উক্ত আয়াতের ব্যখ্যায় তিন হায়েজে তালাক সম্পূর্ণের কথা বলা আছে)
তালাকে রজঈ অর্থাৎ দুই তালাক তথা দুই ইদ্দত পালনের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসবে
স্ত্রীকে দেয়া সম্পদ (দেন মোহর) ফিরিয়ে নেয়া নাজায়েজ
কোন ক্ষেত্রে স্ত্রী যদি ধন-সম্পদের বিনিময়ে তালাক নেয়, সেটাও জায়েজ। স্ত্রী যদি ধন-সম্পদের বিনিময়ে স্বামীর নিকটথেকে তালাক নেয়, তবে তাকে খুলআ তালাক বলে।
এখন সূরা বাকারা ২৩১নং আয়াত লক্ষ্য করি। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন-
তালাক
অর্থাৎ “আর যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দিয়ে দাও, অতঃপর তারা নির্ধারিত ইদ্দত সমাপ্ত করে নেয়,
তখন তোমরানিয়ম অনুযায়ী তাদেরকে রেখে দাও, অথবা সহানুভূতির সাথে তাদেরকে মুক্ত করে দাও। আর তোমরা তাদেরকে জ্বালাতনও বাড়াবাড়ি করার উদ্দেশ্যে আটকে রেখো না। আর যারা এমন করবে,
নিশ্চয়ই তারা নিজেদেরই ক্ষতি করবে।” (সূরাবাকারা-২৩১)
প্রাক ইসলামী যুগে আরবে তালাকের প্রথাও ছিল। তবে সেই প্রথা ছিল সম্পূর্ণ পুরুষের দয়ার উপর। নারী চাইলেও
তালাকনিতে পারতো না। এমন কি সে সময়ে স্বামী স্বৈরাচারের মত স্ত্রীর সাথে তালাক নামক অস্ত্র নিয়ে নারীর বিড়ম্বনা বাড়িয়েদিত। যেমন যদি কোন স্বামী তার স্ত্রীকে বলতো আমি তোমাকে তালাক দিলাম, সে সময়েও আরবে
তালাক বলার সাথেসাথে তালাক কার্যকর হতো না। স্ত্রীকে তার মাসিকের পর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। এমন অবস্থায় কোন অবিবেচক স্বামীস্ত্রীর মাসিক চলাকালে তার তালাক প্রত্যাহার করে নিত। এবং ঐ স্ত্রীকে ভোগ করে আবার তালাক দিত। আর এইভাবেএকের পর এক নাটক করে যেত, যার কারণে ঐ নারী তার অত্যাচারী স্বামীর হাত থেকে কখনও মুক্তি পেতে পারতো না।তাই নারীর প্রতি এই অমানবিক জুলুমকে প্রতিহত করে নারীকে মুক্তি দিতে বাধ্য করতে উপরোক্ত আয়াতে কারীমা নাজিলহয়। উপরোক্ত আয়াত দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, নারীদের সম্মতিতে তাদেরকে তালাক দেয়া যাবে, তাদেরকে
আটকেরাখা যাবে না এবং জ্বালাতন করা যাবে না। উক্ত আয়াতের দ্বারা ইসলাম পুরুষকে সর্বমোট ৩ দফা তালাক দেয়াবাধ্যবাধকতার মধ্যে নিয়ে আসে,
যাতে কেউ আর নারীকে নিয়ে তালাক তালাক খেলা খেলতে না পারে।
আবার কোন নারীকে স্পর্শ করার পূর্বেই (বাসর রাতের পূর্বে) তালাক দেয়া হলে তার কোন ইদ্দতপালনের প্রয়োজন নেই। যেমন আল্লাহ এরশাদ করেন-
তালাক
অর্থাৎ ‘হে আমানুগণ! তোমরা যখন মুমিন নারীদেরকে বিবাহ কর, অতঃপর তাদেরকে স্পর্শ করার পূর্বে তালাক দিয়ে দাও,
তখন তাদের ইদ্দত পালনে বাধ্য করার অধিকার তোমাদের নেই। অতঃপর তোমারা তাদেরকে কিছু দেবে এবং উত্তম
পন্থায়বিদায় দেবে।” (সূরা আহযাব-৪৯)
যাহোক, সূরা বাকারার আয়াতেও তালাকের ব্যাপারে স্পষ্টতা ফুটে উঠেছে। তা সূরা তালাকের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেখানেকুরআন শরীফে তালাকের ব্যাপারে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, সেখানে হাদিস শরীফ অনুসন্ধান না করলেও চলে। কেননাহাদিস দিয়ে কুরআনের আয়াত বাতিল করা যায় না। বরং কুরআনের আয়াত দিয়ে হাদিস বাতিল করা যায়। তবে আরওঅধিক বোঝার স্বার্থে হাদিস শরীফ অনুসন্ধান করা যায়, যদি তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সহায়ক হয়।
এবার দেখি তালাক সম্পর্কে হাদিস শরীফ কি বলে।
১. হাদিস শরীফে উলেখ আছে, রাগের বশবর্তী হয়ে অর্থাৎ রাগের মাথায় তালাক দিলে তা তালাক বলে গণ্য হবে না।যেমন আবু দাউদ শরীফের কিতাবুত তালাক অধ্যায়ের ‘বাবু ফিত তালাক্বি আ’লা গাইজী’ অর্থাৎ ‘রাগান্বিত অবস্থায়
তালাকদেয়া’ অনুচ্ছেদে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হাদিস শরীফটি নিম্নরুপঃ
অর্থাৎ মুহাম্মাদ ইবনে উবায়দ ইবনে আবু সালিহ (র) হতে বর্ণিত, যিনি (সিরিয়ার) ইলিয়া নামক স্থানে বসবাস করতেন।তিনি বলেন, আমি সিরিয়া হতে আদী ইবনে আলী আল কিন্দীর সাথে বের হই। এরপর আমরা মক্কায় উপনীত হলে,আমাকে সাফিয়্যা বিনতে শায়বার নিকট তিনি প্রেরণ করেন।
যিনি আয়শা (রা) হতে এ হাদিসটি সংগ্রহ করেন। রাবী বলেন,আমি আয়শা (রাঃ) কে বলতে শুনেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেনঃ গিলাক অবস্থায়
কোন তালাক হয় না বা দাসমুক্ত করা যায় না। ইমাম আবু দাউদ (র) বলেন, গিলাক অর্থ রাগান্বিত অবস্থায় তালাক প্রদান করা। (আবু দাউদ শরীফ,৩য় খন্ড, ২১৯১ নং হাদিস)
২. এছাড়া নিদ্রিত ও উন্মাদ (নেশাগ্রস্থ বা রোগগ্রস্থ) অবস্থায় তালাক হয় না। (সুনানু নাসাই শরীফ-৩য় খন্ড,-৩৪৩৩ নংহাদিস এবং সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফ-২য় খন্ড-২০৪১, ২০৪২ নং হাদিস)
৩. তালাক হায়েজ তথা রজঃস্রাবের সাথে সম্পর্কিত। এ সম্পর্কে আবু দাউদ শরীফের কিতাবুত তালাক অধ্যায়ের ‘
সুন্নততরিকায় তালাক’ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, “আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)
এর যুগে তাঁরস্ত্রীকে হায়েজ (রজঃস্রাব) অবস্থায় তালাক প্রদান করেন। তখন উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) এ ব্যাপার রাসূলুল্লাহ (সাঃ)
কেজিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, তুমি তাকে তার স্ত্রীকে
ফিরিয়ে আনতে বল এবং হায়েজ হতে পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাকেনিজের কাছে রাখতে বল। এরপর সে
পুনরায় হায়েজ এবং পুনরায় হায়েজ হতে পবিত্র হলে সে তাকে চাইলে রাখতেও
পারেএবং যদি চায় তাকে তালাক দিতে পারে, এই তালাক অবশ্য তার সাথে সহবাসের পূর্বে পবিত্রাবস্থায়
দিতে হবে। আর এইদ্দত আল্লাহ তায়ালা নারীদের তালাক প্রদানের জন্য নির্ধারিত করেছেন।” (
আবু দাউদ শরীফ, ৩য় খন্ড, ২১৭৬ নং হাদিস)
৪. আবু দাউদ শরীফের কিতাবুত তালাক অধ্যায়ে ‘আলবাত্তাতা’ অর্থাৎ এক শব্দে তিন তালাক
প্রদান করা বিষয়ে উল্লেখিতআছে, “নাফি ইবনে উজায়র ইবনে আবদ ইয়াযীদ ইবনে রুকানা
(রা) হতে বর্ণিত। রুকানা ইবনে আবদ ইয়ায়ীদ তাঁর স্ত্রীসুহায়মাকে ‘আলবাত্তাতা’ (এক শব্দে তিন তালাক)
শব্দের দ্বারা তালাক প্রদান করে। তখন এতদসম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)অবহিত করা হয়। তখন তিনি বলেন,
আল্লাাহর শপথ! আমি এর দ্বারা এক তালাকের ইচ্ছা করি। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন,
আল্লাহর শপথ, তুমি কি এর দ্বারা এক তালাকের ইচ্ছা করেছ? তখন জবাবে রুকানা বলেন,আল্লাহর শপথ!
আমি এর দ্বারা এক তালাকের ইচ্ছা করি। এতদশ্রবণে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে স্বীয় স্ত্রী পুনরায় গ্রহণেরনির্দেশ
প্রদান করেন। অতঃপর তিনি উমার (রা) এর খিলাফতকালে তাকে দ্বিতীয় তালাক দেন এবং তৃতীয়
তালাক প্রদানকরেন উসমান (রাঃ) এর খিলাফত কালে।” (আবু দাউদ শরীফ, ৩য় খন্ড, ২২০৩ নং হাদিস)
একসাথে তিন তালাক উচ্চারণকে ইসলামী শরিয়ার পরিভাষায় তালাকে বিদা বলে। একসাথে
তিন তালাক উচ্চারণেতালাক হবে এ ধরণের কোন আইন নবীজি (সাঃ) এর সময়ে ছিল না।
আসলে শারিয়ার এ আইন বানানো হয়েছে নবীজীরঅনেক পরে। এ কথা বলেছেন কিছু বিশ্ববিখ্যাত শারিয়া-সমর্থকরাই।
যেমন, “নবীজীর ওফাতের বহু পরে তালাকের একনূতন নিয়ম দেখা যায়। স্বামী একসাথে তিন-তালাক উচ্চারণ
করে বা লিখিয়া দেয়। এই তালাকে অনুতাপ বা পুনর্বিবেচনারসুযোগ নাই। অজ্ঞ মুসলমানেরা এইভাবে গুনাহ্ করে।
নবীজী তীব্রভাবে ইহাতে বাধা দিয়াছেন”
“নবীজীর সময় থেকে শুরু করে হজরত আবু বকর ও হজরত ওমরের সময় পর্যন্ত একসাথে তিন-তালাক
উচ্চারণকেএক-তালাক ধরা হত। কিন্তু যেহেতু লোকে তাড়াতাড়ি ব্যাপারটার ফয়সালা চাইত তাই হজরত ওমর
একসাথে তিন-তালাককে বৈধ করেন এবং এই আইন চালু করেন” (সূত্রঃ আবু দাউদ শরীফ, ৩য় খন্ড, ২১৯৬নং হাদিস, মুসলিম শরীফ, ৫ম খন্ড, ৩৫৩৮ নং হাদিস)।
তালাক দেওয়া স্ত্রীকে পুনরায় বিয়ে
তালাকের নোটিশের পর পুনরায় বিয়ের ক্ষেত্রে দুই ধরনের অবস্থা হতে পারে। এক, তালাকের নোটিশ দেওয়া হয়েছে কিন্তু তালাক কার্যকর হয়নি। অথবা দুই, তালাক কার্যকর হয়েছে।
তালাকের নোটিশ দেওয়ার পর যে, ৯০ দিন সময় থাকে সেই সময়ের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী যদি চান যে তারা আবার সংসার জীবন (conjugal life) শুরু করবেন তাহলে কোন আইনী বাঁধা নেই।
শুধু একটা আনুষ্ঠানিকতা অনুসরণ করতে হবে। স্বামী একটি আবেদনপত্রে বিয়ে রেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে নিজের ভুল স্বীকার করে নিলে পুনরায় তালাক দেয়া স্ত্রীকে গ্রহণ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না। আগের মতো সংসার করতে পারবেন।
আর যদি তালাক কার্যকরের পর স্বামী-স্ত্রী আবার বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হতে চান তাহলে তারা নতুন করে বিয়ে করে নিলেই হবে। একটি নতুন সাধারণ বিয়ে যেভাবে হয় সেভাবে বিয়ে করে নিলেই হবে।
হিল্লা বিয়ে
অনেক মুসলিম সমাজেই হিল্লা বিয়ে নামক এক পদ্ধতির কথা বলা আছে। এ পদ্ধতি অনুযায়ী, তালাক প্রাপ্ত স্ত্রীকে যদি স্বামী আবার বিয়ে করতে চান তাহলে ঐ স্ত্রীকে স্বামী ব্যতীত অন্য আরেকজন ব্যক্তির সাথে আগে বিয়ে দিতে হবে। সেই বিয়ে কার্যকর করা হবে অর্থ্যাত স্বামী-স্ত্রী ‘কনজুগাল লাইফে’ প্রবেশ করবেন। তারপর পূর্বের ডিভোর্স দেওয়া স্বামীকে বিয়ে করতে পারবেন।
তবে ইসলাম ধর্ম মতেও, হিল্লা বিয়েকে সমর্থন করা হয় না। অনেক ইসলামিক মনীষী এর বিপক্ষে মত দিয়েছেন। মূলত, তালাক দেওয়া স্ত্রীকে পুনরায় বিয়ে করতে ঐ স্বামীর কোন আইনী বাঁধা নেই।
মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশের ৭ (৫) ধারায় বলা আছে, কোন আইনই স্ত্রীকে একই স্বামীকে, যার সাথে তালাক হয়েছে, বিয়ে করা থেকে বিরত করবে না। তবে তিনবার এমন কাজ করা যাবে। অর্থ্যাত সর্বোচ্চ তিনবার তালাক দেওয়া স্ত্রীকে একই স্বামী বিয়ে করতে পারবেন।
Wednesday, 1 May 2019
কিছু মাছলা ওয়া মাছায়েল ।
(তাহারাতঃ)
★ওযুর বিধান ঃআল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন :
হে মুমিনগণ! যখন তোমরা সালাতের জন্য প্রস্তুত হবে,তখন তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল ও দু'হাতের কনুই পর্যন্ত ধৌত করবে এবং তোমাদের মাথা মাসেহ করবে আর দু পায়ের গ্রন্থি পর্যন্ত ধৌত করে।(৫:৬)
এ আয়াত দ্বারা বুঝা যায় অজুর ফরজ চারটি ।
আর ওযুর সুন্নত 13 টি ।
★ওযু ভঙ্গের কারণ সাতটি মতান্তরে নয়টি
গোসলের সম্বন্ধে বিবরণঃ
★গোসলের ফরজ তিনটি :-১.কুলি করা ২.নাকে পানি দেওয়া ৩.সমস্ত শরীর ধৌত করা ।
★গোসল মোট নয় প্রকার ঃ তিন প্রকার গোসল ফরজ ।যেমন জানাবাতের গোসল,হায়েজ ও নেফাসের গোসল ।
এক প্রকার গোসল ওয়াযিব যেমন মৃত ব্যক্তির গোসল ।আর বাকি চার প্রকার গোসল সুন্নত। যেমন জুমার দিনের গোসল,দুই ঈদের দিনের গোসল ,আরাফাতের দিনের গোসল,ইহরাম বাধার গোসল ।
★পানির প্রকারভেদ:-পানি মোট তিন প্রকার ।১.প্রবাহিত পানি ২.স্থির পানি ৩.কূপের পানি ।এই তিন ধরনের পানি দিয়ে পবিত্রতা অর্জন করা যায় ।
(নামাজের অধ্যায়)
নামাযের মাছলা মাছায়েল ঃ
নামাযের শর্তসমূহ
★নামাজ আরম্ভ করিবার পূর্বে যে সমস্ত কাজ অবশ্য কর্তব্য, তাহাকে নামাযের শর্ত বলে । ইহা আটটি; যথা :-
১) শরীর পাক-পবিত্র করিয়া লওয়া, অর্থাৎ অযু কিংবা গোসলের প্রয়োজন হইলে তাহা আদায় করিয়া লইতে হইবে ।
২) পোষাক পাক হওয়া । যদি কাপড়ে কোন নাপাক বস্তু নাগিয়া থাকে তাহা ধুইয়া পাক করিয়া লইবে অথবা উহা পরিবর্তন করিয়া পাক-পবিত্র কাপড় পরিধান করিয়া লইতে হইবে ।
৩) স্থান পাক হওয়া -অর্থাৎ যে স্থানে দাঁড়াইয়া নামায পড়িবে, তাহা পাবিত্র হওয়া ।
৪) ছতর ঢাকিয়া লওয়া – অর্থাৎ নামায পড়িবার সময়ে পুরুষের নাভী হইতে ও স্ত্রীলোক হইলে মুখ, হাতের কব্জা ও পায়ের তলা ব্যতীত সমুদয় শরীর ঢাকিয়া লওয়া কিন্তু বাদী হইলে পেট, পিঠ, পার্শ্ব ও নাভী হইতে জানুর নীচ পযন্ত কাপড় দ্বারা ঢাকিয়া লওয়া ফরয ।
৫) কাবা শরীফের দিক মুখ করিয়া দাঁড়ান ।
৬) নির্দিষ্ট ওয়াক্তে নামাজ আদায় করা । ৭)নিয়ত করা-যে ওয়াক্তের নামায পড়িবে, তাহার নিয়ত করা ।
৮) তাকবীরে তাহরীমা বলা । অর্থৎ নামাজের নিয়ত করিয়া “আল্লাহু আকবার” বলিয়া নামায আরম্ভ করা ।
নামাযের রোকনসমূহ
★নামায আরম্ভ করিবার পর হতে যে সকল কাজ করা ফরয, তাহাকে নামাযের রোকন বলে । ইহা মাত্র ছয়টি; যথা :-
১) দাঁড়াইয়া নামায আদায় করা ।
২) নামাযের মধ্যে কোরান পাকের কিছু আয়াত পাঠ করা ।
৩) রুকু করা ।
৪) সিজদা করা ।
৫) শেষবারে তাশাহুদ পাঠ করা ।
৬) ইচ্ছা পর্বক কোন কাজ করিয়া নামায ভঙ্গ করিয়া লওয়া ।
★পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সে সময় মুস্তাহাব ঃ
১.ফজরের সালাত বিলম্বে আদায় করা মুস্তাহাব ।তবে এত বেশি দেরি করা যাবে না, যেন সূর্যদয়ে আশঙ্কা থাকে।
২.গরমে যোহরের সালাত বিলম্বে পড়া ও শীতকালে যোহরের সালাত বিলম্ব না করে আদায় করা মুস্তাহাব ।
৩.সব সময় আসরের সালাত বিলম্বে পড়া মুস্তাহাব,যতক্ষণ না সূর্যের রং বিবর্ণ হয় ।
৪.মাগরিবের সালাত বিলম্ব না করে আদায় করা মুস্তাহাব ।
৫.এশার সালাত রাত্রে তিন ভাগের এক ভাগ পর্যন্ত বিলম্ব করে আদায় করা মুস্তাহাব ।শেষ রাত্রে যার সজাগ হওয়ার রাস্তা আছে ,তার জন্য বিতর সালাত শেষ রাতে আদায় করা মুস্তাহাব ।
নিষিদ্ধ ওয়াক্তের বিবরণ ঃ
★তিন সময় ফরজ সালাত ,জানাযার সালাত ও তিলাওয়াতের সিজদা আদায় করা নিষিদ্ধ ।
১.সূর্য উদয়ের সময় ২.সূর্য দ্বিপ্রহরের সময় ৩.সূর্য অস্ত যাওয়ার সময়।
★পেশাব-পায়খানা বেগ ছ্যাপে রেখে সালাত আদায় করলে সালাত মাখরুহ হবে।
★সাহু সিজদাহ দেওয়া ওয়াজিব। সালাত আদায় কালে কোন আংশে কম বা বেশি হলে সাহু সিজদাহ দিতে হবে ।
★কোরাআনে ১৪ টি তিলাওয়াতের সিজদা আছে।এ ১৪ টি আয়াত পাঠ করলে বা শ্রবণ করলে তিলাওয়াতে সিজদা দেওয়া ওয়াজিব।
★বিতের সালাত আদায় করা ওয়াজিব। বিতের সালাতের মাঝখানে সালাম ফিরাবে না।এবং ৩য় রাকাতে দোয়ায়ে কূূূনুত পাঠ করা ওয়াজিব।
★জানাযার নামায আদায় করা ফরযে কিফায়ত।কিছু লোক বা একজন আদায় করলে ঐ সমাজের সকলের আদায় করা হয়ে যাবে।আর কেউ আদায় না করলে ঐ সমাজের প্রত্যেকে গুনাগার হব।
★ মৃত ব্যক্তিকে গোলস দেয়া জিবীত মানুষের উপর ওয়াজিব।
★জুমার সালাত আদায় করা ফরযে আইন। তবে মহিলা, গোলাম ও অসুস্থ লোকেদের জন্য ফরজ নয়।
★ঈদের সালাত আদায় করা ওয়াজিব।
★জুমার দিন ইমামের নিকটে বসা উওম।
★জুমার খুতবা শুনা ওয়াজিব।
(যাকাত)
★ধনবান সম্পশালী মুসলমানদের বৎসর শেষে সম্পদের একটি নির্ধারিত অংশ আল্লাহর নির্দেশিত খাতে ব্যয় করার নামই যাকাত।
★যাকাত অর্থ বিশুদ্ধ হওয়া।যাকাত আদায় করা ফরজ।
★যাকাত দেয়ার শর্ত ঃ
১.মুুসলিম হওয়া।
২.আজদ হওয়া।
৩.সম্পদের মালিক হওয়া।
৪.বালিগ হওয়া।
৫.মাল দেনা মুক্ত হওয়া।
৬.নিসাবের মাল এক বছর অতিক্রম করা।
★যাকাত কার ওপর ফরয ?
ইসলামী শরীয়তে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা যে কোন একটির সমমূল্যের সম্পদ একবছর কারো নিকট আবর্তিত হলে শতকরা ২.৫০% সম্পদের মূল্যমান আল্লাহ তা’আলার নির্দেশিত আট প্রকার খাতে ব্যয় করাকেই যাকাত।
★যাকাতের অর্থ ব্যয়ের খাতসমূহ :
আল্লাহ তা’আলা কুরআনে যাকাতের অর্থ ব্যয়ে আটটি খাত উল্লেখ করেছেন। ১.ফকির, ২.মিসকিন, ৩.যাকাত আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারী, ৪.যাদের চিত্ত অকর্ষণ প্রয়োজন, ৫.দাসত্ব থেকে মুক্তি জন্য, ৬.ঋণগ্রস্থদের ঋণ থেকে মুক্তির জন্য, ৭.আল্লাহর পথে যারা জিহাদ করে তাদের
জন্য, ৮.মুসাফিরদের জন্য।
জাকাত ফরয করা হয় ২য় হিজরীতে। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে কারিমের বহু জায়গায় ইরশাদ করেছেন,
(وأقيموا الصلاة وآتوا الزكاة واركعوا مع الراكعين )البقرة: ৪৩)
‘আর তোমরা নামায কায়েম কর, জাকাত আদায় করো এবং রুকু কর রুকুকারীদের সঙ্গে।’ (সূরা বাকারা : ৪৩)
(والذين في أموالهم حق معلوم للسائل والمحروم) المعارج ২৪/২৫)
‘আর যাদের ধন সম্পদে রয়েছে ভিক্ষুক এবং বঞ্চিতদের জন্য নির্দিষ্ট অধিকার।’ আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
من آتاه الله مالاً فلم يؤد زكاته مثل له يوم القيامة شجاعاً أقرع له زبيبتان يُطوقه يوم القيامة ثم يأخذ بلهزمتيه – يعني شدقيه – يقول أنا مالُك أنا كنزك ” الشجاع : ذكر الحيات، والأقرع : الذي تمعط فروة رأسه لكثرة سُمه
‘আল্লাহ তা‘আলা যাকে সম্পদ দিয়েছেন অথচ সে তার জাকাত আদায় করে না, কিয়ামত দিবসে তার সম্পদকে দুই চোখ বিশিষ্ট বিষাক্ত সাপে পরিণত করা হবে। তারপর সাপটিকে কিয়ামতের সে দিবসে তার গলায় জড়িয়ে দেয়া হবে। সাপ তার দুই মুখে দংশন করতে করতে বলতে থাকবে, আমি তোমার বিত্ত, আমি তোমার গচ্ছিত সম্পদ।’
(সিয়াম বা রোজার অধ্যায়ঃ)
★ফারসি শব্দ রোজার আরবি অর্থ হচ্ছে সওম, বহুবচনে সিয়াম। সওম বা সিয়ামের বাংলা অর্থ বিরত থাকা। ইসলামী শরীয়তে সওম হল আল্লাহর নির্দেশ পালনের উদ্দেশে নিয়তসহ সুবহে সাদিকের শুরু থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা। ২য় হিজরীর শাবান মাসে মদীনায় রোজা ফরজ সংক্রান্ত আয়াত নাজিল হয় ।
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হলো যেভাবে তা ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা সংযমী হও”।
(সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৩)।
সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা আরও বলেছেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সেই মাসকে পায় সে যেন রোজা রাখে”।
পবিত্র রমজানের ফজিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে হাদিসের কিতাবগুলোতে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এর ভেতর থেকে কিছু হাদিস এখানে উল্লেখ করা হলো-
প্রিয় নবীজি (সা.) এর প্রিয় সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেছেন, রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, যখন রমজান মাস আসে আসমানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, আর শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। (বুখারী, মুসলিম)
অপর হাদিসে এসেছে, হযরত ইবনে সা’দ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম (সা.) এরশাদ করেছেন, বেহেশতের ৮টি দরজা রয়েছে। এর মধ্যে ১টি দরজার নাম রাইয়ান। রোজাদার ব্যতিত আর কেউ ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (বুখারী, মুসলিম)
সফরে রোযা রাখা না রাখা উভয়ের অনুমতি আছে।
❑ হাদীস : হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, হামযা ইবনে আমরুল আসলামী (রাঃ) অধিক মাত্রায় রোযা রাখতে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি নবী করীম (সঃ) – কে বললেন, হে রাসুল (সঃ)! আমি সফরেও রোযা রেখে থাকি। নবী করীম (সঃ) বললেন, সফর অবস্থায় তুমি ইচ্ছা করলে রোযা নাও রাখতে পার। (বেখারী , ১/৩৩৫)
মৃত ব্যক্তির ফরয রোযার কাজা থাকলে করণীয়।
❑ হাদীস : হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, মৃত ব্যক্তির উপর রোযার কাজা থাকলে অভিভাবক তার পক্ষ থেকে তা আদায় করবে। (বোখারী,১/৩৩৬)
সূর্যাস্তের সাথে সাথে অনতিবিলম্বে ইফতার করা।
❑ হাদীস : সাহল ইবনে সা’দ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ইশরাদ করেছেন, যতদিন লোকেরা তাড়াতাড়ি (সূর্যাস্তের সাথে সাথে) ইফতার করবে , ততদিন কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে না। (ছহীহ বোখারী শরীফ,১/ ৩৩৬)
প্রতি মাসের ১৩,১৪,১৫ তারিখে রোযা রাখা।
❑ হাদীস : হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন, আমার পরম বন্ধু নবী করীম (সঃ) আমাকে তিনটি বিষয়ের অসিয়ত করে গেছেন, (১) আমি যেন প্রতি মাসের (১৩,১৪,১৫,তারিখে) তিনটি রোযা রাখি, (২) চাশতের সময় দু’রাকাত নামায পড়ি, (৩) রাত্রে নিদ্রা যাওয়ার আগেই বেতেরের নামায আদায় করি। (বোখারী, ১/৩৩৭)
জুমআর দিন রোযা রাখা।
❑ হাদীস : আবু হোরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন, আমি নবী করীম (সঃ) -কে বলতে শুনেছি ,তোমাদের কেউ যেন কখনো শুধু জুমআর দিনে রোযা না রাখে। (যদি রাখতে হয়) তবে জুমআর আগের কিংবা পরের দিনও যেন রোযা রাখে। (বোখারী, ১/৩৩৭)
সাওম বা রোজার ইতিহাসঃ কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার। [ সুরা বাকারা ২:১৮৩ ]
أَيَّامًا مَّعْدُودَاتٍ فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ فَمَن تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ لَّهُ وَأَن تَصُومُواْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ
গণনার কয়েকটি দিনের জন্য অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে, অসুখ থাকবে অথবা সফরে থাকবে, তার পক্ষে অন্য সময়ে সে রোজা পূরণ করে নিতে হবে। আর এটি যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্ট দায়ক হয়, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্যদান করবে। যে ব্যক্তি খুশীর সাথে সৎকর্ম করে, তা তার জন্য কল্যাণ কর হয়। আর যদি রোজা রাখ, তবে তোমাদের জন্যে বিশেষ কল্যাণকর, যদি তোমরা তা বুঝতে পার। [ সুরা বাকারা ২:১৮৪ ]
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيَ أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ يُرِيدُ اللّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلاَ يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُواْ الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ اللّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর এবং তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন আল্লাহ তা'আলার মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর। [ সুরা বাকারা ২:১৮৫] ★রোজার ৩ ফরজ :
নিয়ত করা
সব ধরনের পানাহার থেকে বিরত থাকা
যৌন আচরণ থেকে বিরত থাকা।
★রোজা রাখার ৪ শর্ত :
মুসলিম হওয়া
বালেগ হওয়া
সক্ষম হওয়া
ঋতুস্রাব থেকে বিরত থাকা নারী।
রোজা ভঙ্গ হলে যা করণীয় :-
বিনা কারণে রোজা ভঙ্গ করলে তাকে অবশ্যই কাজা-কাফফারা উভয়ই আদায় করা ওয়াজিব। যতটি রোজা ভঙ্গ হবে, ততটি রোজা আদায় করতে হবে। কাজা রোজা একটির পরিবর্তে একটি অর্থাৎ রোজার কাজা হিসেবে শুধু একটি রোজাই যথেষ্ট। কাফফারা আদায় করার তিনটি বিধান রয়েছে।
একটি রোজা ভঙ্গের জন্য একাধারে ৬০টি রোজা রাখতে হবে। কাফফারা ধারাবাহিকভাবে ৬০টি রোজার মাঝে কোনো একটি ভঙ্গ হলে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।
যদি কারও জন্য ৬০টি রোজা পালন সম্ভব না হয় তবে ৬০ জন মিসকিনকে দুই বেলা খাওয়াতে হবে। কেউ অসুস্থতাজনিত কারণে রোজা রাখার ক্ষমতা না থাকলে ৬০ জন ফকির, মিসকিন, গরিব বা অসহায়কে প্রতিদিন দুই বেলা করে পেটভরে খাওয়াতে হবে।
গোলাম বা দাসী আজাদ করে দিতে হবে।
যেসব কারণে রমজান মাসে রোজা ভঙ্গ করা যাবে কিন্তু পরে কাজা করতে হয় তা হচ্ছে
মুসাফির অবস্থায়
রোগ-ব্যাধি বৃদ্ধির বেশি আশঙ্কা থাকলে
মাতৃগর্ভে সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে
এমন ক্ষুধা বা তৃষ্ণা হয়, যাতে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকতে পারে
শক্তিহীন বৃদ্ধ হলে
কোনো রোজাদারকে সাপে দংশন করলে।
মহিলাদের মাসিক হায়েজ-নেফাসকালীন রোজা ভঙ্গ করা যায়
যেসব কারণে শুধু কাজা আদায় করতে হয়
স্ত্রীকে চুম্বন বা স্পর্শ করার কারণে যদি বীর্যপাত হয়
ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে
পাথরের কণা, লোহার টুকরা, ফলের বিচি গিলে ফেললে
ডুশ গ্রহণ করলে
বিন্দু পরিমান কোন খাবার খেলে তবে অনিচ্ছাকৃত ভাবে বা মনের ভুলে খেলেও রোজা ভাংবে না তবে মনে আসা মাত্রই খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে
নাকে বা কানে ওষুধ দিলে (যদি তা পেটে পৌঁছে)
মাথার ক্ষতস্থানে ওষুধ দেওয়ার পর তা যদি মস্তিষ্কে বা পেটে পৌঁছে
যোনিপথ ব্যতীত অন্য কোনোভাবে সহবাস করার ফলে বীর্য নির্গত হলে
স্ত্রী লোকের যোনিপথে ওষুধ দিলে। যা কিছু পানাহারের স্থলাভিষিক্ত। এটি দুইটি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে। ১. যদি রোযাদারের শরীরে রক্ত পুশ করা হয়। যেমন- আহত হয়ে রক্তক্ষরণের কারণে কারো শরীরে যদি রক্ত পুশ করা হয়; তাহলে সে ব্যক্তির রোযা ভেঙ্গে যাবে। যেহেতু পানাহারের উদ্দেশ্য হচ্ছে— রক্ত তৈরী। ২. খাদ্যের বিকল্প হিসেবে ইনজেকশন পুশ করা। কারণ এমন ইনজেকশন নিলে পানাহারের প্রয়োজন হয় না। তবে, যেসব ইনজেকশন পানাহারের স্থলাভিষিক্ত নয়; বরং চিকিৎসার জন্য দেয়া হয়, উদাহরণতঃ ইনসুলিন, পেনেসিলিন কিংবা শরীর চাঙ্গা করার জন্য দেয়া হয় কিংবা টীকা হিসেবে দেয়া হয় এগুলো রোযা ভঙ্গ করবে না; চাই এসব ইনজেকশন মাংশপেশীতে দেয়া হোক কিংবা শিরাতে দেয়া হোক। (শাইখ মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম এর ফতোয়াসমগ্র ৪/১৮৯) তবে, সাবধানতা স্বরূপ এসব ইনজেকশন রাতে নেয়া যেতে পারে।
—: অযু বা গোসলের সময় রোযার কথা স্মরণ থাকা অবস্থায় অনিচ্ছাকৃতভাবে গলার ভেতর পানি চলে গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
সুফিয়ান সাওরী রহ. বলেন, ‘রোযা অবস্থায় কুলি করতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে গলার ভেতর পানি চলে গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং তা কাযা করতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক: ৭৩৮০)
—: যা সাধারণত আহারযোগ্য নয় বা কোনো উপকারে আসে না, তা খেলেও রোযা ভেঙ্গে যাবে। আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রাযি. ও ইকরিমা রহ. বলেন, ‘(পেটে) কোনো কিছু প্রবেশ করলে রোযা ভেঙ্গে যায়। কোনো কিছু বের হওয়ার দ্বারা রোযা ভাঙ্গে না।’ (সহীহ বুখারী ১/২৬০)
—: দাঁত থেকে রক্ত বের হয়ে যদি তা থুথুর সাথে ভেতরে চলে যায় তবে রক্তের পরিমাণ থুথুর সমান বা বেশি হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (আলবাহরুর রায়েক ২/২৭৩; রদ্দুল মুহতার ২/৩৯৬)
—: হস্তমৈথুনে বীর্যপাত হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। আর এটা যে ভয়াবহ গুনাহের কাজ তা বলাই বাহুল্য।
—: মুখে বমি চলে আসার পর ইচ্ছাকৃতভাবে গিলে ফেললে রোযা ভেঙ্গে যাবে। যদিও তা পরিমাণে অল্প হয়। (আলবাহরুর রায়েক ২/২৭৪; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪১৫)
—: রোযা অবস্থায় হায়েয বা নেফাস শুরু হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
আবু সাঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসে আছে, নবী করীম ﷺ ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আযহায় মহিলাদের লক্ষ্য করে বললেন-
أليس إذا حاضت لم تصل ولم تصم قلن بلى، قال : فذلك من نقصان دينها.
