Tuesday, 30 April 2019

চারজন সর্বশ্রেষ্ঠ জান্নাতী নারীর কাহিনী

আল্লাহর রসুল (স) একবার চারটা দাগ কেটে সাহাবীদের (রা) জিজ্ঞেস করলেন
” তোমরা কি জানো এগুলো কি?” সাহাবিগণ উত্তর দিলেন ” আল্লাহ ও তাঁর রাসুল ভাল জানেন” ।
রসুল (স) বললেন ” সর্বশ্রেষ্ঠ চার জান্নাতি নারী হল
1-খাদিজাহ বিনতে খুআইলিদ,
2- ফাতিমাহ্ বিনতে মুহাম্মাদ(সা)
3- মারিয়াম বিনতে ইমরান ( ঈসা আর এর মা ) এবং
4-আসিয়াহ্ বিনতে মুযাহিম ( ফেরাউনের স্ত্রী) ।

খাদিজাহ (রা )হল প্রথম ব্যক্তি যিনি আল্লাহর রাসুলের প্রতি ইমান এনেছিলেন। কেন তাকে সর্বশ্রেষ্ঠ নারীদের একজন বলা হয়েছে? এটা কি তাঁর ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য?
নাকি তাঁর জ্ঞানের জন্য?
ঠিক কি কারণে তাঁকে এই উপাধি দেয়া হয়েছে তা নিয়ে আমাদের গভীর ভাবে চিন্তা করা দরকার।
বিশেষ করে আমাদের মা -বোনদের।
আমরা যদি এই চার মহীয়সী নারীর জীবন পর্যালোচনা করি তাহলে তাদের মধ্যে দুটি বিষয়ের মিল দেখি –
প্রথমত:
তাঁরা অত্যন্ত শক্তিশালী ইমানের অধিকারী ছিলেন। তাঁদের ইমান ছিল সর্বোচচ পর্যায়ের । এটা হল সেই রকম বিশ্বাস যাতে কোন ভাবেই চিড় বা ফাটল ধরানো যায়না।
যে অন্তরে বিশ্বাস আছে সে অন্তর চোখের দেখা, কানের শোনা কে উপেক্ষা করে তাঁর বিশ্বাসকে প্রাধান্য দেয়।
তাঁর কল্পনায় শুধুই থাকে বিশ্বাস । আর এঁদের সকলের ইমান যে বিশ্বাসের অনেক উঁচু পর্যায়ে ছিল ,এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

ফিরাউনের স্ত্রী , আসিয়াহ ( আ ) উদাহরণ ধরুন-
একজন মহিলা পৃথিবীতেে যা চাইতে পারে তার সবই তাঁর ছিল। আরামদায়ক জীবন, ধন সম্পদ, ধনী ও প্রভাবশালী স্বামী, ক্ষমতা, দাসদাসী, খাদেম। কিন্তু ইমানের স্বার্থে, আল্লাহর জন্য তিনি এর সবই পরিত্যাগ করতে রাজি ছিলেন।
তিনি বাস করতেন সে সময়ের সর্বোৎকৃষ্ট প্রাসাদে। কিন্তু তারপরও তিনি আল্লাহ সুবহানা তাআলার কাছে দুয়া করেছিলেন –
আর ঈমানদারদের ব্যাপারে ফেরাউনের স্ত্রীর উদাহরণ দিচ্ছেন –
যখন সে দোয়া করলো, ”
হে আমার রব, আমার জন্য তোমার কাছে জান্নাতে একটি ঘর বানিয়ে দাও …!
(66:11)
আমাদের বুঝতে হবে আসিয়াহ(আ) একটি অত্যন্ত বিষাক্ত পরিবেশে ছিলেন, যা ছিল সব দিক থেকেই ইমানের পরিপন্থী। আল্লাহর শত্রুদের সাথেই ছিল তাঁর বসবাস। কুফরি শক্তিকে উপেক্ষা করে নিজেকে আল্লাহর পথে অটুট রেখে তিনি ইমানের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন ।
আমরা অপর তিন জনের জীবন পর্যালোচনা করলেও একই রকম বলীয়ান ইমানের দৃষ্টান্ত দেখতে পাই।

তাদের মধ্যে দ্বিতীয় যে ব্যপারটি ছিল তা হলো-

তাঁরা সর্বশ্রেষ্ঠ মা।

মরিয়ম (আ ) বড় করেছিলেন ঈসা( আ)কে আর আসিয়াহ্ (আ)বড় করেছিলেন মুসা (আ)কে ।
মা খাদিজাহ (রা) কে আল্লাহ এত মর্যাদা দিয়েছেন তা কিন্তু এই জন্য নয় যে তিনি অনেক সফল ব্যবসায়ী ছিলেন।
বরং তিনি ছিলেন আল্লাহর রসুল মুহাম্মদ (স) এর অসাধারণ এক সহধর্মিণী। আল্লাহর রাসুলের (স) যখনি প্রয়োজন, তখনি তিনি পাশে পেয়েছিলেন খাদিজা (রা)কে ।
ইসলামের শিশু অবস্থায় সবচেয়ে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন মা খাদিজা ( রা)।
আল্লাহর রাসুল (স) নবুয়তের শুরুতে সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতিতে অবিচল সাহস আর প্রেরণা দিয়েছেন মা খাদিজাহ্ (রা)।রাসূল ( সা) কে একজন অভিভাবকের মতো আগলে রেখে হেরা গূহায় ধ্যান রত অবস্থায় কি অকৃত্রিম বন্ধুর মতো সেবা করেছেন সে ইতিহাস অনেকেরই জানা ।

আর ফাতিমা(রা) ছিলেন রসূল ( সা ) সবচেয়ে ছোট ও আদরের কন্যা এবং আমিরুল মু’মিনীন আলীর (রা) সহধর্মিণী।
আলী অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন। ঘরের কাজ করতে ফাতিমাকে(রা)কে অনেক কষ্ট পেতে হত।
আটা পিষতে পিষতে তাঁর কোমল হাতে কঠিন ক্ষত হয়ে গিয়েছিল । অথচ তিনি ছিলেন সর্ব শ্রেষ্ঠ রাসূল এবং তৎকালীন মদিনা ইসলামি রাষ্ট্রের কর্ণধারের সম্মানিত কন্যা!
একবার আলী (রা ) এর ইচ্ছায় তাঁরা আল্লাহর রাসুল (স) এর কাছে একজন ভৃত্য প্রার্থনা করলেন।
আল্লাহর রসুল (স) তাদের জবাবে বললেন আমি তোমাদের এরচেয়েও উত্তম কিছু শিখিয়ে দিচ্ছি।
তোমরা শুতে যাবার আগে 33 সুবহানাল্লাহ ,
33 বার আলহামদুলিললাহ এবং
34 আল্লাহু আকবর পড়বে ।
ফাতিমাকে আল্লাহর রাসুল (স) অত্যন্ত ভালবাসতেন।
তিনি বলেছিলেন ফাতিমা আমার দেহের অংশ,
সে যাতে খুশি হয় , আমিও তাতে খুশি হই। সে যাতে কষ্ট পায়, আমিও তাতে কষ্ট পাই। ফাতিমা(রা) ছিলেন আল্লাহর রাসুলের (সা) অত্যন্ত আদরের সন্তান।
তিনি পৃথিবীতেই জাননাতের সু- সংবাদ পেয়েছিলেন । তিনি হবেন জাননাতের নারীদের কর্ণধার! সুবহান আললাহ!
তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত একমাত্র তিনি ই ছিলেন তাঁর জীবিত সন্তান ।

আল্লাহর রাসুল (স) চাইলে ফাতিমা( রা)কে একজন কেন, দশ জন খাদেম দিতে পারতেন । কিন্তু তিনি তা না করে ফাতিমাকে(রা) কে উপদেশ দিলেন, ঘরের কাজ নিজের হাতে করে যেতে।
আর হয়তো এই কারণেই ফাতিমা (রা) হয়ে উঠলেন চার সর্বশ্রেষ্ঠ নারীদের একজন।
জ্ঞানের দিক থেকে যদিও মা আয়েশা (রা )খাদিজাহ(রা) ও ফাতেমার (রা )উপরে, কিন্তু মর্যাদার দিক থেকে উনি খাদিজাহ(রা) ও ফাতেমার(রা) সমকক্ষ ছিলন না।
আমাদের বোনেরা, আপনারা যখন আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করবেন তখন আপনাদের কিসের উপর বেশি প্রাধান্য দেয়া দরকার তা ঠিক করে নেবেন ।
তথাকথিত নারীবাদীরা আপনাদের কে জাগতিক ব্যপারে কিছুটা সাহায্য করলেও আখিরাতে জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা করতে পারবে না ।
হযরত ফাতেমা জাহরা (রাঃ) ছিলেন নারী ও পুরুষ তথা

গোটা মানব জাতির জন্য অসাধারণ ত্যাগ, বিশ্বস্ততা, অন্যায়ের ব্যাপারে

আপোসহীনতা, সততা, দানশীলতা, ধৈর্য, চারিত্রিক পবিত্রতা, আল্লাহর প্রতি

সন্তুষ্টিসহ অনেক মহান স্বর্গীয় গুণের আদর্শ। আর এ জন্যেই তাঁর উপাধি ছিল আস-সিদ্দিক্বা

বা সত্য-নিষ্ঠ, আল-মুবারাকাহ বা বরকতপ্রাপ্ত, আত-ত্বাহিরা বা পবিত্র, আল-মারজিয়া বা

আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, আয যাকিয়া বা সতী, আয জাহরা বা দ্যূতিময় প্রভৃতি।

স্নেহময়ী জননীর মত বিশ্বনবী (সাঃ)’র সেবা-যত্ন করা এবং বিপদের সময়

তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য মহীয়সী নারী ফাতিমা (রাঃ)’র অন্য একটি

নাম উম্মে আবিহা বা পিতার জননী। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁকে সকল

যুগের নারীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে উল্লেখ করেছেন এবং আল্লাহর দরবারে তাঁর বিশেষ

মর্যাদার কারণে তাঁকে দেখলে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করতেন।

মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ফাতেমা আমার দেহের অংশ, যা কিছু তাকে সন্তুষ্ট

করে তা আমাকে সন্তুষ্ট করে এবং যা কিছু আমাকে সন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও

সন্তুষ্ট করে, আর যা কিছু ফাতেমাকে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়,

আর যা আমাকে কষ্ট দেয়, তা আল্লাহকেও কষ্ট দেয়।

হযরত ফাতিমা (রাঃ) বেহেশতে সর্ব প্রথম প্রবেশ করবেন বলে বিশ্বনবী- সাঃ উল্লেখ করেছেন।



অনেক ইসলামী বর্ণনা অনুযায়ী পবিত্র কোরআনের সূরা কাওসার-এ

উল্লেখিত কাওসার বলতে হযরত ফাতেমা (রাঃ) কেই বোঝানো হয়েছে।

মক্কার কাফের ও মুশরিকরা যখন বিশ্বনবী (সাঃ)কে আবতার বা নির্বংশ বলে উপহাস করতো, এবং

রাসূলের ওফাতের পরই তার ধর্ম শেষ হয়ে যাবে বলে প্রচার করতো তখন এই সূরা নাজেল হয়।

এ সূরায় কাফেররাই নির্বংশ হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

হযরত ফাতিমা (রাঃ)’র মাধ্যমে রাসূলে পাক (সাঃ)’র বংশধারা আজো অব্যাহত রয়েছে।

অন্যদিকে নির্মূল হয়ে গেছে আবু লাহাব ও আবু জাহেলদের বংশধর।



হযরত ফাতিমা (রাঃ) ছিলেন বিশ্বনবী (সাঃ) ‘র আহলে বাইত বা পবিত্র

বংশধারায় জন্ম নেয়া মুসলমানদের ১১ জন ইমামের জননী।

বিশ্বনবী (সাঃ) ও স্বামী আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (রাঃ)’র পর এই ১১ জনই

ইসলামকে সব সংকট ও দূর্যোগের কবল থেকে রক্ষার তরী হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন।

এরই প্রমাণ দেখা যায় কারবালায় তাঁর পুত্র হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)ও এর আগে হযরত ইমাম

হাসান (রাঃ)’র নজিরবিহীন আত্মত্যাগে। মুসলমানদের নেতা হিসেবে ও বেহেশতী

যুবকদের সর্দার হিসেবে এই দুই মহাপুরুষকে গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন হযরত ফাতেমা (রাঃ)।

বিশ্বনবী (সাঃ) তাঁদেরকে নিজ সন্তান বলে উল্লেখ করতেন।
একজন পরিপূর্ণ আদর্শ মানুষ হিসেবে হযরত ফাতিমা (রাঃ)  এটা প্রমাণ করেছেন যে,

পরিপূর্ণতার শিখরে ওঠার জন্য নারী হওয়া বা পুরুষ হওয়া জরুরী কোনো শর্ত নয়।

তিনি জন্ম নিয়েছিলেন এমন এক যুগে যখন আরবরা নারীকে মনে করতো কেবল ভোগের সামগ্রী এবং

জাত্যাভিমানী আরবদের ঘরে কণ্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করলে তারা

অমর্যাদার ভয়ে কণ্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিত বা গোপনে মেরে ফেলতো ।

কিন্তু মহান আল্লাহ তার সর্বশেষ রাসূল ও সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের ঘরে একজন কন্যা

সন্তান পাঠিয়ে নারী জাতির জন্য অশেষ সম্মান ও মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন।
হযরত ফাতিমা (রাঃ) ছিলেন একজন আদর্শ জননী,একজন আদর্শ স্ত্রী বা গৃহিনী,একজন আদর্শ সমাজ-সেবিকা।

অর্থাৎ মুসলিম নারী যে শালীনতা বজায় রেখে জীবনের সবক্ষেত্রে

গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে তাঁর দৃষ্টান্ত দেখিয়ে গেছেন নবী-নন্দিনী।

আজকের যুগে যেসব মহিলা বা বুদ্ধিজীবী নারী-মুক্তির কথা ভাবছেন তাদের জন্য প্রকৃত আদর্শ হওয়া উচিত হযরত ফাতিমা (রাঃ)।



বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)’র ওফাতের পর খুব বেশি দিন বাঁচেন নি হযরত ফাতিমা (রাঃ)।

এ সময় ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও বাণীকে জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার

জন্য অসম-সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন নবী-নন্দিনী।

বিশ্বনবী (সাঃ)’র ওসিয়ত প্রচার এবং কিভাবে মুসলমানরা বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা

পাবে তা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন

বলে মনে করেন অনেক মুসলমান বিশেষজ্ঞ,ঐতিহাসিক ও আলেম।

তাদের মতে, ঐসব নির্যাতনের কারণেই তাঁকে অকালে শাহাদত বরণ করতে হয়েছে।

এমনকি অনেকে মনে করেন, তাঁর কবরও অবমাননার শিকার হতে পারে এমন

আশঙ্কায় তিনি তাকে গোপনে গভীর রাতে দাফন করতে বলেছিলেন স্বামী আমিরুল

মুমিনীন হযরত আলী (রাঃ) কে। আজো সকল শ্রেষ্ঠ গুণে গুণান্বিত এই মহিয়সী ও নীর্ভিক সংগ্রামী নারীর কবর অচিহ্নিত।

অন্যদিকে অন্য অনেক মুসলমান মনে করেন,

রাসূল (সাঃ)’র বিয়োগ-ব্যথায় শোকাকুল হযরত ফাতিমা (রাঃ) স্বাভাবিকভাবেই মারা গিয়েছিলেন

এবং তিনি কারো নির্যাতনের কারণে মারা যান নি।

যাই হোক্, হযরত ফাতিমা (রাঃ) মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ ও মুক্তির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন।

তাই মুক্তিকামী মুসলমানরা আজও কেবল তাঁর পবিত্র নাম স্মরণ করেই ইসলামের জন্য জীবন বিলিয়ে দিতে দ্বিধা বোধ করেন না।



হযরত ফাতিমা (রাঃ)’র সান্নিধ্য ও সেবা না পেলে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী(রাঃ)’র জীবনও

পুরোপুরি বিকশিত ও পরিপূর্ণতা লাভ করতো না। তাঁরা ছিলেন একে-অপরের প্রতি পুরোপুরি সন্তুষ্ট।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) হযরত ফাতিমা (রাঃ)-কে মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতা বলেও প্রশংসা করেছেন।

তিনি বলতেন,আমি যখনই বেহেশতের সুবাস পেতে চাইতাম তখনই কণ্যা ফাতেমার ঘ্রাণ নেই।

রাসূল (সাঃ)একবার প্রাণপ্রিয় কণ্যাকে বলেছিলেন, হে ফাতেমা! আল্লাহ তোমাকে নির্বাচিত করেছেন,

তোমাকে পরিপূর্ণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় সজ্জিত করেছেন এবং তোমাকে বিশ্বের নারীকূলের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।
হযরত ইমাম হাসান মুজতাবা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, একবার শুক্রবার রাতে

দেখলাম মা ফাতিমা (রাঃ) এবাদতে মগ্ন। একটানা রূকু ও আর সেজদায় থাকতে থাকতে ভোরের আলো ফুটে উঠলো।

আমি শুনতে পেলাম তিনি মুমিন নারী ও পুরুষের জন্য অনেক দোয়া করছেন,কিন্তু নিজের

জন্য কোনো দোয়াই করলেন না। আমি প্রশ্ন করলাম, মা, আপনি কেন নিজের জন্য দোয়া করলেন না,

যেভাবে অন্যরা দোয়া করে থাকে?তিনি জবাবে বললেন, হে আমার পুত্র! আগে প্রতিবেশির কথা ভাবতে হবে, এরপর নিজের ঘরের কথা … ।



আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করা ছাড়াও প্রায়ই

রোজা রাখা ও গরীব-দূঃখীকে অসাধারণ মাত্রায় দান-খয়রাত করা ছিল হযরত ফাতিমা (রাঃ) ’র একটি বড় বৈশিষ্ট্য।

জনসাধারণ বা কারো উদ্দেশ্যে যে কোনো বক্তব্য রাখার আগে দীর্ঘক্ষণ ধরে মহান

আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামতের কথা খুব সুন্দর ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায় তুলে ধরে আল্লাহর প্রশংসা করা ছিল তাঁর অন্য একটি বড় বৈশিষ্ট্য।

বিশ্বনবী (সাঃ)’র আহলে বাইতের অন্য সদস্যদের মত তিনিও কখনও অন্যায়ের সাথে আপোস করেন নি।

আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা বা সক্রিয় থাকার মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন আনন্দ।

হযরত ফাতিমা (রাঃ) বলেছেন, আল্লাহর সেবায় মশগুল হয়ে যে সন্তুষ্টি পাই তা

আমাকে অন্য সব সন্তুষ্টি বা আনন্দ থেকে বিরত রাখে এবং সব সময় মহান আল্লাহর

সুন্দর দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ রাখার প্রার্থণা ছাড়া আমার অন্য কোনো প্রত্যাশা নেই।
হযরত খাদিজাতুল কুবরা  রাদিয়াল্লাহু ঃ-নাম তাঁর খাদীজা। কুনিয়াত ‘উম্মু হিন্দ’ এবং লকব ‘তাহিরা’।

পিতা খুওয়াইলিদ, মাতা ফাতিমা বিনতু যায়িদ। জন্ম ‘আমুল ফীল’ বা হস্তীবর্ষের পনের বছর আগে মক্কা নগরীতে।

পিতৃ-বংশের উর্ধ পুরুষ কুসাঈ-এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর সা. নসবের সাথে তাঁর নসব মিলিত হয়েছে।

জাহিলী যুগেই পূতপবিত্র চরিত্রের জন্য ‘তাহিরা’ উপাধি লাভ করেন।

(আল–ইসাবা) রাসূলুল্লাহ সা. ও খাদীজার রা. মধ্যে ফুফু-ভাতিজার দূর সম্পর্ক ছিল।

এ কারণে, নবুওয়াত লাভের পর খাদীজা রা. রাসূলুল্লাহকে সা. তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবন

নাওফিলের কাছে নিয়ে গিয়ে বলেন, ‘আপনার ভাতিজার কথা শুনুন।’ সম্ভবতঃ বংশগত সম্পর্কের ভিত্তিতেই তিনি একথা বলেছিলেন।

পিতা খুওয়াইলিদ তৎকালীন আরব সমাজের বিশিষ্ট তাওরাত ও ইনজীল বিশেষজ্ঞ ওয়ারাকা ইবন নাওফিলকে

খাদীজার বর নির্বাচন করেছিলেন, কিন্তু কেন যে তা বাস্তবে রূপ লাভ করেনি সে সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা নীরব।

শেষ পর্যন্ত আবু হালা ইবন যারারাহ আত-তামীমীর সাথে তাঁর প্রথম বিয়ে হয়।

জাহিলী যুগেই তাঁর মৃত্যু হয়। আবু হালার মৃত্যুর পর ’আতীক বিন আবিদ আল-মাখযুমীর সাথে তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে হয়।

(শারহুল মাওয়াহিব, আল–ইসতিয়াব) তবে কাতাদার সূত্রে জানা যায়, তাঁর প্রথম স্বামী ’আতীক, অতঃপর আবু হালা।

ইবন ইসহাকও এ মত সমর্থন করেছেন বলে ইউনুস ইবন বুকাইর বর্ণনা করেছেন।

(আল ইসাবাঃ ৪/২৮১) তবে প্রথমোক্ত মতটি ইবন আবদিল বার সহ অধিকাংশের মত বলে ইবন হাজার উল্লেখ করেছেন।

খাদীজার পিতা খুওয়াইলিদ ইবন আসাদ ছিলেন ফিজার যুদ্ধে নিজ গোত্রের কমাণ্ডর।

তিনি ছিলেন বহু সন্তানের জনক। প্রথম পুত্র হিযাম।

এই হিযামের পুত্র প্রখ্যাত সাহাবী হাকীম জাহিলী যুগে মক্কার ‘দারুন নাদওয়ার’ পরিচালনভার লাভ করেছিলেন।

দ্বিতীয় সন্তান হযরত খাদীজা। তৃতীয় সন্তান ‘আওয়াম’ প্রখ্যাত সাহাবী হযরত যুবাইরের রা. পিতা।

রাসূলুল্লাহর সা. ফুফু এবং হযরত হামযার আপন বোন হযরত সাফিয়্যা রা. ছিলেন ‘আওয়ামের’ স্ত্রী বা যুবাইরের রা. মা।

সাফিয়্যা ছিলেন খাদীজার ছোট ভাইয়ের বউ। চতুর্থ সন্তান হালা।

তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. মেয়ে হযরত যয়নাবের রা. স্বামী আবুল আস ইবন রাবী’র মা।

আবূল আ’স রাসূলুল্লাহর সা. বড় জামাই। পঞ্চম সন্তান রুকাইয়া।

পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে হিযাম, আওয়াম এবং রুকাইয়া ইসলামের আবির্ভাবের আগেই মারা যান।

হযরত খাদীজা ও হালা ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন।

খাদীজার পিতার মৃত্যু কখন হয়েছিল, সে সম্পর্কে মতভেদ আছে।

কেউ বলেছেন, ‘ফিজার’ যুদ্ধে মারা যান। ইমাম সুহাইলীর মতে ফিজার যুদ্ধের আগেই মারা যান।

তখন খাদীজার বয়স পঁয়ত্রিশ। কারো কারো মতে রাসূলুল্লাহর সা. বিয়ের পর তিনি মারা যান। (হায়াতুস সাহাবা– ২/৬৫২)।

পিতা বা স্বামীর মৃত্যু বা যে কোন কারণেই হোক কুরাইশ বংশের অনেকের মত খাদীজাও ছিলেন একজন বড় ব্যবসায়ী।

ইবন সা’দ তাঁর ব্যবসায় সম্পর্কে বলছেনঃ ‘খাদীজা ছিলেন অত্যন্ত সম্মানিত ও সম্পদশালী ব্যবসায়ী মহিলা।