মহিলারা তো ঋতুস্রাবের সময় রোযা রাখতে পারে না এবং নামাযও পড়তে পারে না। এটা তোমাদের দ্বীনের অসম্পূর্ণতা। (সহীহ বুখারী ১/৪৪; শরহু মুখতাসারিত তহাবী ২/৪৪০; আননুতাফ ফিলফাতাওয়া ১০০)
—: পেটের এমন ক্ষতে ওষুধ লাগালে রোযা ভেঙ্গে যাবে, যা দিয়ে ওষুধ পেটের ভেতর চলে যায়। বিশেষ প্রয়োজনে এমন ক্ষতে ওষুধ লাগালে পরে সে রোযার কাযা করে নিতে হবে। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৪; রদ্দুল মুহতার ২/৪০২)
—: নাকে ওষুধ বা পানি দিলে তা যদি গলার ভেতরে চলে যায় তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
—: মলদ্বারের ভেতর ওষুধ বা পানি ইত্যাদি গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
★ওযুর বিধান ঃআল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন :
হে মুমিনগণ! যখন তোমরা সালাতের জন্য প্রস্তুত হবে,তখন তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল ও দু'হাতের কনুই পর্যন্ত ধৌত করবে এবং তোমাদের মাথা মাসেহ করবে আর দু পায়ের গ্রন্থি পর্যন্ত ধৌত করে।(৫:৬)
এ আয়াত দ্বারা বুঝা যায় অজুর ফরজ চারটি ।
আর ওযুর সুন্নত 13 টি ।
★ওযু ভঙ্গের কারণ সাতটি মতান্তরে নয়টি
গোসলের সম্বন্ধে বিবরণঃ
★গোসলের ফরজ তিনটি :-১.কুলি করা ২.নাকে পানি দেওয়া ৩.সমস্ত শরীর ধৌত করা ।
★গোসল মোট নয় প্রকার ঃ তিন প্রকার গোসল ফরজ ।যেমন জানাবাতের গোসল,হায়েজ ও নেফাসের গোসল ।
এক প্রকার গোসল ওয়াযিব যেমন মৃত ব্যক্তির গোসল ।আর বাকি চার প্রকার গোসল সুন্নত। যেমন জুমার দিনের গোসল,দুই ঈদের দিনের গোসল ,আরাফাতের দিনের গোসল,ইহরাম বাধার গোসল ।
★পানির প্রকারভেদ:-পানি মোট তিন প্রকার ।১.প্রবাহিত পানি ২.স্থির পানি ৩.কূপের পানি ।এই তিন ধরনের পানি দিয়ে পবিত্রতা অর্জন করা যায় ।
(নামাজের অধ্যায়)
নামাযের মাছলা মাছায়েল ঃ
নামাযের শর্তসমূহ
★নামাজ আরম্ভ করিবার পূর্বে যে সমস্ত কাজ অবশ্য কর্তব্য, তাহাকে নামাযের শর্ত বলে । ইহা আটটি; যথা :-
১) শরীর পাক-পবিত্র করিয়া লওয়া, অর্থাৎ অযু কিংবা গোসলের প্রয়োজন হইলে তাহা আদায় করিয়া লইতে হইবে ।
২) পোষাক পাক হওয়া । যদি কাপড়ে কোন নাপাক বস্তু নাগিয়া থাকে তাহা ধুইয়া পাক করিয়া লইবে অথবা উহা পরিবর্তন করিয়া পাক-পবিত্র কাপড় পরিধান করিয়া লইতে হইবে ।
৩) স্থান পাক হওয়া -অর্থাৎ যে স্থানে দাঁড়াইয়া নামায পড়িবে, তাহা পাবিত্র হওয়া ।
৪) ছতর ঢাকিয়া লওয়া – অর্থাৎ নামায পড়িবার সময়ে পুরুষের নাভী হইতে ও স্ত্রীলোক হইলে মুখ, হাতের কব্জা ও পায়ের তলা ব্যতীত সমুদয় শরীর ঢাকিয়া লওয়া কিন্তু বাদী হইলে পেট, পিঠ, পার্শ্ব ও নাভী হইতে জানুর নীচ পযন্ত কাপড় দ্বারা ঢাকিয়া লওয়া ফরয ।
৫) কাবা শরীফের দিক মুখ করিয়া দাঁড়ান ।
৬) নির্দিষ্ট ওয়াক্তে নামাজ আদায় করা । ৭)নিয়ত করা-যে ওয়াক্তের নামায পড়িবে, তাহার নিয়ত করা ।
৮) তাকবীরে তাহরীমা বলা । অর্থৎ নামাজের নিয়ত করিয়া “আল্লাহু আকবার” বলিয়া নামায আরম্ভ করা ।
নামাযের রোকনসমূহ
★নামায আরম্ভ করিবার পর হতে যে সকল কাজ করা ফরয, তাহাকে নামাযের রোকন বলে । ইহা মাত্র ছয়টি; যথা :-
১) দাঁড়াইয়া নামায আদায় করা ।
২) নামাযের মধ্যে কোরান পাকের কিছু আয়াত পাঠ করা ।
৩) রুকু করা ।
৪) সিজদা করা ।
৫) শেষবারে তাশাহুদ পাঠ করা ।
৬) ইচ্ছা পর্বক কোন কাজ করিয়া নামায ভঙ্গ করিয়া লওয়া ।
★পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সে সময় মুস্তাহাব ঃ
১.ফজরের সালাত বিলম্বে আদায় করা মুস্তাহাব ।তবে এত বেশি দেরি করা যাবে না, যেন সূর্যদয়ে আশঙ্কা থাকে।
২.গরমে যোহরের সালাত বিলম্বে পড়া ও শীতকালে যোহরের সালাত বিলম্ব না করে আদায় করা মুস্তাহাব ।
৩.সব সময় আসরের সালাত বিলম্বে পড়া মুস্তাহাব,যতক্ষণ না সূর্যের রং বিবর্ণ হয় ।
৪.মাগরিবের সালাত বিলম্ব না করে আদায় করা মুস্তাহাব ।
৫.এশার সালাত রাত্রে তিন ভাগের এক ভাগ পর্যন্ত বিলম্ব করে আদায় করা মুস্তাহাব ।শেষ রাত্রে যার সজাগ হওয়ার রাস্তা আছে ,তার জন্য বিতর সালাত শেষ রাতে আদায় করা মুস্তাহাব ।
নিষিদ্ধ ওয়াক্তের বিবরণ ঃ
★তিন সময় ফরজ সালাত ,জানাযার সালাত ও তিলাওয়াতের সিজদা আদায় করা নিষিদ্ধ ।
১.সূর্য উদয়ের সময় ২.সূর্য দ্বিপ্রহরের সময় ৩.সূর্য অস্ত যাওয়ার সময়।
★পেশাব-পায়খানা বেগ ছ্যাপে রেখে সালাত আদায় করলে সালাত মাখরুহ হবে।
★সাহু সিজদাহ দেওয়া ওয়াজিব। সালাত আদায় কালে কোন আংশে কম বা বেশি হলে সাহু সিজদাহ দিতে হবে ।
★কোরাআনে ১৪ টি তিলাওয়াতের সিজদা আছে।এ ১৪ টি আয়াত পাঠ করলে বা শ্রবণ করলে তিলাওয়াতে সিজদা দেওয়া ওয়াজিব।
★বিতের সালাত আদায় করা ওয়াজিব। বিতের সালাতের মাঝখানে সালাম ফিরাবে না।এবং ৩য় রাকাতে দোয়ায়ে কূূূনুত পাঠ করা ওয়াজিব।
★জানাযার নামায আদায় করা ফরযে কিফায়ত।কিছু লোক বা একজন আদায় করলে ঐ সমাজের সকলের আদায় করা হয়ে যাবে।আর কেউ আদায় না করলে ঐ সমাজের প্রত্যেকে গুনাগার হব।
★ মৃত ব্যক্তিকে গোলস দেয়া জিবীত মানুষের উপর ওয়াজিব।
★জুমার সালাত আদায় করা ফরযে আইন। তবে মহিলা, গোলাম ও অসুস্থ লোকেদের জন্য ফরজ নয়।
★ঈদের সালাত আদায় করা ওয়াজিব।
★জুমার দিন ইমামের নিকটে বসা উওম।
★জুমার খুতবা শুনা ওয়াজিব।
(যাকাত)
★ধনবান সম্পশালী মুসলমানদের বৎসর শেষে সম্পদের একটি নির্ধারিত অংশ আল্লাহর নির্দেশিত খাতে ব্যয় করার নামই যাকাত।
★যাকাত অর্থ বিশুদ্ধ হওয়া।যাকাত আদায় করা ফরজ।
★যাকাত দেয়ার শর্ত ঃ
১.মুুসলিম হওয়া।
২.আজদ হওয়া।
৩.সম্পদের মালিক হওয়া।
৪.বালিগ হওয়া।
৫.মাল দেনা মুক্ত হওয়া।
৬.নিসাবের মাল এক বছর অতিক্রম করা।
★যাকাত কার ওপর ফরয ?
ইসলামী শরীয়তে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা যে কোন একটির সমমূল্যের সম্পদ একবছর কারো নিকট আবর্তিত হলে শতকরা ২.৫০% সম্পদের মূল্যমান আল্লাহ তা’আলার নির্দেশিত আট প্রকার খাতে ব্যয় করাকেই যাকাত।
★যাকাতের অর্থ ব্যয়ের খাতসমূহ :
আল্লাহ তা’আলা কুরআনে যাকাতের অর্থ ব্যয়ে আটটি খাত উল্লেখ করেছেন। ১.ফকির, ২.মিসকিন, ৩.যাকাত আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারী, ৪.যাদের চিত্ত অকর্ষণ প্রয়োজন, ৫.দাসত্ব থেকে মুক্তি জন্য, ৬.ঋণগ্রস্থদের ঋণ থেকে মুক্তির জন্য, ৭.আল্লাহর পথে যারা জিহাদ করে তাদের
জন্য, ৮.মুসাফিরদের জন্য।
জাকাত ফরয করা হয় ২য় হিজরীতে। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে কারিমের বহু জায়গায় ইরশাদ করেছেন,
(وأقيموا الصلاة وآتوا الزكاة واركعوا مع الراكعين )البقرة: ৪৩)
‘আর তোমরা নামায কায়েম কর, জাকাত আদায় করো এবং রুকু কর রুকুকারীদের সঙ্গে।’ (সূরা বাকারা : ৪৩)
(والذين في أموالهم حق معلوم للسائل والمحروم) المعارج ২৪/২৫)
‘আর যাদের ধন সম্পদে রয়েছে ভিক্ষুক এবং বঞ্চিতদের জন্য নির্দিষ্ট অধিকার।’ আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
من آتاه الله مالاً فلم يؤد زكاته مثل له يوم القيامة شجاعاً أقرع له زبيبتان يُطوقه يوم القيامة ثم يأخذ بلهزمتيه – يعني شدقيه – يقول أنا مالُك أنا كنزك ” الشجاع : ذكر الحيات، والأقرع : الذي تمعط فروة رأسه لكثرة سُمه
‘আল্লাহ তা‘আলা যাকে সম্পদ দিয়েছেন অথচ সে তার জাকাত আদায় করে না, কিয়ামত দিবসে তার সম্পদকে দুই চোখ বিশিষ্ট বিষাক্ত সাপে পরিণত করা হবে। তারপর সাপটিকে কিয়ামতের সে দিবসে তার গলায় জড়িয়ে দেয়া হবে। সাপ তার দুই মুখে দংশন করতে করতে বলতে থাকবে, আমি তোমার বিত্ত, আমি তোমার গচ্ছিত সম্পদ।’
(সিয়াম বা রোজার অধ্যায়ঃ)
★ফারসি শব্দ রোজার আরবি অর্থ হচ্ছে সওম, বহুবচনে সিয়াম। সওম বা সিয়ামের বাংলা অর্থ বিরত থাকা। ইসলামী শরীয়তে সওম হল আল্লাহর নির্দেশ পালনের উদ্দেশে নিয়তসহ সুবহে সাদিকের শুরু থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা। ২য় হিজরীর শাবান মাসে মদীনায় রোজা ফরজ সংক্রান্ত আয়াত নাজিল হয় ।
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হলো যেভাবে তা ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা সংযমী হও”।
(সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৩)।
সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা আরও বলেছেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সেই মাসকে পায় সে যেন রোজা রাখে”।
পবিত্র রমজানের ফজিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে হাদিসের কিতাবগুলোতে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এর ভেতর থেকে কিছু হাদিস এখানে উল্লেখ করা হলো-
প্রিয় নবীজি (সা.) এর প্রিয় সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেছেন, রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, যখন রমজান মাস আসে আসমানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, আর শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। (বুখারী, মুসলিম)
অপর হাদিসে এসেছে, হযরত ইবনে সা’দ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম (সা.) এরশাদ করেছেন, বেহেশতের ৮টি দরজা রয়েছে। এর মধ্যে ১টি দরজার নাম রাইয়ান। রোজাদার ব্যতিত আর কেউ ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (বুখারী, মুসলিম)
সফরে রোযা রাখা না রাখা উভয়ের অনুমতি আছে।
❑ হাদীস : হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, হামযা ইবনে আমরুল আসলামী (রাঃ) অধিক মাত্রায় রোযা রাখতে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি নবী করীম (সঃ) – কে বললেন, হে রাসুল (সঃ)! আমি সফরেও রোযা রেখে থাকি। নবী করীম (সঃ) বললেন, সফর অবস্থায় তুমি ইচ্ছা করলে রোযা নাও রাখতে পার। (বেখারী , ১/৩৩৫)
মৃত ব্যক্তির ফরয রোযার কাজা থাকলে করণীয়।
❑ হাদীস : হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, মৃত ব্যক্তির উপর রোযার কাজা থাকলে অভিভাবক তার পক্ষ থেকে তা আদায় করবে। (বোখারী,১/৩৩৬)
সূর্যাস্তের সাথে সাথে অনতিবিলম্বে ইফতার করা।
❑ হাদীস : সাহল ইবনে সা’দ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ইশরাদ করেছেন, যতদিন লোকেরা তাড়াতাড়ি (সূর্যাস্তের সাথে সাথে) ইফতার করবে , ততদিন কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে না। (ছহীহ বোখারী শরীফ,১/ ৩৩৬)
প্রতি মাসের ১৩,১৪,১৫ তারিখে রোযা রাখা।
❑ হাদীস : হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন, আমার পরম বন্ধু নবী করীম (সঃ) আমাকে তিনটি বিষয়ের অসিয়ত করে গেছেন, (১) আমি যেন প্রতি মাসের (১৩,১৪,১৫,তারিখে) তিনটি রোযা রাখি, (২) চাশতের সময় দু’রাকাত নামায পড়ি, (৩) রাত্রে নিদ্রা যাওয়ার আগেই বেতেরের নামায আদায় করি। (বোখারী, ১/৩৩৭)
জুমআর দিন রোযা রাখা।
❑ হাদীস : আবু হোরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন, আমি নবী করীম (সঃ) -কে বলতে শুনেছি ,তোমাদের কেউ যেন কখনো শুধু জুমআর দিনে রোযা না রাখে। (যদি রাখতে হয়) তবে জুমআর আগের কিংবা পরের দিনও যেন রোযা রাখে। (বোখারী, ১/৩৩৭)
সাওম বা রোজার ইতিহাসঃ কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার। [ সুরা বাকারা ২:১৮৩ ]
أَيَّامًا مَّعْدُودَاتٍ فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ فَمَن تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ لَّهُ وَأَن تَصُومُواْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ
গণনার কয়েকটি দিনের জন্য অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে, অসুখ থাকবে অথবা সফরে থাকবে, তার পক্ষে অন্য সময়ে সে রোজা পূরণ করে নিতে হবে। আর এটি যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্ট দায়ক হয়, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্যদান করবে। যে ব্যক্তি খুশীর সাথে সৎকর্ম করে, তা তার জন্য কল্যাণ কর হয়। আর যদি রোজা রাখ, তবে তোমাদের জন্যে বিশেষ কল্যাণকর, যদি তোমরা তা বুঝতে পার। [ সুরা বাকারা ২:১৮৪ ]
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيَ أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ يُرِيدُ اللّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلاَ يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُواْ الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ اللّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর এবং তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন আল্লাহ তা'আলার মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর। [ সুরা বাকারা ২:১৮৫] ★রোজার ৩ ফরজ :
নিয়ত করা
সব ধরনের পানাহার থেকে বিরত থাকা
যৌন আচরণ থেকে বিরত থাকা।
★রোজা রাখার ৪ শর্ত :
মুসলিম হওয়া
বালেগ হওয়া
সক্ষম হওয়া
ঋতুস্রাব থেকে বিরত থাকা নারী।
রোজা ভঙ্গ হলে যা করণীয় :-
বিনা কারণে রোজা ভঙ্গ করলে তাকে অবশ্যই কাজা-কাফফারা উভয়ই আদায় করা ওয়াজিব। যতটি রোজা ভঙ্গ হবে, ততটি রোজা আদায় করতে হবে। কাজা রোজা একটির পরিবর্তে একটি অর্থাৎ রোজার কাজা হিসেবে শুধু একটি রোজাই যথেষ্ট। কাফফারা আদায় করার তিনটি বিধান রয়েছে।
একটি রোজা ভঙ্গের জন্য একাধারে ৬০টি রোজা রাখতে হবে। কাফফারা ধারাবাহিকভাবে ৬০টি রোজার মাঝে কোনো একটি ভঙ্গ হলে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।
যদি কারও জন্য ৬০টি রোজা পালন সম্ভব না হয় তবে ৬০ জন মিসকিনকে দুই বেলা খাওয়াতে হবে। কেউ অসুস্থতাজনিত কারণে রোজা রাখার ক্ষমতা না থাকলে ৬০ জন ফকির, মিসকিন, গরিব বা অসহায়কে প্রতিদিন দুই বেলা করে পেটভরে খাওয়াতে হবে।
গোলাম বা দাসী আজাদ করে দিতে হবে।
যেসব কারণে রমজান মাসে রোজা ভঙ্গ করা যাবে কিন্তু পরে কাজা করতে হয় তা হচ্ছে
মুসাফির অবস্থায়
রোগ-ব্যাধি বৃদ্ধির বেশি আশঙ্কা থাকলে
মাতৃগর্ভে সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে
এমন ক্ষুধা বা তৃষ্ণা হয়, যাতে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকতে পারে
শক্তিহীন বৃদ্ধ হলে
কোনো রোজাদারকে সাপে দংশন করলে।
মহিলাদের মাসিক হায়েজ-নেফাসকালীন রোজা ভঙ্গ করা যায়
যেসব কারণে শুধু কাজা আদায় করতে হয়
স্ত্রীকে চুম্বন বা স্পর্শ করার কারণে যদি বীর্যপাত হয়
ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে
পাথরের কণা, লোহার টুকরা, ফলের বিচি গিলে ফেললে
ডুশ গ্রহণ করলে
বিন্দু পরিমান কোন খাবার খেলে তবে অনিচ্ছাকৃত ভাবে বা মনের ভুলে খেলেও রোজা ভাংবে না তবে মনে আসা মাত্রই খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে
নাকে বা কানে ওষুধ দিলে (যদি তা পেটে পৌঁছে)
মাথার ক্ষতস্থানে ওষুধ দেওয়ার পর তা যদি মস্তিষ্কে বা পেটে পৌঁছে
যোনিপথ ব্যতীত অন্য কোনোভাবে সহবাস করার ফলে বীর্য নির্গত হলে
স্ত্রী লোকের যোনিপথে ওষুধ দিলে। যা কিছু পানাহারের স্থলাভিষিক্ত। এটি দুইটি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে। ১. যদি রোযাদারের শরীরে রক্ত পুশ করা হয়। যেমন- আহত হয়ে রক্তক্ষরণের কারণে কারো শরীরে যদি রক্ত পুশ করা হয়; তাহলে সে ব্যক্তির রোযা ভেঙ্গে যাবে। যেহেতু পানাহারের উদ্দেশ্য হচ্ছে— রক্ত তৈরী। ২. খাদ্যের বিকল্প হিসেবে ইনজেকশন পুশ করা। কারণ এমন ইনজেকশন নিলে পানাহারের প্রয়োজন হয় না। তবে, যেসব ইনজেকশন পানাহারের স্থলাভিষিক্ত নয়; বরং চিকিৎসার জন্য দেয়া হয়, উদাহরণতঃ ইনসুলিন, পেনেসিলিন কিংবা শরীর চাঙ্গা করার জন্য দেয়া হয় কিংবা টীকা হিসেবে দেয়া হয় এগুলো রোযা ভঙ্গ করবে না; চাই এসব ইনজেকশন মাংশপেশীতে দেয়া হোক কিংবা শিরাতে দেয়া হোক। (শাইখ মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম এর ফতোয়াসমগ্র ৪/১৮৯) তবে, সাবধানতা স্বরূপ এসব ইনজেকশন রাতে নেয়া যেতে পারে।
—: অযু বা গোসলের সময় রোযার কথা স্মরণ থাকা অবস্থায় অনিচ্ছাকৃতভাবে গলার ভেতর পানি চলে গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
সুফিয়ান সাওরী রহ. বলেন, ‘রোযা অবস্থায় কুলি করতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে গলার ভেতর পানি চলে গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং তা কাযা করতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক: ৭৩৮০)
—: যা সাধারণত আহারযোগ্য নয় বা কোনো উপকারে আসে না, তা খেলেও রোযা ভেঙ্গে যাবে। আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রাযি. ও ইকরিমা রহ. বলেন, ‘(পেটে) কোনো কিছু প্রবেশ করলে রোযা ভেঙ্গে যায়। কোনো কিছু বের হওয়ার দ্বারা রোযা ভাঙ্গে না।’ (সহীহ বুখারী ১/২৬০)
—: দাঁত থেকে রক্ত বের হয়ে যদি তা থুথুর সাথে ভেতরে চলে যায় তবে রক্তের পরিমাণ থুথুর সমান বা বেশি হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (আলবাহরুর রায়েক ২/২৭৩; রদ্দুল মুহতার ২/৩৯৬)
—: হস্তমৈথুনে বীর্যপাত হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। আর এটা যে ভয়াবহ গুনাহের কাজ তা বলাই বাহুল্য।
—: মুখে বমি চলে আসার পর ইচ্ছাকৃতভাবে গিলে ফেললে রোযা ভেঙ্গে যাবে। যদিও তা পরিমাণে অল্প হয়। (আলবাহরুর রায়েক ২/২৭৪; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪১৫)
—: রোযা অবস্থায় হায়েয বা নেফাস শুরু হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
আবু সাঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসে আছে, নবী করীম ﷺ ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আযহায় মহিলাদের লক্ষ্য করে বললেন-
أليس إذا حاضت لم تصل ولم تصم قلن بلى، قال : فذلك من نقصان دينها.
মহিলারা তো ঋতুস্রাবের সময় রোযা রাখতে পারে না এবং নামাযও পড়তে পারে না। এটা তোমাদের দ্বীনের অসম্পূর্ণতা। (সহীহ বুখারী ১/৪৪; শরহু মুখতাসারিত তহাবী ২/৪৪০; আননুতাফ ফিলফাতাওয়া ১০০)
—: পেটের এমন ক্ষতে ওষুধ লাগালে রোযা ভেঙ্গে যাবে, যা দিয়ে ওষুধ পেটের ভেতর চলে যায়। বিশেষ প্রয়োজনে এমন ক্ষতে ওষুধ লাগালে পরে সে রোযার কাযা করে নিতে হবে। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৪; রদ্দুল মুহতার ২/৪০২)
—: নাকে ওষুধ বা পানি দিলে তা যদি গলার ভেতরে চলে যায় তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
—: মলদ্বারের ভেতর ওষুধ বা পানি ইত্যাদি গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
Tuesday, 30 April 2019
উত্তম দোয়া ও আমল
উত্তম চরিত্রের জন্য আমল ঃ-আল্লাহুম্মাহ দিনি লিআহসানিল আ’মালি ওয়া আহসানিল আখলাক্বি; ফাইন্নাহু লা ইয়াহদি লিআহসানিহা ইল্লা আংতা; ওয়া ক্বিনি সাইয়্যিআল আ’মালি ওয়া সাইয়্যিআল আখলাক্বি; ফাইন্নাহু লা ইয়াক্বি সাইয়্যিআহা ইল্লা আংতা।
অর্থ : হে আল্লাহ! আমাকে সর্বোত্তম কাজ ও উন্নত চরিত্র দান করো। কেননা তুমি ছাড়া অন্য কেউ তা দান করতে পারে না। এবং আমাকে অন্যায় কাজ ও খারাপ চরিত্র থেকে বাঁচাও। কেননা তুমি ছাড়া অন্য কেউ তা থেকে কাউকে বাঁচাতে পারে না। (নাসাঈ)
আল্ লাত্বিফু ঃআল্লাহর গুণবাচক নাম (اَللَّطِيْفُ) ‘আল-লাত্বিফু’-এর জিকিরের আমল ও ফজিলত তুলে ধরা হলো-
উচ্চারণ : ‘আল-লাত্বিফু’
অর্থ : ‘নিজের বান্দার ওপর কোমলতা প্রদর্শনকারী’
আল্লাহর গুণবাচক নাম (اَلْعَدْلُ)-এর আমল
ফজিলত
>> যে ব্যক্তি অর্থ সংকটে পড়ে, অতি কষ্টে জীবন-যাপন করে বা অসুস্থতায় তার কেউ সেবা-শুশ্রূষা করে না অথবা তার কন্যা সন্তানের কেউ খোঁজ খবর নেয় না; ওই ব্যক্তি যেন উত্তম রূপে অজু করে দু’রাকাআত নামাজ পড়ে নিজের উদ্দেশ্য সাধনে আল্লাহ তাআলার পবিত্র গুণবাচক (اَللَّطِيْفُ) ‘আল-লাত্বিফু’ নামটি ১০০ বার পাঠ করে; তবে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তাঁর উদ্দেশ্য সম্পাদন করে দেবেন।
>> এমনিভাবে যে ব্যক্তি ছোট শিশু-বাচ্চাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন, রোগমুক্তি এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ পরিপূর্ণতার জন্য নিয়মিত আল্লাহ তাআলার পবিত্র গুণবাচক (اَللَّطِيْفُ) ‘আল-লাত্বিফু’ নামটি ১০০ বার পাঠ করা আবশ্যক।
অন্যের বিপদের দোয়া পাঠ ঃউচ্চারণ :
আলহামদু লিল্লাহিল্লাজি আ’ফানি মিম্মাবতালাকা বিহি, ওয়া ফাদ্দালানি আ’লা কাছিরিম মিম্মান খালাকা তাফদিলা।
অর্থ : সকল প্রশংসা সে আল্লাহর জন্য, যিনি তোমাকে বিপদ দ্বারা পরীক্ষায় নিপতিত করেছেন, তা হতে আমাকে নিরাপদ রেখেছেন এবং তার সৃষ্টির অনেকের চেয়ে আমাকে অনুগ্রহ করেছেন। (তিরমিজি)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে দুনিয়ার সব বিপদাপদে হিফাজত করুন। সবাইকে সব বিপদগ্রস্ত লোকদের কল্যাণে এগিয়ে আসার এবং দোয়া করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
গুনাহ মাফের শ্রেষ্ঠ 5 টি আমল ঃ-পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন,
যারা কখনও কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেলে কিংবা মন্দ কাজে জড়িয়ে পড়ে। অতঃপর সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহ ছাড়া তাদের পাপ কে ক্ষমা করবেন? (সূরা আল-ইমরান: ১৩৫)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, দয়াময় আল্লাহ তায়ালা রাতের বেলায় ক্ষমার হাত প্রসারিত করে ডাকতে থাকেন দিনের বেলায় গোনাহগারদের ক্ষমা করার জন্য। আর রাত্রিকালীন গোনাহগারদের মাফ করার জন্য দিনের বেলা ক্ষমার হাত প্রসারিত করে ডাকতে থাকেন। এ অবস্থা পশ্চিম আকাশ থেকে সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। (সুনানে বায়হাকি : ১৬২৮১)।
তওবা ছাড়াও বিভিন্ন আমল দ্বারা গোনাহ মাফ হওয়ার কথা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।
এ ধরনের কয়েকটি আমল হলো_ প্রথম আমল- দ্বীনি মজলিসে বসা।
বোখারি শরিফে এসেছে, একদা রাসূলুল্লাহ (সা.) মসজিদে তালিমের মজলিসে ছিলেন। এ সময় তিনজন লোক এলো।
তাদের একজন মজলিসে ফাঁকা জায়গা দেখে বসে পড়ল আরেকজন ভিড় দেখে চলে গেল, অপরজন চলে যেতে লজ্জাবোধ করল এবং পেছনে বসল। রাসূল (সা.) আলোচনা শেষে বললেন, আমি তোমাদের তিন ব্যক্তির অবস্থা শোনাব। তাদের একজন আল্লাহর কাছে আশ্রয় নিয়েছে এবং আল্লাহ পাকও তাকে আশ্রয় দিয়েছেন। আরেকজন মজলিস থেকে চলে যেতে লজ্জাবোধ করল আল্লাহ তায়ালাও তাকে শাস্তি দিতে লজ্জাবোধ করলেন। আর তৃতীয় ব্যক্তি মজলিস থেকে বিমুখ হয়ে চলে গেল আল্লাহ পাকও তার থেকে বিমুখ হলেন। (বোখারি : ৬৬)।
দ্বিতীয় আমল নিদ্রা যাওয়ার সময় তিনবার পাঠ করা_ আস্তাগফিরুল্লাহাল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা হুওয়াল হাইয়ুল কাইয়ুমি ওয়া আতুবু ইলাইহি। সাহাবি আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি শয়নকালে তিনবার উপরোক্ত ইস্তেগফার পড়বে তার পাপরাশি সমুদ্রের ফেনা, আকাশের নক্ষত্ররাজি কিংবা মরুভূমির বালুকণা কিংবা দুনিয়ার দিনগুলোর পরিমাণ হলেও আল্লাহ পাক তা মাফ করে দেবেন। (তিরমিজি : ২৩০৪)।
তৃতীয় আমল প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর উপরোক্ত ইস্তিগফার তিনবার পাঠ করা। হজরত বারা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর তিনবার এ ইস্তিগফার পড়বে তার গোনাহগুলো মোচন করা হয়, যদিও সে জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করে থাকে। (তাবরানি : ১৪০০)।
চতুর্থ আমল প্রতিদিন ১০০ বার পাঠ করা_সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি দৈনিক উপরোক্ত তাসবিহ ১০০ বার পাঠ করবে তার পাপগুলো সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হলেও মাফ হয়ে যাবে।(বোখারি ও মুসলিম)।
পঞ্চম আমল নামাজে সূরা ফাতেহার পর আমিন বলা। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, ইমাম যখন সূরা ফাতেহা শেষ করে আমিন বলেন, তখন তোমরাও আমিন বলো। কেননা যার আমিন ফেরেশতাদের আমিনের সঙ্গে মিলে যাবে তার গোনাহগুলো মোচন হয়ে যাবে। (নাসায়ী : ১০০০)
১০টি বিপদ থেকে মুক্তি করবে এ সূরা গুলিঃ-১। সূরা ফতিহা আল্লাহর গজব হতে রক্ষার কারণ হয়।
২। সূরা ইয়াসীন কিয়ামতের দিন পিপার্সাত হওয়া থেকে রক্ষার মাধ্যম হবে।
৩। সূরা দুখান কিয়ামতের দিনের ভয়াল অবস্থা হতে রক্ষার মাধ্যম হবে।
৪। সূরা ওয়াকি’আ দরিদ্রতা হতে রক্ষার কারণ হয়।
৫। সূরা মূলক কবরের আযাব হতে রক্ষার মাধ্যম হবে।
৬। সূরা কাওসার শত্রুর অনিষ্ট হতে রক্ষার কারণ হয়।
৭। সূরা কাফিরুন মৃত্যুর সময় কুফরী হতে রক্ষার কারণ হয়।
৮। সূরা ইখলাস মুনাফিকী হতে রক্ষার কারণ হয়।
৯। সূরা ফালাক হিংসুকের হিংসার হতে রক্ষার কারণ হয়।
১০। সূরা নাস যাবতীয় ওয়াসাওয়াসা হতে রক্ষার কারণ।
সালাতুল তাসবিহ এর ফজিলতঃ
হযরত ইবনে আব্বাস(রাঃ) বলেন, রাসুল (সাঃ) হযরত ইবনে আব্বাস(রাঃ) কে বলেন, “হে আব্বাস, আমার চাচা আমি কি আপনাকে একটি দান বা বকশিশ দিব, আপনার সামনে একটি তফফা পেশ করব, আমি কি আপনাকে এমন একটি আমল বলে দিব যা পালন করলে আপনি ১০ টি উপকার লাভ করবেন অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা আপনার অতিত- ভবিষ্যতের, নতুন-পুরাতন, ভুলে বা জেনেশুনে, ছোট – বড়, গোপনে বা প্রকাশে করা সকল গুনাহ এ মাফ করে দিবেন।সেই আমল হল আপনি ৪রাকাত সালাতুল তাসবিহ আদায় করবেন।
আয়াতুল কুরসির ফজিলতঃ আবু হুরাইরাহ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে রমজানের জাকাতের প্রহরী নিযুক্ত করেন। আমার কাছে এক আগমনকারী এসে ওই মাল থেকে কিছু কিছু করে উঠিয়ে নিয়ে সে তার চাদরে জমা করতে থাকে। আমি তাকে ধরে ফেলি এবং বলি, তোমাকে আমি রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে নিয়ে যাব। সে বলল, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি খুবই অভাবী লোক। তখন আমি তাকে ছেড়ে দেই। সকালে রসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার রাতের বন্দী কী করেছিল? আমি বলি, হে আল্লাহর রসুল! সে তার ভীষণ অভাবের অভিযোগ করায় তার প্রতি আমার দয়া হয়, তাই আমি তাকে ছেড়ে দেই। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, সে তোমাকে মিথ্যা বলেছে। সে আবার আসবে। আমি রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কথায় বুঝলাম যে, সে সত্যিই আবার আসবে। আমি পাহারা দিতে থাকলাম। সে খাদ্য উঠাতে থাকল। আমি আবার তাকে ধরে ফেলে বললাম, তোমাকে আমি রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে নিয়ে যাব। সে আবার ওই কথাই বলল, আমাকে ছেড়ে দিন, আমি খুবই অভাবী।
তার প্রতি আমার দয়া হলো। কাজেই তাকে ছেড়ে দিলাম। সকালে আমাকে রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে আবু হুরায়রা! তোমার রাতের বন্দীটি কী করেছে? আমি বললাম, হে আল্লাহর রসুল! সে অভাবের অভিযোগ করায় আমি তাকে দয়া করে ছেড়ে দিয়েছি। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, সে তোমাকে মিথ্যা বলেছে। সে আবার আসবে। আমি আবার তৃতীয় রাতে পাহারা দেই। অতঃপর সে এসে খাদ্য উঠাতে থাকল। আমি তাকে বলি : এটাই তৃতীয়বার এবং এবারই শেষ। তুমি বারবার বলছ যে, আর আসবে না, অথচ আবার আসছ। সুতরাং তোমাকে আমি রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে নিয়ে যাব। তখন সে বলল, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আপনাকে এমন কতগুলো কথা শিখিয়ে দিচ্ছি যার মাধ্যমে আল্লাহ আপনার উপকার সাধন করবেন। আমি বললাম, ওইগুলো কি? সে বলল, ‘যখন আপনি বিছানায় শয়ন করবেন তখন আয়াতুল কুরসি শেষ পর্যন্ত পড়বেন। এতে মহান আল্লাহ আপনার রক্ষক হবেন এবং সকাল পর্যন্ত আপনার সামনে কোনো শয়তান আসতে পারবে না।’ তারা ভালো জিনিসের খুবই লোভী। অতঃপর (আবু হুরায়রা থেকে এ কথাগুলো শোনার পর) নবী করিম (সা.) বললেন, সে চরম মিথ্যাবাদী হলেও এটা সত্যই বলেছে। হে আবু হুরায়রা! তুমি তিন রাতে কার সঙ্গে কথা বলেছ তা কি জান? আমি বললাম, না। তিনি (সা.) বললেন, সে শয়দান। [সূত্র : সহি বোখারি, ফাতহুল বারী হা/২৩১১]
কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ দোয়াঃ
সকাল-সন্ধা তিন বার এই দোয়া পড়বেঃ
بِسْمِ اللهِ الّذِى لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَىْءٌ فِىْ الاَرْضِ وَلاَ فِى السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ
উচ্চারণঃ বিসমিলস্নাহিলস্নাযি লা ইয়াদুররম্ন মায়াস্ মিহী শাইউন ফিল আরদী ওয়া লা ফিস্সামায়ী ওয়া হুয়াস্সামীউল ‘আলীম।
সকাল-সন্ধা তিন বার এই দোয়া পড়বেঃ
اَعُوْذْ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ
উচ্চারণঃ আউযু বি কালীমাতিলস্নাহিত্ তাম্মাতি মিন শাররী মা খালাকা।
সকাল-সন্ধা তিন বার এই দোয়া পড়বেঃ
اَعُوْذْ بِاللهِ السَّمِيْعِ الْعَلِيْمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ
উচ্চারণঃ আউযু বিলস্নাহিস্ সামীয়ীল ‘আলীমি মিনাশ্ মাইতানির রাযীম।
সকাল সন্ধ্যায় তিন বার قُلْ هُوَ اللهُ শরীফ (সূরাঃ ইখলাস) এবং তিন বার قُلْ اَعُوْذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ (সূরাঃ ফালাক) পড়িবে, এবং তিন বার قُلْ اَعُوْذُ بِرَبِّ النَّاَسِ (সূরাঃ নাস) পড়িবে।
সকাল-সন্ধা এই দোয়াটিও বেশি বেশি পড়া যায়-
اللهُمَّ اِنِّى اَعُوْذُ بِكَ مِنَ الكَسَلِ وَالْحَرَمِ وَسُوْءِ الْكِبَرِ وفِتْنَةِ الدُّنْياَ وَ عَذاَبِ الْقَبْرِ
উচ্চারণঃ আলস্নাহুম্মা ইন্নী আউযুবিকা মিনাল কাসালি ওয়াল হারামী ওয়া সুইল কিবারি ওয়া ফিতনাতিদ্ দুনিয়া ওয়া আযাবিল কবরি।
ভোরে এই দোয়া পড়িবেঃ
اَصْبَحْنَا وَاَصْبَحَ الْمَلِكُ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ, اَلّلهُمَّ اِنِّىْ اَسْئَلُكَ خَيْرَ هذَا الْيَوْمِ وَفَتْحَه وَنَصْرَه وَنُوْرَه وَبَرَكَتَه وَهُدَاه وَاَعُوْذُبِكَ مِنْ شَرِّمَا فِيْه وَشَرِّمَا بَعْدَه-
উচ্চারণঃ আসবাহনা ওয়া আসবাহাল মালিকু লিলস্নাহি রাব্বীল আলামীন, আলস্নাহুম্মা ইন্নী আসআলূকা খাইরা হাযাল ইয়াওমি ওয়া ফাতহাহু ওয়া নাসরাহু ওয়া নূরাহু ওয়া হুদাহু ওয়া আউযুবিকা মিন শাররী মা ফিহি ওয়া শাররী মা বাদাহু।
এই দোয়াটিও সকাল সন্ধ্যায় পড়া যাবেঃ
اَللّهُمَّ بِكَ اَصْبَحْنَا وَبِكَ اَمْسَيْنَا وَبِكَ نَحْنَ وَبِكَ نَمُوْتُ وَاِلَيْكَ النُّشُوْرُ-
উচ্চারণঃ আলস্নাহুম্মা বিকা আসবাহনা ওয়া বিকা আমসাইনা ওয়া বিকা নাহয়া
দৈনিক সকাল সন্ধ্যা কম পক্ষে দশ বার করিয়া এই কালেমায়ে শাহাদাত অবশ্যই পরিবেঃ
لَا اِلهَ اِلّااللهُ وَحْدَه لَا شَرِيْكَ لَه – لَه الْمُلْكُ وَلَه الْحَمْدُ, وَهُوَ عَلى كُلِّ شَيْئٍ قَدِيْرٌ-
উচ্চারণঃ লা ইলাহা ইলস্নালস্নাহু ওয়াহদাহু লা শারীকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু, ওয়া হুয়া আলা কুলিস্ন শাইয়িন কাদীর।
এই তসবীহটি সকাল সন্ধ্যায় একশত বার করিয়া পরিবেঃ
سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِه, سُبْحَانَ اللهِ الْعَظِيْمِ*
উচ্চারণঃ সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী, সুবহানাল্লাহি আজীম।
খাবার খাওয়ার কিছু সুন্নত আমলঃ খানা সামনে আসলে এই দোয়া পড়বে –
اَللّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِيْما رَزَقْتَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা বারিকলানা ফিমা রাজাকতানা ওয়া কিনা আ‘জাবান নার।
খানা খাওয়ার শুরুতে এই দোয়া পড়বে-
بِسْمِ اللّهِ وَ عَلى بَرَكَةِ اللهِ
উচ্চারণঃ বিস্মিল্লাহি ও‘আলা বারাকাতিল্লাহ
খানার শুরুতে দোয়া পড়তে ভুরে গেলে খানার মাঝে স্মরণ আসার পর এই দোয়া পড়বে-
بِسْمِ اللهِ أَوَّلَه وَآخِرَه
উচ্চারণঃ বিসমিল্লাহি আউয়্যালাহু ওয়া আখীরাহ।
খানার শেষে এই দোয়া পড়বে –
اَلْحَمْدُ لِلّهِ الَّذِيْ اَطْعَمَنَا وَ سَقَانَا وَ جَعَلَنَا مِنَ الْمُسْلِمِيْن.
উচ্চারণঃ আলহামদুলিল্লাহিল্লাজী আতআ‘মানা ওয়া ছাক্বানা ওয়া জাআলানা মিনাল মুসলিমীন।
দাওয়াত খাওয়ার পর এই দোয়া পড়বে –
اَللّهُمَّ اَطْعِمْ مَنْ اَطْعَمَنِيْ وَ اَسْقِ مَنْ سَقَانِيْ
উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা আতঈম মান আত‘আামনী ওয়া আস্কী মান সাকানী।
রাতে ঘুমানোর পূর্বে আমল ঃরাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলিম যদি দুইটি কাজ নিয়মিত করতে পারে তাহলে জান্নাতে প্রবেশ করবে। কাজ দুইটি খুবই সহজ কিন্তু করার মানুষ খুব কম। প্রথমত, প্রত্যেক সালাতের পরে ১০ বার ‘সুবহানাল্লাহ’, ১০ বার ‘আল-হামদুলিল্লাহ ‘ ও ১০ বার ‘আল্লাহু আকবার’ বলবে। এতে ১৫০ বার জিহ্বার জিকর হবে এবং আল্লাহর কাছে আমলনামায় বা মিজানে ১৫০০ সাওয়াব হবে। দ্বিতীয়ত, বিছানায় শয়ন করার পরে ৩৪ বার ‘আল্লাহু আকবার’, ৩৩ বার ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ ও ৩৩ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ বলবে। এতে মুখে ১০০ বার ও মিজানে ১ হাজার বার হবে। রাসুল (সা.) আঙুলে গুনে গুনে তা দেখান। সাহাবিরা প্রশ্ন করেন, ‘এই দুইটি কর্ম সহজ হওয়া সত্ত্বেও পালনকারী কম কেন?’ তিনি উত্তরে বলেন, ‘কেউ শুয়ে পড়লে শয়তান এসে এগুলো বলার আগেই ঘুম পাড়িয়ে দেয়। সালাতের পরে এগুলো বলার আগেই তাকে তার বিভিন্ন কথা মনে করিয়ে দেয়।’ (আবু দাউদ, ইবনে হিব্বান, তারগিব)।
আয়াতুল কুরসি : বোখারি বর্ণিত হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি যে, কেউ রাতে বিছানায় শয়ন করার পরে আয়াতুল কুরসি পাঠ করলে সারা রাত আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে হেফাজত করা হবে এবং কোনো শয়তান তার কাছে আসতে পারবে না।
সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত : আবু মাসউদ (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যদি কেউ রাতে সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পাঠ করে তবে তা তার জন্য যথেষ্ট হবে।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
সূরা কাফিরুন : নাওফাল আল-আশজায়ী (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে বলেছেন, তুমি সূরা ‘কাফিরুন’ পড়ে ঘুমাবে, এ শিরক থেকে তোমার বিমুক্তি।’ (তিরমিজি, আবু দাউদ)।
সূরা এখলাস : আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) তাঁর সাহাবিদের বললেন, ‘তোমরা কি পারবে না রাতে কোরআনের এক-তৃতীয়াংশ তেলাওয়াত করতে? বিষয়টি তাদের কাছে কষ্টকর মনে হলো। তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমাদের মধ্যে কে-ই বা তা পারবে? তখন তিনি বলেন, কুল হুআল্লাহু আহাদ সূরাটি কোরআনের এক-তৃতীয়াংশ।’ আবু দারদা (রা.) থেকে একই অর্থে আরেকটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। (বোখারি ও মুসলিম)।
সূরা এখলাস, ফালাক ও নাস একত্রে (তিনবার) : দুই হাত একত্র করে এ সূরাগুলো পাঠ করে হাতে ফুঁ দিয়ে হাত দুইটি যথাসম্ভব শরীরের সর্বত্র বুলানো- এভাবে তিনবার করতে হবে। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতি রাতে বিছানায় গমনের পরে তাঁর মোবারক দুইটি হাত একত্রিত করে তাতে ফুঁ দিতেন এবং তাতে উপরের তিনটি সূরা পাঠ করতেন। এরপর শরীরের যতটুকু স্থান সম্ভব দুই হাত দিয়ে মাসেহ করতেন। মাথা, মুখ ও শরীরের সামনের দিক থেকে শুরু করতেন। এভাবে তিনবার করতেন।’ (বোখারি)।
অজু অবস্থায় ঘুমাতে যাওয়া : ঘুমের জন্য অজু অবস্থায় শয়ন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাসনুন ইবাদত। রাসুলুল্লাহ (সা.) এজন্য বিশেষভাবে উৎসাহ প্রদান করেছেন এবং এ জন্য বিশেষ দুইটি পুরস্কারের সুসংবাদ প্রদান করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের দেহগুলোকে পবিত্র রাখবে, আল্লাহ তোমাদের পবিত্র করুন। যদি কোনো বান্দা অজু অবস্থয় ঘুমান, তবে তার পোশাকের মধ্যে একজন ফেরেশতা শুয়ে থাকেন। রাতে যখনই এ ব্যক্তি নড়াচড়া করে তখনই এ ফেরেশতা বলেন, ‘হে আল্লাহ আপনি এ ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দিন, কারণ সে অজু অবস্থায় ঘুমিয়েছে।’ (ইবনে হিব্বান, তাবারানি, সহিহুত তারগিব)। অন্য হাদিসে মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে কোনো মুসলিম যদি অজু অবস্থায় (আল্লাহর জিকরের ওপর) ঘুমায়, এরপর রাতে কোনো সময় হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে যায় এবং সে (ওই অবস্থায় শুয়ে শুয়ে) আল্লাহর কাছে তার জাগতিক বা পারলৌকিক কোনো কল্যাণ কামনা করে তবে আল্লাহ তাকে তার পার্থিত বস্তু দেবেনই।’ (আবু দাউদ, সহিহ তারগিব, নাসাঈ)। ঘুমের আগে অজু করে সম্ভব হলে ২/৪ রাকাত সালাত আদায় করে ঘুমাবেন। বিশেষত যারা শেষ রাতে তাহাজ্জুদের জন্য উঠতে পারবেন না বলে ভয় পাবেন, তারা ঘুমানোর আগে ২/৪ রাকাত ‘কিয়ামুল্লাইল’ আদায় করে ঘুমাবেন।
অর্থ : হে আল্লাহ! আমাকে সর্বোত্তম কাজ ও উন্নত চরিত্র দান করো। কেননা তুমি ছাড়া অন্য কেউ তা দান করতে পারে না। এবং আমাকে অন্যায় কাজ ও খারাপ চরিত্র থেকে বাঁচাও। কেননা তুমি ছাড়া অন্য কেউ তা থেকে কাউকে বাঁচাতে পারে না। (নাসাঈ)
আল্ লাত্বিফু ঃআল্লাহর গুণবাচক নাম (اَللَّطِيْفُ) ‘আল-লাত্বিফু’-এর জিকিরের আমল ও ফজিলত তুলে ধরা হলো-
উচ্চারণ : ‘আল-লাত্বিফু’
অর্থ : ‘নিজের বান্দার ওপর কোমলতা প্রদর্শনকারী’
আল্লাহর গুণবাচক নাম (اَلْعَدْلُ)-এর আমল
ফজিলত
>> যে ব্যক্তি অর্থ সংকটে পড়ে, অতি কষ্টে জীবন-যাপন করে বা অসুস্থতায় তার কেউ সেবা-শুশ্রূষা করে না অথবা তার কন্যা সন্তানের কেউ খোঁজ খবর নেয় না; ওই ব্যক্তি যেন উত্তম রূপে অজু করে দু’রাকাআত নামাজ পড়ে নিজের উদ্দেশ্য সাধনে আল্লাহ তাআলার পবিত্র গুণবাচক (اَللَّطِيْفُ) ‘আল-লাত্বিফু’ নামটি ১০০ বার পাঠ করে; তবে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তাঁর উদ্দেশ্য সম্পাদন করে দেবেন।
>> এমনিভাবে যে ব্যক্তি ছোট শিশু-বাচ্চাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন, রোগমুক্তি এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ পরিপূর্ণতার জন্য নিয়মিত আল্লাহ তাআলার পবিত্র গুণবাচক (اَللَّطِيْفُ) ‘আল-লাত্বিফু’ নামটি ১০০ বার পাঠ করা আবশ্যক।
অন্যের বিপদের দোয়া পাঠ ঃউচ্চারণ :
আলহামদু লিল্লাহিল্লাজি আ’ফানি মিম্মাবতালাকা বিহি, ওয়া ফাদ্দালানি আ’লা কাছিরিম মিম্মান খালাকা তাফদিলা।
অর্থ : সকল প্রশংসা সে আল্লাহর জন্য, যিনি তোমাকে বিপদ দ্বারা পরীক্ষায় নিপতিত করেছেন, তা হতে আমাকে নিরাপদ রেখেছেন এবং তার সৃষ্টির অনেকের চেয়ে আমাকে অনুগ্রহ করেছেন। (তিরমিজি)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে দুনিয়ার সব বিপদাপদে হিফাজত করুন। সবাইকে সব বিপদগ্রস্ত লোকদের কল্যাণে এগিয়ে আসার এবং দোয়া করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
গুনাহ মাফের শ্রেষ্ঠ 5 টি আমল ঃ-পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন,
যারা কখনও কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেলে কিংবা মন্দ কাজে জড়িয়ে পড়ে। অতঃপর সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহ ছাড়া তাদের পাপ কে ক্ষমা করবেন? (সূরা আল-ইমরান: ১৩৫)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, দয়াময় আল্লাহ তায়ালা রাতের বেলায় ক্ষমার হাত প্রসারিত করে ডাকতে থাকেন দিনের বেলায় গোনাহগারদের ক্ষমা করার জন্য। আর রাত্রিকালীন গোনাহগারদের মাফ করার জন্য দিনের বেলা ক্ষমার হাত প্রসারিত করে ডাকতে থাকেন। এ অবস্থা পশ্চিম আকাশ থেকে সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। (সুনানে বায়হাকি : ১৬২৮১)।
তওবা ছাড়াও বিভিন্ন আমল দ্বারা গোনাহ মাফ হওয়ার কথা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।
এ ধরনের কয়েকটি আমল হলো_ প্রথম আমল- দ্বীনি মজলিসে বসা।
বোখারি শরিফে এসেছে, একদা রাসূলুল্লাহ (সা.) মসজিদে তালিমের মজলিসে ছিলেন। এ সময় তিনজন লোক এলো।
তাদের একজন মজলিসে ফাঁকা জায়গা দেখে বসে পড়ল আরেকজন ভিড় দেখে চলে গেল, অপরজন চলে যেতে লজ্জাবোধ করল এবং পেছনে বসল। রাসূল (সা.) আলোচনা শেষে বললেন, আমি তোমাদের তিন ব্যক্তির অবস্থা শোনাব। তাদের একজন আল্লাহর কাছে আশ্রয় নিয়েছে এবং আল্লাহ পাকও তাকে আশ্রয় দিয়েছেন। আরেকজন মজলিস থেকে চলে যেতে লজ্জাবোধ করল আল্লাহ তায়ালাও তাকে শাস্তি দিতে লজ্জাবোধ করলেন। আর তৃতীয় ব্যক্তি মজলিস থেকে বিমুখ হয়ে চলে গেল আল্লাহ পাকও তার থেকে বিমুখ হলেন। (বোখারি : ৬৬)।
দ্বিতীয় আমল নিদ্রা যাওয়ার সময় তিনবার পাঠ করা_ আস্তাগফিরুল্লাহাল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা হুওয়াল হাইয়ুল কাইয়ুমি ওয়া আতুবু ইলাইহি। সাহাবি আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি শয়নকালে তিনবার উপরোক্ত ইস্তেগফার পড়বে তার পাপরাশি সমুদ্রের ফেনা, আকাশের নক্ষত্ররাজি কিংবা মরুভূমির বালুকণা কিংবা দুনিয়ার দিনগুলোর পরিমাণ হলেও আল্লাহ পাক তা মাফ করে দেবেন। (তিরমিজি : ২৩০৪)।
তৃতীয় আমল প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর উপরোক্ত ইস্তিগফার তিনবার পাঠ করা। হজরত বারা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর তিনবার এ ইস্তিগফার পড়বে তার গোনাহগুলো মোচন করা হয়, যদিও সে জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করে থাকে। (তাবরানি : ১৪০০)।
চতুর্থ আমল প্রতিদিন ১০০ বার পাঠ করা_সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি দৈনিক উপরোক্ত তাসবিহ ১০০ বার পাঠ করবে তার পাপগুলো সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হলেও মাফ হয়ে যাবে।(বোখারি ও মুসলিম)।
পঞ্চম আমল নামাজে সূরা ফাতেহার পর আমিন বলা। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, ইমাম যখন সূরা ফাতেহা শেষ করে আমিন বলেন, তখন তোমরাও আমিন বলো। কেননা যার আমিন ফেরেশতাদের আমিনের সঙ্গে মিলে যাবে তার গোনাহগুলো মোচন হয়ে যাবে। (নাসায়ী : ১০০০)
১০টি বিপদ থেকে মুক্তি করবে এ সূরা গুলিঃ-১। সূরা ফতিহা আল্লাহর গজব হতে রক্ষার কারণ হয়।
২। সূরা ইয়াসীন কিয়ামতের দিন পিপার্সাত হওয়া থেকে রক্ষার মাধ্যম হবে।
৩। সূরা দুখান কিয়ামতের দিনের ভয়াল অবস্থা হতে রক্ষার মাধ্যম হবে।
৪। সূরা ওয়াকি’আ দরিদ্রতা হতে রক্ষার কারণ হয়।
৫। সূরা মূলক কবরের আযাব হতে রক্ষার মাধ্যম হবে।
৬। সূরা কাওসার শত্রুর অনিষ্ট হতে রক্ষার কারণ হয়।
৭। সূরা কাফিরুন মৃত্যুর সময় কুফরী হতে রক্ষার কারণ হয়।
৮। সূরা ইখলাস মুনাফিকী হতে রক্ষার কারণ হয়।
৯। সূরা ফালাক হিংসুকের হিংসার হতে রক্ষার কারণ হয়।
১০। সূরা নাস যাবতীয় ওয়াসাওয়াসা হতে রক্ষার কারণ।
সালাতুল তাসবিহ এর ফজিলতঃ
হযরত ইবনে আব্বাস(রাঃ) বলেন, রাসুল (সাঃ) হযরত ইবনে আব্বাস(রাঃ) কে বলেন, “হে আব্বাস, আমার চাচা আমি কি আপনাকে একটি দান বা বকশিশ দিব, আপনার সামনে একটি তফফা পেশ করব, আমি কি আপনাকে এমন একটি আমল বলে দিব যা পালন করলে আপনি ১০ টি উপকার লাভ করবেন অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা আপনার অতিত- ভবিষ্যতের, নতুন-পুরাতন, ভুলে বা জেনেশুনে, ছোট – বড়, গোপনে বা প্রকাশে করা সকল গুনাহ এ মাফ করে দিবেন।সেই আমল হল আপনি ৪রাকাত সালাতুল তাসবিহ আদায় করবেন।
আয়াতুল কুরসির ফজিলতঃ আবু হুরাইরাহ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে রমজানের জাকাতের প্রহরী নিযুক্ত করেন। আমার কাছে এক আগমনকারী এসে ওই মাল থেকে কিছু কিছু করে উঠিয়ে নিয়ে সে তার চাদরে জমা করতে থাকে। আমি তাকে ধরে ফেলি এবং বলি, তোমাকে আমি রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে নিয়ে যাব। সে বলল, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি খুবই অভাবী লোক। তখন আমি তাকে ছেড়ে দেই। সকালে রসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার রাতের বন্দী কী করেছিল? আমি বলি, হে আল্লাহর রসুল! সে তার ভীষণ অভাবের অভিযোগ করায় তার প্রতি আমার দয়া হয়, তাই আমি তাকে ছেড়ে দেই। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, সে তোমাকে মিথ্যা বলেছে। সে আবার আসবে। আমি রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কথায় বুঝলাম যে, সে সত্যিই আবার আসবে। আমি পাহারা দিতে থাকলাম। সে খাদ্য উঠাতে থাকল। আমি আবার তাকে ধরে ফেলে বললাম, তোমাকে আমি রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে নিয়ে যাব। সে আবার ওই কথাই বলল, আমাকে ছেড়ে দিন, আমি খুবই অভাবী।
তার প্রতি আমার দয়া হলো। কাজেই তাকে ছেড়ে দিলাম। সকালে আমাকে রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে আবু হুরায়রা! তোমার রাতের বন্দীটি কী করেছে? আমি বললাম, হে আল্লাহর রসুল! সে অভাবের অভিযোগ করায় আমি তাকে দয়া করে ছেড়ে দিয়েছি। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, সে তোমাকে মিথ্যা বলেছে। সে আবার আসবে। আমি আবার তৃতীয় রাতে পাহারা দেই। অতঃপর সে এসে খাদ্য উঠাতে থাকল। আমি তাকে বলি : এটাই তৃতীয়বার এবং এবারই শেষ। তুমি বারবার বলছ যে, আর আসবে না, অথচ আবার আসছ। সুতরাং তোমাকে আমি রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে নিয়ে যাব। তখন সে বলল, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আপনাকে এমন কতগুলো কথা শিখিয়ে দিচ্ছি যার মাধ্যমে আল্লাহ আপনার উপকার সাধন করবেন। আমি বললাম, ওইগুলো কি? সে বলল, ‘যখন আপনি বিছানায় শয়ন করবেন তখন আয়াতুল কুরসি শেষ পর্যন্ত পড়বেন। এতে মহান আল্লাহ আপনার রক্ষক হবেন এবং সকাল পর্যন্ত আপনার সামনে কোনো শয়তান আসতে পারবে না।’ তারা ভালো জিনিসের খুবই লোভী। অতঃপর (আবু হুরায়রা থেকে এ কথাগুলো শোনার পর) নবী করিম (সা.) বললেন, সে চরম মিথ্যাবাদী হলেও এটা সত্যই বলেছে। হে আবু হুরায়রা! তুমি তিন রাতে কার সঙ্গে কথা বলেছ তা কি জান? আমি বললাম, না। তিনি (সা.) বললেন, সে শয়দান। [সূত্র : সহি বোখারি, ফাতহুল বারী হা/২৩১১]
কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ দোয়াঃ
সকাল-সন্ধা তিন বার এই দোয়া পড়বেঃ
بِسْمِ اللهِ الّذِى لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَىْءٌ فِىْ الاَرْضِ وَلاَ فِى السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ
উচ্চারণঃ বিসমিলস্নাহিলস্নাযি লা ইয়াদুররম্ন মায়াস্ মিহী শাইউন ফিল আরদী ওয়া লা ফিস্সামায়ী ওয়া হুয়াস্সামীউল ‘আলীম।
সকাল-সন্ধা তিন বার এই দোয়া পড়বেঃ
اَعُوْذْ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ
উচ্চারণঃ আউযু বি কালীমাতিলস্নাহিত্ তাম্মাতি মিন শাররী মা খালাকা।
সকাল-সন্ধা তিন বার এই দোয়া পড়বেঃ
اَعُوْذْ بِاللهِ السَّمِيْعِ الْعَلِيْمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ
উচ্চারণঃ আউযু বিলস্নাহিস্ সামীয়ীল ‘আলীমি মিনাশ্ মাইতানির রাযীম।
সকাল সন্ধ্যায় তিন বার قُلْ هُوَ اللهُ শরীফ (সূরাঃ ইখলাস) এবং তিন বার قُلْ اَعُوْذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ (সূরাঃ ফালাক) পড়িবে, এবং তিন বার قُلْ اَعُوْذُ بِرَبِّ النَّاَسِ (সূরাঃ নাস) পড়িবে।
সকাল-সন্ধা এই দোয়াটিও বেশি বেশি পড়া যায়-
اللهُمَّ اِنِّى اَعُوْذُ بِكَ مِنَ الكَسَلِ وَالْحَرَمِ وَسُوْءِ الْكِبَرِ وفِتْنَةِ الدُّنْياَ وَ عَذاَبِ الْقَبْرِ
উচ্চারণঃ আলস্নাহুম্মা ইন্নী আউযুবিকা মিনাল কাসালি ওয়াল হারামী ওয়া সুইল কিবারি ওয়া ফিতনাতিদ্ দুনিয়া ওয়া আযাবিল কবরি।
ভোরে এই দোয়া পড়িবেঃ
اَصْبَحْنَا وَاَصْبَحَ الْمَلِكُ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ, اَلّلهُمَّ اِنِّىْ اَسْئَلُكَ خَيْرَ هذَا الْيَوْمِ وَفَتْحَه وَنَصْرَه وَنُوْرَه وَبَرَكَتَه وَهُدَاه وَاَعُوْذُبِكَ مِنْ شَرِّمَا فِيْه وَشَرِّمَا بَعْدَه-
উচ্চারণঃ আসবাহনা ওয়া আসবাহাল মালিকু লিলস্নাহি রাব্বীল আলামীন, আলস্নাহুম্মা ইন্নী আসআলূকা খাইরা হাযাল ইয়াওমি ওয়া ফাতহাহু ওয়া নাসরাহু ওয়া নূরাহু ওয়া হুদাহু ওয়া আউযুবিকা মিন শাররী মা ফিহি ওয়া শাররী মা বাদাহু।
এই দোয়াটিও সকাল সন্ধ্যায় পড়া যাবেঃ
اَللّهُمَّ بِكَ اَصْبَحْنَا وَبِكَ اَمْسَيْنَا وَبِكَ نَحْنَ وَبِكَ نَمُوْتُ وَاِلَيْكَ النُّشُوْرُ-
উচ্চারণঃ আলস্নাহুম্মা বিকা আসবাহনা ওয়া বিকা আমসাইনা ওয়া বিকা নাহয়া
দৈনিক সকাল সন্ধ্যা কম পক্ষে দশ বার করিয়া এই কালেমায়ে শাহাদাত অবশ্যই পরিবেঃ
لَا اِلهَ اِلّااللهُ وَحْدَه لَا شَرِيْكَ لَه – لَه الْمُلْكُ وَلَه الْحَمْدُ, وَهُوَ عَلى كُلِّ شَيْئٍ قَدِيْرٌ-
উচ্চারণঃ লা ইলাহা ইলস্নালস্নাহু ওয়াহদাহু লা শারীকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু, ওয়া হুয়া আলা কুলিস্ন শাইয়িন কাদীর।
এই তসবীহটি সকাল সন্ধ্যায় একশত বার করিয়া পরিবেঃ
سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِه, سُبْحَانَ اللهِ الْعَظِيْمِ*
উচ্চারণঃ সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী, সুবহানাল্লাহি আজীম।
খাবার খাওয়ার কিছু সুন্নত আমলঃ খানা সামনে আসলে এই দোয়া পড়বে –
اَللّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِيْما رَزَقْتَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা বারিকলানা ফিমা রাজাকতানা ওয়া কিনা আ‘জাবান নার।
খানা খাওয়ার শুরুতে এই দোয়া পড়বে-
بِسْمِ اللّهِ وَ عَلى بَرَكَةِ اللهِ
উচ্চারণঃ বিস্মিল্লাহি ও‘আলা বারাকাতিল্লাহ
খানার শুরুতে দোয়া পড়তে ভুরে গেলে খানার মাঝে স্মরণ আসার পর এই দোয়া পড়বে-
بِسْمِ اللهِ أَوَّلَه وَآخِرَه
উচ্চারণঃ বিসমিল্লাহি আউয়্যালাহু ওয়া আখীরাহ।
খানার শেষে এই দোয়া পড়বে –
اَلْحَمْدُ لِلّهِ الَّذِيْ اَطْعَمَنَا وَ سَقَانَا وَ جَعَلَنَا مِنَ الْمُسْلِمِيْن.
উচ্চারণঃ আলহামদুলিল্লাহিল্লাজী আতআ‘মানা ওয়া ছাক্বানা ওয়া জাআলানা মিনাল মুসলিমীন।
দাওয়াত খাওয়ার পর এই দোয়া পড়বে –
اَللّهُمَّ اَطْعِمْ مَنْ اَطْعَمَنِيْ وَ اَسْقِ مَنْ سَقَانِيْ
উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা আতঈম মান আত‘আামনী ওয়া আস্কী মান সাকানী।
রাতে ঘুমানোর পূর্বে আমল ঃরাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলিম যদি দুইটি কাজ নিয়মিত করতে পারে তাহলে জান্নাতে প্রবেশ করবে। কাজ দুইটি খুবই সহজ কিন্তু করার মানুষ খুব কম। প্রথমত, প্রত্যেক সালাতের পরে ১০ বার ‘সুবহানাল্লাহ’, ১০ বার ‘আল-হামদুলিল্লাহ ‘ ও ১০ বার ‘আল্লাহু আকবার’ বলবে। এতে ১৫০ বার জিহ্বার জিকর হবে এবং আল্লাহর কাছে আমলনামায় বা মিজানে ১৫০০ সাওয়াব হবে। দ্বিতীয়ত, বিছানায় শয়ন করার পরে ৩৪ বার ‘আল্লাহু আকবার’, ৩৩ বার ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ ও ৩৩ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ বলবে। এতে মুখে ১০০ বার ও মিজানে ১ হাজার বার হবে। রাসুল (সা.) আঙুলে গুনে গুনে তা দেখান। সাহাবিরা প্রশ্ন করেন, ‘এই দুইটি কর্ম সহজ হওয়া সত্ত্বেও পালনকারী কম কেন?’ তিনি উত্তরে বলেন, ‘কেউ শুয়ে পড়লে শয়তান এসে এগুলো বলার আগেই ঘুম পাড়িয়ে দেয়। সালাতের পরে এগুলো বলার আগেই তাকে তার বিভিন্ন কথা মনে করিয়ে দেয়।’ (আবু দাউদ, ইবনে হিব্বান, তারগিব)।
আয়াতুল কুরসি : বোখারি বর্ণিত হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি যে, কেউ রাতে বিছানায় শয়ন করার পরে আয়াতুল কুরসি পাঠ করলে সারা রাত আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে হেফাজত করা হবে এবং কোনো শয়তান তার কাছে আসতে পারবে না।
সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত : আবু মাসউদ (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যদি কেউ রাতে সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পাঠ করে তবে তা তার জন্য যথেষ্ট হবে।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
সূরা কাফিরুন : নাওফাল আল-আশজায়ী (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে বলেছেন, তুমি সূরা ‘কাফিরুন’ পড়ে ঘুমাবে, এ শিরক থেকে তোমার বিমুক্তি।’ (তিরমিজি, আবু দাউদ)।
সূরা এখলাস : আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) তাঁর সাহাবিদের বললেন, ‘তোমরা কি পারবে না রাতে কোরআনের এক-তৃতীয়াংশ তেলাওয়াত করতে? বিষয়টি তাদের কাছে কষ্টকর মনে হলো। তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমাদের মধ্যে কে-ই বা তা পারবে? তখন তিনি বলেন, কুল হুআল্লাহু আহাদ সূরাটি কোরআনের এক-তৃতীয়াংশ।’ আবু দারদা (রা.) থেকে একই অর্থে আরেকটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। (বোখারি ও মুসলিম)।
সূরা এখলাস, ফালাক ও নাস একত্রে (তিনবার) : দুই হাত একত্র করে এ সূরাগুলো পাঠ করে হাতে ফুঁ দিয়ে হাত দুইটি যথাসম্ভব শরীরের সর্বত্র বুলানো- এভাবে তিনবার করতে হবে। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতি রাতে বিছানায় গমনের পরে তাঁর মোবারক দুইটি হাত একত্রিত করে তাতে ফুঁ দিতেন এবং তাতে উপরের তিনটি সূরা পাঠ করতেন। এরপর শরীরের যতটুকু স্থান সম্ভব দুই হাত দিয়ে মাসেহ করতেন। মাথা, মুখ ও শরীরের সামনের দিক থেকে শুরু করতেন। এভাবে তিনবার করতেন।’ (বোখারি)।
অজু অবস্থায় ঘুমাতে যাওয়া : ঘুমের জন্য অজু অবস্থায় শয়ন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাসনুন ইবাদত। রাসুলুল্লাহ (সা.) এজন্য বিশেষভাবে উৎসাহ প্রদান করেছেন এবং এ জন্য বিশেষ দুইটি পুরস্কারের সুসংবাদ প্রদান করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের দেহগুলোকে পবিত্র রাখবে, আল্লাহ তোমাদের পবিত্র করুন। যদি কোনো বান্দা অজু অবস্থয় ঘুমান, তবে তার পোশাকের মধ্যে একজন ফেরেশতা শুয়ে থাকেন। রাতে যখনই এ ব্যক্তি নড়াচড়া করে তখনই এ ফেরেশতা বলেন, ‘হে আল্লাহ আপনি এ ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দিন, কারণ সে অজু অবস্থায় ঘুমিয়েছে।’ (ইবনে হিব্বান, তাবারানি, সহিহুত তারগিব)। অন্য হাদিসে মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে কোনো মুসলিম যদি অজু অবস্থায় (আল্লাহর জিকরের ওপর) ঘুমায়, এরপর রাতে কোনো সময় হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে যায় এবং সে (ওই অবস্থায় শুয়ে শুয়ে) আল্লাহর কাছে তার জাগতিক বা পারলৌকিক কোনো কল্যাণ কামনা করে তবে আল্লাহ তাকে তার পার্থিত বস্তু দেবেনই।’ (আবু দাউদ, সহিহ তারগিব, নাসাঈ)। ঘুমের আগে অজু করে সম্ভব হলে ২/৪ রাকাত সালাত আদায় করে ঘুমাবেন। বিশেষত যারা শেষ রাতে তাহাজ্জুদের জন্য উঠতে পারবেন না বলে ভয় পাবেন, তারা ঘুমানোর আগে ২/৪ রাকাত ‘কিয়ামুল্লাইল’ আদায় করে ঘুমাবেন।
চারজন সর্বশ্রেষ্ঠ জান্নাতী নারীর কাহিনী
আল্লাহর রসুল (স) একবার চারটা দাগ কেটে সাহাবীদের (রা) জিজ্ঞেস করলেন
” তোমরা কি জানো এগুলো কি?” সাহাবিগণ উত্তর দিলেন ” আল্লাহ ও তাঁর রাসুল ভাল জানেন” ।
রসুল (স) বললেন ” সর্বশ্রেষ্ঠ চার জান্নাতি নারী হল
1-খাদিজাহ বিনতে খুআইলিদ,
2- ফাতিমাহ্ বিনতে মুহাম্মাদ(সা)
3- মারিয়াম বিনতে ইমরান ( ঈসা আর এর মা ) এবং
4-আসিয়াহ্ বিনতে মুযাহিম ( ফেরাউনের স্ত্রী) ।
খাদিজাহ (রা )হল প্রথম ব্যক্তি যিনি আল্লাহর রাসুলের প্রতি ইমান এনেছিলেন। কেন তাকে সর্বশ্রেষ্ঠ নারীদের একজন বলা হয়েছে? এটা কি তাঁর ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য?
নাকি তাঁর জ্ঞানের জন্য?
ঠিক কি কারণে তাঁকে এই উপাধি দেয়া হয়েছে তা নিয়ে আমাদের গভীর ভাবে চিন্তা করা দরকার।
বিশেষ করে আমাদের মা -বোনদের।
আমরা যদি এই চার মহীয়সী নারীর জীবন পর্যালোচনা করি তাহলে তাদের মধ্যে দুটি বিষয়ের মিল দেখি –
প্রথমত:
তাঁরা অত্যন্ত শক্তিশালী ইমানের অধিকারী ছিলেন। তাঁদের ইমান ছিল সর্বোচচ পর্যায়ের । এটা হল সেই রকম বিশ্বাস যাতে কোন ভাবেই চিড় বা ফাটল ধরানো যায়না।
যে অন্তরে বিশ্বাস আছে সে অন্তর চোখের দেখা, কানের শোনা কে উপেক্ষা করে তাঁর বিশ্বাসকে প্রাধান্য দেয়।
তাঁর কল্পনায় শুধুই থাকে বিশ্বাস । আর এঁদের সকলের ইমান যে বিশ্বাসের অনেক উঁচু পর্যায়ে ছিল ,এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
ফিরাউনের স্ত্রী , আসিয়াহ ( আ ) উদাহরণ ধরুন-
একজন মহিলা পৃথিবীতেে যা চাইতে পারে তার সবই তাঁর ছিল। আরামদায়ক জীবন, ধন সম্পদ, ধনী ও প্রভাবশালী স্বামী, ক্ষমতা, দাসদাসী, খাদেম। কিন্তু ইমানের স্বার্থে, আল্লাহর জন্য তিনি এর সবই পরিত্যাগ করতে রাজি ছিলেন।
তিনি বাস করতেন সে সময়ের সর্বোৎকৃষ্ট প্রাসাদে। কিন্তু তারপরও তিনি আল্লাহ সুবহানা তাআলার কাছে দুয়া করেছিলেন –
আর ঈমানদারদের ব্যাপারে ফেরাউনের স্ত্রীর উদাহরণ দিচ্ছেন –
যখন সে দোয়া করলো, ”
হে আমার রব, আমার জন্য তোমার কাছে জান্নাতে একটি ঘর বানিয়ে দাও …!