তাঁর বাণিজ্য সম্ভার সিরিয়া যেত এবং তাঁর একার পণ্য কুরাইশদের সকলের পণ্যের সমান হতো।’

ইবন সা’দের এ মন্তব্য দ্বারা খাদীজার ব্যবসায়ের পরিধি উপলব্ধি করা যায়।

অংশীদারী বা মজুরী বিনিময়ে যোগ্য লোক নিয়োগ করে তিনি দেশ বিদেশে মাল কেনাবেচা করতেন।রাসূলুল্লাহ সা. তখন পঁচিশ বছরের যুবক। এর মধ্যে চাচা আবু তালিবের সাথে বা একাকী কয়েকটি বাণিজ্য সফরে গিয়ে ব্যবসায় সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছেন।

ব্যবসায়ে তাঁর সততা ও আমানতদারীর কথাও মক্কার মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।

সবার কাছে তিনি তখন আল-আমীন। তাঁর সুনামের কথা খাদীজার কানেও পৌঁছেছে।

বিশেষতঃ তাঁর ছোট ভাই-বউ সাফিয়্যার কাছে আল-আমীন মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে বহু কথাই শুনে থাকবেন।

হযরত খাদীজা একবার কেনাবেচার জন্য সিরিয়ায় পণ্য পাঠাবার চিন্তা করলেন।

যোগ্য লোকের সন্ধান করছেন।

এ প্রসঙ্গে ওয়াকিদী থেকে যারকানীর বর্ণনাঃ ‘আবু তালিব মুহাম্মাদকে সা. ডেকে বললেনঃ ভাতিজা! আমি একজন দরিদ্র মানুষ, সময়টাও খুব সঙ্কটজনক।

মারাত্মক দুর্ভিক্ষের কবলে আমরা নিপতিত। আমাদের কোন ব্যবসায় বা অন্য কোন উপায়-উপকরণ নেই। তোমার গোত্রের একটি বাণিজ্য কাফিলা সিরিয়া যাচ্ছে।

খাদীজা তাঁর পণ্যের সাথে পাঠানোর জন্য কিছু লোকের খোঁজ করছে। তুমি যদি তার কাছে যেতে, হয়তো তোমাকেই সে নির্বাচন করতো। তোমার চারিত্রিক নিষ্কলুষতা তার জানা আছে।

যদিও তোমার সিরিয়া যাওয়া আমি পছন্দ করিনে এবং ইয়াহুদীদের পক্ষ থেকে তোমার জীবনের আশঙ্কা করি, তবুও এমনটি না করে উপায় নেই।’ জবাবে রাসূল সা. বললেন, সম্ভবতঃ সে নিজেই লোক পাঠাবে।

আবু তালিব বললেনঃ হয়তো অন্য কাউকে সে নিয়োগ করে ফেলবে।

চাচা-ভাতিজার এ সংলাপের কথা খাদীজার কানে গেল। ‘তিনি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট লোক পাঠালেন।’ (টীকা, সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৮) উল্লেখ থাকে যে, কৈশোরে একবার রাসূল সা. চাচার সাথে সিরিয়া গিয়েছিলেন।

তখন পাদরী ‘বুহাইরা’ রাসূলুল্লাহ সা. সম্পর্কে আবু তালিবকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন্।

উপরোক্ত বর্ণনায় আবু তালিব সে দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।

খাদীজা লোক মারফত মুহাম্মাদের সা. কাছে প্রস্তাব পাঠালেন, তিনি যদি ব্যবসায়ের দায়িত্ব নিয়ে সিরিয়া যান, অন্যদের তুলনায় খাদীজা তাঁকে দ্বিগুণ মুনাফা দেবেন। মুহাম্মাদ সা. রাজী হলেন।



খাদীজার রা. পণ্য-সামগ্রী নিয়ে তাঁর বিশ্বস্ত দাস মায়সারাকে সঙ্গে করে মুহাম্মাদ সা. চললেন সিরিয়া।

পথে এক গীর্জার পাশে একটি গাছের ছায়ায় বসে আছেন তিনি। গীর্জার পাদ্রী এগিয়ে গেলেন মায়সারার দিকে।

জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘গাছের নিচে বিশ্রামরত লোকাটি কে?’ মায়সারা বললেনঃ ‘মক্কার হারামবাসী কুরাইশ গোত্রের একটি লোক।’ পাদ্রী বললেনঃ ‘এখন এই গাছের নীচে যিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি একজন নবী ছাড়া আর কেউ নন।’ ঐতিহাসিকরা এই পাদ্রীর নাম ‘নাসতুরা’ বলে উল্লেখ করেছেন। (টীকা, সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৮) তবে ইবন হাজার ’আসকালানী এই পাদ্রীর নাম ‘বুহাইরা’ বলেছেন। (আল–ইসাবাঃ ৪/২৮১) তিনি আরো বলেছেন, এই বাণিজ্য সম্ভার নিয়ে রাসূল সা. বসরার বাজারে গিয়েছিলেন। তাবারী ইবন শিহাব যুহরী থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. খাদীজার পণ্য নিয়ে সিরিয়া নয়, বরং ইয়ামনের এক হাবশী বাজারে গিয়েছিলেন। তবে সিরিয়া যাওয়ার বর্ণনাটাই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। (তারীখুল উম্মাহ আল ইসলামিয়া, মুহাম্মদ আল–খিদরী বেকঃ ১/৬৪)

রাসূলুল্লাহ সা. সিরিয়ার বাজারে পণ্যদ্রব্য বিক্রী করলেন এবং যা কেনার তা কিনলেন। তারপর মায়সারাকে সঙ্গে করে মক্কার পথে রওয়ানা হলেন। পথে মায়সারা লক্ষ্য করলেন, রাসূল সা. তাঁর উটের ওপর সওয়ার হয়ে চলেছেন, আর দু’জন ফিরিশতা দুপুরের প্রচণ্ড রোদে তাঁর ওপর ছায়া বিস্তার করে রেখেছে। এভাবে মক্কায় ফিরে খাদীজার পণ্য-সামগ্রী বিক্রী করলেন।

ব্যবসায়ে এবার দ্বিগুণ অথবা দ্বিগুণের কাছাকাছি মুনাফা হলো। বাড়ী ফিরে বিশ্বস্ত ভৃত্য মায়সারা তাঁর মনিব খাদীজার নিকট পাদ্রীর মন্তব্য এবং সফরের অলৌকিক ঘটনাবলী সবিস্তার বর্ণনা করলেন। (সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৯)

হযরত খাদীজা রা. ছিলেন এক বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমতি ভদ্র মহিলা। তাঁর ধন-সম্পদ, ভদ্রতা ও লৌকিকতায় মক্কার সর্বস্তরের মানুষ মুগ্ধ ছিল। অনেক অভিজাত কুরাইশ যুবকই তাঁকে সহধর্মিনী হিসেবে লাভ করার প্রত্যাশী ছিল।

তিনি তাদের সকলকে প্রত্যাখ্যান করেন। মায়সারার মুখে সবকিছু শুনে খাদীজা নিজেই রাসূলুল্লাহর সা. নিকট বিয়ের পয়গাম পাঠান। (সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৯)

বিয়ের প্রস্তাব কিভাবে এবং কেমন করে হয়েছিল সে সম্পর্কে নানা রকম বর্ণনা রয়েছে।

তবে খাদীজাই যে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহর সা. নিকট প্রস্তাবটি পেশ করেন সে ব্যাপারে সব বর্ণনা একমত।

একটি বর্ণনায় এসেছে, খাদীজা রা. নিজেই রাসূলুল্লাহর সা. সাথে কথা বলেন এবং তাঁর পিতার নিকট প্রস্তাবটি উত্থাপন করার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি অস্বীকৃতি জানান এই বলে যে, দারিদ্রের কারণে হয়তো খাদীজার পিতা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করবেন।

অবশেষে খাদীজার পিতা যখন অতিরিক্ত মদপান করে মাতাল অবস্থায় ছিলেন তখন খাদীজা নিজেই বিষয়টি তাঁর কাছে উত্থাপন করেন এবং সম্মতি আদায় করেন। কিন্তু সুস্থ হয়ে আবার তিনি বেঁকে বসেন। তবে খাদীজা পুনরায় তাঁর সম্মতি আদায় করেন। (হায়াতুস সাহাবা– ২/৬৫২) অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, হযরত ইয়ালার স্ত্রী ও খাদীজার বান্ধবী ‘নাফীসা বিনতু মানিয়্যা’ এ ব্যাপারে পুরো উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

তিনিই সর্বপ্রথম খাদীজার পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট এভাবে প্রস্তাব পেশ করেনঃ ‘আপনাকে যদি ধন-সম্পদ, সৌন্দর্য ও জীবিকার নিশ্চয়তার দিকে আহ্‌বান জানানো হয়, আপনি কি গ্রহণ করবেন? ….এ কথাগুলি ছিল হযরত খাদীজা সম্পর্কে।



কথা পাকাপাকি হয়ে গেল। নির্ধারিত তারিখে আবু তালিব, হামযাসহ রাসূলুল্লাহর সা. খান্দানের আরো কিছু ব্যক্তি খাদীজার বাড়ী উপস্থিত হলেন। খাদীজাও তাঁর খান্দানের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। সকলের উপস্থিতিতে আবু তালিব বিয়ের খুতবা পাঠ করলেন। সাহিত্যিক উৎকর্ষের দিক দিয়ে এ খুতবা জাহিলী যুগের আরবী-গদ্য সাহিত্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। পাঁচশ’ স্বর্ণমুদ্রা মোহর ধার্য হয়। খাদীজা নিজেই উভয় পক্ষের যাবতীয় খরচ বহন করেছিলেন। তিনি দুই উকিয়া সোনা ও রুপো রাসূলুল্লাহর সা. নিকট পাঠান এবং তা দিয়ে উভয়ের পোশাক ও ওয়ালীমার বন্দোবস্ত করতে বলেন। (হায়াতুস সাহাবা– ২/৬৫২) এভাবে হযরত খাদীজা হলেন ‘উম্মুল মুমিনীন’। এটা নবুয়াত প্রকাশের পনের বছর পূর্বের ঘটনা। সে সময় তাঁদের উভয়ের বয়স সম্পর্কে সীরাত বিশেষজ্ঞদের মতপার্থক্য থাকলেও সর্বাধিক সঠিক মতানুযায়ী রাসূলুল্লাহর সা. বয়স ছিল পঁচিশ এবং খাদীজার চল্লিশ।

বিয়ের পনের বছর পর হযরত নবী করীম সা. নবুওয়াত লাভ করেন। তিনি খাদীজাকে রা. সর্বপ্রথম এ বিষয়ে অবহিত করেন। পূর্ব থেকেই খাদীজা রাসূলুল্লাহর সা. নবী হওয়া সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন।

সহীহ বুখারীর ‘ওহীর সূচনা’ অধ্যায়ে একটি হাদীসে বিষয়টির বিস্তারিত আলোচনা এসেছে। হযরত আয়িশা রা. বলেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি প্রথম ওহীর সূচনা হয় ঘুমে সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। স্বপ্নে যা কিছু দেখতেন তা সকাল বেলার সূর্যের আলোর ন্যায় প্রকাশ পেত। তারপর নির্জনে থাকতে ভালোবাসতেন। খানাপিনা সঙ্গে নিয়ে হিরা গুহায় চলে যেতেন।

সেখানে একাধারে কয়েকদিন ইবাদতে মশগুল থাকতেন। খাবার শেষ হয়ে গেলে আবার খাদীজার কাছে ফিরে আসতেন। খাদ্যদ্রব্য নিয়ে আবার গুহায় ফিরে যেতেন। এ অবস্থায় একদিন তাঁর কাছে সত্যের আগমণ হলো।