(66:11)
আমাদের বুঝতে হবে আসিয়াহ(আ) একটি অত্যন্ত বিষাক্ত পরিবেশে ছিলেন, যা ছিল সব দিক থেকেই ইমানের পরিপন্থী। আল্লাহর শত্রুদের সাথেই ছিল তাঁর বসবাস। কুফরি শক্তিকে উপেক্ষা করে নিজেকে আল্লাহর পথে অটুট রেখে তিনি ইমানের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন ।
আমরা অপর তিন জনের জীবন পর্যালোচনা করলেও একই রকম বলীয়ান ইমানের দৃষ্টান্ত দেখতে পাই।
তাদের মধ্যে দ্বিতীয় যে ব্যপারটি ছিল তা হলো-
তাঁরা সর্বশ্রেষ্ঠ মা।
মরিয়ম (আ ) বড় করেছিলেন ঈসা( আ)কে আর আসিয়াহ্ (আ)বড় করেছিলেন মুসা (আ)কে ।
মা খাদিজাহ (রা) কে আল্লাহ এত মর্যাদা দিয়েছেন তা কিন্তু এই জন্য নয় যে তিনি অনেক সফল ব্যবসায়ী ছিলেন।
বরং তিনি ছিলেন আল্লাহর রসুল মুহাম্মদ (স) এর অসাধারণ এক সহধর্মিণী। আল্লাহর রাসুলের (স) যখনি প্রয়োজন, তখনি তিনি পাশে পেয়েছিলেন খাদিজা (রা)কে ।
ইসলামের শিশু অবস্থায় সবচেয়ে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন মা খাদিজা ( রা)।
আল্লাহর রাসুল (স) নবুয়তের শুরুতে সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতিতে অবিচল সাহস আর প্রেরণা দিয়েছেন মা খাদিজাহ্ (রা)।রাসূল ( সা) কে একজন অভিভাবকের মতো আগলে রেখে হেরা গূহায় ধ্যান রত অবস্থায় কি অকৃত্রিম বন্ধুর মতো সেবা করেছেন সে ইতিহাস অনেকেরই জানা ।
আর ফাতিমা(রা) ছিলেন রসূল ( সা ) সবচেয়ে ছোট ও আদরের কন্যা এবং আমিরুল মু’মিনীন আলীর (রা) সহধর্মিণী।
আলী অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন। ঘরের কাজ করতে ফাতিমাকে(রা)কে অনেক কষ্ট পেতে হত।
আটা পিষতে পিষতে তাঁর কোমল হাতে কঠিন ক্ষত হয়ে গিয়েছিল । অথচ তিনি ছিলেন সর্ব শ্রেষ্ঠ রাসূল এবং তৎকালীন মদিনা ইসলামি রাষ্ট্রের কর্ণধারের সম্মানিত কন্যা!
একবার আলী (রা ) এর ইচ্ছায় তাঁরা আল্লাহর রাসুল (স) এর কাছে একজন ভৃত্য প্রার্থনা করলেন।
আল্লাহর রসুল (স) তাদের জবাবে বললেন আমি তোমাদের এরচেয়েও উত্তম কিছু শিখিয়ে দিচ্ছি।
তোমরা শুতে যাবার আগে 33 সুবহানাল্লাহ ,
33 বার আলহামদুলিললাহ এবং
34 আল্লাহু আকবর পড়বে ।
ফাতিমাকে আল্লাহর রাসুল (স) অত্যন্ত ভালবাসতেন।
তিনি বলেছিলেন ফাতিমা আমার দেহের অংশ,
সে যাতে খুশি হয় , আমিও তাতে খুশি হই। সে যাতে কষ্ট পায়, আমিও তাতে কষ্ট পাই। ফাতিমা(রা) ছিলেন আল্লাহর রাসুলের (সা) অত্যন্ত আদরের সন্তান।
তিনি পৃথিবীতেই জাননাতের সু- সংবাদ পেয়েছিলেন । তিনি হবেন জাননাতের নারীদের কর্ণধার! সুবহান আললাহ!
তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত একমাত্র তিনি ই ছিলেন তাঁর জীবিত সন্তান ।
আল্লাহর রাসুল (স) চাইলে ফাতিমা( রা)কে একজন কেন, দশ জন খাদেম দিতে পারতেন । কিন্তু তিনি তা না করে ফাতিমাকে(রা) কে উপদেশ দিলেন, ঘরের কাজ নিজের হাতে করে যেতে।
আর হয়তো এই কারণেই ফাতিমা (রা) হয়ে উঠলেন চার সর্বশ্রেষ্ঠ নারীদের একজন।
জ্ঞানের দিক থেকে যদিও মা আয়েশা (রা )খাদিজাহ(রা) ও ফাতেমার (রা )উপরে, কিন্তু মর্যাদার দিক থেকে উনি খাদিজাহ(রা) ও ফাতেমার(রা) সমকক্ষ ছিলন না।
আমাদের বোনেরা, আপনারা যখন আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করবেন তখন আপনাদের কিসের উপর বেশি প্রাধান্য দেয়া দরকার তা ঠিক করে নেবেন ।
তথাকথিত নারীবাদীরা আপনাদের কে জাগতিক ব্যপারে কিছুটা সাহায্য করলেও আখিরাতে জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা করতে পারবে না ।
হযরত ফাতেমা জাহরা (রাঃ) ছিলেন নারী ও পুরুষ তথা
গোটা মানব জাতির জন্য অসাধারণ ত্যাগ, বিশ্বস্ততা, অন্যায়ের ব্যাপারে
আপোসহীনতা, সততা, দানশীলতা, ধৈর্য, চারিত্রিক পবিত্রতা, আল্লাহর প্রতি
সন্তুষ্টিসহ অনেক মহান স্বর্গীয় গুণের আদর্শ। আর এ জন্যেই তাঁর উপাধি ছিল আস-সিদ্দিক্বা
বা সত্য-নিষ্ঠ, আল-মুবারাকাহ বা বরকতপ্রাপ্ত, আত-ত্বাহিরা বা পবিত্র, আল-মারজিয়া বা
আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, আয যাকিয়া বা সতী, আয জাহরা বা দ্যূতিময় প্রভৃতি।
স্নেহময়ী জননীর মত বিশ্বনবী (সাঃ)’র সেবা-যত্ন করা এবং বিপদের সময়
তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য মহীয়সী নারী ফাতিমা (রাঃ)’র অন্য একটি
নাম উম্মে আবিহা বা পিতার জননী। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁকে সকল
যুগের নারীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে উল্লেখ করেছেন এবং আল্লাহর দরবারে তাঁর বিশেষ
মর্যাদার কারণে তাঁকে দেখলে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করতেন।
মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ফাতেমা আমার দেহের অংশ, যা কিছু তাকে সন্তুষ্ট
করে তা আমাকে সন্তুষ্ট করে এবং যা কিছু আমাকে সন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও
সন্তুষ্ট করে, আর যা কিছু ফাতেমাকে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়,
আর যা আমাকে কষ্ট দেয়, তা আল্লাহকেও কষ্ট দেয়।
হযরত ফাতিমা (রাঃ) বেহেশতে সর্ব প্রথম প্রবেশ করবেন বলে বিশ্বনবী- সাঃ উল্লেখ করেছেন।
অনেক ইসলামী বর্ণনা অনুযায়ী পবিত্র কোরআনের সূরা কাওসার-এ
উল্লেখিত কাওসার বলতে হযরত ফাতেমা (রাঃ) কেই বোঝানো হয়েছে।
মক্কার কাফের ও মুশরিকরা যখন বিশ্বনবী (সাঃ)কে আবতার বা নির্বংশ বলে উপহাস করতো, এবং
রাসূলের ওফাতের পরই তার ধর্ম শেষ হয়ে যাবে বলে প্রচার করতো তখন এই সূরা নাজেল হয়।
এ সূরায় কাফেররাই নির্বংশ হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
হযরত ফাতিমা (রাঃ)’র মাধ্যমে রাসূলে পাক (সাঃ)’র বংশধারা আজো অব্যাহত রয়েছে।
অন্যদিকে নির্মূল হয়ে গেছে আবু লাহাব ও আবু জাহেলদের বংশধর।
হযরত ফাতিমা (রাঃ) ছিলেন বিশ্বনবী (সাঃ) ‘র আহলে বাইত বা পবিত্র
বংশধারায় জন্ম নেয়া মুসলমানদের ১১ জন ইমামের জননী।
বিশ্বনবী (সাঃ) ও স্বামী আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (রাঃ)’র পর এই ১১ জনই
ইসলামকে সব সংকট ও দূর্যোগের কবল থেকে রক্ষার তরী হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন।
এরই প্রমাণ দেখা যায় কারবালায় তাঁর পুত্র হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)ও এর আগে হযরত ইমাম
হাসান (রাঃ)’র নজিরবিহীন আত্মত্যাগে। মুসলমানদের নেতা হিসেবে ও বেহেশতী
যুবকদের সর্দার হিসেবে এই দুই মহাপুরুষকে গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন হযরত ফাতেমা (রাঃ)।
বিশ্বনবী (সাঃ) তাঁদেরকে নিজ সন্তান বলে উল্লেখ করতেন।
একজন পরিপূর্ণ আদর্শ মানুষ হিসেবে হযরত ফাতিমা (রাঃ) এটা প্রমাণ করেছেন যে,
পরিপূর্ণতার শিখরে ওঠার জন্য নারী হওয়া বা পুরুষ হওয়া জরুরী কোনো শর্ত নয়।
তিনি জন্ম নিয়েছিলেন এমন এক যুগে যখন আরবরা নারীকে মনে করতো কেবল ভোগের সামগ্রী এবং
জাত্যাভিমানী আরবদের ঘরে কণ্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করলে তারা
অমর্যাদার ভয়ে কণ্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিত বা গোপনে মেরে ফেলতো ।
কিন্তু মহান আল্লাহ তার সর্বশেষ রাসূল ও সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের ঘরে একজন কন্যা
সন্তান পাঠিয়ে নারী জাতির জন্য অশেষ সম্মান ও মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন।
হযরত ফাতিমা (রাঃ) ছিলেন একজন আদর্শ জননী,একজন আদর্শ স্ত্রী বা গৃহিনী,একজন আদর্শ সমাজ-সেবিকা।
অর্থাৎ মুসলিম নারী যে শালীনতা বজায় রেখে জীবনের সবক্ষেত্রে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে তাঁর দৃষ্টান্ত দেখিয়ে গেছেন নবী-নন্দিনী।
আজকের যুগে যেসব মহিলা বা বুদ্ধিজীবী নারী-মুক্তির কথা ভাবছেন তাদের জন্য প্রকৃত আদর্শ হওয়া উচিত হযরত ফাতিমা (রাঃ)।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)’র ওফাতের পর খুব বেশি দিন বাঁচেন নি হযরত ফাতিমা (রাঃ)।
এ সময় ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও বাণীকে জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার
জন্য অসম-সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন নবী-নন্দিনী।
বিশ্বনবী (সাঃ)’র ওসিয়ত প্রচার এবং কিভাবে মুসলমানরা বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা
পাবে তা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন
বলে মনে করেন অনেক মুসলমান বিশেষজ্ঞ,ঐতিহাসিক ও আলেম।
তাদের মতে, ঐসব নির্যাতনের কারণেই তাঁকে অকালে শাহাদত বরণ করতে হয়েছে।
এমনকি অনেকে মনে করেন, তাঁর কবরও অবমাননার শিকার হতে পারে এমন
আশঙ্কায় তিনি তাকে গোপনে গভীর রাতে দাফন করতে বলেছিলেন স্বামী আমিরুল
মুমিনীন হযরত আলী (রাঃ) কে। আজো সকল শ্রেষ্ঠ গুণে গুণান্বিত এই মহিয়সী ও নীর্ভিক সংগ্রামী নারীর কবর অচিহ্নিত।
অন্যদিকে অন্য অনেক মুসলমান মনে করেন,
রাসূল (সাঃ)’র বিয়োগ-ব্যথায় শোকাকুল হযরত ফাতিমা (রাঃ) স্বাভাবিকভাবেই মারা গিয়েছিলেন
এবং তিনি কারো নির্যাতনের কারণে মারা যান নি।
যাই হোক্, হযরত ফাতিমা (রাঃ) মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ ও মুক্তির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন।
তাই মুক্তিকামী মুসলমানরা আজও কেবল তাঁর পবিত্র নাম স্মরণ করেই ইসলামের জন্য জীবন বিলিয়ে দিতে দ্বিধা বোধ করেন না।
হযরত ফাতিমা (রাঃ)’র সান্নিধ্য ও সেবা না পেলে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী(রাঃ)’র জীবনও
পুরোপুরি বিকশিত ও পরিপূর্ণতা লাভ করতো না। তাঁরা ছিলেন একে-অপরের প্রতি পুরোপুরি সন্তুষ্ট।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) হযরত ফাতিমা (রাঃ)-কে মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতা বলেও প্রশংসা করেছেন।
তিনি বলতেন,আমি যখনই বেহেশতের সুবাস পেতে চাইতাম তখনই কণ্যা ফাতেমার ঘ্রাণ নেই।
রাসূল (সাঃ)একবার প্রাণপ্রিয় কণ্যাকে বলেছিলেন, হে ফাতেমা! আল্লাহ তোমাকে নির্বাচিত করেছেন,
তোমাকে পরিপূর্ণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় সজ্জিত করেছেন এবং তোমাকে বিশ্বের নারীকূলের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।
হযরত ইমাম হাসান মুজতাবা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, একবার শুক্রবার রাতে
দেখলাম মা ফাতিমা (রাঃ) এবাদতে মগ্ন। একটানা রূকু ও আর সেজদায় থাকতে থাকতে ভোরের আলো ফুটে উঠলো।
আমি শুনতে পেলাম তিনি মুমিন নারী ও পুরুষের জন্য অনেক দোয়া করছেন,কিন্তু নিজের
জন্য কোনো দোয়াই করলেন না। আমি প্রশ্ন করলাম, মা, আপনি কেন নিজের জন্য দোয়া করলেন না,
যেভাবে অন্যরা দোয়া করে থাকে?তিনি জবাবে বললেন, হে আমার পুত্র! আগে প্রতিবেশির কথা ভাবতে হবে, এরপর নিজের ঘরের কথা … ।
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করা ছাড়াও প্রায়ই
রোজা রাখা ও গরীব-দূঃখীকে অসাধারণ মাত্রায় দান-খয়রাত করা ছিল হযরত ফাতিমা (রাঃ) ’র একটি বড় বৈশিষ্ট্য।
জনসাধারণ বা কারো উদ্দেশ্যে যে কোনো বক্তব্য রাখার আগে দীর্ঘক্ষণ ধরে মহান
আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামতের কথা খুব সুন্দর ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায় তুলে ধরে আল্লাহর প্রশংসা করা ছিল তাঁর অন্য একটি বড় বৈশিষ্ট্য।
বিশ্বনবী (সাঃ)’র আহলে বাইতের অন্য সদস্যদের মত তিনিও কখনও অন্যায়ের সাথে আপোস করেন নি।
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা বা সক্রিয় থাকার মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন আনন্দ।
হযরত ফাতিমা (রাঃ) বলেছেন, আল্লাহর সেবায় মশগুল হয়ে যে সন্তুষ্টি পাই তা
আমাকে অন্য সব সন্তুষ্টি বা আনন্দ থেকে বিরত রাখে এবং সব সময় মহান আল্লাহর
সুন্দর দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ রাখার প্রার্থণা ছাড়া আমার অন্য কোনো প্রত্যাশা নেই।
হযরত খাদিজাতুল কুবরা রাদিয়াল্লাহু ঃ-নাম তাঁর খাদীজা। কুনিয়াত ‘উম্মু হিন্দ’ এবং লকব ‘তাহিরা’।
পিতা খুওয়াইলিদ, মাতা ফাতিমা বিনতু যায়িদ। জন্ম ‘আমুল ফীল’ বা হস্তীবর্ষের পনের বছর আগে মক্কা নগরীতে।
পিতৃ-বংশের উর্ধ পুরুষ কুসাঈ-এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর সা. নসবের সাথে তাঁর নসব মিলিত হয়েছে।
জাহিলী যুগেই পূতপবিত্র চরিত্রের জন্য ‘তাহিরা’ উপাধি লাভ করেন।
(আল–ইসাবা) রাসূলুল্লাহ সা. ও খাদীজার রা. মধ্যে ফুফু-ভাতিজার দূর সম্পর্ক ছিল।
এ কারণে, নবুওয়াত লাভের পর খাদীজা রা. রাসূলুল্লাহকে সা. তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবন
নাওফিলের কাছে নিয়ে গিয়ে বলেন, ‘আপনার ভাতিজার কথা শুনুন।’ সম্ভবতঃ বংশগত সম্পর্কের ভিত্তিতেই তিনি একথা বলেছিলেন।
পিতা খুওয়াইলিদ তৎকালীন আরব সমাজের বিশিষ্ট তাওরাত ও ইনজীল বিশেষজ্ঞ ওয়ারাকা ইবন নাওফিলকে
খাদীজার বর নির্বাচন করেছিলেন, কিন্তু কেন যে তা বাস্তবে রূপ লাভ করেনি সে সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা নীরব।
শেষ পর্যন্ত আবু হালা ইবন যারারাহ আত-তামীমীর সাথে তাঁর প্রথম বিয়ে হয়।
জাহিলী যুগেই তাঁর মৃত্যু হয়। আবু হালার মৃত্যুর পর ’আতীক বিন আবিদ আল-মাখযুমীর সাথে তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে হয়।
(শারহুল মাওয়াহিব, আল–ইসতিয়াব) তবে কাতাদার সূত্রে জানা যায়, তাঁর প্রথম স্বামী ’আতীক, অতঃপর আবু হালা।
ইবন ইসহাকও এ মত সমর্থন করেছেন বলে ইউনুস ইবন বুকাইর বর্ণনা করেছেন।
(আল ইসাবাঃ ৪/২৮১) তবে প্রথমোক্ত মতটি ইবন আবদিল বার সহ অধিকাংশের মত বলে ইবন হাজার উল্লেখ করেছেন।
খাদীজার পিতা খুওয়াইলিদ ইবন আসাদ ছিলেন ফিজার যুদ্ধে নিজ গোত্রের কমাণ্ডর।
তিনি ছিলেন বহু সন্তানের জনক। প্রথম পুত্র হিযাম।
এই হিযামের পুত্র প্রখ্যাত সাহাবী হাকীম জাহিলী যুগে মক্কার ‘দারুন নাদওয়ার’ পরিচালনভার লাভ করেছিলেন।
দ্বিতীয় সন্তান হযরত খাদীজা। তৃতীয় সন্তান ‘আওয়াম’ প্রখ্যাত সাহাবী হযরত যুবাইরের রা. পিতা।
রাসূলুল্লাহর সা. ফুফু এবং হযরত হামযার আপন বোন হযরত সাফিয়্যা রা. ছিলেন ‘আওয়ামের’ স্ত্রী বা যুবাইরের রা. মা।
সাফিয়্যা ছিলেন খাদীজার ছোট ভাইয়ের বউ। চতুর্থ সন্তান হালা।
তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. মেয়ে হযরত যয়নাবের রা. স্বামী আবুল আস ইবন রাবী’র মা।
আবূল আ’স রাসূলুল্লাহর সা. বড় জামাই। পঞ্চম সন্তান রুকাইয়া।
পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে হিযাম, আওয়াম এবং রুকাইয়া ইসলামের আবির্ভাবের আগেই মারা যান।
হযরত খাদীজা ও হালা ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন।
খাদীজার পিতার মৃত্যু কখন হয়েছিল, সে সম্পর্কে মতভেদ আছে।
কেউ বলেছেন, ‘ফিজার’ যুদ্ধে মারা যান। ইমাম সুহাইলীর মতে ফিজার যুদ্ধের আগেই মারা যান।
তখন খাদীজার বয়স পঁয়ত্রিশ। কারো কারো মতে রাসূলুল্লাহর সা. বিয়ের পর তিনি মারা যান। (হায়াতুস সাহাবা– ২/৬৫২)।
পিতা বা স্বামীর মৃত্যু বা যে কোন কারণেই হোক কুরাইশ বংশের অনেকের মত খাদীজাও ছিলেন একজন বড় ব্যবসায়ী।
ইবন সা’দ তাঁর ব্যবসায় সম্পর্কে বলছেনঃ ‘খাদীজা ছিলেন অত্যন্ত সম্মানিত ও সম্পদশালী ব্যবসায়ী মহিলা।
তাঁর বাণিজ্য সম্ভার সিরিয়া যেত এবং তাঁর একার পণ্য কুরাইশদের সকলের পণ্যের সমান হতো।’
ইবন সা’দের এ মন্তব্য দ্বারা খাদীজার ব্যবসায়ের পরিধি উপলব্ধি করা যায়।
অংশীদারী বা মজুরী বিনিময়ে যোগ্য লোক নিয়োগ করে তিনি দেশ বিদেশে মাল কেনাবেচা করতেন।রাসূলুল্লাহ সা. তখন পঁচিশ বছরের যুবক। এর মধ্যে চাচা আবু তালিবের সাথে বা একাকী কয়েকটি বাণিজ্য সফরে গিয়ে ব্যবসায় সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছেন।
ব্যবসায়ে তাঁর সততা ও আমানতদারীর কথাও মক্কার মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।
সবার কাছে তিনি তখন আল-আমীন। তাঁর সুনামের কথা খাদীজার কানেও পৌঁছেছে।
বিশেষতঃ তাঁর ছোট ভাই-বউ সাফিয়্যার কাছে আল-আমীন মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে বহু কথাই শুনে থাকবেন।
হযরত খাদীজা একবার কেনাবেচার জন্য সিরিয়ায় পণ্য পাঠাবার চিন্তা করলেন।
যোগ্য লোকের সন্ধান করছেন।
এ প্রসঙ্গে ওয়াকিদী থেকে যারকানীর বর্ণনাঃ ‘আবু তালিব মুহাম্মাদকে সা. ডেকে বললেনঃ ভাতিজা! আমি একজন দরিদ্র মানুষ, সময়টাও খুব সঙ্কটজনক।
মারাত্মক দুর্ভিক্ষের কবলে আমরা নিপতিত। আমাদের কোন ব্যবসায় বা অন্য কোন উপায়-উপকরণ নেই। তোমার গোত্রের একটি বাণিজ্য কাফিলা সিরিয়া যাচ্ছে।
খাদীজা তাঁর পণ্যের সাথে পাঠানোর জন্য কিছু লোকের খোঁজ করছে। তুমি যদি তার কাছে যেতে, হয়তো তোমাকেই সে নির্বাচন করতো। তোমার চারিত্রিক নিষ্কলুষতা তার জানা আছে।
যদিও তোমার সিরিয়া যাওয়া আমি পছন্দ করিনে এবং ইয়াহুদীদের পক্ষ থেকে তোমার জীবনের আশঙ্কা করি, তবুও এমনটি না করে উপায় নেই।’ জবাবে রাসূল সা. বললেন, সম্ভবতঃ সে নিজেই লোক পাঠাবে।
আবু তালিব বললেনঃ হয়তো অন্য কাউকে সে নিয়োগ করে ফেলবে।
চাচা-ভাতিজার এ সংলাপের কথা খাদীজার কানে গেল। ‘তিনি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট লোক পাঠালেন।’ (টীকা, সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৮) উল্লেখ থাকে যে, কৈশোরে একবার রাসূল সা. চাচার সাথে সিরিয়া গিয়েছিলেন।
তখন পাদরী ‘বুহাইরা’ রাসূলুল্লাহ সা. সম্পর্কে আবু তালিবকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন্।
উপরোক্ত বর্ণনায় আবু তালিব সে দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।
খাদীজা লোক মারফত মুহাম্মাদের সা. কাছে প্রস্তাব পাঠালেন, তিনি যদি ব্যবসায়ের দায়িত্ব নিয়ে সিরিয়া যান, অন্যদের তুলনায় খাদীজা তাঁকে দ্বিগুণ মুনাফা দেবেন। মুহাম্মাদ সা. রাজী হলেন।
খাদীজার রা. পণ্য-সামগ্রী নিয়ে তাঁর বিশ্বস্ত দাস মায়সারাকে সঙ্গে করে মুহাম্মাদ সা. চললেন সিরিয়া।
পথে এক গীর্জার পাশে একটি গাছের ছায়ায় বসে আছেন তিনি। গীর্জার পাদ্রী এগিয়ে গেলেন মায়সারার দিকে।
জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘গাছের নিচে বিশ্রামরত লোকাটি কে?’ মায়সারা বললেনঃ ‘মক্কার হারামবাসী কুরাইশ গোত্রের একটি লোক।’ পাদ্রী বললেনঃ ‘এখন এই গাছের নীচে যিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি একজন নবী ছাড়া আর কেউ নন।’ ঐতিহাসিকরা এই পাদ্রীর নাম ‘নাসতুরা’ বলে উল্লেখ করেছেন। (টীকা, সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৮) তবে ইবন হাজার ’আসকালানী এই পাদ্রীর নাম ‘বুহাইরা’ বলেছেন। (আল–ইসাবাঃ ৪/২৮১) তিনি আরো বলেছেন, এই বাণিজ্য সম্ভার নিয়ে রাসূল সা. বসরার বাজারে গিয়েছিলেন। তাবারী ইবন শিহাব যুহরী থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. খাদীজার পণ্য নিয়ে সিরিয়া নয়, বরং ইয়ামনের এক হাবশী বাজারে গিয়েছিলেন। তবে সিরিয়া যাওয়ার বর্ণনাটাই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। (তারীখুল উম্মাহ আল ইসলামিয়া, মুহাম্মদ আল–খিদরী বেকঃ ১/৬৪)
রাসূলুল্লাহ সা. সিরিয়ার বাজারে পণ্যদ্রব্য বিক্রী করলেন এবং যা কেনার তা কিনলেন। তারপর মায়সারাকে সঙ্গে করে মক্কার পথে রওয়ানা হলেন। পথে মায়সারা লক্ষ্য করলেন, রাসূল সা. তাঁর উটের ওপর সওয়ার হয়ে চলেছেন, আর দু’জন ফিরিশতা দুপুরের প্রচণ্ড রোদে তাঁর ওপর ছায়া বিস্তার করে রেখেছে। এভাবে মক্কায় ফিরে খাদীজার পণ্য-সামগ্রী বিক্রী করলেন।
ব্যবসায়ে এবার দ্বিগুণ অথবা দ্বিগুণের কাছাকাছি মুনাফা হলো। বাড়ী ফিরে বিশ্বস্ত ভৃত্য মায়সারা তাঁর মনিব খাদীজার নিকট পাদ্রীর মন্তব্য এবং সফরের অলৌকিক ঘটনাবলী সবিস্তার বর্ণনা করলেন। (সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৯)
হযরত খাদীজা রা. ছিলেন এক বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমতি ভদ্র মহিলা। তাঁর ধন-সম্পদ, ভদ্রতা ও লৌকিকতায় মক্কার সর্বস্তরের মানুষ মুগ্ধ ছিল। অনেক অভিজাত কুরাইশ যুবকই তাঁকে সহধর্মিনী হিসেবে লাভ করার প্রত্যাশী ছিল।
তিনি তাদের সকলকে প্রত্যাখ্যান করেন। মায়সারার মুখে সবকিছু শুনে খাদীজা নিজেই রাসূলুল্লাহর সা. নিকট বিয়ের পয়গাম পাঠান। (সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৯)
বিয়ের প্রস্তাব কিভাবে এবং কেমন করে হয়েছিল সে সম্পর্কে নানা রকম বর্ণনা রয়েছে।
তবে খাদীজাই যে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহর সা. নিকট প্রস্তাবটি পেশ করেন সে ব্যাপারে সব বর্ণনা একমত।
একটি বর্ণনায় এসেছে, খাদীজা রা. নিজেই রাসূলুল্লাহর সা. সাথে কথা বলেন এবং তাঁর পিতার নিকট প্রস্তাবটি উত্থাপন করার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি অস্বীকৃতি জানান এই বলে যে, দারিদ্রের কারণে হয়তো খাদীজার পিতা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করবেন।
অবশেষে খাদীজার পিতা যখন অতিরিক্ত মদপান করে মাতাল অবস্থায় ছিলেন তখন খাদীজা নিজেই বিষয়টি তাঁর কাছে উত্থাপন করেন এবং সম্মতি আদায় করেন। কিন্তু সুস্থ হয়ে আবার তিনি বেঁকে বসেন। তবে খাদীজা পুনরায় তাঁর সম্মতি আদায় করেন। (হায়াতুস সাহাবা– ২/৬৫২) অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, হযরত ইয়ালার স্ত্রী ও খাদীজার বান্ধবী ‘নাফীসা বিনতু মানিয়্যা’ এ ব্যাপারে পুরো উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
তিনিই সর্বপ্রথম খাদীজার পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট এভাবে প্রস্তাব পেশ করেনঃ ‘আপনাকে যদি ধন-সম্পদ, সৌন্দর্য ও জীবিকার নিশ্চয়তার দিকে আহ্বান জানানো হয়, আপনি কি গ্রহণ করবেন? ….এ কথাগুলি ছিল হযরত খাদীজা সম্পর্কে।
কথা পাকাপাকি হয়ে গেল। নির্ধারিত তারিখে আবু তালিব, হামযাসহ রাসূলুল্লাহর সা. খান্দানের আরো কিছু ব্যক্তি খাদীজার বাড়ী উপস্থিত হলেন। খাদীজাও তাঁর খান্দানের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। সকলের উপস্থিতিতে আবু তালিব বিয়ের খুতবা পাঠ করলেন। সাহিত্যিক উৎকর্ষের দিক দিয়ে এ খুতবা জাহিলী যুগের আরবী-গদ্য সাহিত্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। পাঁচশ’ স্বর্ণমুদ্রা মোহর ধার্য হয়। খাদীজা নিজেই উভয় পক্ষের যাবতীয় খরচ বহন করেছিলেন। তিনি দুই উকিয়া সোনা ও রুপো রাসূলুল্লাহর সা. নিকট পাঠান এবং তা দিয়ে উভয়ের পোশাক ও ওয়ালীমার বন্দোবস্ত করতে বলেন। (হায়াতুস সাহাবা– ২/৬৫২) এভাবে হযরত খাদীজা হলেন ‘উম্মুল মুমিনীন’। এটা নবুয়াত প্রকাশের পনের বছর পূর্বের ঘটনা। সে সময় তাঁদের উভয়ের বয়স সম্পর্কে সীরাত বিশেষজ্ঞদের মতপার্থক্য থাকলেও সর্বাধিক সঠিক মতানুযায়ী রাসূলুল্লাহর সা. বয়স ছিল পঁচিশ এবং খাদীজার চল্লিশ।
বিয়ের পনের বছর পর হযরত নবী করীম সা. নবুওয়াত লাভ করেন। তিনি খাদীজাকে রা. সর্বপ্রথম এ বিষয়ে অবহিত করেন। পূর্ব থেকেই খাদীজা রাসূলুল্লাহর সা. নবী হওয়া সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন।
সহীহ বুখারীর ‘ওহীর সূচনা’ অধ্যায়ে একটি হাদীসে বিষয়টির বিস্তারিত আলোচনা এসেছে। হযরত আয়িশা রা. বলেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি প্রথম ওহীর সূচনা হয় ঘুমে সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। স্বপ্নে যা কিছু দেখতেন তা সকাল বেলার সূর্যের আলোর ন্যায় প্রকাশ পেত। তারপর নির্জনে থাকতে ভালোবাসতেন। খানাপিনা সঙ্গে নিয়ে হিরা গুহায় চলে যেতেন।
সেখানে একাধারে কয়েকদিন ইবাদতে মশগুল থাকতেন। খাবার শেষ হয়ে গেলে আবার খাদীজার কাছে ফিরে আসতেন। খাদ্যদ্রব্য নিয়ে আবার গুহায় ফিরে যেতেন। এ অবস্থায় একদিন তাঁর কাছে সত্যের আগমণ হলো।
ফিরিশতা এসে তাঁকে বললেনঃ আপনি পড়ুন।তিনি বললেনঃ ‘আমি তো পড়া-লেখার লোক নই।’ ফিরিশতা তাঁকে এমন জোরে চেপে ধরলেন যে তিনি কষ্ট অনুভব করলেন। ছেড়ে দিয়ে আবার বললেনঃ ‘পড়ুন’। তিনি আবারো বললেনঃ ‘আমি পড়া-লেখার লোক নই’। ফিরিশতা দ্বিতীয় ও তৃতীয়বারও তাঁর সাথে প্রথমবারের মত আচরণ করলেন।
অবশেষে বললেনঃ ‘পড়ুন’ আপনার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্তপিণ্ড থেকে….’ রাসূল সা. ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরলেন। খাদীজাকে ডেকে বললেনঃ ‘আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও, কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও।’ তিনি ঢেকে দিলেন। তাঁর ভয় দূর হয়ে গেল।
তিনি খাদীজার নিকট পুরো ঘটনা খুলে বললেন এবং নিজের জীবনের আশংকার কথা ব্যক্ত করলেন। খাদীজা বললেনঃ না, তা কক্ষণো হতে পারে না। আল্লাহর কসম, তিনি আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না।
আপনি আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ়কারী, গরীব-দুঃখীর সাহায্যকারী, অতিথিপরায়ণ ও মানুষের বিপদে সাহায্যকারী। অতঃপর খাদীজা রা. রাসূলুল্লাহকে সা. সংগে করে তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবন নাওফিলের নিকট নিয়ে যান। সেই জাহিলী যুগে তিনি খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। হিব্রু ভাষায় ইনজীল কিতাব লিখতেন। তিনি বৃদ্ধ ও দৃষ্টিহীন। খাদীজা রা. বললেনঃ ‘শুনুন তো আপনার ভাতিজা কি বলে।’ তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘ভাতিজা তোমার বিষয়টি কি?’ রাসূলুল্লাহ সা. পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন। শুনে ওয়ারাকা বললেনঃ ‘এতো সেই ‘নামূস’-আল্লাহ যাঁকে মুসার আ. নিকট পাঠিয়েছিলেন। আফসুস! সে দিন যদি আমি জীবিত ও সুস্থ থাকতাম, যেদিন তোমার দেশবাসী তোমাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে।’ রাসূলুল্লাহ সা. জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘এরা আমাকে দেশ থেকে বের করে দেবে? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, তুমি যা নিয়ে এসেছো, যখনই কোন ব্যক্তি তা নিয়ে এসেছে, সারা দুনিয়া তাঁর বিরোধী হয়ে গেছে। যদি সে সময় পর্যন্ত আমি বেঁচে থাকি, তোমাকে সব ধরণের সাহায্য করবো। (বুখারী, ১ম খণ্ড) এ ঘটনার অল্প কিছুদিনের মধ্যে ওয়ারাকার মৃত্যু হয়।
ইসলাম গ্রহণের পর হযরত খাদীজা তাঁর সকল ধন-সম্পদ তাবলীগে দ্বীনের লক্ষ্যে ওয়াকফ করেন। রাসূল সা. ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে আল্লাহর ইবাদাত এবং ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। সংসারের সকল আয় বন্ধ হয়ে যায়। সেই সাথে বাড়তে থাকে খাদীজার দুশ্চিন্তা। তিনি ধৈর্য ও সহনশীলতার সাথে সব প্রতিকূল অবস্থার মুকাবিলা করেন। আল–ইসতিয়াব গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, ‘মুশরিকদের প্রত্যাখ্যান ও অবিশ্বাসের কারণে রাসূল সা. যে ব্যথা অনুভব করতেন, খাদীজার কাছে এলে তা দূর হয়ে যেত। কারণ, তিনি রাসূলকে সা. সান্ত্বনা দিতেন, সাহস ও উৎসাহ যোগাতেন। তাঁর সব কথাই তিনি বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করতেন। মুশরিকদের সকল অমার্জিত আচরণ তিনি রাসূলুল্লাহর সা. কাছে অত্যন্ত হালকা ও তুচ্ছভাবে তুলে ধরতেন।’ (তাবাকাত– ৩/৭৪০)
নবুওয়াতের সপ্তম বছর মুহাররম মাসে কুরাইশরা মুসলমানদের বয়কট করে। তাঁরা ‘শিয়াবে আবু তালিবে’ আশ্রয় গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহর সা. সাথে খাদীজাও সেখানে অন্তরীণ হন। প্রায় তিনটি বছর বনী হাশিম দারুণ দুর্ভিক্ষের মাঝে অতিবাহিত করে। গাছের পাতা ছাড়া জীবন ধারণের আর কোন ব্যবস্থা তাদের ছিল না। স্বামীর সাথে খাদীজাও হাসি মুখে সে কষ্ট সহ্য করেন। এমন দুর্দিনে হযরত খাদীজা রা. নিজের প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন উপায়ে কিছু খাদ্য খাবারের ব্যবস্থা মাঝে মাঝে করতেন। তাঁর তিন ভাতিজা- হাকীম ইবন হিযাম, আবুল বুখতারী ও যুময়া ইবনুল আসওয়াদ- তাঁরা সকলে ছিলেন কুরাইশ নেতৃবর্গের অন্যতম। অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা বিভিন্নভাবে মুসলমানদের কাছে খাদ্যশস্য পাঠানোর ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। একদিন হাকীম ইবন হিযাম তাঁর চাকরের মাধ্যমে ফুফু খাদীজার রা. কাছে কিছু গম পাঠাচ্ছিলেন। পথে আবু জাহল বাধা দেয়। হঠাৎ আবুল বুখতারী সেখানে উপস্থিত হন। তিনি আবু জাহলকে বললেন, এক ব্যক্তি তাঁর ফুফুকে সামান্য খাদ্য পাঠাচ্ছে, তুমি তা বাধা দিচ্ছ? (সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৯২)
নামায ফরয হওয়ার হুকুম নাযিল হয়নি, হযরত খাদীজা রা. ঘরের মধ্যে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে সেই প্রথম থেকেই নামায আদায় করতেন। (তাবাকাত– ৮/১০) ইবন ইসহাক উল্লেখ করেছেন, একদিন আলী রা. দেখতে পেলেন, তাঁরা দু’জন অর্থাৎ নবী সা. ও খাদীজা রা. নামায আদায় করছেন। আলী রা. জিজ্ঞেস করলেনঃ মুহাম্মাদ, এ কি? রাসূল সা. তখন নতুন দ্বীনের দাওয়াত আলীর কাছে পেশ করলেন এবং একথা কাউকে বলতে নিষেধ করলেন। (হায়াতুস সাহাবা– ১/৭০) এ বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায়, উম্মাতে মুহাম্মাদীর সা. মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত খাদীজা রা. রাসূলুল্লাহর সা. সাথে নামায আদায়ের গৌরব অর্জন করেন।
আফীক আল-কিন্দী নামক এক ব্যক্তি কিছু কেনাকাটার জন্য মক্কায় এসেছিলেন। হযরত আব্বাসের রা. বাড়েতে অবস্থান করছিলেন তিনি। একদিন সকালে লক্ষ্য করলেন, এক যুবক কাবার কাছে এসে আসমানের দিকে তাকালো। তারপর কিবলামুখী হয়ে দাঁড়ালো। একজন কিশোর এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর এলো এক মহিলা। সেও তাদের দু’জনের পেছনে দাঁড়ালো। তারা নামায শেষ করে চলে গেল। দৃশ্যটি আফীক কিন্দী দেখলেন। আব্বাসকে তিনি বললেনঃ ‘বড় রকমের একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে।’ আব্বাস বললেনঃ ‘হ্যাঁ’ তিনি আরো বললেনঃ ‘এ নওজোয়ান আমার ভাতিজা মুহাম্মাদ।’ কিশোরটি আমার আরেক ভাতিজা আলী এবং মহিলাটি মুহাম্মাদের স্ত্রী। ….আমার জানামতে দুনিয়ায় তারা তিনজনই মাত্র এই নতুন ধর্মের অনুসারী।’ (তাবাকাতঃ ৮/১০–১১)
ইবনুল আসীর বলেন, এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মার ইজমা হয়েছে যে, হযরত খাদীজা রাসূলুল্লাহর সা. ওপর সর্বপ্রথম ঈমান আনেন। ইসলাম গ্রহণের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল পঞ্চাশ বছর। তাঁর ইসলাম গ্রহণের প্রভাব তাঁর পিতৃকুলের লোকদের ওপরও পড়ে। ইসলামের আবির্ভাবের সময় পিতৃকুল বনু আসাদ ইবন আবদিল উয্যার পনের জন্য বিখ্যাত ব্যক্তি জীবিত ছিলেন। তাঁদের দশজনই ইসলাম গ্রহণ করেন। অন্য পাঁচজন কাফির অবস্থায় বদর যুদ্ধে নিহত হন।
রাসূলুল্লাহর সা. সাথে পঁচিশ বছর দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করার পর নবুওয়াতের দশম বছরে দশই রামাদান পঁয়ষট্টি বছর বয়সে হযরত খাদীজা মক্কায় ইনতিকাল করেন। জানাযা নামাযের বিধান তখনো প্রচলিত হয়নি। সুতরাং বিনা জানাযায় তাঁকে মক্কার কবরস্তান জান্নাতুল মুয়াল্লায় দাফন করা হয়। হযরত নবী করীম সা. নিজেই তাঁর লাশ কবরে নামান। (আল–ইসাবাঃ ৪/২৮৩)
হযরত খাদীজা রা. ওয়াফাতের অল্প কিছুদিন পর রাসূলুল্লাহর সা. বিশেষ হিতাকাঙ্ক্ষী চাচা আবু তালিব মারা যান। অবশ্য আল-ইসতিয়াবের একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে, আবু তালিবের মৃত্যুর তিনদিন পর খাদীজা ইনতিকাল করেন। বিপদে-আপদে এ চাচাই রাসূলুল্লাহকে সা. নানাভাবে সাহায্য করতেন। রাসূলুল্লাহর সা. দুই নিকটাত্মীয়ের ওয়াফাতের কারণে মুসলিম উম্মাহ্র নিকট এ বছরটি ‘আমুল হুয্ন’ বা শোকের বছর নামে অভিহিত হয়েছে।
হযরত খাদীজা রা. ছিলেন বহু সন্তানের জননী। প্রথম স্বামী আবু হালার ঔরসে হালা ও হিন্দ নামে দু’ছেলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা উভয়ে ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। হিন্দ বদর মতান্তরে উহুদ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন প্রাঞ্জলভাষী বাগ্মী। উটের যুদ্ধে আলীর রা. পক্ষে শাহাদাত বরণ করেন। দ্বিতীয় স্বামী ’আতীকের ঔরসে হিন্দা নাম্মী এক মেয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনিও ইসলাম গ্রহণ করে সাহাবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। (শারহুল মাওয়াকিব, আল–ইসতিয়াব, হাশিয়া, সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৭) অবশ্য অন্য একট বর্ণনা মতে প্রথম পক্ষে তাঁর তিনটি সন্তান জন্মলাভ করেন। দুই ছেলে- হিন্দ ও হারিস। হারিসকে এক কাফির কাবার রুকনে ইয়ামনীর নিকট শহীদ করে ফেলে। এক কন্যা যয়নাব। আর দ্বিতীয় পক্ষের কন্যাটির কুনিয়াত ছিল উম্মু মুহাম্মাদ। (দাখিরা–ই–মা’রিফ–ই–ইসলামিয়া)
হযরত রাসূলে কারীমের সা. পবিত্র ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন তাঁর ছয় সন্তান। প্রথম সন্তান হযরত কাসিম। অল্প বয়সে মক্কা শরীফে ইনতিকাল করেন। তাঁর নাম অনুসারে রাসূলুল্লাহর সা. কুনিয়াত হয় আবুল কাসিম। মৃত্যুর পূর্বে তিনি হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটা শিখেছিলেন। দ্বিতীয় সন্তান হযরত যয়নাব। তৃতীয় সন্তান হযরত আবদুল্লাহ। তিনি নবুওয়াত প্রাপ্তির পর জন্মলাভ করেছিলেন, তাই ‘তাইয়্যেব ও তাহির’ লকব লাভ করেন। অল্প বয়সে ইনতিকাল করেন। চতুর্থ সন্তান হযরত রুকাইয়া। পঞ্চম সন্তান হযরত উম্মু কুলসুম। ষষ্ঠ সন্তান হযরত ফাতিমা রা.। উল্লেখ্য যে, ইবরাহীম ছিলেন হযরত মারিয়ার গর্ভজাত সন্তান।
হযরত খাদীজা রা. সন্তানদের খুব আদর করতেন। আর্থিক সচ্ছলতাও ছিল। উকবার দাসী সালামাকে মজুরীর বিনিময়ে সন্তানদের দেখাশোনার জন্য নিয়োজিত করেছিলেন।
হযরত নবী কারীমের সা. পবিত্র স্ত্রীগণের মধ্যে হযরত খাদীজার স্থান সর্বেোচ্চে। তিনি প্রথম স্ত্রী, চল্লিশ বছর বয়সে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে বিয়ে হয়। তাঁর জীবদ্দশায় নবী করীম সা. আর কোন বিয়ে করেননি। হযরত ইবরাহীম ছাড়া রাসূলুল্লাহর সা. সব সন্তানই তার গর্ভে পয়দা হয়েছেন।
উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজার ফজীলত ও মর্যাদা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি, আরবের সেই ঘোর অন্ধকার দিনে কিভাবে এক মহিলা নিঃসঙ্কোচে রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াতে বিশ্বাস স্থাপন করছেন। তাঁর মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ও সংশয় নেই। সেই ওহী নাযিলের প্রথম দিনটি, ওয়ারাকার নিকট গমন এবং রাসূলুল্লাহর সা. নবী হওয়া সম্পর্কে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা- সবকিছুই গভীরভাবে ভেবে দেখার বিষয়। রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াত লাভের পূর্ব থেকে খাদীজা যেন দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন- তিনি নবী হবেন। তাই জিবরাঈলের আগমণের পর ক্ষণিকের জন্যও তার মনে কোন রকম ইতস্ততঃভাব দেখা দেয়নি। এতে তাঁর গভীর দূরদৃষ্টি ও তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নবুওয়াত লাভের পূর্বে ও পরে সর্বদাই তিনি রাসূলুল্লাহকে সা. সম্মান করেছেন, তাঁর প্রতিটি কথা বিশ্বাস করেছেন। পঁচিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে মুহূর্তের জন্যও তাঁর মনে কোন প্রকার সন্দেহ দানা বাঁধতে পারেনি। সেই জাহিলী যুগেও তিনি ছিলেন পূতঃপবিত্র। কখনো মূর্তিপূজা করেননি। নবী করীম সা. একদিন তাঁকে বললেনঃ ‘আমি কখনো লাত-উযযার ইবাদত করবো না।’ খাদীজা বলেছিলেনঃ লাত-উয্যার কথা ছেড়ে দিন। তাদের প্রসঙ্গই উত্থাপন করবেন না। (মুসনাদে আহমাদ– ৪/২২২)
নবুওয়াতে মুহাম্মাদীর সা. ওপর প্রথম বিশ্বাস স্থাপনকারী এবং তাঁর সাথে প্রথম সালাত আদায়কারীই শুধু তিনি নন।
সেই ঘোর দুর্দিনে ইসলামের জন্য তিনি যে শক্তি যুগিয়েছেন চিরদিন তা অম্লান হয়ে থাকবে।
ইসলামের সেই সূচনা লগ্নে প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. পরামর্শ দাত্রী।
রাসূলুল্লাহর সা. সাথে বিয়ের পর সমস্ত সম্পদ তিনি স্বামীর হাতে তুলে দেন। যায়িদ বিন হারিসা ছিলেন তাঁর প্রিয় দাস। তাকেও তিনি স্বামীর হাতে তুলে দেন। রাসূলুল্লাহ সা. যায়িদকে বেশী ভালোবাসতেন, তাই তাঁকে খুশী করার জন্য তাকে আযাদ করে দেন।
মক্কার একজন ধনবতী মহিলা হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজ হাতে স্বামীর সেবা করতেন। একবার তিনি বরতনে করে রাসূলুল্লাহর সা. জন্য কিছু নিয়ে আসছিলেন।
হযরত জিবরীল আ. রাসূলকে সা. বললেন, ‘আপনি তাঁকে আল্লাহ তা’আলা ও আমার সালাম পৌঁছিয়ে দিন।’ (বুখারী)
হযরত রাসূলে করীম সা. প্রিয়তমা স্ত্রী খাদীজার রা. স্মৃতি তাঁর মৃত্যুর পরও ভোলেননি।
তাঁর মৃত্যুর পর বাড়ীতে যখনই কোন পশু জবেহ হতো, তিনি তালাশ করে তাঁর বান্ধবীদের ঘরে ঘরে গোশত পাঠিয়ে দিতেন।
হযরত আয়িশা বলেনঃ যদিও আমি খাদীজাকে রা. দেখিনি, তবুও তাঁর প্রতি আমার ঈর্ষা হতো। অন্য কারো বেলায় কিন্তু এমনটি হতো না। কারণ, নবী কারীম সা. সবসময় তাঁর কথা স্মরণ করতেন।’
মাঝে মাঝে হযরত আয়িশা রা. রাসূলুল্লাহকে সা. রাগিয়ে তুলতেন।
রাসূল সা. বলতেনঃ ‘আল্লাহ আমার অন্তরে তাঁর ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন।’
হযরত খাদীজার রা. ওয়াফাতের পর তাঁর বোন হালা একবার রাসূলে কারীমের সা. সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলেন।
রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর কণ্ঠস্বর শুনেই বলে উঠলেন ‘হালা এসেছো’? রাসূলুল্লাহর সা. মানসপটে তখন খাদীজার স্মৃতি ভেসে উঠেছিল।
আয়িশা রা. বলে ফেললেন, ‘আপনি একজন বৃদ্ধার কথা মনে করছেন যিনি মারা গেছেন।
আল্লাহ তার চেয়ে অনেক উত্তম স্ত্রী আপনাকে দান করেছেন।’
জবাবে নবী কারীম সা. বললেনঃ ‘কক্ষনো না।
মানুষ যখন আমাকে মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে, সে তখন আমাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে।
সবাই যখন কাফির ছিল, তখন সে মুসলমান। কেউ যখন আমার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি, তখন সে আমাকে সাহায্য করেছে। তাঁর গর্ভেই আমার সন্তান হয়েছে।’ আমরা মনে করি হযরত খাদীজার মূল্যায়ন এর চেয়ে আর বেশী কিছু হতে পারে না।
হযরত খাদীজার ফজীলাত সম্পর্কে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছেঃ ধরাপৃষ্ঠের সর্বোত্তম নারী মরিয়ম বিনতু ইমরান ও খাদীজা বিনতু খুওয়াইলিদ। হযরত জিবরাঈল আ. বসে আছেন রাসূলুল্লাহর সা. কাছে। এমন সময় খাদীজা আসলেন। জিবরাইল আ. রাসূলুল্লাহকে সা. বললেন, ‘তাঁকে মণি-মুক্তার তৈরী একটি বেহেশতী মহলের সুসংবাদ দিন।’ (বুখারী)।
হযরত আছিয়া ঃ-দুনিয়াতে জান্নাতের সুসংবাদ পাওয়া চারজন রমণীর মধ্যে হযরত আছিয়া অন্যতম ।তিনি ছিলেন ফেরাউনের স্ত্রী। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন—
وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا لِّلَّذِينَ آمَنُوا اِمْرَأَةَ فِرْعَوْنَ إِذْ قَالَتْ رَبِّ ابْنِ لِي عِندَكَ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ وَنَجِّنِي مِن فِرْعَوْنَ وَعَمَلِهِ وَنَجِّنِي مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ
মুমিনদের জন্যে ফেরাউন-পত্নীর দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। সে বললঃ হে আমার পালনকর্তা! আপনার সন্নিকটে জান্নাতে আমার জন্যে একটি গৃহ নির্মাণ করুন, আমাকে ফেরাউন ও তার দুস্কর্ম থেকে উদ্ধার করুন এবং আমাকে যালেম সম্প্রদায় থেকে মুক্তি দিন।–সুরা—আততাহরীম, আয়াত ১১।
মুসলিম নারীদের জন্য চির বরণীয় ও অনুসরণীয় এক ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন আছিয়া। সবুজ শ্যামলিমায় ঘেরা সুউচ্চ প্রাসাদের আলীশান মহলে তিনি বসবাস করতেন। সবুজ বৃক্ষের তলদেশে প্রাসাদের গা ঘেষে নীল দরিয়ার স্বচ্ছ পানি বয়ে চলত অবিরাম। এমন সব নেয়ামত ও আয়েশের মাঝেও আছিয়া ছলেন অতৃপ্ত, অস্থির। তাহলে কোন সে পিপাসায় তিনি কাতর ছিলেন? কিসের অভাবে ছটফট করতেন তিনি?
আল্লাহ পাকের কাছে আছিয়া কাতর দুয়া করেছিলেন—তিনি যেন তাঁর স্বামীর দুঙ্কর্ম থেকে তাঁকে হেফাজত করেন। তাঁর জুলুমবাজ কওমের হাত থেকে রেহাই দেন তাঁকে। তিনি আরো বলেছিলেন, তাঁর স্বামীর পৃষ্ঠপোষকতায় যে পাপের রাজ্য কায়েম হয়েছে, সেখান থেকে বের হতে তিনি উদগ্রীব হয়ে পড়েছেন। অথচ এক সময় তিনি স্বামীর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। হৃদয়জুড়ে ছিল তাঁর ভালবাসা। তাহলে তাঁর এ অভিযোগের প্রেক্ষাপট কী?
ফেরাউন তাঁর সুউচ্চ রাজপ্রাসাদ, সুদূর বিস্তৃত সাম্রাজ্যে অপ্রতিদ্বন্ধি বাদশাহ ছিল। সে ছিল ভীষণ কঠোর প্রকৃতির ও পাষাণ দিল। নির্বিচারে প্রজাসাধারণের উপর সে জুলুম করত। অত্যাচারে জর্জরিত করত তাদের। ফেরাউন স্বেচ্ছাচারিতার চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। অত্যন্ত অহংকার ও গর্ব করে বেড়াত সে। বনী ইসরাঈল ছিল তাঁর অবৈধ অত্যাচারের নিশানা। তারা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে অত্যন্ত কষ্টের ভেতর দিয়ে ফেরাউনি রাজ্যে জীবন যাপন করছিল । বিপদ মুসিবতে ধৈর্য ধরা ছাড়া তাদের কিছুই করার ছিল না।
একদিন রাজদুরবারের প্রধান জ্যোতিষী ফেরাউনের কাছে এসে বলল—বাদশাহ নামদার। অচিরেই বনী ইসরাঈলের মাঝে একজন সন্তান জম্ম নিবে। তাঁর হাতে আপনার সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য। জ্যোতিষীর এ সংবাদ বনী ইসরাঈলের উপর অত্যাচারের আগুনে ঘি ঢেলে দিল। ফেরাউনের পাষণ্ডতা উথলে উঠলো। জ্যোতিষীর এ অসহনীয় কথায় তাঁর উন্মত্ততা বেড়ে গেল কয়েকগুণ। নিজেকে একটু প্রবোধ দেয়ার জন্য, মনটাকে একটু সুস্থির করার জন্য বনী ইস্প্রাঈলের উপর জুলুমের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। সে তাদের নবজাতক পুত্র সন্তানদের ধীরে ধীরে নৃশংসভাবে হত্যা করতে লাগল। তবে শুধু কন্যা সন্তানদের জীবিত রাখত। অবশেষে আল্লাহ পাক বনী ইসরাঈলের ভাগ্য লিখনে পরিবর্তন আনলেন। তাদের পর্যাপ্ত শক্তি ও ক্ষমতা দান করলেন। ফলে ফেরাউন যে বিভীষিকার আশংকা করত, তা স্বচক্ষে দেখতে বাধ্য হয় সে।লোমহর্ষক এ ঘটনার শুরুটা খুবই অম্লমধুর । ফেরাউনের রাজপ্রাসাদের অনতিদূরে ছোট্ট এক ঝুপড়িতে ইউহানিব নাম্নী এক মহিলা বাস করতেন। তাঁর গর্ভধারণের সময় ঘনিয়ে এলে নিজগৃহের এক কোণায় তিনি আবদ্ধ হয়ে রইলেন। প্রসব বেদনা শুরু হলে তিনি মেয়েকে বললেন যাও, জলদি একজন ধাত্রী ডেকে নিয়ে আস। মেয়ে ধাত্রী ডেকে আনল। ইউহানিবের ঘরে একটি সুন্দর ফুটফুটে পুত্রসন্তান ভূমিষ্ট হল। তিনি ফেরাউনের নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার কথা করে ভয় ও আতংকে শিউরে উঠলেন। নিজেকেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এই নিষ্পাপ ফুলের মত শিশুকে কি মেরে ফেলা হবে? ছেলের প্রতি ভালবাসায় তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলেন। সিংস্র ফেরাউনের হিংস্রহাত থেকে বাঁচতে একাধারে তিন মাস গৃহভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকলেন তিনি। এজন্য ইউহানিব প্রতিটি মুহূর্তেই চিন্তা ও আতংকের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করতেন। নিজের প্রতি নয়, ছেলে মূসার প্রতি ভয় ও ভালবাসায় তিনি গভীর চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তবে আল্লাহ পাক তাঁর সহায় ছিলেন। তিনি তাঁকে নির্দেশ দিলেন, এ শিশুটির জন্য একটি কাঠের সিন্দুক তৈরি কর। তারপর তাঁকে সিন্দুকের ভেতর ভরে নীল দরিয়ায় ভাসিয়ে দাও। আর তোমার মেয়েকে সিন্দুকের অনুসরণ করে নীল নুদের পার দিয়ে চক্কর দিতে বল। এ ঐশী আদেশ পেয়ে মুসা জননীর চিত্ত প্রশান্ত হল। মন থেকে সব ডর—ভয় মুছে গিয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন তিনি। সুন্দর একটি সিন্দুক বানানো হল। ইউহানিব নয়নের মণি মুসাকে সেখানে রেখে দিয়ে মেয়েকে বললেন, সিন্দুকটি মাথায় করে নীল নদের ঘাটে নিয়ে যাও। চতুর মেয়ে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কাজ সম্পন্ন করল। ইউহানিব সন্তান সমেত সিন্দুকটি নীল নুদে ভাসিয়ে দিলেন। প্রবাহমান নদীর ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে সিন্দুকটা নাচতে নাচতে এগিয়ে চলল। সন্তানকে আল্লাহর হাতে সঁপে দিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে মা জননী ঘরে ফিরলেন। মেয়েকে পাঠিয়ে দিলেন সিন্দুকের পেছনে পেছনে। নদীর ফস্রোতে ভাসতে ভাওতে সিন্দুকটি ফেরাউনের মর্মর নির্মিত সুদৃশ্য সিঁড়ির গোড়ায় এসে থামল। ফেরাউনের স্ত্রী, কন্যা, সেবিকারা এখানে বসেই নদীর শীতল হাওয়ায় গা জুড়াত। প্রাসাদের এক খিড়কি দিয়ে আছিয়া এ সিন্দুকটি দেখতে পেলেন। বাচ্ছাসহ সিন্দুকটি উপরে তুলে আনা হল। ফেরাউনের সিপাহী ও প্রহরীরা আশাপাশেই ছিল। তাদের সবার হাতেই শিশু হননের যাবতীয় অস্ত্র ও হাতিয়ার উন্মুখ হয়ে রয়েছে। তাদের কাজই ছিল, বনী ইসরাঈলের ঘরে কোন নবজাতকের সন্ধান পেলে তাঁকে বধ করে নীল নদে সেই লাশটা ভাসিয়ে দিবে কিংবা দূরের কোন মরু উপত্যকায় ফেলে আসবে। শিশুটিকে প্রথম দর্শনেই ফেরাউনের মনে একটি ভালবাসা জেগে উঠল। কিন্তু তাঁর আশ পাশের লোকেরা শিশুটিকে হত্যা কুরে ফেলতে তাঁকে নানাভাবে উত্তেজিত করতে লাগল। কেউ একজন বলেও ফেলল, মহারাজ! সিন্দুকে বাচ্ছা রেখে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া আসলে আপনার বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র। জ্যোতিষীর কথা অনুযায়ী হতে পারে এই বাচ্ছাটিই আপনার রাজ্য পতনের কারণ হবে। তাদের এই কথোপকথনের মাঝে আছিয়া এক কদম সামনে এসে বললেন,
وَقَالَتِ امْرَأَتُ فِرْعَوْنَ قُرَّتُ عَيْنٍ لِّي وَلَكَ لَا تَقْتُلُوهُ عَسَى أَن يَنفَعَنَا أَوْ نَتَّخِذَهُ وَلَدًا وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ
এ শিশু আমার ও তোমার নয়নমণি, তাকে হত্যা করো না। এ আমাদের উপকারে আসতে পারে অথবা আমরা তাকে পুত্র করে নিতে পারি। প্রকৃতপক্ষে পরিণাম সম্পর্কে তাদের কোন খবর ছিল না।–সুরা কাসাস, আয়াত ৯।
আছিয়া স্বামীর কাছে এ শিশুটির ব্যাপারে তাঁর সাধারণ হুকুম বলবৎ না করার জন্য উপর্যুপরি অনুরোধ করতে লাগ্লেন। প্রত্যাশা নিয়ে তিনি বললেন, হতে পারে এ শিশু বড় হয়ে আমার একান্ত বাধ্যগত হবে আর আমরা তাঁকে আমাদের সন্তানরূপে গ্রহণ করবো। এক পর্যায়ে ফেরাউন তাঁর কোথা মেনে নিল। রাজপ্রাসাদে মূসা তখন ফেরাউনের পুত্রবৎ হয়ে গেল। মানস সন্তানের প্রতি অগাধ ভালবাসায় আছিয়ার দিল টইটম্বুর। আনন্দের দোলায় তিনি দুলতে লাগলেন।প্রাসাদের লোকেরা এ শিশুর জন্য একজন ধাত্রী খুঁজতে লাগল। হাজার হলেও এতো এখন রাজপুত্র। আর ফেরাউন তো শুধু বাদশাই নয়। প্রজাসাধারণের স্বকল্পিত প্রভুও সে। কাজেই চতুর্দিক থেকে ধাত্রীদের আগমন্ব প্রাসাদ ভরে উঠলো। ফেরাউন ও আছিয়া বাচ্ছার জন্য একজন যুৎসই ধাত্রীর জন্য প্রতীক্ষমান। কিন্তু রজোপ্রাসাদে আগত কোন মহিলার স্তনই মুখে নিচ্ছে না বাচ্চাটি। প্রধানমন্ত্রী হাসান তাঁর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি মেলে ধ্রল চারদিকে। ইত্যবসরে মূসার সহোদরা বোন সামনে এগিয়ে এসে বলল আমি একজন ধাত্রীর সন্ধান দিতে পারি তোমাদের, আশা করা যায় এ বাচ্চা তাঁর দুধ পান করবে। বাচ্চাটির অবিরাম কান্না আমার মনে খুবকরুণ হয়ে বিঁধছে, তাই আমি তোমাদের সাহায্যে এগিয়ে এলাম। অন্যথায় এতে আমার কোন গরজ নেই। আছিয়া বললেন—জলদি গিয়ে তাঁকে নিয়ে আস, দেখছো না সে কেমন জোরে জোরে চিৎকার করছে। ক্ষুধার তাড়নায় মুখটা একেবারে পাংশু হয়ে গেছে ছেলেটির। মেয়েটি বলল আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না রাণী মা! আমি এক্ষুণি তাঁকে নিয়ে হাজির হচ্ছি।
মূসার বোন মারিয়াম দৌড়ে মায়ের কাছে গেল। মাকে বলল—আম্মা!সসুসংবাদ শুনুন। তাঁকে নিয়ে অবাক কাণ্ড ঘটে গেছে। মূসা আগত কোন মহিলার দুধই পান করছে না। সকলেই হতাশ হয়ে ফিরে গেছে। আমি তাদেরকে আপনার কথা বলে এসেছি। চলুন, চলুন জলদি চলুন।
ইউহানিব বলতে লাগলেন, আমার প্রচন্ড ভয় হচ্ছে, যদি তারা কোনভাবে বুঝে ফেলেয়ামি তাঁর মা, তাহলে কী হবে? কিন্তু আমার তো আর তর সইছে না। সেই কখন থেকে যে অবিরাম দুধ ঝরে পড়ছে।মারয়াম বলল, আম্মা! তাড়াতাড়ি চলুন, আমাদের অনেক দেরি হয়্ব যাচ্ছে। তারা উভয়ে রাজপ্রাসাদে রওয়ানা হলেন। সেখানে পৌঁছে দেখলেন মূসার কান্নার আওয়া উচ্ছে উঠে গেছে। আছিয়া তাঁকে কোলে তুলে হেলিয়ে দুলিয়ে প্রবোধ দিচ্ছে আর আদর করছে। কিন্তু কান্না থামছে না কিছুতেই। ইউহানিব তাঁর কাছে গিয়ে বললেন—রাণী মা! একে আমার কাছে দিন। আছিয়া মারয়ামকে লক্ষ্য করে বললেন—এই ক্লি সেই ধাত্রী? মারয়াম বলল জি হ্যাঁ—রাণী মা ! আপনি নিশ্চিন্তে বাচ্ছাকে তাঁর হাতে দিন। মনে হচ্ছে অবশ্যই সে এর দুধ পান করবে এবং কান্নাও বন্ধ করবে। ইউহানিব বাচ্ছাকে কোলে নিতেই সে নীরব হয়ে গেল। তাঁর চোখে ফুটে উঠল একটি খুশীর ঝিলিক। নিতান্ত শান্ত ভঙ্গিতে সে তাঁর দুধ পান করতে লাগল। পাশে দাঁড়ানো আছিয়ার খুশি আর ধরে না। প্রশান্তির একটি নিঃশ্বাস ছাড়লেন তিনি। কিন্তু চতুর ফেরাউনের মনের ভেতর একটি সন্দেহ দানা বেঁধে উঠল।
ফেরাউন তাঁকে জিজ্ঞেস করল আচ্ছা, বলতো কে তুমি? এ বাচ্ছা আর সব মহিলা থেকে মুখ থেকে মুখ ফিরিয়ে তোমার দিধই বা কেন মুখে নিল? ইউহানিব বললেন আসলে আমার পেশাই হচ্ছে দুধ পান করানো। আমার দুধ বড়ই সুমিষ্ট ও সুপেয়। সব ধরণের শিশুরাই আগ্রহ ভরে আমার দুধ পান করে। আর যে একবার আমার দুধ খায় সে অন্যদের দুধ মুখেই নিতে চায় না। ফেরাউন প্রধানমন্ত্রী হামানের দিকে ইশারা করে বলল এ মহিলার ভাতা দ্বিগুণ করে দাও আর তাঁর থাকার সুবন্দোবস্ত করে দাও। মূসা জননী এসব কথা শুনে এবং পুরিস্থিতির অনুকূলতা অনুভব করে অত্যন্ত খুশী হলেন। আল্লাহ পাকের ওয়াদা যে এত দ্রুত বাস্তবায়িত হবে, তা তিনি ভাবতেই পারেননি।
আছিয়া তাঁকে বললেন—তুমি আমাদের এই প্রাসাদেই অবস্থান করো। আমি তোমার থাকার জন্য মনোরম একটি কামরা এবং উপযোগী খাবার—দাবারের ব্যবস্থা করে দিব। ইউহানিব বললেন—রাণী মা! আপনাকে অনেক অনেক শুকরিয়া। আমি চাচ্ছি এ বাচ্ছাকে আমার ঘরেই দুধ পান করাবো। সেখানকার পুঅরিবেশ খুব মনোরম। আর আমিও অবলীলায় সেখানে চলা—ফেরা করতে পারবো। এ বাচ্চারও বোধহয় কোন কষ্ট হবে না। আছিয়া বললেন—তোমার যা ইচ্ছে তা করো। মূসা জননী সন্তান নিয়ে ঘরে ফিরলেন। আল্লাহর শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতায় মুখর হয়ে উঠলেন তিনি। তিনিই তো তাঁর দিলে প্রশান্তি দিয়েছেন। মনের অস্থিরতা দূর করেছেন । আর আদরে দুলালকে তাঁর কোলেই ফিরিয়ে দিয়েছেন। খুব বেশি আওময় তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়নি। আদরে যত্নে মা ছেলেকে লালন পালন করতে লাগলেন। আছিয়ার যখনই বাচ্ছাটিকে দেখতে মন চাইত তিনি কাউকে পাঠিয়ে তাঁকে রাজপ্রাসাফে নিয়ে আসতেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে তৃপ্তি ভরে দেখতেন। একটু একটু করে মূসা হাঁটুতে ভর দিয়ে চলতে শিখলেন। কখনো কখনো দু—পায়ে ভর করে থাকতেন কিছুক্ষণ। ভাঙ্গা ভাঙ্গা করে অল্প—সল্প কথাও বলতেন মাঝে মধ্যে। যখনই আছিয়া মুসার সাথে একটু আমোদ—আহ্লাদ করতেন সে অত্যধিক আনন্দিত হয়ে উঠত। তবে আর কোন মহিলার সামনে সে এতটা আনন্দিত, এতটা অকৃত্রিম হত না।কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের সিঁড়িতে পদার্পণ করলেন মূসা। আছিয়ার হৃদয় কন্দরে স্নেহের বৃক্ষটি এখন পত্র পল্লবে সুশোভিত। মানস পুত্র মুসাকে না দেখে থাকতে পারেনা তিনি। দুগ্ধপানের মেয়াদ শেষ হতেই মূসাকে রাজপ্রাসাদে দিয়ে গিয়েছিলেন ইউহানিব। জ্যোতিষীর কথা শুনে ফেরাউনের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া নিষ্ঠুরতা তাঁর চোখের সামনে ছিল অহেতুক ঝামেলা এড়িয়ে চলাই সমীচীন মনে করেছেন তিনি। কিন্তু ফেরাউন জানত না, তাঁর গৃহেই আগ্নেয়গিরির এক ভয়ঙ্গকর লাভা বিস্ফোরিত হওয়ার জন্য ধীরে ধীরে স্ফীত হচ্ছে।
খোদাকে পরিত্যাগ করে হামানসহ যারা ফেরাউনের সামনে সেজদায় লুটিয়ে পড়ত, আছিয়া সাদের প্রতি ভীষণ রুষ্ট ছিলেন। ভীতি ও ভক্তি নিয়ে তারা অসম্ভব সব উপাধিতে ভূষিত করত ফেরাউনকে। এগুলো দেখে আছিয়া সিমাহীন অস্থির হয়ে উঠতেন। তাঁর স্বামী যখন অহংকারে মদমত্ত হয়ে বলত আমিই তোমাদের ভমহান প্রভু; তিনি মনে মনে বলতেন, হায়রে কপাল! কোন শয়তানের পাল্লায় যে পড়েছি। এ অন্ধ অহমিকায় আর কতকাল সে ডুবে থাকবে। কিসের নেশায় সে এ মহা মুসিবতকে বরণ করে নিচ্ছে? ফেরাউনের স্বকল্পিত প্রভুত্বকে প্রচন্ড ভাবে ঘৃণা করতেন তিনি।
তাঁর ভক্তদের ভাঁড়ামিপূর্ণ কার্যকলাপ দেখে দূর থেকে শুধু আফসোস করে বলতেন—সবগুলো একেকটা উম্মাদ।
হৃদয়ের মনিকোঠায় মূসাকে ধারণ করতেন আছিয়া। প্রগাঢ় ভালবাসায় ভরিয়ে রাখতেন তাঁকে। হঠাৎ একদিন একটি লোক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে তাঁকে সংবাদ দিল মূসা জনৈক কিবতীকে হত্যা করে ফেলেছে। স্বগোষ্ঠীয় এক লোকের পক্ষাবলম্বন করেই এ কাজটা সে করেছে। আছিয়ার কন্যাদের সেবা করত যারা, তাদের একজনের স্বামী হিজকীল এসে তাঁকে জানালেন, শহরে দুজন লোক ঝগড়া করছিল। একজন মূসার স্বগোত্রীয় অপরজন কিবতী। কিবতী লোকটির বিরুদ্ধে অপরজন মূসার সহযোগিতা চাইলে মূসা তাঁকে প্রচন্ড ঘুষি মারে। আর এতেই লোকটির ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যায়। আছিয়া মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথাগুলো শুনছিলেন, হঠাৎ দূর থেকে ফেরাউনের ক্রোধান্বিত চিৎকারে তিনি সচকিত হয়ে উঠলেন। তাঁর বিকট আওয়াজে প্রাসাদ যেন কাঁপতে লাগল। কোথায় মূসা? এখনো কেন তাঁকে বন্দী করা হচ্ছে না। সিপাহী! ঐ কুলাঙ্গারকে এক্ষুণি আমার সামনে হাজির কর। আমি নিহত কিবতীর প্রতিশোধ নিতে চাই। এক্ষুণি। পরিস্থিতির ভয়াবহতায় আছিয়া খুব শংকিত হয়ে উঠলেন। মূসার প্রতি উৎকন্ঠায় তাঁর প্রাণ ব্যাকুল হয়ে উঠল। অনন্ত অসীম পরমসত্তার কাছে মিনতির দু’হাত তুলে ধরলেন তিনি। ভক্তি গদগদ কণ্ঠে মহান মা;বুদের কাছে তিনি মুসার কল্যাণের জন্য প্রার্থনা শুরু করে দিলেন। ইলাহী! মূঊসাকে ফেরাউন আর তাঁর সাঙ্গপাঙ্গাদের অনিষ্ট থেকে তুমি হেফাজত করো। তাদের বর্বরতা থেকে তুমি নিরাপদ রাখো।
হিজকীল সেখান থেকে চলে গেলেন। নিজের স্বভাবশুদ্ধতার বদৌলতে তিনিও এক আল্লাহয় বিশ্বাস করতেন এবং দাম্ভিক ফেরাউনের প্রভুত্বকে প্রত্যাখ্যান করতেন। দ্রুত মূসার কাছে গিয়ে তাঁকে সর্তক করে দিয়ে তিনি বললেন—