ফিরিশতা এসে তাঁকে বললেনঃ আপনি পড়ুন।তিনি বললেনঃ ‘আমি তো পড়া-লেখার লোক নই।’ ফিরিশতা তাঁকে এমন জোরে চেপে ধরলেন যে তিনি কষ্ট অনুভব করলেন। ছেড়ে দিয়ে আবার বললেনঃ ‘পড়ুন’। তিনি আবারো বললেনঃ ‘আমি পড়া-লেখার লোক নই’। ফিরিশতা দ্বিতীয় ও তৃতীয়বারও তাঁর সাথে প্রথমবারের মত আচরণ করলেন।

অবশেষে বললেনঃ ‘পড়ুন’ আপনার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্তপিণ্ড থেকে….’ রাসূল সা. ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরলেন। খাদীজাকে ডেকে বললেনঃ ‘আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও, কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও।’ তিনি ঢেকে দিলেন। তাঁর ভয় দূর হয়ে গেল।

তিনি খাদীজার নিকট পুরো ঘটনা খুলে বললেন এবং নিজের জীবনের আশংকার কথা ব্যক্ত করলেন। খাদীজা বললেনঃ না, তা কক্ষণো হতে পারে না। আল্লাহর কসম, তিনি আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না।

আপনি আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ়কারী, গরীব-দুঃখীর সাহায্যকারী, অতিথিপরায়ণ ও মানুষের বিপদে সাহায্যকারী। অতঃপর খাদীজা রা. রাসূলুল্লাহকে সা. সংগে করে তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবন নাওফিলের নিকট নিয়ে যান। সেই জাহিলী যুগে তিনি খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। হিব্রু ভাষায় ইনজীল কিতাব লিখতেন। তিনি বৃদ্ধ ও দৃষ্টিহীন। খাদীজা রা. বললেনঃ ‘শুনুন তো আপনার ভাতিজা কি বলে।’ তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘ভাতিজা তোমার বিষয়টি কি?’ রাসূলুল্লাহ সা. পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন। শুনে ওয়ারাকা বললেনঃ ‘এতো সেই ‘নামূস’-আল্লাহ যাঁকে মুসার আ. নিকট পাঠিয়েছিলেন। আফসুস! সে দিন যদি আমি জীবিত ও সুস্থ থাকতাম, যেদিন তোমার দেশবাসী তোমাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে।’ রাসূলুল্লাহ সা. জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘এরা আমাকে দেশ থেকে বের করে দেবে? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, তুমি যা নিয়ে এসেছো, যখনই কোন ব্যক্তি তা নিয়ে এসেছে, সারা দুনিয়া তাঁর বিরোধী হয়ে গেছে। যদি সে সময় পর্যন্ত আমি বেঁচে থাকি, তোমাকে সব ধরণের সাহায্য করবো। (বুখারী, ১ম খণ্ড) এ ঘটনার অল্প কিছুদিনের মধ্যে ওয়ারাকার মৃত্যু হয়।

ইসলাম গ্রহণের পর হযরত খাদীজা তাঁর সকল ধন-সম্পদ তাবলীগে দ্বীনের লক্ষ্যে ওয়াকফ করেন। রাসূল সা. ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে আল্লাহর ইবাদাত এবং ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। সংসারের সকল আয় বন্ধ হয়ে যায়। সেই সাথে বাড়তে থাকে খাদীজার দুশ্চিন্তা। তিনি ধৈর্য ও সহনশীলতার সাথে সব প্রতিকূল অবস্থার মুকাবিলা করেন। আল–ইসতিয়াব গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, ‘মুশরিকদের প্রত্যাখ্যান ও অবিশ্বাসের কারণে রাসূল সা. যে ব্যথা অনুভব করতেন, খাদীজার কাছে এলে তা দূর হয়ে যেত। কারণ, তিনি রাসূলকে সা. সান্ত্বনা দিতেন, সাহস ও উৎসাহ যোগাতেন। তাঁর সব কথাই তিনি বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করতেন। মুশরিকদের সকল অমার্জিত আচরণ তিনি রাসূলুল্লাহর সা. কাছে অত্যন্ত হালকা ও তুচ্ছভাবে তুলে ধরতেন।’ (তাবাকাত– ৩/৭৪০)

নবুওয়াতের সপ্তম বছর মুহাররম মাসে কুরাইশরা মুসলমানদের বয়কট করে। তাঁরা ‘শিয়াবে আবু তালিবে’ আশ্রয় গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহর সা. সাথে খাদীজাও সেখানে অন্তরীণ হন। প্রায় তিনটি বছর বনী হাশিম দারুণ দুর্ভিক্ষের মাঝে অতিবাহিত করে। গাছের পাতা ছাড়া জীবন ধারণের আর কোন ব্যবস্থা তাদের ছিল না। স্বামীর সাথে খাদীজাও হাসি মুখে সে কষ্ট সহ্য করেন। এমন দুর্দিনে হযরত খাদীজা রা. নিজের প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন উপায়ে কিছু খাদ্য খাবারের ব্যবস্থা মাঝে মাঝে করতেন। তাঁর তিন ভাতিজা- হাকীম ইবন হিযাম, আবুল বুখতারী ও যুময়া ইবনুল আসওয়াদ- তাঁরা সকলে ছিলেন কুরাইশ নেতৃবর্গের অন্যতম। অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা বিভিন্নভাবে মুসলমানদের কাছে খাদ্যশস্য পাঠানোর ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। একদিন হাকীম ইবন হিযাম তাঁর চাকরের মাধ্যমে ফুফু খাদীজার রা. কাছে কিছু গম পাঠাচ্ছিলেন। পথে আবু জাহল বাধা দেয়। হঠাৎ আবুল বুখতারী সেখানে উপস্থিত হন। তিনি আবু জাহলকে বললেন, এক ব্যক্তি তাঁর ফুফুকে সামান্য খাদ্য পাঠাচ্ছে, তুমি তা বাধা দিচ্ছ? (সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৯২)

নামায ফরয হওয়ার হুকুম নাযিল হয়নি, হযরত খাদীজা রা. ঘরের মধ্যে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে সেই প্রথম থেকেই নামায আদায় করতেন। (তাবাকাত– ৮/১০) ইবন ইসহাক উল্লেখ করেছেন, একদিন আলী রা. দেখতে পেলেন, তাঁরা দু’জন অর্থাৎ নবী সা. ও খাদীজা রা. নামায আদায় করছেন। আলী রা. জিজ্ঞেস করলেনঃ মুহাম্মাদ, এ কি? রাসূল সা. তখন নতুন দ্বীনের দাওয়াত আলীর কাছে পেশ করলেন এবং একথা কাউকে বলতে নিষেধ করলেন। (হায়াতুস সাহাবা– ১/৭০) এ বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায়, উম্মাতে মুহাম্মাদীর সা. মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত খাদীজা রা. রাসূলুল্লাহর সা. সাথে নামায আদায়ের গৌরব অর্জন করেন।

আফীক আল-কিন্দী নামক এক ব্যক্তি কিছু কেনাকাটার জন্য মক্কায় এসেছিলেন। হযরত আব্বাসের রা. বাড়েতে অবস্থান করছিলেন তিনি। একদিন সকালে লক্ষ্য করলেন, এক যুবক কাবার কাছে এসে আসমানের দিকে তাকালো। তারপর কিবলামুখী হয়ে দাঁড়ালো। একজন কিশোর এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর এলো এক মহিলা। সেও তাদের দু’জনের পেছনে দাঁড়ালো। তারা নামায শেষ করে চলে গেল। দৃশ্যটি আফীক কিন্দী দেখলেন। আব্বাসকে তিনি বললেনঃ ‘বড় রকমের একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে।’ আব্বাস বললেনঃ ‘হ্যাঁ’ তিনি আরো বললেনঃ ‘এ নওজোয়ান আমার ভাতিজা মুহাম্মাদ।’ কিশোরটি আমার আরেক ভাতিজা আলী এবং মহিলাটি মুহাম্মাদের স্ত্রী। ….আমার জানামতে দুনিয়ায় তারা তিনজনই মাত্র এই নতুন ধর্মের অনুসারী।’ (তাবাকাতঃ ৮/১০–১১)

ইবনুল আসীর বলেন, এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মার ইজমা হয়েছে যে, হযরত খাদীজা রাসূলুল্লাহর সা. ওপর সর্বপ্রথম ঈমান আনেন। ইসলাম গ্রহণের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল পঞ্চাশ বছর। তাঁর ইসলাম গ্রহণের প্রভাব তাঁর পিতৃকুলের লোকদের ওপরও পড়ে। ইসলামের আবির্ভাবের সময় পিতৃকুল বনু আসাদ ইবন আবদিল উয্‌যার পনের জন্য বিখ্যাত ব্যক্তি জীবিত ছিলেন। তাঁদের দশজনই ইসলাম গ্রহণ করেন। অন্য পাঁচজন কাফির অবস্থায় বদর যুদ্ধে নিহত হন।

রাসূলুল্লাহর সা. সাথে পঁচিশ বছর দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করার পর নবুওয়াতের দশম বছরে দশই রামাদান পঁয়ষট্টি বছর বয়সে হযরত খাদীজা মক্কায় ইনতিকাল করেন। জানাযা নামাযের বিধান তখনো প্রচলিত হয়নি। সুতরাং বিনা জানাযায় তাঁকে মক্কার কবরস্তান জান্নাতুল মুয়াল্লায় দাফন করা হয়। হযরত নবী করীম সা. নিজেই তাঁর লাশ কবরে নামান। (আল–ইসাবাঃ ৪/২৮৩)

হযরত খাদীজা রা. ওয়াফাতের অল্প কিছুদিন পর রাসূলুল্লাহর সা. বিশেষ হিতাকাঙ্ক্ষী চাচা আবু তালিব মারা যান। অবশ্য আল-ইসতিয়াবের একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে, আবু তালিবের মৃত্যুর তিনদিন পর খাদীজা ইনতিকাল করেন। বিপদে-আপদে এ চাচাই রাসূলুল্লাহকে সা. নানাভাবে সাহায্য করতেন। রাসূলুল্লাহর সা. দুই নিকটাত্মীয়ের ওয়াফাতের কারণে মুসলিম উম্মাহ্‌র নিকট এ বছরটি ‘আমুল হুয্‌ন’ বা শোকের বছর নামে অভিহিত হয়েছে।

হযরত খাদীজা রা. ছিলেন বহু সন্তানের জননী। প্রথম স্বামী আবু হালার ঔরসে হালা ও হিন্দ নামে দু’ছেলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা উভয়ে ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। হিন্দ বদর মতান্তরে উহুদ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন প্রাঞ্জলভাষী বাগ্মী। উটের যুদ্ধে আলীর রা. পক্ষে শাহাদাত বরণ করেন। দ্বিতীয় স্বামী ’আতীকের ঔরসে হিন্দা নাম্মী এক মেয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনিও ইসলাম গ্রহণ করে সাহাবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। (শারহুল মাওয়াকিব, আল–ইসতিয়াব, হাশিয়া, সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৭) অবশ্য অন্য একট বর্ণনা মতে প্রথম পক্ষে তাঁর তিনটি সন্তান জন্মলাভ করেন। দুই ছেলে- হিন্দ ও হারিস। হারিসকে এক কাফির কাবার রুকনে ইয়ামনীর নিকট শহীদ করে ফেলে। এক কন্যা যয়নাব। আর দ্বিতীয় পক্ষের কন্যাটির কুনিয়াত ছিল উম্মু মুহাম্মাদ। (দাখিরা–ই–মা’রিফ–ই–ইসলামিয়া)

হযরত রাসূলে কারীমের সা. পবিত্র ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন তাঁর ছয় সন্তান। প্রথম সন্তান হযরত কাসিম। অল্প বয়সে মক্কা শরীফে ইনতিকাল করেন। তাঁর নাম অনুসারে রাসূলুল্লাহর সা. কুনিয়াত হয় আবুল কাসিম। মৃত্যুর পূর্বে তিনি হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটা শিখেছিলেন। দ্বিতীয় সন্তান হযরত যয়নাব। তৃতীয় সন্তান হযরত আবদুল্লাহ। তিনি নবুওয়াত প্রাপ্তির পর জন্মলাভ করেছিলেন, তাই ‘তাইয়্যেব ও তাহির’ লকব লাভ করেন। অল্প বয়সে ইনতিকাল করেন। চতুর্থ সন্তান হযরত রুকাইয়া। পঞ্চম সন্তান হযরত উম্মু কুলসুম। ষষ্ঠ সন্তান হযরত ফাতিমা রা.। উল্লেখ্য যে, ইবরাহীম ছিলেন হযরত মারিয়ার গর্ভজাত সন্তান।

হযরত খাদীজা রা. সন্তানদের খুব আদর করতেন। আর্থিক সচ্ছলতাও ছিল। উকবার দাসী সালামাকে মজুরীর বিনিময়ে সন্তানদের দেখাশোনার জন্য নিয়োজিত করেছিলেন।

হযরত নবী কারীমের সা. পবিত্র স্ত্রীগণের মধ্যে হযরত খাদীজার স্থান সর্বেোচ্চে। তিনি প্রথম স্ত্রী, চল্লিশ বছর বয়সে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে বিয়ে হয়। তাঁর জীবদ্দশায় নবী করীম সা. আর কোন বিয়ে করেননি। হযরত ইবরাহীম ছাড়া রাসূলুল্লাহর সা. সব সন্তানই তার গর্ভে পয়দা হয়েছেন।

উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজার ফজীলত ও মর্যাদা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি, আরবের সেই ঘোর অন্ধকার দিনে কিভাবে এক মহিলা নিঃসঙ্কোচে রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াতে বিশ্বাস স্থাপন করছেন। তাঁর মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ও সংশয় নেই। সেই ওহী নাযিলের প্রথম দিনটি, ওয়ারাকার নিকট গমন এবং রাসূলুল্লাহর সা. নবী হওয়া সম্পর্কে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা- সবকিছুই গভীরভাবে ভেবে দেখার বিষয়। রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াত লাভের পূর্ব থেকে খাদীজা যেন দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন- তিনি নবী হবেন। তাই জিবরাঈলের আগমণের পর ক্ষণিকের জন্যও তার মনে কোন রকম ইতস্ততঃভাব দেখা দেয়নি। এতে তাঁর গভীর দূরদৃষ্টি ও তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নবুওয়াত লাভের পূর্বে ও পরে সর্বদাই তিনি রাসূলুল্লাহকে সা. সম্মান করেছেন, তাঁর প্রতিটি কথা বিশ্বাস করেছেন। পঁচিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে মুহূর্তের জন্যও তাঁর মনে কোন প্রকার সন্দেহ দানা বাঁধতে পারেনি। সেই জাহিলী যুগেও তিনি ছিলেন পূতঃপবিত্র। কখনো মূর্তিপূজা করেননি। নবী করীম সা. একদিন তাঁকে বললেনঃ ‘আমি কখনো লাত-উযযার ইবাদত করবো না।’ খাদীজা বলেছিলেনঃ লাত-উয্‌যার কথা ছেড়ে দিন। তাদের প্রসঙ্গই উত্থাপন করবেন না। (মুসনাদে আহমাদ– ৪/২২২)

নবুওয়াতে মুহাম্মাদীর সা. ওপর প্রথম বিশ্বাস স্থাপনকারী এবং তাঁর সাথে প্রথম সালাত আদায়কারীই শুধু তিনি নন।

সেই ঘোর দুর্দিনে ইসলামের জন্য তিনি যে শক্তি যুগিয়েছেন চিরদিন তা অম্লান হয়ে থাকবে।

ইসলামের সেই সূচনা লগ্নে প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. পরামর্শ দাত্রী।

রাসূলুল্লাহর সা. সাথে বিয়ের পর সমস্ত সম্পদ তিনি স্বামীর হাতে তুলে দেন। যায়িদ বিন হারিসা ছিলেন তাঁর প্রিয় দাস। তাকেও তিনি স্বামীর হাতে তুলে দেন। রাসূলুল্লাহ সা. যায়িদকে বেশী ভালোবাসতেন, তাই তাঁকে খুশী করার জন্য তাকে আযাদ করে দেন।



মক্কার একজন ধনবতী মহিলা হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজ হাতে স্বামীর সেবা করতেন। একবার তিনি বরতনে করে রাসূলুল্লাহর সা. জন্য কিছু নিয়ে আসছিলেন।

হযরত জিবরীল আ. রাসূলকে সা. বললেন, ‘আপনি তাঁকে আল্লাহ তা’আলা ও আমার সালাম পৌঁছিয়ে দিন।’ (বুখারী)

হযরত রাসূলে করীম সা. প্রিয়তমা স্ত্রী খাদীজার রা. স্মৃতি তাঁর মৃত্যুর পরও ভোলেননি।

তাঁর মৃত্যুর পর বাড়ীতে যখনই কোন পশু জবেহ হতো, তিনি তালাশ করে তাঁর বান্ধবীদের ঘরে ঘরে গোশত পাঠিয়ে দিতেন।

হযরত আয়িশা বলেনঃ যদিও আমি খাদীজাকে রা. দেখিনি, তবুও তাঁর প্রতি আমার ঈর্ষা হতো। অন্য কারো বেলায় কিন্তু এমনটি হতো না। কারণ, নবী কারীম সা. সবসময় তাঁর কথা স্মরণ করতেন।’

মাঝে মাঝে হযরত আয়িশা রা. রাসূলুল্লাহকে সা. রাগিয়ে তুলতেন।

রাসূল সা. বলতেনঃ ‘আল্লাহ আমার অন্তরে তাঁর ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন।’

হযরত খাদীজার রা. ওয়াফাতের পর তাঁর বোন হালা একবার রাসূলে কারীমের সা. সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলেন।

রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর কণ্ঠস্বর শুনেই বলে উঠলেন ‘হালা এসেছো’? রাসূলুল্লাহর সা. মানসপটে তখন খাদীজার স্মৃতি ভেসে উঠেছিল।

আয়িশা রা. বলে ফেললেন, ‘আপনি একজন বৃদ্ধার কথা মনে করছেন যিনি মারা গেছেন।

আল্লাহ তার চেয়ে অনেক উত্তম স্ত্রী আপনাকে দান করেছেন।’

জবাবে নবী কারীম সা. বললেনঃ ‘কক্ষনো না।

মানুষ যখন আমাকে মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে, সে তখন আমাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে।

সবাই যখন কাফির ছিল, তখন সে মুসলমান। কেউ যখন আমার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি, তখন সে আমাকে সাহায্য করেছে। তাঁর গর্ভেই আমার সন্তান হয়েছে।’ আমরা মনে করি হযরত খাদীজার মূল্যায়ন এর চেয়ে আর বেশী কিছু হতে পারে না।



হযরত খাদীজার ফজীলাত সম্পর্কে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছেঃ ধরাপৃষ্ঠের সর্বোত্তম নারী মরিয়ম বিনতু ইমরান ও খাদীজা বিনতু খুওয়াইলিদ। হযরত জিবরাঈল আ. বসে আছেন রাসূলুল্লাহর সা. কাছে। এমন সময় খাদীজা আসলেন। জিবরাইল আ. রাসূলুল্লাহকে সা. বললেন, ‘তাঁকে মণি-মুক্তার তৈরী একটি বেহেশতী মহলের সুসংবাদ দিন।’ (বুখারী)।


হযরত আছিয়া  ঃ-দুনিয়াতে জান্নাতের সুসংবাদ পাওয়া  চারজন রমণীর মধ্যে হযরত আছিয়া  অন্যতম ।তিনি ছিলেন ফেরাউনের স্ত্রী।  আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন—

وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا لِّلَّذِينَ آمَنُوا اِمْرَأَةَ فِرْعَوْنَ إِذْ قَالَتْ رَبِّ ابْنِ لِي عِندَكَ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ وَنَجِّنِي مِن فِرْعَوْنَ وَعَمَلِهِ وَنَجِّنِي مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ

মুমিনদের জন্যে ফেরাউন-পত্নীর দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। সে বললঃ হে আমার পালনকর্তা! আপনার সন্নিকটে জান্নাতে আমার জন্যে একটি গৃহ নির্মাণ করুন, আমাকে ফেরাউন ও তার দুস্কর্ম থেকে উদ্ধার করুন এবং আমাকে যালেম সম্প্রদায় থেকে মুক্তি দিন।–সুরা—আততাহরীম, আয়াত ১১।

মুসলিম নারীদের জন্য চির বরণীয় ও অনুসরণীয় এক ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন আছিয়া। সবুজ শ্যামলিমায় ঘেরা সুউচ্চ প্রাসাদের আলীশান মহলে তিনি বসবাস করতেন। সবুজ বৃক্ষের তলদেশে প্রাসাদের গা ঘেষে নীল দরিয়ার স্বচ্ছ পানি বয়ে চলত অবিরাম। এমন সব নেয়ামত ও আয়েশের মাঝেও আছিয়া ছলেন অতৃপ্ত, অস্থির। তাহলে কোন সে পিপাসায় তিনি কাতর ছিলেন? কিসের অভাবে ছটফট করতেন তিনি?

আল্লাহ পাকের কাছে আছিয়া কাতর দুয়া করেছিলেন—তিনি যেন তাঁর স্বামীর দুঙ্কর্ম থেকে তাঁকে হেফাজত করেন। তাঁর জুলুমবাজ কওমের হাত থেকে রেহাই দেন তাঁকে। তিনি আরো বলেছিলেন, তাঁর স্বামীর পৃষ্ঠপোষকতায় যে পাপের রাজ্য কায়েম হয়েছে, সেখান থেকে বের হতে তিনি উদগ্রীব হয়ে পড়েছেন। অথচ এক সময় তিনি স্বামীর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। হৃদয়জুড়ে ছিল তাঁর ভালবাসা। তাহলে তাঁর এ অভিযোগের প্রেক্ষাপট কী?

ফেরাউন তাঁর সুউচ্চ রাজপ্রাসাদ, সুদূর বিস্তৃত সাম্রাজ্যে অপ্রতিদ্বন্ধি বাদশাহ ছিল। সে ছিল ভীষণ কঠোর প্রকৃতির ও পাষাণ দিল। নির্বিচারে প্রজাসাধারণের উপর সে জুলুম করত। অত্যাচারে জর্জরিত করত তাদের। ফেরাউন স্বেচ্ছাচারিতার চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। অত্যন্ত অহংকার ও গর্ব করে বেড়াত সে। বনী ইসরাঈল ছিল তাঁর অবৈধ অত্যাচারের নিশানা। তারা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে অত্যন্ত কষ্টের ভেতর দিয়ে ফেরাউনি রাজ্যে জীবন যাপন করছিল । বিপদ মুসিবতে ধৈর্য ধরা ছাড়া তাদের কিছুই করার ছিল না।