وَجَاء رَجُلٌ مِّنْ أَقْصَى الْمَدِينَةِ يَسْعَى قَالَ يَا مُوسَى إِنَّ الْمَلَأَ يَأْتَمِرُونَ بِكَ لِيَقْتُلُوكَ فَاخْرُجْ إِنِّي لَكَ مِنَ النَّاصِحِينَ
হে মূসা, রাজ্যের পরিষদবর্গ তোমাকে হত্যা করার পরমর্শ করছে। অতএব, তুমি বের হয়ে যাও। আমি তোমার হিতাকাঙ্ক্ষী।–সুরা কাসাস, আয়াত ২০।
মূসা হিজকীলের কথা আমলে নিয়ে তখনই ফেরাউনবাহিনী থেকে আত্মরক্ষার জন্য একদিকে পালিয়ে গেলেন। হিজকীল প্রাসাদে ফিরে এসে দেখলেন আছিয়া মূসার জীবনাশংকায় কম্পমান। তিনি কিছুটা নিচু আওয়াজে বললেন—রাণী মা! আর ভয়ের কোন কারণ নেই। আমি মূসা পর্যন্ত সব কোথা পৌঁছে দিয়েছি এবং আসন্ন বিপদ সম্পর্কেও সর্তক করেছি ত্তাকে। শহর ছেড়ে দূরে কোথাও—যেখানে ফেরাউনের সিপাহীরা তাঁর নাগাল পাবে না। চলে যাওয়ার জন্য সুপারিশ করেছি আমি। আছিয়া বললেন—মহান প্রভুর শুকরিয়া। তিনি মূসাকে ফেরাউনের হিংস্রতা ও নিষ্ঠুরতা থেকে হেফাজত করুন। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতি আমাকে কুড়ে কুড়ে খাবে। সে তো আমার সন্তান সমতুল্য। আমার কোলে পিঠেই সে বড় হয়ে উঠেছে। তাঁকে ছাড়া আমি থাকব কেমন করে? আচ্ছা একটু খোঁজ নিয়ে দেখ না সে কোথায় গেছে। হিজকীল বললেন, রাণী মা! আসুন! মহিমান্বিত স্রষ্টার কাছে আমরা তাঁর কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করি।
একে একে কয়েক বছর কেটে গেল। মূসা আর মিসরে ফিরে এলেন না। মূসাকে এক নজর দেখার অধীর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আছিয়া প্রায় নিরাশ হয়ে গেলেন। কারো কাছে মূসার কোনো সংবাদ নেই। সবাই যেন মূসাকে ভুলে গেল। সময় গড়িয়ে চলল। ফেরাউন ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের মুনে বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গেল যে, মূসা কস্মিনকালেও আর ফিরে আসবে না। তবে কয়েক বছর মূসা ঠিকই ফিরে এলেন। এবার তিনি আল্লাহ পাকের একজন নবী ও পয়গম্বর হয়ে এলেন। মূসা (আঃ) হকের দাওয়াত আর খোদায়ী শিক্ষার মহা সওগাত নিয়ে এলেন। আল্লাহ পাক তাঁকে ফেরাউনের কাছে এ দাওয়াত নিতে যেতে বলেছেন। যার অসহনীয় অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মানবেতর জীবন—যাপন করছে বনী ইসরাঈলের লোকগুলো। জীবনে ন্যূনতম অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে পরাধীনতার শৃংখলে তারা আষ্টে পৃষ্ঠে বাঁধা। তাদের মুক্তির পয়গাম নিয়েই মূসা (আঃ) এসেছেন। নীল দরিয়ার জোয়ার ভাটা আসে কিন্তু উদ্ধত ফেরাউনের নির্মম নিষ্ঠুরতায় কোন ভাটা নেই। মানুষকে মাবুদ বানানো দুরাচার কিবতীদের লাগামহীন উস্কানীতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে ফেরাউন। এ পাগলা ঘোড়াকে নিবৃত্ত করার জন্যই ইনসাফেরচাবুক নিয়ে মূসা (আঃ) এলেন। কিন্তু অনাকাঙ্গিত সেই কিবতী হত্যা স্মৃতিটি তাঁর মনে একতি ভয় ধরিয়ে দিল। প্রভুর শরণাপন্ন হয়ে তিনি বললেন
“পরওয়ারদেগার! আমি তাদের এক ব্যক্তিকে (অনিচ্ছায়) হত্যা করেছিলাম। আমি আশংকা করছি, তারাও আমাকে হত্যা করে ফেলবে। আল্লাহ পাক তাঁকে আশ্বস্ত করলেন, এবার তিনি আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে বললেন,
সহযোগীদের সত্য বিনাশী ষড়যন্ত্র আমি বরদাশত করতে পারি।
আমার যাবতীয় কাজ আসান করে দিন। সব বাঁধা বিপত্তিকে নস্যাৎ করে দিয়ে দাওয়াতের পথকে সুগম করে দিন।
হযরত মারিয়াম আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঃ-মারিয়াম বিনতে ইমরান, যিনি ঈসা (আঃ)-এর কুমারী মাতা ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যাকে জান্নাতের শ্রেষ্ঠ চারজন মহিলার অন্যতম হিসাবে বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি বলেন,
أفضلُ نساءِ أهلِ الجنتِ خديجتُ بنتِ خُوَيْلدِ وفاطمةُ بنتِ محمدٍ ومريمُــــــــــــ
‘জান্নাতবাসী মহিলাগণের মধ্যে সেরা হ’লেন চারজন: খাদীজা বিনতে খুওয়ালিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ, মারিয়াম বিনতে ইমরান এবং আসিয়া বিনতে মুযাহিম, যিনি ফেরাঊনের স্ত্রী’।[2]
মারিয়ামের জন্ম ও লালন-পালন :
মারিয়ামের জন্ম ও লালন-পালন সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
إِذْ قَالَتِ امْرَأَةُ عِمْرَانَ رَبِّ إِنِّي نَذَرْتُ لَكَ مَا فِيْ بَطْنِيْ مُحَرَّراً فَتَقَبَّلْ مِنِّي إِنَّكَ أَنتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ- فَلَمَّا وَضَعَتْهَا قَالَتْ رَبِّ إِنِّي وَضَعْتُهَا أُنثَى وَاللهُ أَعْلَمُ بِمَا وَضَعَتْ وَلَيْسَ الذَّكَرُ كَالأُنثَى وَإِنِّي سَمَّيْتُهَا مَرْيَمَ وِإِنِّي أُعِيْذُهَا بِكَ وَذُرِّيَّتَهَا مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ- فَتَقَبَّلَهَا رَبُّهَا بِقَبُولٍ حَسَنٍ وَأَنبَتَهَا نَبَاتاً حَسَناً وَكَفَّلَهَا زَكَرِيَّا، كُلَّمَا دَخَلَ عَلَيْهَا زَكَرِيَّا الْمِحْرَابَ وَجَدَ عِندَهَا رِزْقاً قَالَ يَا مَرْيَمُ أَنَّى لَكِ هَـذَا قَالَتْ هُوَ مِنْ عِندِ اللهِ إنَّ اللهَ يَرْزُقُ مَنْ يََّشَآءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ- (آل عمران ৩৫-৩৭)-
‘যখন ইমরানের স্ত্রী বলল, হে আমার প্রভু! আমার গর্ভে যা রয়েছে তাকে আমি তোমার নামে উৎসর্গ করলাম সবার কাছ থেকে মুক্ত হিসাবে। অতএব আমার পক্ষ থেকে তুমি তাকে কবুল করে নাও। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আলে ইমরান ৩৫)। ‘অতঃপর সে যখন তাকে প্রসব করল, তখন বলল, হে প্রভু! আমি তো কন্যা সন্তান প্রসব করেছি! অথচ আল্লাহ ভাল করেই জানেন, সে কি প্রসব করেছে। (আল্লাহ সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,) এই কন্যার মত কোন পুত্রই যে নেই। আর আমি তার নাম রাখলাম ‘মারিয়াম’। (মারিয়ামের মা দো‘আ করে বলল, হে আল্লাহ!) আমি তাকে ও তার সন্তানদেরকে তোমার আশ্রয়ে সমর্পণ করছি, অভিশপ্ত শয়তানের কবল হ’তে’ (৩৬)। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তার প্রভু তাকে উত্তমভাবে গ্রহণ করে নিলেনএবং তাকে প্রবৃদ্ধি দান করলেন সুন্দর প্রবৃদ্ধি। আর তিনি তাকে যাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে সমর্পণ করলেন। (অতঃপর ঘটনা হ’ল এই যে,) যখনই যাকারিয়া মেহরাবের মধ্যে তার কাছে আসতেন, তখনই কিছু খাদ্য দেখতে পেতেন। তিনি জিজ্ঞেস করতেন, মারিয়াম! এসব কোথা থেকে তোমার কাছে এল? মারিয়াম বলত, ‘এসব আল্লাহর নিকট থেকে আসে। নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিযিক দান করে থাকেন’ (আলে ইমরান ৩/৩৫-৩৭)।
উল্লেখ্য যে, আল্লাহর নামে উৎসর্গীত সন্তান পালন করাকে তখনকার সময়ে খুবই পুণ্যের কাজ মনে করা হ’ত। আর সেকারণে মারিয়ামকে প্রতিপালনের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। ফলে লটারীর ব্যবস্থা করা হয় এবং আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর বয়োবৃদ্ধ নবী হযরত যাকারিয়া (আঃ) মারিয়ামের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন (আলে ইমরান ৩/৪৪)।
ঈসার জন্ম ও লালন-পালন :
এভাবে মেহরাবে অবস্থান করে মারিয়াম বায়তুল মুক্বাদ্দাসের খিদমত করতে থাকেন। সম্মানিত নবী ও মারিয়ামের বয়োবৃদ্ধ খালু যাকারিয়া (আঃ) সর্বদা তাকে দেখাশুনা করতেন। মেহরাবের উত্তর-পূর্বদিকে সম্ভবতঃ খেজুর বাগান ও ঝর্ণাধারা ছিল। যেখানে মারিয়াম পর্দা টাঙিয়ে মাঝে-মধ্যে পায়চারি করতেন। অভ্যাসমত তিনি উক্ত নির্জন স্থানে একদিন পায়চারি করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ মানুষের বেশে সেখানে জিবরাঈল উপস্থিত হন। স্বাভাবিকভাবেই তাতে মারিয়াম ভীত হয়ে পড়েন। এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ:
وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ مَرْيَمَ إِذِ انتَبَذَتْ مِنْ أَهْلِهَا مَكَاناً شَرْقِيًّا- فَاتَّخَذَتْ مِن دُونِهِمْ حِجَاباً فَأَرْسَلْنَا إِلَيْهَا رُوحَنَا فَتَمَثَّلَ لَهَا بَشَرًا سَوِيًّا- قَالَتْ إِنِّي أَعُوذُ بِالرَّحْمَن مِنكَ إِن كُنتَ تَقِيًّا- قَالَ إِنَّمَا أَنَا رَسُولُ رَبِّكِ لِأَهَبَ لَكِ غُلاَمًا زَكِيًّا- قَالَتْ أَنَّى يَكُونُ لِي غُلاَمٌ وَلَمْ يَمْسَسْنِي بَشَرٌ وَلَمْ أَكُ بَغِيًّا- قَالَ كَذَلِكِ قَالَ رَبُّكِ هُوَ عَلَيَّ هَيِّنٌ وَلِنَجْعَلَهُ آيَةً لِلنَّاسِ وَرَحْمَةً مِّنَّا وَكَانَ أَمْرًا مَّقْضِيًّا- (مريم ১৬-২১)-
(হে মুহাম্মাদ!) ‘আপনি এই কিতাবে মারিয়ামের কথা বর্ণনা করুন। যখন সে তার পরিবারের লোকজন হ’তে পৃথক হয়ে পূর্বদিকে একস্থানে আশ্রয় নিল’ (মারিয়াম ১৬)। ‘অতঃপর সে তাদের থেকে আড়াল করার জন্য পর্দা টাঙিয়ে নিল। অতঃপর আমরা তার নিকটে আমাদের ‘রূহ’ (অর্থাৎ জিব্রীলকে) প্রেরণ করলাম। সে তার কাছে গিয়ে পূর্ণাঙ্গ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল’ (১৭)। ‘মারিয়াম বলল, আমি তোমার থেকে করুণাময় আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যদি তুমি আল্লাহভীরু হও’ (১৮)। ‘সে বলল, আমি তো কেবল তোমার প্রভুর প্রেরিত। এজন্য যে, আমি তোমাকে একটি পবিত্র পুত্র সন্তান দান করে যাব’ (১৯)। ‘মারিয়াম বলল, কিভাবে আমার পুত্র সন্তান হবে? অথচ কোন মানুষ আমাকে স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণী নই’ (২০)। ‘সে বলল, এভাবেই হবে। তোমার পালনকর্তা বলেছেন, এটা আমার জন্য সহজ ব্যাপার এবং আমরা তাকে (ঈসাকে) মানবজাতির জন্য একটা নিদর্শন ও আমাদের পক্ষ হ’তে বিশেষ অনুগ্রহরূপে পয়দা করতে চাই। তাছাড়া এটা (পূর্ব থেকেই) নির্ধারিত বিষয়’ (মারিয়াম ১৯/১৬-২১)। অতঃপর জিব্রীল মারিয়ামের মুখে অথবা তাঁর পরিহিত জামায় ফুঁক মারলেন এবং তাতেই তাঁর গর্ভ সঞ্চার হ’ল (আম্বিয়া ২১/৯১; তাহরীম ৬৬/১২)। অন্য আয়াতে একে ‘আল্লাহর কলেমা’ (بِكَلِمَةٍ مِنْهُ) অর্থাৎ ‘কুন্’ (হও) বলা হয়েছে (আলে ইমরান ৩/৪৫)।অতঃপর আল্লাহ বলেন,
فَحَمَلَتْهُ فَانتَبَذَتْ بِهِ مَكَانًا قَصِيًّا- فَأَجَاءهَا الْمَخَاضُ إِلَى جِذْعِ النَّخْلَةِ قَالَتْ يَا لَيْتَنِي مِتُّ قَبْلَ هَذَا وَكُنتُ نَسْيًا مَّنْسِيًّا- فَنَادَاهَا مِنْ تَحْتِهَا أَلاَّ تَحْزَنِي قَدْ جَعَلَ رَبُّكِ تَحْتَكِ سَرِيًّا- وَهُزِّيْ إِلَيْكِ بِجِذْعِ النَّخْلَةِ تُسَاقِطْ عَلَيْكِ رُطَبًا جَنِيًّا- فَكُلِيْ وَاشْرَبِيْ وَقَرِّيْ عَيْنًا فَإِمَّا تَرَيِنَّ مِنَ الْبَشَرِ أَحَدًا فَقُولِيْ إِنِّيْ نَذَرْتُ لِلرَّحْمَنِ صَوْماً فَلَنْ أُكَلِّمَ الْيَوْمَ إِنسِيًّا- (مريم ২২-২৬)-
‘অতঃপর মারিয়াম গর্ভে সন্তান ধারণ করল এবং তৎসহ একটু দূরবর্তী স্থানে চলে গেল’ (মারিয়াম ২২)। ‘এমতাবস্থায় প্রসব বেদনা তাকে একটি খর্জুর বৃক্ষের মূলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। তখন সে বলল, হায়! আমি যদি এর আগেই মারা যেতাম এবং আমি যদি মানুষের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতাম’ (২৩)। ‘এমন সময় ফেরেশতা তাকে নিম্নদেশ থেকে (অর্থাৎ পার্শ্ববর্তী নিম্নভূমি থেকে) আওয়ায দিয়ে বলল, তুমি দুঃখ করো না। তোমার পালনকর্তা তোমার পাদদেশে একটি ঝর্ণাধারা সৃষ্টি করেছেন’ (২৪)। ‘আর তুমি খর্জুর বৃক্ষের কান্ড ধরে নিজের দিকে নাড়া দাও, তা থেকে তোমার দিকে সুপক্ক খেজুর পতিত হবে’ (২৫)। ‘তুমি আহার কর, পান কর এং স্বীয় চক্ষু শীতল কর। আর যদি কোন মানুষকে তুমি দেখ, তবে তাকে বলে দিয়ো যে, আমি দয়াময় আল্লাহর জন্য ছিয়াম পালনের মানত করেছি। সুতরাং আমি আজ কারু সাথে কোন মতেই কথা বলব না’ (মারিয়াম ১৯/২২-২৬)।
উল্লেখ্য যে, ইসলাম-পূর্ব কালের বিভিন্ন শরী‘আতে সম্ভবতঃ ছিয়াম পালনের সাথে অন্যতম নিয়ম ছিল সারাদিন মৌনতা অবলম্বন করা। হযরত যাকারিয়া (আঃ)-কেও সন্তান প্রদানের নিদর্শন হিসাবে তিন দিন ছিয়ামের সাথে মৌনতা অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে ঐ অবস্থায় ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলার অবকাশ ছিল (মারিয়াম ১৯/১০-১১)। একইভাবে মারিয়ামকেও নির্দেশ দেওয়া হ’ল (মারিয়াম ১৯/২৬)।
” তোমরা কি জানো এগুলো কি?” সাহাবিগণ উত্তর দিলেন ” আল্লাহ ও তাঁর রাসুল ভাল জানেন” ।
রসুল (স) বললেন ” সর্বশ্রেষ্ঠ চার জান্নাতি নারী হল
1-খাদিজাহ বিনতে খুআইলিদ,
2- ফাতিমাহ্ বিনতে মুহাম্মাদ(সা)
3- মারিয়াম বিনতে ইমরান ( ঈসা আর এর মা ) এবং
4-আসিয়াহ্ বিনতে মুযাহিম ( ফেরাউনের স্ত্রী) ।
খাদিজাহ (রা )হল প্রথম ব্যক্তি যিনি আল্লাহর রাসুলের প্রতি ইমান এনেছিলেন। কেন তাকে সর্বশ্রেষ্ঠ নারীদের একজন বলা হয়েছে? এটা কি তাঁর ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য?
নাকি তাঁর জ্ঞানের জন্য?
ঠিক কি কারণে তাঁকে এই উপাধি দেয়া হয়েছে তা নিয়ে আমাদের গভীর ভাবে চিন্তা করা দরকার।
বিশেষ করে আমাদের মা -বোনদের।
আমরা যদি এই চার মহীয়সী নারীর জীবন পর্যালোচনা করি তাহলে তাদের মধ্যে দুটি বিষয়ের মিল দেখি –
প্রথমত:
তাঁরা অত্যন্ত শক্তিশালী ইমানের অধিকারী ছিলেন। তাঁদের ইমান ছিল সর্বোচচ পর্যায়ের । এটা হল সেই রকম বিশ্বাস যাতে কোন ভাবেই চিড় বা ফাটল ধরানো যায়না।
যে অন্তরে বিশ্বাস আছে সে অন্তর চোখের দেখা, কানের শোনা কে উপেক্ষা করে তাঁর বিশ্বাসকে প্রাধান্য দেয়।
তাঁর কল্পনায় শুধুই থাকে বিশ্বাস । আর এঁদের সকলের ইমান যে বিশ্বাসের অনেক উঁচু পর্যায়ে ছিল ,এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
ফিরাউনের স্ত্রী , আসিয়াহ ( আ ) উদাহরণ ধরুন-
একজন মহিলা পৃথিবীতেে যা চাইতে পারে তার সবই তাঁর ছিল। আরামদায়ক জীবন, ধন সম্পদ, ধনী ও প্রভাবশালী স্বামী, ক্ষমতা, দাসদাসী, খাদেম। কিন্তু ইমানের স্বার্থে, আল্লাহর জন্য তিনি এর সবই পরিত্যাগ করতে রাজি ছিলেন।
তিনি বাস করতেন সে সময়ের সর্বোৎকৃষ্ট প্রাসাদে। কিন্তু তারপরও তিনি আল্লাহ সুবহানা তাআলার কাছে দুয়া করেছিলেন –
আর ঈমানদারদের ব্যাপারে ফেরাউনের স্ত্রীর উদাহরণ দিচ্ছেন –
যখন সে দোয়া করলো, ”
হে আমার রব, আমার জন্য তোমার কাছে জান্নাতে একটি ঘর বানিয়ে দাও …!
(66:11)
আমাদের বুঝতে হবে আসিয়াহ(আ) একটি অত্যন্ত বিষাক্ত পরিবেশে ছিলেন, যা ছিল সব দিক থেকেই ইমানের পরিপন্থী। আল্লাহর শত্রুদের সাথেই ছিল তাঁর বসবাস। কুফরি শক্তিকে উপেক্ষা করে নিজেকে আল্লাহর পথে অটুট রেখে তিনি ইমানের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন ।
আমরা অপর তিন জনের জীবন পর্যালোচনা করলেও একই রকম বলীয়ান ইমানের দৃষ্টান্ত দেখতে পাই।
তাদের মধ্যে দ্বিতীয় যে ব্যপারটি ছিল তা হলো-
তাঁরা সর্বশ্রেষ্ঠ মা।
মরিয়ম (আ ) বড় করেছিলেন ঈসা( আ)কে আর আসিয়াহ্ (আ)বড় করেছিলেন মুসা (আ)কে ।
মা খাদিজাহ (রা) কে আল্লাহ এত মর্যাদা দিয়েছেন তা কিন্তু এই জন্য নয় যে তিনি অনেক সফল ব্যবসায়ী ছিলেন।
বরং তিনি ছিলেন আল্লাহর রসুল মুহাম্মদ (স) এর অসাধারণ এক সহধর্মিণী। আল্লাহর রাসুলের (স) যখনি প্রয়োজন, তখনি তিনি পাশে পেয়েছিলেন খাদিজা (রা)কে ।
ইসলামের শিশু অবস্থায় সবচেয়ে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন মা খাদিজা ( রা)।
আল্লাহর রাসুল (স) নবুয়তের শুরুতে সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতিতে অবিচল সাহস আর প্রেরণা দিয়েছেন মা খাদিজাহ্ (রা)।রাসূল ( সা) কে একজন অভিভাবকের মতো আগলে রেখে হেরা গূহায় ধ্যান রত অবস্থায় কি অকৃত্রিম বন্ধুর মতো সেবা করেছেন সে ইতিহাস অনেকেরই জানা ।
আর ফাতিমা(রা) ছিলেন রসূল ( সা ) সবচেয়ে ছোট ও আদরের কন্যা এবং আমিরুল মু’মিনীন আলীর (রা) সহধর্মিণী।
আলী অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন। ঘরের কাজ করতে ফাতিমাকে(রা)কে অনেক কষ্ট পেতে হত।
আটা পিষতে পিষতে তাঁর কোমল হাতে কঠিন ক্ষত হয়ে গিয়েছিল । অথচ তিনি ছিলেন সর্ব শ্রেষ্ঠ রাসূল এবং তৎকালীন মদিনা ইসলামি রাষ্ট্রের কর্ণধারের সম্মানিত কন্যা!
একবার আলী (রা ) এর ইচ্ছায় তাঁরা আল্লাহর রাসুল (স) এর কাছে একজন ভৃত্য প্রার্থনা করলেন।
আল্লাহর রসুল (স) তাদের জবাবে বললেন আমি তোমাদের এরচেয়েও উত্তম কিছু শিখিয়ে দিচ্ছি।
তোমরা শুতে যাবার আগে 33 সুবহানাল্লাহ ,
33 বার আলহামদুলিললাহ এবং
34 আল্লাহু আকবর পড়বে ।
ফাতিমাকে আল্লাহর রাসুল (স) অত্যন্ত ভালবাসতেন।
তিনি বলেছিলেন ফাতিমা আমার দেহের অংশ,
সে যাতে খুশি হয় , আমিও তাতে খুশি হই। সে যাতে কষ্ট পায়, আমিও তাতে কষ্ট পাই। ফাতিমা(রা) ছিলেন আল্লাহর রাসুলের (সা) অত্যন্ত আদরের সন্তান।
তিনি পৃথিবীতেই জাননাতের সু- সংবাদ পেয়েছিলেন । তিনি হবেন জাননাতের নারীদের কর্ণধার! সুবহান আললাহ!
তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত একমাত্র তিনি ই ছিলেন তাঁর জীবিত সন্তান ।
আল্লাহর রাসুল (স) চাইলে ফাতিমা( রা)কে একজন কেন, দশ জন খাদেম দিতে পারতেন । কিন্তু তিনি তা না করে ফাতিমাকে(রা) কে উপদেশ দিলেন, ঘরের কাজ নিজের হাতে করে যেতে।
আর হয়তো এই কারণেই ফাতিমা (রা) হয়ে উঠলেন চার সর্বশ্রেষ্ঠ নারীদের একজন।
জ্ঞানের দিক থেকে যদিও মা আয়েশা (রা )খাদিজাহ(রা) ও ফাতেমার (রা )উপরে, কিন্তু মর্যাদার দিক থেকে উনি খাদিজাহ(রা) ও ফাতেমার(রা) সমকক্ষ ছিলন না।
আমাদের বোনেরা, আপনারা যখন আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করবেন তখন আপনাদের কিসের উপর বেশি প্রাধান্য দেয়া দরকার তা ঠিক করে নেবেন ।
তথাকথিত নারীবাদীরা আপনাদের কে জাগতিক ব্যপারে কিছুটা সাহায্য করলেও আখিরাতে জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা করতে পারবে না ।
হযরত ফাতেমা জাহরা (রাঃ) ছিলেন নারী ও পুরুষ তথা
গোটা মানব জাতির জন্য অসাধারণ ত্যাগ, বিশ্বস্ততা, অন্যায়ের ব্যাপারে
আপোসহীনতা, সততা, দানশীলতা, ধৈর্য, চারিত্রিক পবিত্রতা, আল্লাহর প্রতি
সন্তুষ্টিসহ অনেক মহান স্বর্গীয় গুণের আদর্শ। আর এ জন্যেই তাঁর উপাধি ছিল আস-সিদ্দিক্বা
বা সত্য-নিষ্ঠ, আল-মুবারাকাহ বা বরকতপ্রাপ্ত, আত-ত্বাহিরা বা পবিত্র, আল-মারজিয়া বা
আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, আয যাকিয়া বা সতী, আয জাহরা বা দ্যূতিময় প্রভৃতি।
স্নেহময়ী জননীর মত বিশ্বনবী (সাঃ)’র সেবা-যত্ন করা এবং বিপদের সময়
তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য মহীয়সী নারী ফাতিমা (রাঃ)’র অন্য একটি
নাম উম্মে আবিহা বা পিতার জননী। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁকে সকল
যুগের নারীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে উল্লেখ করেছেন এবং আল্লাহর দরবারে তাঁর বিশেষ
মর্যাদার কারণে তাঁকে দেখলে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করতেন।
মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ফাতেমা আমার দেহের অংশ, যা কিছু তাকে সন্তুষ্ট
করে তা আমাকে সন্তুষ্ট করে এবং যা কিছু আমাকে সন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও
সন্তুষ্ট করে, আর যা কিছু ফাতেমাকে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়,
আর যা আমাকে কষ্ট দেয়, তা আল্লাহকেও কষ্ট দেয়।
হযরত ফাতিমা (রাঃ) বেহেশতে সর্ব প্রথম প্রবেশ করবেন বলে বিশ্বনবী- সাঃ উল্লেখ করেছেন।
অনেক ইসলামী বর্ণনা অনুযায়ী পবিত্র কোরআনের সূরা কাওসার-এ
উল্লেখিত কাওসার বলতে হযরত ফাতেমা (রাঃ) কেই বোঝানো হয়েছে।
মক্কার কাফের ও মুশরিকরা যখন বিশ্বনবী (সাঃ)কে আবতার বা নির্বংশ বলে উপহাস করতো, এবং
রাসূলের ওফাতের পরই তার ধর্ম শেষ হয়ে যাবে বলে প্রচার করতো তখন এই সূরা নাজেল হয়।
এ সূরায় কাফেররাই নির্বংশ হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
হযরত ফাতিমা (রাঃ)’র মাধ্যমে রাসূলে পাক (সাঃ)’র বংশধারা আজো অব্যাহত রয়েছে।
অন্যদিকে নির্মূল হয়ে গেছে আবু লাহাব ও আবু জাহেলদের বংশধর।
হযরত ফাতিমা (রাঃ) ছিলেন বিশ্বনবী (সাঃ) ‘র আহলে বাইত বা পবিত্র
বংশধারায় জন্ম নেয়া মুসলমানদের ১১ জন ইমামের জননী।
বিশ্বনবী (সাঃ) ও স্বামী আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (রাঃ)’র পর এই ১১ জনই
ইসলামকে সব সংকট ও দূর্যোগের কবল থেকে রক্ষার তরী হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন।
এরই প্রমাণ দেখা যায় কারবালায় তাঁর পুত্র হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)ও এর আগে হযরত ইমাম
হাসান (রাঃ)’র নজিরবিহীন আত্মত্যাগে। মুসলমানদের নেতা হিসেবে ও বেহেশতী
যুবকদের সর্দার হিসেবে এই দুই মহাপুরুষকে গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন হযরত ফাতেমা (রাঃ)।
বিশ্বনবী (সাঃ) তাঁদেরকে নিজ সন্তান বলে উল্লেখ করতেন।
একজন পরিপূর্ণ আদর্শ মানুষ হিসেবে হযরত ফাতিমা (রাঃ) এটা প্রমাণ করেছেন যে,
পরিপূর্ণতার শিখরে ওঠার জন্য নারী হওয়া বা পুরুষ হওয়া জরুরী কোনো শর্ত নয়।
তিনি জন্ম নিয়েছিলেন এমন এক যুগে যখন আরবরা নারীকে মনে করতো কেবল ভোগের সামগ্রী এবং
জাত্যাভিমানী আরবদের ঘরে কণ্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করলে তারা
অমর্যাদার ভয়ে কণ্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিত বা গোপনে মেরে ফেলতো ।
কিন্তু মহান আল্লাহ তার সর্বশেষ রাসূল ও সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের ঘরে একজন কন্যা
সন্তান পাঠিয়ে নারী জাতির জন্য অশেষ সম্মান ও মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন।
হযরত ফাতিমা (রাঃ) ছিলেন একজন আদর্শ জননী,একজন আদর্শ স্ত্রী বা গৃহিনী,একজন আদর্শ সমাজ-সেবিকা।
অর্থাৎ মুসলিম নারী যে শালীনতা বজায় রেখে জীবনের সবক্ষেত্রে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে তাঁর দৃষ্টান্ত দেখিয়ে গেছেন নবী-নন্দিনী।
আজকের যুগে যেসব মহিলা বা বুদ্ধিজীবী নারী-মুক্তির কথা ভাবছেন তাদের জন্য প্রকৃত আদর্শ হওয়া উচিত হযরত ফাতিমা (রাঃ)।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)’র ওফাতের পর খুব বেশি দিন বাঁচেন নি হযরত ফাতিমা (রাঃ)।
এ সময় ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও বাণীকে জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার
জন্য অসম-সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন নবী-নন্দিনী।
বিশ্বনবী (সাঃ)’র ওসিয়ত প্রচার এবং কিভাবে মুসলমানরা বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা
পাবে তা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন
বলে মনে করেন অনেক মুসলমান বিশেষজ্ঞ,ঐতিহাসিক ও আলেম।
তাদের মতে, ঐসব নির্যাতনের কারণেই তাঁকে অকালে শাহাদত বরণ করতে হয়েছে।
এমনকি অনেকে মনে করেন, তাঁর কবরও অবমাননার শিকার হতে পারে এমন
আশঙ্কায় তিনি তাকে গোপনে গভীর রাতে দাফন করতে বলেছিলেন স্বামী আমিরুল
মুমিনীন হযরত আলী (রাঃ) কে। আজো সকল শ্রেষ্ঠ গুণে গুণান্বিত এই মহিয়সী ও নীর্ভিক সংগ্রামী নারীর কবর অচিহ্নিত।
অন্যদিকে অন্য অনেক মুসলমান মনে করেন,
রাসূল (সাঃ)’র বিয়োগ-ব্যথায় শোকাকুল হযরত ফাতিমা (রাঃ) স্বাভাবিকভাবেই মারা গিয়েছিলেন
এবং তিনি কারো নির্যাতনের কারণে মারা যান নি।
যাই হোক্, হযরত ফাতিমা (রাঃ) মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ ও মুক্তির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন।
তাই মুক্তিকামী মুসলমানরা আজও কেবল তাঁর পবিত্র নাম স্মরণ করেই ইসলামের জন্য জীবন বিলিয়ে দিতে দ্বিধা বোধ করেন না।
হযরত ফাতিমা (রাঃ)’র সান্নিধ্য ও সেবা না পেলে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী(রাঃ)’র জীবনও
পুরোপুরি বিকশিত ও পরিপূর্ণতা লাভ করতো না। তাঁরা ছিলেন একে-অপরের প্রতি পুরোপুরি সন্তুষ্ট।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) হযরত ফাতিমা (রাঃ)-কে মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতা বলেও প্রশংসা করেছেন।
তিনি বলতেন,আমি যখনই বেহেশতের সুবাস পেতে চাইতাম তখনই কণ্যা ফাতেমার ঘ্রাণ নেই।
রাসূল (সাঃ)একবার প্রাণপ্রিয় কণ্যাকে বলেছিলেন, হে ফাতেমা! আল্লাহ তোমাকে নির্বাচিত করেছেন,
তোমাকে পরিপূর্ণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় সজ্জিত করেছেন এবং তোমাকে বিশ্বের নারীকূলের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।
হযরত ইমাম হাসান মুজতাবা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, একবার শুক্রবার রাতে
দেখলাম মা ফাতিমা (রাঃ) এবাদতে মগ্ন। একটানা রূকু ও আর সেজদায় থাকতে থাকতে ভোরের আলো ফুটে উঠলো।
আমি শুনতে পেলাম তিনি মুমিন নারী ও পুরুষের জন্য অনেক দোয়া করছেন,কিন্তু নিজের
জন্য কোনো দোয়াই করলেন না। আমি প্রশ্ন করলাম, মা, আপনি কেন নিজের জন্য দোয়া করলেন না,
যেভাবে অন্যরা দোয়া করে থাকে?তিনি জবাবে বললেন, হে আমার পুত্র! আগে প্রতিবেশির কথা ভাবতে হবে, এরপর নিজের ঘরের কথা … ।
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করা ছাড়াও প্রায়ই
রোজা রাখা ও গরীব-দূঃখীকে অসাধারণ মাত্রায় দান-খয়রাত করা ছিল হযরত ফাতিমা (রাঃ) ’র একটি বড় বৈশিষ্ট্য।
জনসাধারণ বা কারো উদ্দেশ্যে যে কোনো বক্তব্য রাখার আগে দীর্ঘক্ষণ ধরে মহান
আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামতের কথা খুব সুন্দর ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায় তুলে ধরে আল্লাহর প্রশংসা করা ছিল তাঁর অন্য একটি বড় বৈশিষ্ট্য।
বিশ্বনবী (সাঃ)’র আহলে বাইতের অন্য সদস্যদের মত তিনিও কখনও অন্যায়ের সাথে আপোস করেন নি।
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা বা সক্রিয় থাকার মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন আনন্দ।
হযরত ফাতিমা (রাঃ) বলেছেন, আল্লাহর সেবায় মশগুল হয়ে যে সন্তুষ্টি পাই তা
আমাকে অন্য সব সন্তুষ্টি বা আনন্দ থেকে বিরত রাখে এবং সব সময় মহান আল্লাহর
সুন্দর দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ রাখার প্রার্থণা ছাড়া আমার অন্য কোনো প্রত্যাশা নেই।
হযরত খাদিজাতুল কুবরা রাদিয়াল্লাহু ঃ-নাম তাঁর খাদীজা। কুনিয়াত ‘উম্মু হিন্দ’ এবং লকব ‘তাহিরা’।
পিতা খুওয়াইলিদ, মাতা ফাতিমা বিনতু যায়িদ। জন্ম ‘আমুল ফীল’ বা হস্তীবর্ষের পনের বছর আগে মক্কা নগরীতে।
পিতৃ-বংশের উর্ধ পুরুষ কুসাঈ-এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর সা. নসবের সাথে তাঁর নসব মিলিত হয়েছে।
জাহিলী যুগেই পূতপবিত্র চরিত্রের জন্য ‘তাহিরা’ উপাধি লাভ করেন।
(আল–ইসাবা) রাসূলুল্লাহ সা. ও খাদীজার রা. মধ্যে ফুফু-ভাতিজার দূর সম্পর্ক ছিল।
এ কারণে, নবুওয়াত লাভের পর খাদীজা রা. রাসূলুল্লাহকে সা. তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবন
নাওফিলের কাছে নিয়ে গিয়ে বলেন, ‘আপনার ভাতিজার কথা শুনুন।’ সম্ভবতঃ বংশগত সম্পর্কের ভিত্তিতেই তিনি একথা বলেছিলেন।
পিতা খুওয়াইলিদ তৎকালীন আরব সমাজের বিশিষ্ট তাওরাত ও ইনজীল বিশেষজ্ঞ ওয়ারাকা ইবন নাওফিলকে
খাদীজার বর নির্বাচন করেছিলেন, কিন্তু কেন যে তা বাস্তবে রূপ লাভ করেনি সে সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা নীরব।
শেষ পর্যন্ত আবু হালা ইবন যারারাহ আত-তামীমীর সাথে তাঁর প্রথম বিয়ে হয়।
জাহিলী যুগেই তাঁর মৃত্যু হয়। আবু হালার মৃত্যুর পর ’আতীক বিন আবিদ আল-মাখযুমীর সাথে তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে হয়।