একদিন রাজদুরবারের প্রধান জ্যোতিষী ফেরাউনের কাছে এসে বলল—বাদশাহ নামদার। অচিরেই বনী ইসরাঈলের মাঝে একজন সন্তান জম্ম নিবে। তাঁর হাতে আপনার সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য। জ্যোতিষীর এ সংবাদ বনী ইসরাঈলের উপর অত্যাচারের আগুনে ঘি ঢেলে দিল। ফেরাউনের পাষণ্ডতা উথলে উঠলো। জ্যোতিষীর এ অসহনীয় কথায় তাঁর উন্মত্ততা বেড়ে গেল কয়েকগুণ। নিজেকে একটু প্রবোধ দেয়ার জন্য, মনটাকে একটু সুস্থির করার জন্য বনী ইস্প্রাঈলের উপর জুলুমের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। সে তাদের নবজাতক পুত্র সন্তানদের ধীরে ধীরে নৃশংসভাবে হত্যা করতে লাগল। তবে শুধু কন্যা সন্তানদের জীবিত রাখত। অবশেষে আল্লাহ পাক বনী ইসরাঈলের ভাগ্য লিখনে পরিবর্তন আনলেন। তাদের পর্যাপ্ত শক্তি ও ক্ষমতা দান করলেন। ফলে ফেরাউন যে বিভীষিকার আশংকা করত, তা স্বচক্ষে দেখতে বাধ্য হয় সে।লোমহর্ষক এ ঘটনার শুরুটা খুবই অম্লমধুর । ফেরাউনের রাজপ্রাসাদের অনতিদূরে ছোট্ট এক ঝুপড়িতে ইউহানিব নাম্নী এক মহিলা বাস করতেন। তাঁর গর্ভধারণের সময় ঘনিয়ে এলে নিজগৃহের এক কোণায় তিনি আবদ্ধ হয়ে রইলেন। প্রসব বেদনা শুরু হলে তিনি মেয়েকে বললেন যাও, জলদি একজন ধাত্রী ডেকে নিয়ে আস। মেয়ে ধাত্রী ডেকে আনল। ইউহানিবের ঘরে একটি সুন্দর ফুটফুটে পুত্রসন্তান ভূমিষ্ট হল। তিনি ফেরাউনের নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার কথা করে ভয় ও আতংকে শিউরে উঠলেন। নিজেকেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এই নিষ্পাপ ফুলের মত শিশুকে কি মেরে ফেলা হবে? ছেলের প্রতি ভালবাসায় তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলেন। সিংস্র ফেরাউনের হিংস্রহাত থেকে বাঁচতে একাধারে তিন মাস গৃহভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকলেন তিনি। এজন্য ইউহানিব প্রতিটি মুহূর্তেই চিন্তা ও আতংকের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করতেন। নিজের প্রতি নয়, ছেলে মূসার প্রতি ভয় ও ভালবাসায় তিনি গভীর চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তবে আল্লাহ পাক তাঁর সহায় ছিলেন। তিনি তাঁকে নির্দেশ দিলেন, এ শিশুটির জন্য একটি কাঠের সিন্দুক তৈরি কর। তারপর তাঁকে সিন্দুকের ভেতর ভরে নীল দরিয়ায় ভাসিয়ে দাও। আর তোমার মেয়েকে সিন্দুকের অনুসরণ করে নীল নুদের পার দিয়ে চক্কর দিতে বল। এ ঐশী আদেশ পেয়ে মুসা জননীর চিত্ত প্রশান্ত হল। মন থেকে সব ডর—ভয় মুছে গিয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন তিনি। সুন্দর একটি সিন্দুক বানানো হল। ইউহানিব নয়নের মণি মুসাকে সেখানে রেখে দিয়ে মেয়েকে বললেন, সিন্দুকটি মাথায় করে নীল নদের ঘাটে নিয়ে যাও। চতুর মেয়ে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কাজ সম্পন্ন করল। ইউহানিব সন্তান সমেত সিন্দুকটি নীল নুদে ভাসিয়ে দিলেন। প্রবাহমান নদীর ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে সিন্দুকটা নাচতে নাচতে এগিয়ে চলল। সন্তানকে আল্লাহর হাতে সঁপে দিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে মা জননী ঘরে ফিরলেন। মেয়েকে পাঠিয়ে দিলেন সিন্দুকের পেছনে পেছনে। নদীর ফস্রোতে ভাসতে ভাওতে সিন্দুকটি ফেরাউনের মর্মর নির্মিত সুদৃশ্য সিঁড়ির গোড়ায় এসে থামল। ফেরাউনের স্ত্রী, কন্যা, সেবিকারা এখানে বসেই নদীর শীতল হাওয়ায় গা জুড়াত। প্রাসাদের এক খিড়কি দিয়ে আছিয়া এ সিন্দুকটি দেখতে পেলেন। বাচ্ছাসহ সিন্দুকটি উপরে তুলে আনা হল। ফেরাউনের সিপাহী ও প্রহরীরা আশাপাশেই ছিল। তাদের সবার হাতেই শিশু হননের যাবতীয় অস্ত্র ও হাতিয়ার উন্মুখ হয়ে রয়েছে। তাদের কাজই ছিল, বনী ইসরাঈলের ঘরে কোন নবজাতকের সন্ধান পেলে তাঁকে বধ করে নীল নদে সেই লাশটা ভাসিয়ে দিবে কিংবা দূরের কোন মরু উপত্যকায় ফেলে আসবে। শিশুটিকে প্রথম দর্শনেই ফেরাউনের মনে একটি ভালবাসা জেগে উঠল। কিন্তু তাঁর আশ পাশের লোকেরা শিশুটিকে হত্যা কুরে ফেলতে তাঁকে নানাভাবে উত্তেজিত করতে লাগল। কেউ একজন বলেও ফেলল, মহারাজ! সিন্দুকে বাচ্ছা রেখে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া আসলে আপনার বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র। জ্যোতিষীর কথা অনুযায়ী হতে পারে এই বাচ্ছাটিই আপনার রাজ্য পতনের কারণ হবে। তাদের এই কথোপকথনের মাঝে আছিয়া এক কদম সামনে এসে বললেন,

وَقَالَتِ امْرَأَتُ فِرْعَوْنَ قُرَّتُ عَيْنٍ لِّي وَلَكَ لَا تَقْتُلُوهُ عَسَى أَن يَنفَعَنَا أَوْ نَتَّخِذَهُ وَلَدًا وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ

এ শিশু আমার ও তোমার নয়নমণি, তাকে হত্যা করো না। এ আমাদের উপকারে আসতে পারে অথবা আমরা তাকে পুত্র করে নিতে পারি। প্রকৃতপক্ষে পরিণাম সম্পর্কে তাদের কোন খবর ছিল না।–সুরা কাসাস, আয়াত ৯।

আছিয়া স্বামীর কাছে এ শিশুটির ব্যাপারে তাঁর সাধারণ হুকুম বলবৎ না করার জন্য উপর্যুপরি অনুরোধ করতে লাগ্লেন। প্রত্যাশা নিয়ে তিনি বললেন, হতে পারে এ শিশু বড় হয়ে আমার একান্ত বাধ্যগত হবে আর আমরা তাঁকে আমাদের সন্তানরূপে গ্রহণ করবো। এক পর্যায়ে ফেরাউন তাঁর কোথা মেনে নিল। রাজপ্রাসাদে মূসা তখন ফেরাউনের পুত্রবৎ হয়ে গেল। মানস সন্তানের প্রতি অগাধ ভালবাসায় আছিয়ার দিল টইটম্বুর। আনন্দের দোলায় তিনি দুলতে লাগলেন।প্রাসাদের লোকেরা এ শিশুর জন্য একজন ধাত্রী খুঁজতে লাগল। হাজার হলেও এতো এখন রাজপুত্র। আর ফেরাউন তো শুধু বাদশাই নয়। প্রজাসাধারণের স্বকল্পিত প্রভুও সে। কাজেই চতুর্দিক থেকে ধাত্রীদের আগমন্ব প্রাসাদ ভরে উঠলো। ফেরাউন ও আছিয়া বাচ্ছার জন্য একজন যুৎসই ধাত্রীর জন্য প্রতীক্ষমান। কিন্তু রজোপ্রাসাদে আগত কোন মহিলার স্তনই মুখে নিচ্ছে না বাচ্চাটি। প্রধানমন্ত্রী হাসান তাঁর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি মেলে ধ্রল চারদিকে। ইত্যবসরে মূসার সহোদরা বোন সামনে এগিয়ে এসে বলল আমি একজন ধাত্রীর সন্ধান দিতে পারি তোমাদের, আশা করা যায় এ বাচ্চা তাঁর দুধ পান করবে। বাচ্চাটির অবিরাম কান্না আমার মনে খুবকরুণ হয়ে বিঁধছে, তাই আমি তোমাদের সাহায্যে এগিয়ে এলাম। অন্যথায় এতে আমার কোন গরজ নেই। আছিয়া বললেন—জলদি গিয়ে তাঁকে নিয়ে আস, দেখছো না সে কেমন জোরে জোরে চিৎকার করছে। ক্ষুধার তাড়নায় মুখটা একেবারে পাংশু হয়ে গেছে ছেলেটির। মেয়েটি বলল আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না রাণী মা! আমি এক্ষুণি তাঁকে নিয়ে হাজির হচ্ছি।

মূসার বোন মারিয়াম দৌড়ে মায়ের কাছে গেল। মাকে বলল—আম্মা!সসুসংবাদ শুনুন। তাঁকে নিয়ে অবাক কাণ্ড ঘটে গেছে। মূসা আগত কোন মহিলার দুধই পান করছে না। সকলেই হতাশ হয়ে ফিরে গেছে। আমি তাদেরকে আপনার কথা বলে এসেছি। চলুন, চলুন জলদি চলুন।

ইউহানিব বলতে লাগলেন, আমার প্রচন্ড ভয় হচ্ছে, যদি তারা কোনভাবে বুঝে ফেলেয়ামি তাঁর মা, তাহলে কী হবে? কিন্তু আমার তো আর তর সইছে না। সেই কখন থেকে যে অবিরাম দুধ ঝরে পড়ছে।মারয়াম বলল, আম্মা! তাড়াতাড়ি চলুন, আমাদের অনেক দেরি হয়্ব যাচ্ছে। তারা উভয়ে রাজপ্রাসাদে রওয়ানা হলেন। সেখানে পৌঁছে দেখলেন মূসার কান্নার আওয়া উচ্ছে উঠে গেছে। আছিয়া তাঁকে কোলে তুলে হেলিয়ে দুলিয়ে প্রবোধ দিচ্ছে আর আদর করছে। কিন্তু কান্না থামছে না কিছুতেই। ইউহানিব তাঁর কাছে গিয়ে বললেন—রাণী মা! একে আমার কাছে দিন। আছিয়া মারয়ামকে লক্ষ্য করে বললেন—এই ক্লি সেই ধাত্রী? মারয়াম বলল জি হ্যাঁ—রাণী মা ! আপনি নিশ্চিন্তে বাচ্ছাকে তাঁর হাতে দিন। মনে হচ্ছে অবশ্যই সে এর দুধ পান করবে এবং কান্নাও বন্ধ করবে। ইউহানিব বাচ্ছাকে কোলে নিতেই সে নীরব হয়ে গেল। তাঁর চোখে ফুটে উঠল একটি খুশীর ঝিলিক। নিতান্ত শান্ত ভঙ্গিতে সে তাঁর দুধ পান করতে লাগল। পাশে দাঁড়ানো আছিয়ার খুশি আর ধরে না। প্রশান্তির একটি নিঃশ্বাস ছাড়লেন তিনি। কিন্তু চতুর ফেরাউনের মনের ভেতর একটি সন্দেহ দানা বেঁধে উঠল।

ফেরাউন তাঁকে জিজ্ঞেস করল আচ্ছা, বলতো কে তুমি? এ বাচ্ছা আর সব মহিলা থেকে মুখ থেকে মুখ ফিরিয়ে তোমার দিধই বা কেন মুখে নিল? ইউহানিব বললেন আসলে আমার পেশাই হচ্ছে দুধ পান করানো। আমার দুধ বড়ই সুমিষ্ট ও সুপেয়। সব ধরণের শিশুরাই আগ্রহ ভরে আমার দুধ পান করে। আর যে একবার আমার দুধ খায় সে অন্যদের দুধ মুখেই নিতে চায় না। ফেরাউন প্রধানমন্ত্রী হামানের দিকে ইশারা করে বলল এ মহিলার ভাতা দ্বিগুণ করে দাও আর তাঁর থাকার সুবন্দোবস্ত করে দাও। মূসা জননী এসব কথা শুনে এবং পুরিস্থিতির অনুকূলতা অনুভব করে অত্যন্ত খুশী হলেন। আল্লাহ পাকের ওয়াদা যে এত দ্রুত বাস্তবায়িত হবে, তা তিনি ভাবতেই পারেননি।