(শারহুল মাওয়াহিব, আল–ইসতিয়াব) তবে কাতাদার সূত্রে জানা যায়, তাঁর প্রথম স্বামী ’আতীক, অতঃপর আবু হালা।
ইবন ইসহাকও এ মত সমর্থন করেছেন বলে ইউনুস ইবন বুকাইর বর্ণনা করেছেন।
(আল ইসাবাঃ ৪/২৮১) তবে প্রথমোক্ত মতটি ইবন আবদিল বার সহ অধিকাংশের মত বলে ইবন হাজার উল্লেখ করেছেন।
খাদীজার পিতা খুওয়াইলিদ ইবন আসাদ ছিলেন ফিজার যুদ্ধে নিজ গোত্রের কমাণ্ডর।
তিনি ছিলেন বহু সন্তানের জনক। প্রথম পুত্র হিযাম।
এই হিযামের পুত্র প্রখ্যাত সাহাবী হাকীম জাহিলী যুগে মক্কার ‘দারুন নাদওয়ার’ পরিচালনভার লাভ করেছিলেন।
দ্বিতীয় সন্তান হযরত খাদীজা। তৃতীয় সন্তান ‘আওয়াম’ প্রখ্যাত সাহাবী হযরত যুবাইরের রা. পিতা।
রাসূলুল্লাহর সা. ফুফু এবং হযরত হামযার আপন বোন হযরত সাফিয়্যা রা. ছিলেন ‘আওয়ামের’ স্ত্রী বা যুবাইরের রা. মা।
সাফিয়্যা ছিলেন খাদীজার ছোট ভাইয়ের বউ। চতুর্থ সন্তান হালা।
তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. মেয়ে হযরত যয়নাবের রা. স্বামী আবুল আস ইবন রাবী’র মা।
আবূল আ’স রাসূলুল্লাহর সা. বড় জামাই। পঞ্চম সন্তান রুকাইয়া।
পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে হিযাম, আওয়াম এবং রুকাইয়া ইসলামের আবির্ভাবের আগেই মারা যান।
হযরত খাদীজা ও হালা ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন।
খাদীজার পিতার মৃত্যু কখন হয়েছিল, সে সম্পর্কে মতভেদ আছে।
কেউ বলেছেন, ‘ফিজার’ যুদ্ধে মারা যান। ইমাম সুহাইলীর মতে ফিজার যুদ্ধের আগেই মারা যান।
তখন খাদীজার বয়স পঁয়ত্রিশ। কারো কারো মতে রাসূলুল্লাহর সা. বিয়ের পর তিনি মারা যান। (হায়াতুস সাহাবা– ২/৬৫২)।
পিতা বা স্বামীর মৃত্যু বা যে কোন কারণেই হোক কুরাইশ বংশের অনেকের মত খাদীজাও ছিলেন একজন বড় ব্যবসায়ী।
ইবন সা’দ তাঁর ব্যবসায় সম্পর্কে বলছেনঃ ‘খাদীজা ছিলেন অত্যন্ত সম্মানিত ও সম্পদশালী ব্যবসায়ী মহিলা।
তাঁর বাণিজ্য সম্ভার সিরিয়া যেত এবং তাঁর একার পণ্য কুরাইশদের সকলের পণ্যের সমান হতো।’
ইবন সা’দের এ মন্তব্য দ্বারা খাদীজার ব্যবসায়ের পরিধি উপলব্ধি করা যায়।
অংশীদারী বা মজুরী বিনিময়ে যোগ্য লোক নিয়োগ করে তিনি দেশ বিদেশে মাল কেনাবেচা করতেন।রাসূলুল্লাহ সা. তখন পঁচিশ বছরের যুবক। এর মধ্যে চাচা আবু তালিবের সাথে বা একাকী কয়েকটি বাণিজ্য সফরে গিয়ে ব্যবসায় সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছেন।
ব্যবসায়ে তাঁর সততা ও আমানতদারীর কথাও মক্কার মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।
সবার কাছে তিনি তখন আল-আমীন। তাঁর সুনামের কথা খাদীজার কানেও পৌঁছেছে।
বিশেষতঃ তাঁর ছোট ভাই-বউ সাফিয়্যার কাছে আল-আমীন মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে বহু কথাই শুনে থাকবেন।
হযরত খাদীজা একবার কেনাবেচার জন্য সিরিয়ায় পণ্য পাঠাবার চিন্তা করলেন।
যোগ্য লোকের সন্ধান করছেন।
এ প্রসঙ্গে ওয়াকিদী থেকে যারকানীর বর্ণনাঃ ‘আবু তালিব মুহাম্মাদকে সা. ডেকে বললেনঃ ভাতিজা! আমি একজন দরিদ্র মানুষ, সময়টাও খুব সঙ্কটজনক।
মারাত্মক দুর্ভিক্ষের কবলে আমরা নিপতিত। আমাদের কোন ব্যবসায় বা অন্য কোন উপায়-উপকরণ নেই। তোমার গোত্রের একটি বাণিজ্য কাফিলা সিরিয়া যাচ্ছে।
খাদীজা তাঁর পণ্যের সাথে পাঠানোর জন্য কিছু লোকের খোঁজ করছে। তুমি যদি তার কাছে যেতে, হয়তো তোমাকেই সে নির্বাচন করতো। তোমার চারিত্রিক নিষ্কলুষতা তার জানা আছে।
যদিও তোমার সিরিয়া যাওয়া আমি পছন্দ করিনে এবং ইয়াহুদীদের পক্ষ থেকে তোমার জীবনের আশঙ্কা করি, তবুও এমনটি না করে উপায় নেই।’ জবাবে রাসূল সা. বললেন, সম্ভবতঃ সে নিজেই লোক পাঠাবে।
আবু তালিব বললেনঃ হয়তো অন্য কাউকে সে নিয়োগ করে ফেলবে।
চাচা-ভাতিজার এ সংলাপের কথা খাদীজার কানে গেল। ‘তিনি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট লোক পাঠালেন।’ (টীকা, সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৮) উল্লেখ থাকে যে, কৈশোরে একবার রাসূল সা. চাচার সাথে সিরিয়া গিয়েছিলেন।
তখন পাদরী ‘বুহাইরা’ রাসূলুল্লাহ সা. সম্পর্কে আবু তালিবকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন্।
উপরোক্ত বর্ণনায় আবু তালিব সে দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।
খাদীজা লোক মারফত মুহাম্মাদের সা. কাছে প্রস্তাব পাঠালেন, তিনি যদি ব্যবসায়ের দায়িত্ব নিয়ে সিরিয়া যান, অন্যদের তুলনায় খাদীজা তাঁকে দ্বিগুণ মুনাফা দেবেন। মুহাম্মাদ সা. রাজী হলেন।
খাদীজার রা. পণ্য-সামগ্রী নিয়ে তাঁর বিশ্বস্ত দাস মায়সারাকে সঙ্গে করে মুহাম্মাদ সা. চললেন সিরিয়া।
পথে এক গীর্জার পাশে একটি গাছের ছায়ায় বসে আছেন তিনি। গীর্জার পাদ্রী এগিয়ে গেলেন মায়সারার দিকে।
জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘গাছের নিচে বিশ্রামরত লোকাটি কে?’ মায়সারা বললেনঃ ‘মক্কার হারামবাসী কুরাইশ গোত্রের একটি লোক।’ পাদ্রী বললেনঃ ‘এখন এই গাছের নীচে যিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি একজন নবী ছাড়া আর কেউ নন।’ ঐতিহাসিকরা এই পাদ্রীর নাম ‘নাসতুরা’ বলে উল্লেখ করেছেন। (টীকা, সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৮) তবে ইবন হাজার ’আসকালানী এই পাদ্রীর নাম ‘বুহাইরা’ বলেছেন। (আল–ইসাবাঃ ৪/২৮১) তিনি আরো বলেছেন, এই বাণিজ্য সম্ভার নিয়ে রাসূল সা. বসরার বাজারে গিয়েছিলেন। তাবারী ইবন শিহাব যুহরী থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. খাদীজার পণ্য নিয়ে সিরিয়া নয়, বরং ইয়ামনের এক হাবশী বাজারে গিয়েছিলেন। তবে সিরিয়া যাওয়ার বর্ণনাটাই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। (তারীখুল উম্মাহ আল ইসলামিয়া, মুহাম্মদ আল–খিদরী বেকঃ ১/৬৪)
রাসূলুল্লাহ সা. সিরিয়ার বাজারে পণ্যদ্রব্য বিক্রী করলেন এবং যা কেনার তা কিনলেন। তারপর মায়সারাকে সঙ্গে করে মক্কার পথে রওয়ানা হলেন। পথে মায়সারা লক্ষ্য করলেন, রাসূল সা. তাঁর উটের ওপর সওয়ার হয়ে চলেছেন, আর দু’জন ফিরিশতা দুপুরের প্রচণ্ড রোদে তাঁর ওপর ছায়া বিস্তার করে রেখেছে। এভাবে মক্কায় ফিরে খাদীজার পণ্য-সামগ্রী বিক্রী করলেন।
ব্যবসায়ে এবার দ্বিগুণ অথবা দ্বিগুণের কাছাকাছি মুনাফা হলো। বাড়ী ফিরে বিশ্বস্ত ভৃত্য মায়সারা তাঁর মনিব খাদীজার নিকট পাদ্রীর মন্তব্য এবং সফরের অলৌকিক ঘটনাবলী সবিস্তার বর্ণনা করলেন। (সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৯)
হযরত খাদীজা রা. ছিলেন এক বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমতি ভদ্র মহিলা। তাঁর ধন-সম্পদ, ভদ্রতা ও লৌকিকতায় মক্কার সর্বস্তরের মানুষ মুগ্ধ ছিল। অনেক অভিজাত কুরাইশ যুবকই তাঁকে সহধর্মিনী হিসেবে লাভ করার প্রত্যাশী ছিল।
তিনি তাদের সকলকে প্রত্যাখ্যান করেন। মায়সারার মুখে সবকিছু শুনে খাদীজা নিজেই রাসূলুল্লাহর সা. নিকট বিয়ের পয়গাম পাঠান। (সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৯)
বিয়ের প্রস্তাব কিভাবে এবং কেমন করে হয়েছিল সে সম্পর্কে নানা রকম বর্ণনা রয়েছে।
তবে খাদীজাই যে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহর সা. নিকট প্রস্তাবটি পেশ করেন সে ব্যাপারে সব বর্ণনা একমত।
একটি বর্ণনায় এসেছে, খাদীজা রা. নিজেই রাসূলুল্লাহর সা. সাথে কথা বলেন এবং তাঁর পিতার নিকট প্রস্তাবটি উত্থাপন করার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি অস্বীকৃতি জানান এই বলে যে, দারিদ্রের কারণে হয়তো খাদীজার পিতা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করবেন।
অবশেষে খাদীজার পিতা যখন অতিরিক্ত মদপান করে মাতাল অবস্থায় ছিলেন তখন খাদীজা নিজেই বিষয়টি তাঁর কাছে উত্থাপন করেন এবং সম্মতি আদায় করেন। কিন্তু সুস্থ হয়ে আবার তিনি বেঁকে বসেন। তবে খাদীজা পুনরায় তাঁর সম্মতি আদায় করেন। (হায়াতুস সাহাবা– ২/৬৫২) অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, হযরত ইয়ালার স্ত্রী ও খাদীজার বান্ধবী ‘নাফীসা বিনতু মানিয়্যা’ এ ব্যাপারে পুরো উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
তিনিই সর্বপ্রথম খাদীজার পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট এভাবে প্রস্তাব পেশ করেনঃ ‘আপনাকে যদি ধন-সম্পদ, সৌন্দর্য ও জীবিকার নিশ্চয়তার দিকে আহ্বান জানানো হয়, আপনি কি গ্রহণ করবেন? ….এ কথাগুলি ছিল হযরত খাদীজা সম্পর্কে।
কথা পাকাপাকি হয়ে গেল। নির্ধারিত তারিখে আবু তালিব, হামযাসহ রাসূলুল্লাহর সা. খান্দানের আরো কিছু ব্যক্তি খাদীজার বাড়ী উপস্থিত হলেন। খাদীজাও তাঁর খান্দানের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। সকলের উপস্থিতিতে আবু তালিব বিয়ের খুতবা পাঠ করলেন। সাহিত্যিক উৎকর্ষের দিক দিয়ে এ খুতবা জাহিলী যুগের আরবী-গদ্য সাহিত্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। পাঁচশ’ স্বর্ণমুদ্রা মোহর ধার্য হয়। খাদীজা নিজেই উভয় পক্ষের যাবতীয় খরচ বহন করেছিলেন। তিনি দুই উকিয়া সোনা ও রুপো রাসূলুল্লাহর সা. নিকট পাঠান এবং তা দিয়ে উভয়ের পোশাক ও ওয়ালীমার বন্দোবস্ত করতে বলেন। (হায়াতুস সাহাবা– ২/৬৫২) এভাবে হযরত খাদীজা হলেন ‘উম্মুল মুমিনীন’। এটা নবুয়াত প্রকাশের পনের বছর পূর্বের ঘটনা। সে সময় তাঁদের উভয়ের বয়স সম্পর্কে সীরাত বিশেষজ্ঞদের মতপার্থক্য থাকলেও সর্বাধিক সঠিক মতানুযায়ী রাসূলুল্লাহর সা. বয়স ছিল পঁচিশ এবং খাদীজার চল্লিশ।
বিয়ের পনের বছর পর হযরত নবী করীম সা. নবুওয়াত লাভ করেন। তিনি খাদীজাকে রা. সর্বপ্রথম এ বিষয়ে অবহিত করেন। পূর্ব থেকেই খাদীজা রাসূলুল্লাহর সা. নবী হওয়া সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন।
সহীহ বুখারীর ‘ওহীর সূচনা’ অধ্যায়ে একটি হাদীসে বিষয়টির বিস্তারিত আলোচনা এসেছে। হযরত আয়িশা রা. বলেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি প্রথম ওহীর সূচনা হয় ঘুমে সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। স্বপ্নে যা কিছু দেখতেন তা সকাল বেলার সূর্যের আলোর ন্যায় প্রকাশ পেত। তারপর নির্জনে থাকতে ভালোবাসতেন। খানাপিনা সঙ্গে নিয়ে হিরা গুহায় চলে যেতেন।
সেখানে একাধারে কয়েকদিন ইবাদতে মশগুল থাকতেন। খাবার শেষ হয়ে গেলে আবার খাদীজার কাছে ফিরে আসতেন। খাদ্যদ্রব্য নিয়ে আবার গুহায় ফিরে যেতেন। এ অবস্থায় একদিন তাঁর কাছে সত্যের আগমণ হলো।
ফিরিশতা এসে তাঁকে বললেনঃ আপনি পড়ুন।তিনি বললেনঃ ‘আমি তো পড়া-লেখার লোক নই।’ ফিরিশতা তাঁকে এমন জোরে চেপে ধরলেন যে তিনি কষ্ট অনুভব করলেন। ছেড়ে দিয়ে আবার বললেনঃ ‘পড়ুন’। তিনি আবারো বললেনঃ ‘আমি পড়া-লেখার লোক নই’। ফিরিশতা দ্বিতীয় ও তৃতীয়বারও তাঁর সাথে প্রথমবারের মত আচরণ করলেন।
অবশেষে বললেনঃ ‘পড়ুন’ আপনার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্তপিণ্ড থেকে….’ রাসূল সা. ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরলেন। খাদীজাকে ডেকে বললেনঃ ‘আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও, কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও।’ তিনি ঢেকে দিলেন। তাঁর ভয় দূর হয়ে গেল।
তিনি খাদীজার নিকট পুরো ঘটনা খুলে বললেন এবং নিজের জীবনের আশংকার কথা ব্যক্ত করলেন। খাদীজা বললেনঃ না, তা কক্ষণো হতে পারে না। আল্লাহর কসম, তিনি আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না।
আপনি আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ়কারী, গরীব-দুঃখীর সাহায্যকারী, অতিথিপরায়ণ ও মানুষের বিপদে সাহায্যকারী। অতঃপর খাদীজা রা. রাসূলুল্লাহকে সা. সংগে করে তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবন নাওফিলের নিকট নিয়ে যান। সেই জাহিলী যুগে তিনি খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। হিব্রু ভাষায় ইনজীল কিতাব লিখতেন। তিনি বৃদ্ধ ও দৃষ্টিহীন। খাদীজা রা. বললেনঃ ‘শুনুন তো আপনার ভাতিজা কি বলে।’ তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘ভাতিজা তোমার বিষয়টি কি?’ রাসূলুল্লাহ সা. পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন। শুনে ওয়ারাকা বললেনঃ ‘এতো সেই ‘নামূস’-আল্লাহ যাঁকে মুসার আ. নিকট পাঠিয়েছিলেন। আফসুস! সে দিন যদি আমি জীবিত ও সুস্থ থাকতাম, যেদিন তোমার দেশবাসী তোমাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে।’ রাসূলুল্লাহ সা. জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘এরা আমাকে দেশ থেকে বের করে দেবে? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, তুমি যা নিয়ে এসেছো, যখনই কোন ব্যক্তি তা নিয়ে এসেছে, সারা দুনিয়া তাঁর বিরোধী হয়ে গেছে। যদি সে সময় পর্যন্ত আমি বেঁচে থাকি, তোমাকে সব ধরণের সাহায্য করবো। (বুখারী, ১ম খণ্ড) এ ঘটনার অল্প কিছুদিনের মধ্যে ওয়ারাকার মৃত্যু হয়।
ইসলাম গ্রহণের পর হযরত খাদীজা তাঁর সকল ধন-সম্পদ তাবলীগে দ্বীনের লক্ষ্যে ওয়াকফ করেন। রাসূল সা. ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে আল্লাহর ইবাদাত এবং ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। সংসারের সকল আয় বন্ধ হয়ে যায়। সেই সাথে বাড়তে থাকে খাদীজার দুশ্চিন্তা। তিনি ধৈর্য ও সহনশীলতার সাথে সব প্রতিকূল অবস্থার মুকাবিলা করেন। আল–ইসতিয়াব গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, ‘মুশরিকদের প্রত্যাখ্যান ও অবিশ্বাসের কারণে রাসূল সা. যে ব্যথা অনুভব করতেন, খাদীজার কাছে এলে তা দূর হয়ে যেত। কারণ, তিনি রাসূলকে সা. সান্ত্বনা দিতেন, সাহস ও উৎসাহ যোগাতেন। তাঁর সব কথাই তিনি বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করতেন। মুশরিকদের সকল অমার্জিত আচরণ তিনি রাসূলুল্লাহর সা. কাছে অত্যন্ত হালকা ও তুচ্ছভাবে তুলে ধরতেন।’ (তাবাকাত– ৩/৭৪০)
নবুওয়াতের সপ্তম বছর মুহাররম মাসে কুরাইশরা মুসলমানদের বয়কট করে। তাঁরা ‘শিয়াবে আবু তালিবে’ আশ্রয় গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহর সা. সাথে খাদীজাও সেখানে অন্তরীণ হন। প্রায় তিনটি বছর বনী হাশিম দারুণ দুর্ভিক্ষের মাঝে অতিবাহিত করে। গাছের পাতা ছাড়া জীবন ধারণের আর কোন ব্যবস্থা তাদের ছিল না। স্বামীর সাথে খাদীজাও হাসি মুখে সে কষ্ট সহ্য করেন। এমন দুর্দিনে হযরত খাদীজা রা. নিজের প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন উপায়ে কিছু খাদ্য খাবারের ব্যবস্থা মাঝে মাঝে করতেন। তাঁর তিন ভাতিজা- হাকীম ইবন হিযাম, আবুল বুখতারী ও যুময়া ইবনুল আসওয়াদ- তাঁরা সকলে ছিলেন কুরাইশ নেতৃবর্গের অন্যতম। অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা বিভিন্নভাবে মুসলমানদের কাছে খাদ্যশস্য পাঠানোর ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। একদিন হাকীম ইবন হিযাম তাঁর চাকরের মাধ্যমে ফুফু খাদীজার রা. কাছে কিছু গম পাঠাচ্ছিলেন। পথে আবু জাহল বাধা দেয়। হঠাৎ আবুল বুখতারী সেখানে উপস্থিত হন। তিনি আবু জাহলকে বললেন, এক ব্যক্তি তাঁর ফুফুকে সামান্য খাদ্য পাঠাচ্ছে, তুমি তা বাধা দিচ্ছ? (সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৯২)
নামায ফরয হওয়ার হুকুম নাযিল হয়নি, হযরত খাদীজা রা. ঘরের মধ্যে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে সেই প্রথম থেকেই নামায আদায় করতেন। (তাবাকাত– ৮/১০) ইবন ইসহাক উল্লেখ করেছেন, একদিন আলী রা. দেখতে পেলেন, তাঁরা দু’জন অর্থাৎ নবী সা. ও খাদীজা রা. নামায আদায় করছেন। আলী রা. জিজ্ঞেস করলেনঃ মুহাম্মাদ, এ কি? রাসূল সা. তখন নতুন দ্বীনের দাওয়াত আলীর কাছে পেশ করলেন এবং একথা কাউকে বলতে নিষেধ করলেন। (হায়াতুস সাহাবা– ১/৭০) এ বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায়, উম্মাতে মুহাম্মাদীর সা. মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত খাদীজা রা. রাসূলুল্লাহর সা. সাথে নামায আদায়ের গৌরব অর্জন করেন।
আফীক আল-কিন্দী নামক এক ব্যক্তি কিছু কেনাকাটার জন্য মক্কায় এসেছিলেন। হযরত আব্বাসের রা. বাড়েতে অবস্থান করছিলেন তিনি। একদিন সকালে লক্ষ্য করলেন, এক যুবক কাবার কাছে এসে আসমানের দিকে তাকালো। তারপর কিবলামুখী হয়ে দাঁড়ালো। একজন কিশোর এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর এলো এক মহিলা। সেও তাদের দু’জনের পেছনে দাঁড়ালো। তারা নামায শেষ করে চলে গেল। দৃশ্যটি আফীক কিন্দী দেখলেন। আব্বাসকে তিনি বললেনঃ ‘বড় রকমের একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে।’ আব্বাস বললেনঃ ‘হ্যাঁ’ তিনি আরো বললেনঃ ‘এ নওজোয়ান আমার ভাতিজা মুহাম্মাদ।’ কিশোরটি আমার আরেক ভাতিজা আলী এবং মহিলাটি মুহাম্মাদের স্ত্রী। ….আমার জানামতে দুনিয়ায় তারা তিনজনই মাত্র এই নতুন ধর্মের অনুসারী।’ (তাবাকাতঃ ৮/১০–১১)
ইবনুল আসীর বলেন, এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মার ইজমা হয়েছে যে, হযরত খাদীজা রাসূলুল্লাহর সা. ওপর সর্বপ্রথম ঈমান আনেন। ইসলাম গ্রহণের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল পঞ্চাশ বছর। তাঁর ইসলাম গ্রহণের প্রভাব তাঁর পিতৃকুলের লোকদের ওপরও পড়ে। ইসলামের আবির্ভাবের সময় পিতৃকুল বনু আসাদ ইবন আবদিল উয্যার পনের জন্য বিখ্যাত ব্যক্তি জীবিত ছিলেন। তাঁদের দশজনই ইসলাম গ্রহণ করেন। অন্য পাঁচজন কাফির অবস্থায় বদর যুদ্ধে নিহত হন।
রাসূলুল্লাহর সা. সাথে পঁচিশ বছর দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করার পর নবুওয়াতের দশম বছরে দশই রামাদান পঁয়ষট্টি বছর বয়সে হযরত খাদীজা মক্কায় ইনতিকাল করেন। জানাযা নামাযের বিধান তখনো প্রচলিত হয়নি। সুতরাং বিনা জানাযায় তাঁকে মক্কার কবরস্তান জান্নাতুল মুয়াল্লায় দাফন করা হয়। হযরত নবী করীম সা. নিজেই তাঁর লাশ কবরে নামান। (আল–ইসাবাঃ ৪/২৮৩)
হযরত খাদীজা রা. ওয়াফাতের অল্প কিছুদিন পর রাসূলুল্লাহর সা. বিশেষ হিতাকাঙ্ক্ষী চাচা আবু তালিব মারা যান। অবশ্য আল-ইসতিয়াবের একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে, আবু তালিবের মৃত্যুর তিনদিন পর খাদীজা ইনতিকাল করেন। বিপদে-আপদে এ চাচাই রাসূলুল্লাহকে সা. নানাভাবে সাহায্য করতেন। রাসূলুল্লাহর সা. দুই নিকটাত্মীয়ের ওয়াফাতের কারণে মুসলিম উম্মাহ্র নিকট এ বছরটি ‘আমুল হুয্ন’ বা শোকের বছর নামে অভিহিত হয়েছে।
হযরত খাদীজা রা. ছিলেন বহু সন্তানের জননী। প্রথম স্বামী আবু হালার ঔরসে হালা ও হিন্দ নামে দু’ছেলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা উভয়ে ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। হিন্দ বদর মতান্তরে উহুদ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন প্রাঞ্জলভাষী বাগ্মী। উটের যুদ্ধে আলীর রা. পক্ষে শাহাদাত বরণ করেন। দ্বিতীয় স্বামী ’আতীকের ঔরসে হিন্দা নাম্মী এক মেয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনিও ইসলাম গ্রহণ করে সাহাবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। (শারহুল মাওয়াকিব, আল–ইসতিয়াব, হাশিয়া, সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৭) অবশ্য অন্য একট বর্ণনা মতে প্রথম পক্ষে তাঁর তিনটি সন্তান জন্মলাভ করেন। দুই ছেলে- হিন্দ ও হারিস। হারিসকে এক কাফির কাবার রুকনে ইয়ামনীর নিকট শহীদ করে ফেলে। এক কন্যা যয়নাব। আর দ্বিতীয় পক্ষের কন্যাটির কুনিয়াত ছিল উম্মু মুহাম্মাদ। (দাখিরা–ই–মা’রিফ–ই–ইসলামিয়া)
হযরত রাসূলে কারীমের সা. পবিত্র ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন তাঁর ছয় সন্তান। প্রথম সন্তান হযরত কাসিম। অল্প বয়সে মক্কা শরীফে ইনতিকাল করেন। তাঁর নাম অনুসারে রাসূলুল্লাহর সা. কুনিয়াত হয় আবুল কাসিম। মৃত্যুর পূর্বে তিনি হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটা শিখেছিলেন। দ্বিতীয় সন্তান হযরত যয়নাব। তৃতীয় সন্তান হযরত আবদুল্লাহ। তিনি নবুওয়াত প্রাপ্তির পর জন্মলাভ করেছিলেন, তাই ‘তাইয়্যেব ও তাহির’ লকব লাভ করেন। অল্প বয়সে ইনতিকাল করেন। চতুর্থ সন্তান হযরত রুকাইয়া। পঞ্চম সন্তান হযরত উম্মু কুলসুম। ষষ্ঠ সন্তান হযরত ফাতিমা রা.। উল্লেখ্য যে, ইবরাহীম ছিলেন হযরত মারিয়ার গর্ভজাত সন্তান।
হযরত খাদীজা রা. সন্তানদের খুব আদর করতেন। আর্থিক সচ্ছলতাও ছিল। উকবার দাসী সালামাকে মজুরীর বিনিময়ে সন্তানদের দেখাশোনার জন্য নিয়োজিত করেছিলেন।
হযরত নবী কারীমের সা. পবিত্র স্ত্রীগণের মধ্যে হযরত খাদীজার স্থান সর্বেোচ্চে। তিনি প্রথম স্ত্রী, চল্লিশ বছর বয়সে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে বিয়ে হয়। তাঁর জীবদ্দশায় নবী করীম সা. আর কোন বিয়ে করেননি। হযরত ইবরাহীম ছাড়া রাসূলুল্লাহর সা. সব সন্তানই তার গর্ভে পয়দা হয়েছেন।
উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজার ফজীলত ও মর্যাদা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি, আরবের সেই ঘোর অন্ধকার দিনে কিভাবে এক মহিলা নিঃসঙ্কোচে রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াতে বিশ্বাস স্থাপন করছেন। তাঁর মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ও সংশয় নেই। সেই ওহী নাযিলের প্রথম দিনটি, ওয়ারাকার নিকট গমন এবং রাসূলুল্লাহর সা. নবী হওয়া সম্পর্কে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা- সবকিছুই গভীরভাবে ভেবে দেখার বিষয়। রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াত লাভের পূর্ব থেকে খাদীজা যেন দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন- তিনি নবী হবেন। তাই জিবরাঈলের আগমণের পর ক্ষণিকের জন্যও তার মনে কোন রকম ইতস্ততঃভাব দেখা দেয়নি। এতে তাঁর গভীর দূরদৃষ্টি ও তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নবুওয়াত লাভের পূর্বে ও পরে সর্বদাই তিনি রাসূলুল্লাহকে সা. সম্মান করেছেন, তাঁর প্রতিটি কথা বিশ্বাস করেছেন। পঁচিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে মুহূর্তের জন্যও তাঁর মনে কোন প্রকার সন্দেহ দানা বাঁধতে পারেনি। সেই জাহিলী যুগেও তিনি ছিলেন পূতঃপবিত্র। কখনো মূর্তিপূজা করেননি। নবী করীম সা. একদিন তাঁকে বললেনঃ ‘আমি কখনো লাত-উযযার ইবাদত করবো না।’ খাদীজা বলেছিলেনঃ লাত-উয্যার কথা ছেড়ে দিন। তাদের প্রসঙ্গই উত্থাপন করবেন না। (মুসনাদে আহমাদ– ৪/২২২)
নবুওয়াতে মুহাম্মাদীর সা. ওপর প্রথম বিশ্বাস স্থাপনকারী এবং তাঁর সাথে প্রথম সালাত আদায়কারীই শুধু তিনি নন।
সেই ঘোর দুর্দিনে ইসলামের জন্য তিনি যে শক্তি যুগিয়েছেন চিরদিন তা অম্লান হয়ে থাকবে।
ইসলামের সেই সূচনা লগ্নে প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. পরামর্শ দাত্রী।
রাসূলুল্লাহর সা. সাথে বিয়ের পর সমস্ত সম্পদ তিনি স্বামীর হাতে তুলে দেন। যায়িদ বিন হারিসা ছিলেন তাঁর প্রিয় দাস। তাকেও তিনি স্বামীর হাতে তুলে দেন। রাসূলুল্লাহ সা. যায়িদকে বেশী ভালোবাসতেন, তাই তাঁকে খুশী করার জন্য তাকে আযাদ করে দেন।
মক্কার একজন ধনবতী মহিলা হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজ হাতে স্বামীর সেবা করতেন। একবার তিনি বরতনে করে রাসূলুল্লাহর সা. জন্য কিছু নিয়ে আসছিলেন।
হযরত জিবরীল আ. রাসূলকে সা. বললেন, ‘আপনি তাঁকে আল্লাহ তা’আলা ও আমার সালাম পৌঁছিয়ে দিন।’ (বুখারী)
হযরত রাসূলে করীম সা. প্রিয়তমা স্ত্রী খাদীজার রা. স্মৃতি তাঁর মৃত্যুর পরও ভোলেননি।
তাঁর মৃত্যুর পর বাড়ীতে যখনই কোন পশু জবেহ হতো, তিনি তালাশ করে তাঁর বান্ধবীদের ঘরে ঘরে গোশত পাঠিয়ে দিতেন।
হযরত আয়িশা বলেনঃ যদিও আমি খাদীজাকে রা. দেখিনি, তবুও তাঁর প্রতি আমার ঈর্ষা হতো। অন্য কারো বেলায় কিন্তু এমনটি হতো না। কারণ, নবী কারীম সা. সবসময় তাঁর কথা স্মরণ করতেন।’
মাঝে মাঝে হযরত আয়িশা রা. রাসূলুল্লাহকে সা. রাগিয়ে তুলতেন।
রাসূল সা. বলতেনঃ ‘আল্লাহ আমার অন্তরে তাঁর ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন।’
হযরত খাদীজার রা. ওয়াফাতের পর তাঁর বোন হালা একবার রাসূলে কারীমের সা. সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলেন।
রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর কণ্ঠস্বর শুনেই বলে উঠলেন ‘হালা এসেছো’? রাসূলুল্লাহর সা. মানসপটে তখন খাদীজার স্মৃতি ভেসে উঠেছিল।
আয়িশা রা. বলে ফেললেন, ‘আপনি একজন বৃদ্ধার কথা মনে করছেন যিনি মারা গেছেন।
আল্লাহ তার চেয়ে অনেক উত্তম স্ত্রী আপনাকে দান করেছেন।’
জবাবে নবী কারীম সা. বললেনঃ ‘কক্ষনো না।
মানুষ যখন আমাকে মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে, সে তখন আমাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে।
সবাই যখন কাফির ছিল, তখন সে মুসলমান। কেউ যখন আমার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি, তখন সে আমাকে সাহায্য করেছে। তাঁর গর্ভেই আমার সন্তান হয়েছে।’ আমরা মনে করি হযরত খাদীজার মূল্যায়ন এর চেয়ে আর বেশী কিছু হতে পারে না।
হযরত খাদীজার ফজীলাত সম্পর্কে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছেঃ ধরাপৃষ্ঠের সর্বোত্তম নারী মরিয়ম বিনতু ইমরান ও খাদীজা বিনতু খুওয়াইলিদ। হযরত জিবরাঈল আ. বসে আছেন রাসূলুল্লাহর সা. কাছে। এমন সময় খাদীজা আসলেন। জিবরাইল আ. রাসূলুল্লাহকে সা. বললেন, ‘তাঁকে মণি-মুক্তার তৈরী একটি বেহেশতী মহলের সুসংবাদ দিন।’ (বুখারী)।
হযরত আছিয়া ঃ-দুনিয়াতে জান্নাতের সুসংবাদ পাওয়া চারজন রমণীর মধ্যে হযরত আছিয়া অন্যতম ।তিনি ছিলেন ফেরাউনের স্ত্রী। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন—
وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا لِّلَّذِينَ آمَنُوا اِمْرَأَةَ فِرْعَوْنَ إِذْ قَالَتْ رَبِّ ابْنِ لِي عِندَكَ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ وَنَجِّنِي مِن فِرْعَوْنَ وَعَمَلِهِ وَنَجِّنِي مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ
মুমিনদের জন্যে ফেরাউন-পত্নীর দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। সে বললঃ হে আমার পালনকর্তা! আপনার সন্নিকটে জান্নাতে আমার জন্যে একটি গৃহ নির্মাণ করুন, আমাকে ফেরাউন ও তার দুস্কর্ম থেকে উদ্ধার করুন এবং আমাকে যালেম সম্প্রদায় থেকে মুক্তি দিন।–সুরা—আততাহরীম, আয়াত ১১।
মুসলিম নারীদের জন্য চির বরণীয় ও অনুসরণীয় এক ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন আছিয়া। সবুজ শ্যামলিমায় ঘেরা সুউচ্চ প্রাসাদের আলীশান মহলে তিনি বসবাস করতেন। সবুজ বৃক্ষের তলদেশে প্রাসাদের গা ঘেষে নীল দরিয়ার স্বচ্ছ পানি বয়ে চলত অবিরাম। এমন সব নেয়ামত ও আয়েশের মাঝেও আছিয়া ছলেন অতৃপ্ত, অস্থির। তাহলে কোন সে পিপাসায় তিনি কাতর ছিলেন? কিসের অভাবে ছটফট করতেন তিনি?
আল্লাহ পাকের কাছে আছিয়া কাতর দুয়া করেছিলেন—তিনি যেন তাঁর স্বামীর দুঙ্কর্ম থেকে তাঁকে হেফাজত করেন। তাঁর জুলুমবাজ কওমের হাত থেকে রেহাই দেন তাঁকে। তিনি আরো বলেছিলেন, তাঁর স্বামীর পৃষ্ঠপোষকতায় যে পাপের রাজ্য কায়েম হয়েছে, সেখান থেকে বের হতে তিনি উদগ্রীব হয়ে পড়েছেন। অথচ এক সময় তিনি স্বামীর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। হৃদয়জুড়ে ছিল তাঁর ভালবাসা। তাহলে তাঁর এ অভিযোগের প্রেক্ষাপট কী?