আছিয়া তাঁকে বললেন—তুমি আমাদের এই প্রাসাদেই অবস্থান করো। আমি তোমার থাকার জন্য মনোরম একটি কামরা এবং উপযোগী খাবার—দাবারের ব্যবস্থা করে দিব। ইউহানিব বললেন—রাণী মা! আপনাকে অনেক অনেক শুকরিয়া। আমি চাচ্ছি এ বাচ্ছাকে আমার ঘরেই দুধ পান করাবো। সেখানকার পুঅরিবেশ খুব মনোরম। আর আমিও অবলীলায় সেখানে চলা—ফেরা করতে পারবো। এ বাচ্চারও বোধহয় কোন কষ্ট হবে না। আছিয়া বললেন—তোমার যা ইচ্ছে তা করো। মূসা জননী সন্তান নিয়ে ঘরে ফিরলেন। আল্লাহর শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতায় মুখর হয়ে উঠলেন তিনি। তিনিই তো তাঁর দিলে প্রশান্তি দিয়েছেন। মনের অস্থিরতা দূর করেছেন । আর আদরে দুলালকে তাঁর কোলেই ফিরিয়ে দিয়েছেন। খুব বেশি আওময় তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়নি। আদরে যত্নে মা ছেলেকে লালন পালন করতে লাগলেন। আছিয়ার যখনই বাচ্ছাটিকে দেখতে মন চাইত তিনি কাউকে পাঠিয়ে তাঁকে রাজপ্রাসাফে নিয়ে আসতেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে তৃপ্তি ভরে দেখতেন। একটু একটু করে মূসা হাঁটুতে ভর দিয়ে চলতে শিখলেন। কখনো কখনো দু—পায়ে ভর করে থাকতেন কিছুক্ষণ। ভাঙ্গা ভাঙ্গা করে অল্প—সল্প কথাও বলতেন মাঝে মধ্যে। যখনই আছিয়া মুসার সাথে একটু আমোদ—আহ্লাদ করতেন সে অত্যধিক আনন্দিত হয়ে উঠত। তবে আর কোন মহিলার সামনে সে এতটা আনন্দিত, এতটা অকৃত্রিম হত না।কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের সিঁড়িতে পদার্পণ করলেন মূসা। আছিয়ার হৃদয় কন্দরে স্নেহের বৃক্ষটি এখন পত্র পল্লবে সুশোভিত। মানস পুত্র মুসাকে না দেখে থাকতে পারেনা তিনি। দুগ্ধপানের মেয়াদ শেষ হতেই মূসাকে রাজপ্রাসাদে দিয়ে গিয়েছিলেন ইউহানিব। জ্যোতিষীর কথা শুনে ফেরাউনের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া নিষ্ঠুরতা তাঁর চোখের সামনে ছিল অহেতুক ঝামেলা এড়িয়ে চলাই সমীচীন মনে করেছেন তিনি। কিন্তু ফেরাউন জানত না, তাঁর গৃহেই আগ্নেয়গিরির এক ভয়ঙ্গকর লাভা বিস্ফোরিত হওয়ার জন্য ধীরে ধীরে স্ফীত হচ্ছে।

খোদাকে পরিত্যাগ করে হামানসহ যারা ফেরাউনের সামনে সেজদায় লুটিয়ে পড়ত, আছিয়া সাদের প্রতি ভীষণ রুষ্ট ছিলেন। ভীতি ও ভক্তি নিয়ে তারা অসম্ভব সব উপাধিতে ভূষিত করত ফেরাউনকে। এগুলো দেখে আছিয়া সিমাহীন অস্থির হয়ে উঠতেন। তাঁর স্বামী যখন অহংকারে মদমত্ত হয়ে বলত আমিই তোমাদের ভমহান প্রভু; তিনি মনে মনে বলতেন, হায়রে কপাল! কোন শয়তানের পাল্লায় যে পড়েছি। এ অন্ধ অহমিকায় আর কতকাল সে ডুবে থাকবে। কিসের নেশায় সে এ মহা মুসিবতকে বরণ করে নিচ্ছে? ফেরাউনের স্বকল্পিত প্রভুত্বকে প্রচন্ড ভাবে ঘৃণা করতেন তিনি।

তাঁর ভক্তদের ভাঁড়ামিপূর্ণ কার্যকলাপ দেখে দূর থেকে শুধু আফসোস করে বলতেন—সবগুলো একেকটা উম্মাদ।

হৃদয়ের মনিকোঠায় মূসাকে ধারণ করতেন আছিয়া। প্রগাঢ় ভালবাসায় ভরিয়ে রাখতেন তাঁকে। হঠাৎ একদিন একটি লোক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে তাঁকে সংবাদ দিল মূসা জনৈক কিবতীকে হত্যা করে ফেলেছে। স্বগোষ্ঠীয়       এক লোকের পক্ষাবলম্বন করেই এ কাজটা সে করেছে। আছিয়ার কন্যাদের সেবা করত যারা, তাদের একজনের স্বামী হিজকীল এসে তাঁকে জানালেন, শহরে দুজন লোক ঝগড়া করছিল। একজন মূসার স্বগোত্রীয় অপরজন কিবতী। কিবতী লোকটির বিরুদ্ধে অপরজন মূসার সহযোগিতা চাইলে মূসা তাঁকে প্রচন্ড ঘুষি মারে। আর এতেই লোকটির ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যায়। আছিয়া মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথাগুলো শুনছিলেন, হঠাৎ দূর থেকে ফেরাউনের ক্রোধান্বিত চিৎকারে তিনি সচকিত হয়ে উঠলেন। তাঁর বিকট আওয়াজে প্রাসাদ যেন কাঁপতে লাগল। কোথায় মূসা? এখনো কেন তাঁকে বন্দী করা হচ্ছে না। সিপাহী! ঐ কুলাঙ্গারকে এক্ষুণি আমার সামনে হাজির কর। আমি নিহত কিবতীর প্রতিশোধ নিতে চাই। এক্ষুণি। পরিস্থিতির ভয়াবহতায় আছিয়া খুব শংকিত হয়ে উঠলেন। মূসার প্রতি উৎকন্ঠায় তাঁর প্রাণ ব্যাকুল হয়ে উঠল। অনন্ত অসীম পরমসত্তার কাছে মিনতির দু’হাত তুলে ধরলেন তিনি। ভক্তি গদগদ কণ্ঠে মহান মা;বুদের কাছে তিনি মুসার কল্যাণের জন্য প্রার্থনা শুরু করে দিলেন। ইলাহী! মূঊসাকে ফেরাউন আর তাঁর সাঙ্গপাঙ্গাদের অনিষ্ট থেকে তুমি হেফাজত করো। তাদের বর্বরতা থেকে তুমি নিরাপদ রাখো।

হিজকীল সেখান থেকে চলে গেলেন। নিজের স্বভাবশুদ্ধতার বদৌলতে তিনিও এক আল্লাহয় বিশ্বাস করতেন এবং দাম্ভিক ফেরাউনের প্রভুত্বকে প্রত্যাখ্যান করতেন। দ্রুত মূসার কাছে গিয়ে তাঁকে সর্তক করে দিয়ে তিনি বললেন—

وَجَاء رَجُلٌ مِّنْ أَقْصَى الْمَدِينَةِ يَسْعَى قَالَ يَا مُوسَى إِنَّ الْمَلَأَ يَأْتَمِرُونَ بِكَ لِيَقْتُلُوكَ فَاخْرُجْ إِنِّي لَكَ مِنَ النَّاصِحِينَ

হে মূসা, রাজ্যের পরিষদবর্গ তোমাকে হত্যা করার পরমর্শ করছে। অতএব, তুমি বের হয়ে যাও। আমি তোমার হিতাকাঙ্ক্ষী।–সুরা কাসাস, আয়াত ২০।

মূসা হিজকীলের কথা আমলে নিয়ে তখনই ফেরাউনবাহিনী থেকে আত্মরক্ষার জন্য একদিকে পালিয়ে গেলেন। হিজকীল প্রাসাদে ফিরে এসে দেখলেন আছিয়া মূসার জীবনাশংকায় কম্পমান। তিনি কিছুটা নিচু আওয়াজে বললেন—রাণী মা! আর ভয়ের কোন কারণ নেই। আমি মূসা পর্যন্ত সব কোথা পৌঁছে দিয়েছি এবং আসন্ন বিপদ সম্পর্কেও সর্তক করেছি ত্তাকে। শহর ছেড়ে দূরে কোথাও—যেখানে ফেরাউনের সিপাহীরা তাঁর নাগাল পাবে না। চলে যাওয়ার জন্য সুপারিশ করেছি আমি। আছিয়া বললেন—মহান প্রভুর শুকরিয়া। তিনি মূসাকে ফেরাউনের হিংস্রতা ও নিষ্ঠুরতা থেকে হেফাজত করুন। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতি আমাকে কুড়ে কুড়ে খাবে। সে তো আমার সন্তান সমতুল্য। আমার কোলে পিঠেই সে বড় হয়ে উঠেছে। তাঁকে ছাড়া আমি থাকব কেমন করে? আচ্ছা একটু খোঁজ নিয়ে দেখ না সে কোথায় গেছে। হিজকীল বললেন, রাণী মা! আসুন! মহিমান্বিত স্রষ্টার কাছে আমরা তাঁর কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করি।

একে একে কয়েক বছর কেটে গেল। মূসা আর মিসরে ফিরে এলেন না। মূসাকে এক নজর দেখার অধীর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আছিয়া প্রায় নিরাশ হয়ে গেলেন। কারো কাছে মূসার কোনো সংবাদ নেই। সবাই যেন মূসাকে ভুলে গেল। সময় গড়িয়ে চলল। ফেরাউন ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের মুনে বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গেল যে, মূসা কস্মিনকালেও আর ফিরে আসবে না। তবে কয়েক বছর মূসা ঠিকই ফিরে এলেন। এবার তিনি আল্লাহ পাকের একজন নবী ও পয়গম্বর হয়ে এলেন। মূসা (আঃ) হকের দাওয়াত আর খোদায়ী শিক্ষার মহা সওগাত নিয়ে এলেন। আল্লাহ পাক তাঁকে ফেরাউনের কাছে এ দাওয়াত নিতে যেতে বলেছেন। যার অসহনীয় অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মানবেতর জীবন—যাপন করছে বনী ইসরাঈলের লোকগুলো। জীবনে ন্যূনতম অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে পরাধীনতার শৃংখলে তারা আষ্টে পৃষ্ঠে বাঁধা। তাদের মুক্তির পয়গাম নিয়েই মূসা (আঃ) এসেছেন। নীল দরিয়ার জোয়ার ভাটা আসে কিন্তু উদ্ধত ফেরাউনের নির্মম নিষ্ঠুরতায় কোন ভাটা নেই। মানুষকে মাবুদ বানানো দুরাচার কিবতীদের লাগামহীন উস্কানীতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে ফেরাউন। এ পাগলা ঘোড়াকে নিবৃত্ত করার জন্যই ইনসাফেরচাবুক নিয়ে মূসা (আঃ) এলেন। কিন্তু অনাকাঙ্গিত সেই কিবতী হত্যা স্মৃতিটি তাঁর মনে একতি ভয় ধরিয়ে দিল। প্রভুর শরণাপন্ন হয়ে তিনি বললেন

“পরওয়ারদেগার! আমি তাদের এক ব্যক্তিকে (অনিচ্ছায়) হত্যা করেছিলাম। আমি আশংকা করছি, তারাও আমাকে হত্যা করে ফেলবে। আল্লাহ পাক তাঁকে আশ্বস্ত করলেন, এবার তিনি আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে বললেন,

সহযোগীদের সত্য বিনাশী ষড়যন্ত্র আমি বরদাশত করতে পারি।

আমার যাবতীয় কাজ আসান করে দিন। সব বাঁধা বিপত্তিকে নস্যাৎ করে দিয়ে দাওয়াতের পথকে সুগম করে দিন।


হযরত মারিয়াম আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঃ-মারিয়াম বিনতে ইমরান, যিনি ঈসা (আঃ)-এর কুমারী মাতা ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যাকে জান্নাতের শ্রেষ্ঠ চারজন মহিলার অন্যতম হিসাবে বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি বলেন,
أفضلُ نساءِ أهلِ الجنتِ خديجتُ بنتِ خُوَيْلدِ وفاطمةُ بنتِ محمدٍ ومريمُــــــــــــ
‘জান্নাতবাসী মহিলাগণের মধ্যে সেরা হ’লেন চারজন: খাদীজা বিনতে খুওয়ালিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ, মারিয়াম বিনতে ইমরান এবং আসিয়া বিনতে মুযাহিম, যিনি ফেরাঊনের স্ত্রী’।[2]
মারিয়ামের জন্ম ও লালন-পালন :
মারিয়ামের জন্ম ও লালন-পালন সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
إِذْ قَالَتِ امْرَأَةُ عِمْرَانَ رَبِّ إِنِّي نَذَرْتُ لَكَ مَا فِيْ بَطْنِيْ مُحَرَّراً فَتَقَبَّلْ مِنِّي إِنَّكَ أَنتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ- فَلَمَّا وَضَعَتْهَا قَالَتْ رَبِّ إِنِّي وَضَعْتُهَا أُنثَى وَاللهُ أَعْلَمُ بِمَا وَضَعَتْ وَلَيْسَ الذَّكَرُ كَالأُنثَى وَإِنِّي سَمَّيْتُهَا مَرْيَمَ وِإِنِّي أُعِيْذُهَا بِكَ وَذُرِّيَّتَهَا مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ- فَتَقَبَّلَهَا رَبُّهَا بِقَبُولٍ حَسَنٍ وَأَنبَتَهَا نَبَاتاً حَسَناً وَكَفَّلَهَا زَكَرِيَّا، كُلَّمَا دَخَلَ عَلَيْهَا زَكَرِيَّا الْمِحْرَابَ وَجَدَ عِندَهَا رِزْقاً قَالَ يَا مَرْيَمُ أَنَّى لَكِ هَـذَا قَالَتْ هُوَ مِنْ عِندِ اللهِ إنَّ اللهَ يَرْزُقُ مَنْ يََّشَآءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ- (آل عمران ৩৫-৩৭)-
‘যখন ইমরানের স্ত্রী বলল, হে আমার প্রভু! আমার গর্ভে যা রয়েছে তাকে আমি তোমার নামে উৎসর্গ করলাম সবার কাছ থেকে মুক্ত হিসাবে। অতএব আমার পক্ষ থেকে তুমি তাকে কবুল করে নাও। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আলে ইমরান ৩৫)। ‘অতঃপর সে যখন তাকে প্রসব করল, তখন বলল, হে প্রভু! আমি তো কন্যা সন্তান প্রসব করেছি! অথচ আল্লাহ ভাল করেই জানেন, সে কি প্রসব করেছে। (আল্লাহ সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,) এই কন্যার মত কোন পুত্রই যে নেই। আর আমি তার নাম রাখলাম ‘মারিয়াম’। (মারিয়ামের  মা  দো‘আ  করে  বলল,  হে  আল্লাহ!)  আমি তাকে ও তার সন্তানদেরকে তোমার আশ্রয়ে সমর্পণ করছি, অভিশপ্ত শয়তানের কবল হ’তে’ (৩৬)। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তার প্রভু তাকে উত্তমভাবে গ্রহণ করে নিলেনএবং তাকে প্রবৃদ্ধি দান করলেন সুন্দর প্রবৃদ্ধি। আর তিনি তাকে যাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে সমর্পণ করলেন। (অতঃপর ঘটনা হ’ল এই যে,) যখনই যাকারিয়া মেহরাবের মধ্যে তার কাছে আসতেন, তখনই কিছু খাদ্য দেখতে পেতেন। তিনি জিজ্ঞেস করতেন, মারিয়াম! এসব কোথা থেকে তোমার কাছে এল? মারিয়াম বলত, ‘এসব আল্লাহর নিকট থেকে আসে। নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিযিক দান করে থাকেন’ (আলে ইমরান ৩/৩৫-৩৭)।
উল্লেখ্য যে, আল্লাহর নামে উৎসর্গীত সন্তান পালন করাকে তখনকার সময়ে খুবই পুণ্যের কাজ মনে করা হ’ত। আর সেকারণে মারিয়ামকে প্রতিপালনের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। ফলে লটারীর ব্যবস্থা করা হয় এবং আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর বয়োবৃদ্ধ নবী হযরত যাকারিয়া (আঃ) মারিয়ামের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন (আলে ইমরান ৩/৪৪)।
ঈসার জন্ম ও লালন-পালন :
এভাবে মেহরাবে অবস্থান করে মারিয়াম বায়তুল মুক্বাদ্দাসের খিদমত করতে থাকেন। সম্মানিত নবী ও মারিয়ামের বয়োবৃদ্ধ খালু যাকারিয়া (আঃ) সর্বদা তাকে দেখাশুনা করতেন। মেহরাবের উত্তর-পূর্বদিকে সম্ভবতঃ খেজুর বাগান ও ঝর্ণাধারা ছিল। যেখানে মারিয়াম পর্দা টাঙিয়ে মাঝে-মধ্যে পায়চারি করতেন। অভ্যাসমত তিনি উক্ত নির্জন স্থানে একদিন পায়চারি করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ মানুষের বেশে সেখানে জিবরাঈল উপস্থিত হন। স্বাভাবিকভাবেই তাতে মারিয়াম ভীত হয়ে পড়েন। এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ:
وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ مَرْيَمَ إِذِ انتَبَذَتْ مِنْ أَهْلِهَا مَكَاناً شَرْقِيًّا- فَاتَّخَذَتْ مِن دُونِهِمْ حِجَاباً فَأَرْسَلْنَا إِلَيْهَا رُوحَنَا فَتَمَثَّلَ لَهَا بَشَرًا سَوِيًّا- قَالَتْ إِنِّي أَعُوذُ بِالرَّحْمَن مِنكَ إِن كُنتَ تَقِيًّا- قَالَ إِنَّمَا أَنَا رَسُولُ رَبِّكِ لِأَهَبَ لَكِ غُلاَمًا زَكِيًّا- قَالَتْ أَنَّى يَكُونُ لِي غُلاَمٌ وَلَمْ يَمْسَسْنِي بَشَرٌ وَلَمْ أَكُ بَغِيًّا- قَالَ كَذَلِكِ قَالَ رَبُّكِ هُوَ عَلَيَّ هَيِّنٌ وَلِنَجْعَلَهُ آيَةً لِلنَّاسِ وَرَحْمَةً مِّنَّا وَكَانَ أَمْرًا مَّقْضِيًّا- (مريم ১৬-২১)-
(হে মুহাম্মাদ!) ‘আপনি এই কিতাবে মারিয়ামের কথা বর্ণনা করুন। যখন সে তার পরিবারের লোকজন হ’তে পৃথক হয়ে পূর্বদিকে একস্থানে আশ্রয় নিল’ (মারিয়াম ১৬)। ‘অতঃপর সে তাদের থেকে আড়াল করার জন্য পর্দা টাঙিয়ে নিল। অতঃপর আমরা তার নিকটে আমাদের ‘রূহ’ (অর্থাৎ জিব্রীলকে) প্রেরণ করলাম। সে তার কাছে গিয়ে পূর্ণাঙ্গ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল’ (১৭)। ‘মারিয়াম বলল, আমি তোমার থেকে করুণাময় আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যদি তুমি আল্লাহভীরু হও’ (১৮)। ‘সে বলল, আমি তো কেবল তোমার প্রভুর প্রেরিত। এজন্য যে, আমি তোমাকে একটি পবিত্র পুত্র সন্তান দান করে যাব’ (১৯)। ‘মারিয়াম বলল, কিভাবে আমার পুত্র সন্তান হবে? অথচ কোন মানুষ আমাকে স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণী নই’ (২০)। ‘সে বলল, এভাবেই হবে। তোমার পালনকর্তা বলেছেন, এটা আমার জন্য সহজ ব্যাপার এবং আমরা তাকে (ঈসাকে) মানবজাতির জন্য একটা নিদর্শন ও আমাদের পক্ষ হ’তে বিশেষ অনুগ্রহরূপে পয়দা করতে চাই। তাছাড়া এটা (পূর্ব থেকেই) নির্ধারিত বিষয়’ (মারিয়াম ১৯/১৬-২১)। অতঃপর জিব্রীল মারিয়ামের মুখে অথবা তাঁর পরিহিত জামায় ফুঁক মারলেন এবং তাতেই তাঁর গর্ভ সঞ্চার হ’ল (আম্বিয়া ২১/৯১; তাহরীম ৬৬/১২)। অন্য আয়াতে একে ‘আল্লাহর কলেমা’ (بِكَلِمَةٍ مِنْهُ) অর্থাৎ ‘কুন্’ (হও) বলা হয়েছে (আলে ইমরান ৩/৪৫)।অতঃপর আল্লাহ বলেন,
فَحَمَلَتْهُ فَانتَبَذَتْ بِهِ مَكَانًا قَصِيًّا- فَأَجَاءهَا الْمَخَاضُ إِلَى جِذْعِ النَّخْلَةِ قَالَتْ يَا لَيْتَنِي مِتُّ قَبْلَ هَذَا وَكُنتُ نَسْيًا مَّنْسِيًّا- فَنَادَاهَا مِنْ تَحْتِهَا أَلاَّ تَحْزَنِي قَدْ جَعَلَ رَبُّكِ تَحْتَكِ سَرِيًّا- وَهُزِّيْ إِلَيْكِ بِجِذْعِ النَّخْلَةِ تُسَاقِطْ عَلَيْكِ رُطَبًا جَنِيًّا- فَكُلِيْ وَاشْرَبِيْ وَقَرِّيْ عَيْنًا فَإِمَّا تَرَيِنَّ مِنَ الْبَشَرِ أَحَدًا فَقُولِيْ إِنِّيْ نَذَرْتُ لِلرَّحْمَنِ صَوْماً فَلَنْ أُكَلِّمَ الْيَوْمَ إِنسِيًّا- (مريم ২২-২৬)-
‘অতঃপর মারিয়াম গর্ভে সন্তান ধারণ করল এবং তৎসহ একটু দূরবর্তী স্থানে চলে গেল’ (মারিয়াম ২২)। ‘এমতাবস্থায় প্রসব বেদনা তাকে একটি খর্জুর বৃক্ষের মূলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। তখন সে বলল, হায়! আমি যদি এর আগেই মারা যেতাম এবং আমি যদি মানুষের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতাম’ (২৩)। ‘এমন সময় ফেরেশতা তাকে নিম্নদেশ থেকে (অর্থাৎ পার্শ্ববর্তী নিম্নভূমি থেকে) আওয়ায দিয়ে বলল, তুমি দুঃখ করো না। তোমার পালনকর্তা তোমার পাদদেশে একটি ঝর্ণাধারা সৃষ্টি করেছেন’ (২৪)। ‘আর তুমি খর্জুর বৃক্ষের কান্ড ধরে নিজের দিকে নাড়া দাও, তা থেকে তোমার দিকে সুপক্ক খেজুর পতিত হবে’ (২৫)। ‘তুমি আহার কর, পান কর এং স্বীয় চক্ষু শীতল কর। আর যদি কোন মানুষকে তুমি দেখ, তবে তাকে বলে দিয়ো যে, আমি দয়াময় আল্লাহর জন্য ছিয়াম পালনের মানত করেছি। সুতরাং আমি আজ কারু সাথে কোন মতেই কথা বলব না’ (মারিয়াম ১৯/২২-২৬)।
উল্লেখ্য যে, ইসলাম-পূর্ব কালের বিভিন্ন শরী‘আতে সম্ভবতঃ ছিয়াম পালনের সাথে অন্যতম নিয়ম ছিল সারাদিন মৌনতা অবলম্বন করা। হযরত যাকারিয়া (আঃ)-কেও সন্তান প্রদানের নিদর্শন হিসাবে তিন দিন ছিয়ামের সাথে মৌনতা অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে ঐ অবস্থায় ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলার অবকাশ ছিল (মারিয়াম ১৯/১০-১১)। একইভাবে মারিয়ামকেও নির্দেশ দেওয়া হ’ল (মারিয়াম ১৯/২৬)।

No comments:

Post a Comment

কোরআনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

০১) প্রশ্নঃ পবিত্র কুরআনুল কারীমে কতটি সূরা আছে? উত্তরঃ ১১৪টি। ০২) প্রশ্নঃ পবিত্র কুরআনের প্রথম সূরার নাম কি? উত্তরঃ সূরা ফাতিহা। ০৩) প্রশ্ন...