ফেরাউন তাঁর সুউচ্চ রাজপ্রাসাদ, সুদূর বিস্তৃত সাম্রাজ্যে অপ্রতিদ্বন্ধি বাদশাহ ছিল। সে ছিল ভীষণ কঠোর প্রকৃতির ও পাষাণ দিল। নির্বিচারে প্রজাসাধারণের উপর সে জুলুম করত। অত্যাচারে জর্জরিত করত তাদের। ফেরাউন স্বেচ্ছাচারিতার চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। অত্যন্ত অহংকার ও গর্ব করে বেড়াত সে। বনী ইসরাঈল ছিল তাঁর অবৈধ অত্যাচারের নিশানা। তারা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে অত্যন্ত কষ্টের ভেতর দিয়ে ফেরাউনি রাজ্যে জীবন যাপন করছিল । বিপদ মুসিবতে ধৈর্য ধরা ছাড়া তাদের কিছুই করার ছিল না।
একদিন রাজদুরবারের প্রধান জ্যোতিষী ফেরাউনের কাছে এসে বলল—বাদশাহ নামদার। অচিরেই বনী ইসরাঈলের মাঝে একজন সন্তান জম্ম নিবে। তাঁর হাতে আপনার সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য। জ্যোতিষীর এ সংবাদ বনী ইসরাঈলের উপর অত্যাচারের আগুনে ঘি ঢেলে দিল। ফেরাউনের পাষণ্ডতা উথলে উঠলো। জ্যোতিষীর এ অসহনীয় কথায় তাঁর উন্মত্ততা বেড়ে গেল কয়েকগুণ। নিজেকে একটু প্রবোধ দেয়ার জন্য, মনটাকে একটু সুস্থির করার জন্য বনী ইস্প্রাঈলের উপর জুলুমের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। সে তাদের নবজাতক পুত্র সন্তানদের ধীরে ধীরে নৃশংসভাবে হত্যা করতে লাগল। তবে শুধু কন্যা সন্তানদের জীবিত রাখত। অবশেষে আল্লাহ পাক বনী ইসরাঈলের ভাগ্য লিখনে পরিবর্তন আনলেন। তাদের পর্যাপ্ত শক্তি ও ক্ষমতা দান করলেন। ফলে ফেরাউন যে বিভীষিকার আশংকা করত, তা স্বচক্ষে দেখতে বাধ্য হয় সে।লোমহর্ষক এ ঘটনার শুরুটা খুবই অম্লমধুর । ফেরাউনের রাজপ্রাসাদের অনতিদূরে ছোট্ট এক ঝুপড়িতে ইউহানিব নাম্নী এক মহিলা বাস করতেন। তাঁর গর্ভধারণের সময় ঘনিয়ে এলে নিজগৃহের এক কোণায় তিনি আবদ্ধ হয়ে রইলেন। প্রসব বেদনা শুরু হলে তিনি মেয়েকে বললেন যাও, জলদি একজন ধাত্রী ডেকে নিয়ে আস। মেয়ে ধাত্রী ডেকে আনল। ইউহানিবের ঘরে একটি সুন্দর ফুটফুটে পুত্রসন্তান ভূমিষ্ট হল। তিনি ফেরাউনের নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার কথা করে ভয় ও আতংকে শিউরে উঠলেন। নিজেকেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এই নিষ্পাপ ফুলের মত শিশুকে কি মেরে ফেলা হবে? ছেলের প্রতি ভালবাসায় তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলেন। সিংস্র ফেরাউনের হিংস্রহাত থেকে বাঁচতে একাধারে তিন মাস গৃহভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকলেন তিনি। এজন্য ইউহানিব প্রতিটি মুহূর্তেই চিন্তা ও আতংকের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করতেন। নিজের প্রতি নয়, ছেলে মূসার প্রতি ভয় ও ভালবাসায় তিনি গভীর চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তবে আল্লাহ পাক তাঁর সহায় ছিলেন। তিনি তাঁকে নির্দেশ দিলেন, এ শিশুটির জন্য একটি কাঠের সিন্দুক তৈরি কর। তারপর তাঁকে সিন্দুকের ভেতর ভরে নীল দরিয়ায় ভাসিয়ে দাও। আর তোমার মেয়েকে সিন্দুকের অনুসরণ করে নীল নুদের পার দিয়ে চক্কর দিতে বল। এ ঐশী আদেশ পেয়ে মুসা জননীর চিত্ত প্রশান্ত হল। মন থেকে সব ডর—ভয় মুছে গিয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন তিনি। সুন্দর একটি সিন্দুক বানানো হল। ইউহানিব নয়নের মণি মুসাকে সেখানে রেখে দিয়ে মেয়েকে বললেন, সিন্দুকটি মাথায় করে নীল নদের ঘাটে নিয়ে যাও। চতুর মেয়ে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কাজ সম্পন্ন করল। ইউহানিব সন্তান সমেত সিন্দুকটি নীল নুদে ভাসিয়ে দিলেন। প্রবাহমান নদীর ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে সিন্দুকটা নাচতে নাচতে এগিয়ে চলল। সন্তানকে আল্লাহর হাতে সঁপে দিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে মা জননী ঘরে ফিরলেন। মেয়েকে পাঠিয়ে দিলেন সিন্দুকের পেছনে পেছনে। নদীর ফস্রোতে ভাসতে ভাওতে সিন্দুকটি ফেরাউনের মর্মর নির্মিত সুদৃশ্য সিঁড়ির গোড়ায় এসে থামল। ফেরাউনের স্ত্রী, কন্যা, সেবিকারা এখানে বসেই নদীর শীতল হাওয়ায় গা জুড়াত। প্রাসাদের এক খিড়কি দিয়ে আছিয়া এ সিন্দুকটি দেখতে পেলেন। বাচ্ছাসহ সিন্দুকটি উপরে তুলে আনা হল। ফেরাউনের সিপাহী ও প্রহরীরা আশাপাশেই ছিল। তাদের সবার হাতেই শিশু হননের যাবতীয় অস্ত্র ও হাতিয়ার উন্মুখ হয়ে রয়েছে। তাদের কাজই ছিল, বনী ইসরাঈলের ঘরে কোন নবজাতকের সন্ধান পেলে তাঁকে বধ করে নীল নদে সেই লাশটা ভাসিয়ে দিবে কিংবা দূরের কোন মরু উপত্যকায় ফেলে আসবে। শিশুটিকে প্রথম দর্শনেই ফেরাউনের মনে একটি ভালবাসা জেগে উঠল। কিন্তু তাঁর আশ পাশের লোকেরা শিশুটিকে হত্যা কুরে ফেলতে তাঁকে নানাভাবে উত্তেজিত করতে লাগল। কেউ একজন বলেও ফেলল, মহারাজ! সিন্দুকে বাচ্ছা রেখে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া আসলে আপনার বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র। জ্যোতিষীর কথা অনুযায়ী হতে পারে এই বাচ্ছাটিই আপনার রাজ্য পতনের কারণ হবে। তাদের এই কথোপকথনের মাঝে আছিয়া এক কদম সামনে এসে বললেন,
وَقَالَتِ امْرَأَتُ فِرْعَوْنَ قُرَّتُ عَيْنٍ لِّي وَلَكَ لَا تَقْتُلُوهُ عَسَى أَن يَنفَعَنَا أَوْ نَتَّخِذَهُ وَلَدًا وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ
এ শিশু আমার ও তোমার নয়নমণি, তাকে হত্যা করো না। এ আমাদের উপকারে আসতে পারে অথবা আমরা তাকে পুত্র করে নিতে পারি। প্রকৃতপক্ষে পরিণাম সম্পর্কে তাদের কোন খবর ছিল না।–সুরা কাসাস, আয়াত ৯।
আছিয়া স্বামীর কাছে এ শিশুটির ব্যাপারে তাঁর সাধারণ হুকুম বলবৎ না করার জন্য উপর্যুপরি অনুরোধ করতে লাগ্লেন। প্রত্যাশা নিয়ে তিনি বললেন, হতে পারে এ শিশু বড় হয়ে আমার একান্ত বাধ্যগত হবে আর আমরা তাঁকে আমাদের সন্তানরূপে গ্রহণ করবো। এক পর্যায়ে ফেরাউন তাঁর কোথা মেনে নিল। রাজপ্রাসাদে মূসা তখন ফেরাউনের পুত্রবৎ হয়ে গেল। মানস সন্তানের প্রতি অগাধ ভালবাসায় আছিয়ার দিল টইটম্বুর। আনন্দের দোলায় তিনি দুলতে লাগলেন।প্রাসাদের লোকেরা এ শিশুর জন্য একজন ধাত্রী খুঁজতে লাগল। হাজার হলেও এতো এখন রাজপুত্র। আর ফেরাউন তো শুধু বাদশাই নয়। প্রজাসাধারণের স্বকল্পিত প্রভুও সে। কাজেই চতুর্দিক থেকে ধাত্রীদের আগমন্ব প্রাসাদ ভরে উঠলো। ফেরাউন ও আছিয়া বাচ্ছার জন্য একজন যুৎসই ধাত্রীর জন্য প্রতীক্ষমান। কিন্তু রজোপ্রাসাদে আগত কোন মহিলার স্তনই মুখে নিচ্ছে না বাচ্চাটি। প্রধানমন্ত্রী হাসান তাঁর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি মেলে ধ্রল চারদিকে। ইত্যবসরে মূসার সহোদরা বোন সামনে এগিয়ে এসে বলল আমি একজন ধাত্রীর সন্ধান দিতে পারি তোমাদের, আশা করা যায় এ বাচ্চা তাঁর দুধ পান করবে। বাচ্চাটির অবিরাম কান্না আমার মনে খুবকরুণ হয়ে বিঁধছে, তাই আমি তোমাদের সাহায্যে এগিয়ে এলাম। অন্যথায় এতে আমার কোন গরজ নেই। আছিয়া বললেন—জলদি গিয়ে তাঁকে নিয়ে আস, দেখছো না সে কেমন জোরে জোরে চিৎকার করছে। ক্ষুধার তাড়নায় মুখটা একেবারে পাংশু হয়ে গেছে ছেলেটির। মেয়েটি বলল আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না রাণী মা! আমি এক্ষুণি তাঁকে নিয়ে হাজির হচ্ছি।
মূসার বোন মারিয়াম দৌড়ে মায়ের কাছে গেল। মাকে বলল—আম্মা!সসুসংবাদ শুনুন। তাঁকে নিয়ে অবাক কাণ্ড ঘটে গেছে। মূসা আগত কোন মহিলার দুধই পান করছে না। সকলেই হতাশ হয়ে ফিরে গেছে। আমি তাদেরকে আপনার কথা বলে এসেছি। চলুন, চলুন জলদি চলুন।
ইউহানিব বলতে লাগলেন, আমার প্রচন্ড ভয় হচ্ছে, যদি তারা কোনভাবে বুঝে ফেলেয়ামি তাঁর মা, তাহলে কী হবে? কিন্তু আমার তো আর তর সইছে না। সেই কখন থেকে যে অবিরাম দুধ ঝরে পড়ছে।মারয়াম বলল, আম্মা! তাড়াতাড়ি চলুন, আমাদের অনেক দেরি হয়্ব যাচ্ছে। তারা উভয়ে রাজপ্রাসাদে রওয়ানা হলেন। সেখানে পৌঁছে দেখলেন মূসার কান্নার আওয়া উচ্ছে উঠে গেছে। আছিয়া তাঁকে কোলে তুলে হেলিয়ে দুলিয়ে প্রবোধ দিচ্ছে আর আদর করছে। কিন্তু কান্না থামছে না কিছুতেই। ইউহানিব তাঁর কাছে গিয়ে বললেন—রাণী মা! একে আমার কাছে দিন। আছিয়া মারয়ামকে লক্ষ্য করে বললেন—এই ক্লি সেই ধাত্রী? মারয়াম বলল জি হ্যাঁ—রাণী মা ! আপনি নিশ্চিন্তে বাচ্ছাকে তাঁর হাতে দিন। মনে হচ্ছে অবশ্যই সে এর দুধ পান করবে এবং কান্নাও বন্ধ করবে। ইউহানিব বাচ্ছাকে কোলে নিতেই সে নীরব হয়ে গেল। তাঁর চোখে ফুটে উঠল একটি খুশীর ঝিলিক। নিতান্ত শান্ত ভঙ্গিতে সে তাঁর দুধ পান করতে লাগল। পাশে দাঁড়ানো আছিয়ার খুশি আর ধরে না। প্রশান্তির একটি নিঃশ্বাস ছাড়লেন তিনি। কিন্তু চতুর ফেরাউনের মনের ভেতর একটি সন্দেহ দানা বেঁধে উঠল।
ফেরাউন তাঁকে জিজ্ঞেস করল আচ্ছা, বলতো কে তুমি? এ বাচ্ছা আর সব মহিলা থেকে মুখ থেকে মুখ ফিরিয়ে তোমার দিধই বা কেন মুখে নিল? ইউহানিব বললেন আসলে আমার পেশাই হচ্ছে দুধ পান করানো। আমার দুধ বড়ই সুমিষ্ট ও সুপেয়। সব ধরণের শিশুরাই আগ্রহ ভরে আমার দুধ পান করে। আর যে একবার আমার দুধ খায় সে অন্যদের দুধ মুখেই নিতে চায় না। ফেরাউন প্রধানমন্ত্রী হামানের দিকে ইশারা করে বলল এ মহিলার ভাতা দ্বিগুণ করে দাও আর তাঁর থাকার সুবন্দোবস্ত করে দাও। মূসা জননী এসব কথা শুনে এবং পুরিস্থিতির অনুকূলতা অনুভব করে অত্যন্ত খুশী হলেন। আল্লাহ পাকের ওয়াদা যে এত দ্রুত বাস্তবায়িত হবে, তা তিনি ভাবতেই পারেননি।
আছিয়া তাঁকে বললেন—তুমি আমাদের এই প্রাসাদেই অবস্থান করো। আমি তোমার থাকার জন্য মনোরম একটি কামরা এবং উপযোগী খাবার—দাবারের ব্যবস্থা করে দিব। ইউহানিব বললেন—রাণী মা! আপনাকে অনেক অনেক শুকরিয়া। আমি চাচ্ছি এ বাচ্ছাকে আমার ঘরেই দুধ পান করাবো। সেখানকার পুঅরিবেশ খুব মনোরম। আর আমিও অবলীলায় সেখানে চলা—ফেরা করতে পারবো। এ বাচ্চারও বোধহয় কোন কষ্ট হবে না। আছিয়া বললেন—তোমার যা ইচ্ছে তা করো। মূসা জননী সন্তান নিয়ে ঘরে ফিরলেন। আল্লাহর শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতায় মুখর হয়ে উঠলেন তিনি। তিনিই তো তাঁর দিলে প্রশান্তি দিয়েছেন। মনের অস্থিরতা দূর করেছেন । আর আদরে দুলালকে তাঁর কোলেই ফিরিয়ে দিয়েছেন। খুব বেশি আওময় তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়নি। আদরে যত্নে মা ছেলেকে লালন পালন করতে লাগলেন। আছিয়ার যখনই বাচ্ছাটিকে দেখতে মন চাইত তিনি কাউকে পাঠিয়ে তাঁকে রাজপ্রাসাফে নিয়ে আসতেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে তৃপ্তি ভরে দেখতেন। একটু একটু করে মূসা হাঁটুতে ভর দিয়ে চলতে শিখলেন। কখনো কখনো দু—পায়ে ভর করে থাকতেন কিছুক্ষণ। ভাঙ্গা ভাঙ্গা করে অল্প—সল্প কথাও বলতেন মাঝে মধ্যে। যখনই আছিয়া মুসার সাথে একটু আমোদ—আহ্লাদ করতেন সে অত্যধিক আনন্দিত হয়ে উঠত। তবে আর কোন মহিলার সামনে সে এতটা আনন্দিত, এতটা অকৃত্রিম হত না।কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের সিঁড়িতে পদার্পণ করলেন মূসা। আছিয়ার হৃদয় কন্দরে স্নেহের বৃক্ষটি এখন পত্র পল্লবে সুশোভিত। মানস পুত্র মুসাকে না দেখে থাকতে পারেনা তিনি। দুগ্ধপানের মেয়াদ শেষ হতেই মূসাকে রাজপ্রাসাদে দিয়ে গিয়েছিলেন ইউহানিব। জ্যোতিষীর কথা শুনে ফেরাউনের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া নিষ্ঠুরতা তাঁর চোখের সামনে ছিল অহেতুক ঝামেলা এড়িয়ে চলাই সমীচীন মনে করেছেন তিনি। কিন্তু ফেরাউন জানত না, তাঁর গৃহেই আগ্নেয়গিরির এক ভয়ঙ্গকর লাভা বিস্ফোরিত হওয়ার জন্য ধীরে ধীরে স্ফীত হচ্ছে।
খোদাকে পরিত্যাগ করে হামানসহ যারা ফেরাউনের সামনে সেজদায় লুটিয়ে পড়ত, আছিয়া সাদের প্রতি ভীষণ রুষ্ট ছিলেন। ভীতি ও ভক্তি নিয়ে তারা অসম্ভব সব উপাধিতে ভূষিত করত ফেরাউনকে। এগুলো দেখে আছিয়া সিমাহীন অস্থির হয়ে উঠতেন। তাঁর স্বামী যখন অহংকারে মদমত্ত হয়ে বলত আমিই তোমাদের ভমহান প্রভু; তিনি মনে মনে বলতেন, হায়রে কপাল! কোন শয়তানের পাল্লায় যে পড়েছি। এ অন্ধ অহমিকায় আর কতকাল সে ডুবে থাকবে। কিসের নেশায় সে এ মহা মুসিবতকে বরণ করে নিচ্ছে? ফেরাউনের স্বকল্পিত প্রভুত্বকে প্রচন্ড ভাবে ঘৃণা করতেন তিনি।
তাঁর ভক্তদের ভাঁড়ামিপূর্ণ কার্যকলাপ দেখে দূর থেকে শুধু আফসোস করে বলতেন—সবগুলো একেকটা উম্মাদ।
হৃদয়ের মনিকোঠায় মূসাকে ধারণ করতেন আছিয়া। প্রগাঢ় ভালবাসায় ভরিয়ে রাখতেন তাঁকে। হঠাৎ একদিন একটি লোক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে তাঁকে সংবাদ দিল মূসা জনৈক কিবতীকে হত্যা করে ফেলেছে। স্বগোষ্ঠীয় এক লোকের পক্ষাবলম্বন করেই এ কাজটা সে করেছে। আছিয়ার কন্যাদের সেবা করত যারা, তাদের একজনের স্বামী হিজকীল এসে তাঁকে জানালেন, শহরে দুজন লোক ঝগড়া করছিল। একজন মূসার স্বগোত্রীয় অপরজন কিবতী। কিবতী লোকটির বিরুদ্ধে অপরজন মূসার সহযোগিতা চাইলে মূসা তাঁকে প্রচন্ড ঘুষি মারে। আর এতেই লোকটির ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যায়। আছিয়া মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথাগুলো শুনছিলেন, হঠাৎ দূর থেকে ফেরাউনের ক্রোধান্বিত চিৎকারে তিনি সচকিত হয়ে উঠলেন। তাঁর বিকট আওয়াজে প্রাসাদ যেন কাঁপতে লাগল। কোথায় মূসা? এখনো কেন তাঁকে বন্দী করা হচ্ছে না। সিপাহী! ঐ কুলাঙ্গারকে এক্ষুণি আমার সামনে হাজির কর। আমি নিহত কিবতীর প্রতিশোধ নিতে চাই। এক্ষুণি। পরিস্থিতির ভয়াবহতায় আছিয়া খুব শংকিত হয়ে উঠলেন। মূসার প্রতি উৎকন্ঠায় তাঁর প্রাণ ব্যাকুল হয়ে উঠল। অনন্ত অসীম পরমসত্তার কাছে মিনতির দু’হাত তুলে ধরলেন তিনি। ভক্তি গদগদ কণ্ঠে মহান মা;বুদের কাছে তিনি মুসার কল্যাণের জন্য প্রার্থনা শুরু করে দিলেন। ইলাহী! মূঊসাকে ফেরাউন আর তাঁর সাঙ্গপাঙ্গাদের অনিষ্ট থেকে তুমি হেফাজত করো। তাদের বর্বরতা থেকে তুমি নিরাপদ রাখো।
হিজকীল সেখান থেকে চলে গেলেন। নিজের স্বভাবশুদ্ধতার বদৌলতে তিনিও এক আল্লাহয় বিশ্বাস করতেন এবং দাম্ভিক ফেরাউনের প্রভুত্বকে প্রত্যাখ্যান করতেন। দ্রুত মূসার কাছে গিয়ে তাঁকে সর্তক করে দিয়ে তিনি বললেন—
وَجَاء رَجُلٌ مِّنْ أَقْصَى الْمَدِينَةِ يَسْعَى قَالَ يَا مُوسَى إِنَّ الْمَلَأَ يَأْتَمِرُونَ بِكَ لِيَقْتُلُوكَ فَاخْرُجْ إِنِّي لَكَ مِنَ النَّاصِحِينَ
হে মূসা, রাজ্যের পরিষদবর্গ তোমাকে হত্যা করার পরমর্শ করছে। অতএব, তুমি বের হয়ে যাও। আমি তোমার হিতাকাঙ্ক্ষী।–সুরা কাসাস, আয়াত ২০।
মূসা হিজকীলের কথা আমলে নিয়ে তখনই ফেরাউনবাহিনী থেকে আত্মরক্ষার জন্য একদিকে পালিয়ে গেলেন। হিজকীল প্রাসাদে ফিরে এসে দেখলেন আছিয়া মূসার জীবনাশংকায় কম্পমান। তিনি কিছুটা নিচু আওয়াজে বললেন—রাণী মা! আর ভয়ের কোন কারণ নেই। আমি মূসা পর্যন্ত সব কোথা পৌঁছে দিয়েছি এবং আসন্ন বিপদ সম্পর্কেও সর্তক করেছি ত্তাকে। শহর ছেড়ে দূরে কোথাও—যেখানে ফেরাউনের সিপাহীরা তাঁর নাগাল পাবে না। চলে যাওয়ার জন্য সুপারিশ করেছি আমি। আছিয়া বললেন—মহান প্রভুর শুকরিয়া। তিনি মূসাকে ফেরাউনের হিংস্রতা ও নিষ্ঠুরতা থেকে হেফাজত করুন। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতি আমাকে কুড়ে কুড়ে খাবে। সে তো আমার সন্তান সমতুল্য। আমার কোলে পিঠেই সে বড় হয়ে উঠেছে। তাঁকে ছাড়া আমি থাকব কেমন করে? আচ্ছা একটু খোঁজ নিয়ে দেখ না সে কোথায় গেছে। হিজকীল বললেন, রাণী মা! আসুন! মহিমান্বিত স্রষ্টার কাছে আমরা তাঁর কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করি।
একে একে কয়েক বছর কেটে গেল। মূসা আর মিসরে ফিরে এলেন না। মূসাকে এক নজর দেখার অধীর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আছিয়া প্রায় নিরাশ হয়ে গেলেন। কারো কাছে মূসার কোনো সংবাদ নেই। সবাই যেন মূসাকে ভুলে গেল। সময় গড়িয়ে চলল। ফেরাউন ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের মুনে বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গেল যে, মূসা কস্মিনকালেও আর ফিরে আসবে না। তবে কয়েক বছর মূসা ঠিকই ফিরে এলেন। এবার তিনি আল্লাহ পাকের একজন নবী ও পয়গম্বর হয়ে এলেন। মূসা (আঃ) হকের দাওয়াত আর খোদায়ী শিক্ষার মহা সওগাত নিয়ে এলেন। আল্লাহ পাক তাঁকে ফেরাউনের কাছে এ দাওয়াত নিতে যেতে বলেছেন। যার অসহনীয় অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মানবেতর জীবন—যাপন করছে বনী ইসরাঈলের লোকগুলো। জীবনে ন্যূনতম অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে পরাধীনতার শৃংখলে তারা আষ্টে পৃষ্ঠে বাঁধা। তাদের মুক্তির পয়গাম নিয়েই মূসা (আঃ) এসেছেন। নীল দরিয়ার জোয়ার ভাটা আসে কিন্তু উদ্ধত ফেরাউনের নির্মম নিষ্ঠুরতায় কোন ভাটা নেই। মানুষকে মাবুদ বানানো দুরাচার কিবতীদের লাগামহীন উস্কানীতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে ফেরাউন। এ পাগলা ঘোড়াকে নিবৃত্ত করার জন্যই ইনসাফেরচাবুক নিয়ে মূসা (আঃ) এলেন। কিন্তু অনাকাঙ্গিত সেই কিবতী হত্যা স্মৃতিটি তাঁর মনে একতি ভয় ধরিয়ে দিল। প্রভুর শরণাপন্ন হয়ে তিনি বললেন
“পরওয়ারদেগার! আমি তাদের এক ব্যক্তিকে (অনিচ্ছায়) হত্যা করেছিলাম। আমি আশংকা করছি, তারাও আমাকে হত্যা করে ফেলবে। আল্লাহ পাক তাঁকে আশ্বস্ত করলেন, এবার তিনি আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে বললেন,
সহযোগীদের সত্য বিনাশী ষড়যন্ত্র আমি বরদাশত করতে পারি।
আমার যাবতীয় কাজ আসান করে দিন। সব বাঁধা বিপত্তিকে নস্যাৎ করে দিয়ে দাওয়াতের পথকে সুগম করে দিন।
হযরত মারিয়াম আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঃ-মারিয়াম বিনতে ইমরান, যিনি ঈসা (আঃ)-এর কুমারী মাতা ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যাকে জান্নাতের শ্রেষ্ঠ চারজন মহিলার অন্যতম হিসাবে বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি বলেন,
أفضلُ نساءِ أهلِ الجنتِ خديجتُ بنتِ خُوَيْلدِ وفاطمةُ بنتِ محمدٍ ومريمُــــــــــــ
‘জান্নাতবাসী মহিলাগণের মধ্যে সেরা হ’লেন চারজন: খাদীজা বিনতে খুওয়ালিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ, মারিয়াম বিনতে ইমরান এবং আসিয়া বিনতে মুযাহিম, যিনি ফেরাঊনের স্ত্রী’।[2]
মারিয়ামের জন্ম ও লালন-পালন :
মারিয়ামের জন্ম ও লালন-পালন সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
إِذْ قَالَتِ امْرَأَةُ عِمْرَانَ رَبِّ إِنِّي نَذَرْتُ لَكَ مَا فِيْ بَطْنِيْ مُحَرَّراً فَتَقَبَّلْ مِنِّي إِنَّكَ أَنتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ- فَلَمَّا وَضَعَتْهَا قَالَتْ رَبِّ إِنِّي وَضَعْتُهَا أُنثَى وَاللهُ أَعْلَمُ بِمَا وَضَعَتْ وَلَيْسَ الذَّكَرُ كَالأُنثَى وَإِنِّي سَمَّيْتُهَا مَرْيَمَ وِإِنِّي أُعِيْذُهَا بِكَ وَذُرِّيَّتَهَا مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ- فَتَقَبَّلَهَا رَبُّهَا بِقَبُولٍ حَسَنٍ وَأَنبَتَهَا نَبَاتاً حَسَناً وَكَفَّلَهَا زَكَرِيَّا، كُلَّمَا دَخَلَ عَلَيْهَا زَكَرِيَّا الْمِحْرَابَ وَجَدَ عِندَهَا رِزْقاً قَالَ يَا مَرْيَمُ أَنَّى لَكِ هَـذَا قَالَتْ هُوَ مِنْ عِندِ اللهِ إنَّ اللهَ يَرْزُقُ مَنْ يََّشَآءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ- (آل عمران ৩৫-৩৭)-
‘যখন ইমরানের স্ত্রী বলল, হে আমার প্রভু! আমার গর্ভে যা রয়েছে তাকে আমি তোমার নামে উৎসর্গ করলাম সবার কাছ থেকে মুক্ত হিসাবে। অতএব আমার পক্ষ থেকে তুমি তাকে কবুল করে নাও। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আলে ইমরান ৩৫)। ‘অতঃপর সে যখন তাকে প্রসব করল, তখন বলল, হে প্রভু! আমি তো কন্যা সন্তান প্রসব করেছি! অথচ আল্লাহ ভাল করেই জানেন, সে কি প্রসব করেছে। (আল্লাহ সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,) এই কন্যার মত কোন পুত্রই যে নেই। আর আমি তার নাম রাখলাম ‘মারিয়াম’। (মারিয়ামের মা দো‘আ করে বলল, হে আল্লাহ!) আমি তাকে ও তার সন্তানদেরকে তোমার আশ্রয়ে সমর্পণ করছি, অভিশপ্ত শয়তানের কবল হ’তে’ (৩৬)। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তার প্রভু তাকে উত্তমভাবে গ্রহণ করে নিলেনএবং তাকে প্রবৃদ্ধি দান করলেন সুন্দর প্রবৃদ্ধি। আর তিনি তাকে যাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে সমর্পণ করলেন। (অতঃপর ঘটনা হ’ল এই যে,) যখনই যাকারিয়া মেহরাবের মধ্যে তার কাছে আসতেন, তখনই কিছু খাদ্য দেখতে পেতেন। তিনি জিজ্ঞেস করতেন, মারিয়াম! এসব কোথা থেকে তোমার কাছে এল? মারিয়াম বলত, ‘এসব আল্লাহর নিকট থেকে আসে। নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিযিক দান করে থাকেন’ (আলে ইমরান ৩/৩৫-৩৭)।
উল্লেখ্য যে, আল্লাহর নামে উৎসর্গীত সন্তান পালন করাকে তখনকার সময়ে খুবই পুণ্যের কাজ মনে করা হ’ত। আর সেকারণে মারিয়ামকে প্রতিপালনের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। ফলে লটারীর ব্যবস্থা করা হয় এবং আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর বয়োবৃদ্ধ নবী হযরত যাকারিয়া (আঃ) মারিয়ামের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন (আলে ইমরান ৩/৪৪)।
ঈসার জন্ম ও লালন-পালন :
এভাবে মেহরাবে অবস্থান করে মারিয়াম বায়তুল মুক্বাদ্দাসের খিদমত করতে থাকেন। সম্মানিত নবী ও মারিয়ামের বয়োবৃদ্ধ খালু যাকারিয়া (আঃ) সর্বদা তাকে দেখাশুনা করতেন। মেহরাবের উত্তর-পূর্বদিকে সম্ভবতঃ খেজুর বাগান ও ঝর্ণাধারা ছিল। যেখানে মারিয়াম পর্দা টাঙিয়ে মাঝে-মধ্যে পায়চারি করতেন। অভ্যাসমত তিনি উক্ত নির্জন স্থানে একদিন পায়চারি করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ মানুষের বেশে সেখানে জিবরাঈল উপস্থিত হন। স্বাভাবিকভাবেই তাতে মারিয়াম ভীত হয়ে পড়েন। এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ:
وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ مَرْيَمَ إِذِ انتَبَذَتْ مِنْ أَهْلِهَا مَكَاناً شَرْقِيًّا- فَاتَّخَذَتْ مِن دُونِهِمْ حِجَاباً فَأَرْسَلْنَا إِلَيْهَا رُوحَنَا فَتَمَثَّلَ لَهَا بَشَرًا سَوِيًّا- قَالَتْ إِنِّي أَعُوذُ بِالرَّحْمَن مِنكَ إِن كُنتَ تَقِيًّا- قَالَ إِنَّمَا أَنَا رَسُولُ رَبِّكِ لِأَهَبَ لَكِ غُلاَمًا زَكِيًّا- قَالَتْ أَنَّى يَكُونُ لِي غُلاَمٌ وَلَمْ يَمْسَسْنِي بَشَرٌ وَلَمْ أَكُ بَغِيًّا- قَالَ كَذَلِكِ قَالَ رَبُّكِ هُوَ عَلَيَّ هَيِّنٌ وَلِنَجْعَلَهُ آيَةً لِلنَّاسِ وَرَحْمَةً مِّنَّا وَكَانَ أَمْرًا مَّقْضِيًّا- (مريم ১৬-২১)-
(হে মুহাম্মাদ!) ‘আপনি এই কিতাবে মারিয়ামের কথা বর্ণনা করুন। যখন সে তার পরিবারের লোকজন হ’তে পৃথক হয়ে পূর্বদিকে একস্থানে আশ্রয় নিল’ (মারিয়াম ১৬)। ‘অতঃপর সে তাদের থেকে আড়াল করার জন্য পর্দা টাঙিয়ে নিল। অতঃপর আমরা তার নিকটে আমাদের ‘রূহ’ (অর্থাৎ জিব্রীলকে) প্রেরণ করলাম। সে তার কাছে গিয়ে পূর্ণাঙ্গ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল’ (১৭)। ‘মারিয়াম বলল, আমি তোমার থেকে করুণাময় আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যদি তুমি আল্লাহভীরু হও’ (১৮)। ‘সে বলল, আমি তো কেবল তোমার প্রভুর প্রেরিত। এজন্য যে, আমি তোমাকে একটি পবিত্র পুত্র সন্তান দান করে যাব’ (১৯)। ‘মারিয়াম বলল, কিভাবে আমার পুত্র সন্তান হবে? অথচ কোন মানুষ আমাকে স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণী নই’ (২০)। ‘সে বলল, এভাবেই হবে। তোমার পালনকর্তা বলেছেন, এটা আমার জন্য সহজ ব্যাপার এবং আমরা তাকে (ঈসাকে) মানবজাতির জন্য একটা নিদর্শন ও আমাদের পক্ষ হ’তে বিশেষ অনুগ্রহরূপে পয়দা করতে চাই। তাছাড়া এটা (পূর্ব থেকেই) নির্ধারিত বিষয়’ (মারিয়াম ১৯/১৬-২১)। অতঃপর জিব্রীল মারিয়ামের মুখে অথবা তাঁর পরিহিত জামায় ফুঁক মারলেন এবং তাতেই তাঁর গর্ভ সঞ্চার হ’ল (আম্বিয়া ২১/৯১; তাহরীম ৬৬/১২)। অন্য আয়াতে একে ‘আল্লাহর কলেমা’ (بِكَلِمَةٍ مِنْهُ) অর্থাৎ ‘কুন্’ (হও) বলা হয়েছে (আলে ইমরান ৩/৪৫)।অতঃপর আল্লাহ বলেন,
فَحَمَلَتْهُ فَانتَبَذَتْ بِهِ مَكَانًا قَصِيًّا- فَأَجَاءهَا الْمَخَاضُ إِلَى جِذْعِ النَّخْلَةِ قَالَتْ يَا لَيْتَنِي مِتُّ قَبْلَ هَذَا وَكُنتُ نَسْيًا مَّنْسِيًّا- فَنَادَاهَا مِنْ تَحْتِهَا أَلاَّ تَحْزَنِي قَدْ جَعَلَ رَبُّكِ تَحْتَكِ سَرِيًّا- وَهُزِّيْ إِلَيْكِ بِجِذْعِ النَّخْلَةِ تُسَاقِطْ عَلَيْكِ رُطَبًا جَنِيًّا- فَكُلِيْ وَاشْرَبِيْ وَقَرِّيْ عَيْنًا فَإِمَّا تَرَيِنَّ مِنَ الْبَشَرِ أَحَدًا فَقُولِيْ إِنِّيْ نَذَرْتُ لِلرَّحْمَنِ صَوْماً فَلَنْ أُكَلِّمَ الْيَوْمَ إِنسِيًّا- (مريم ২২-২৬)-
‘অতঃপর মারিয়াম গর্ভে সন্তান ধারণ করল এবং তৎসহ একটু দূরবর্তী স্থানে চলে গেল’ (মারিয়াম ২২)। ‘এমতাবস্থায় প্রসব বেদনা তাকে একটি খর্জুর বৃক্ষের মূলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। তখন সে বলল, হায়! আমি যদি এর আগেই মারা যেতাম এবং আমি যদি মানুষের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতাম’ (২৩)। ‘এমন সময় ফেরেশতা তাকে নিম্নদেশ থেকে (অর্থাৎ পার্শ্ববর্তী নিম্নভূমি থেকে) আওয়ায দিয়ে বলল, তুমি দুঃখ করো না। তোমার পালনকর্তা তোমার পাদদেশে একটি ঝর্ণাধারা সৃষ্টি করেছেন’ (২৪)। ‘আর তুমি খর্জুর বৃক্ষের কান্ড ধরে নিজের দিকে নাড়া দাও, তা থেকে তোমার দিকে সুপক্ক খেজুর পতিত হবে’ (২৫)। ‘তুমি আহার কর, পান কর এং স্বীয় চক্ষু শীতল কর। আর যদি কোন মানুষকে তুমি দেখ, তবে তাকে বলে দিয়ো যে, আমি দয়াময় আল্লাহর জন্য ছিয়াম পালনের মানত করেছি। সুতরাং আমি আজ কারু সাথে কোন মতেই কথা বলব না’ (মারিয়াম ১৯/২২-২৬)।
উল্লেখ্য যে, ইসলাম-পূর্ব কালের বিভিন্ন শরী‘আতে সম্ভবতঃ ছিয়াম পালনের সাথে অন্যতম নিয়ম ছিল সারাদিন মৌনতা অবলম্বন করা। হযরত যাকারিয়া (আঃ)-কেও সন্তান প্রদানের নিদর্শন হিসাবে তিন দিন ছিয়ামের সাথে মৌনতা অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে ঐ অবস্থায় ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলার অবকাশ ছিল (মারিয়াম ১৯/১০-১১)। একইভাবে মারিয়ামকেও নির্দেশ দেওয়া হ’ল (মারিয়াম ১৯/২৬)।
Subscribe to:
Comments (Atom)
কোরআনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
০১) প্রশ্নঃ পবিত্র কুরআনুল কারীমে কতটি সূরা আছে? উত্তরঃ ১১৪টি। ০২) প্রশ্নঃ পবিত্র কুরআনের প্রথম সূরার নাম কি? উত্তরঃ সূরা ফাতিহা। ০৩) প্রশ্ন...
-
ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) ছিলেন হযরত নূহ (আঃ)-এর সম্ভবত: এগারোতম অধঃস্তন পুরুষ। নূহ থেকে ইবরাহীম পর্যন্ত প্রায় ২০০০ বছরের ব্যবধান ছিল। হযরত ছা...
-
০১) প্রশ্নঃ পবিত্র কুরআনুল কারীমে কতটি সূরা আছে? উত্তরঃ ১১৪টি। ০২) প্রশ্নঃ পবিত্র কুরআনের প্রথম সূরার নাম কি? উত্তরঃ সূরা ফাতিহা। ০৩) প্রশ্ন...