Tuesday, 30 April 2019

উত্তম দোয়া ও আমল

উত্তম চরিত্রের জন্য আমল ঃ-আল্লাহুম্মাহ দিনি লিআহসানিল আ’মালি ওয়া আহসানিল আখলাক্বি; ফাইন্নাহু লা ইয়াহদি লিআহসানিহা ইল্লা আংতা; ওয়া ক্বিনি সাইয়্যিআল আ’মালি ওয়া সাইয়্যিআল আখলাক্বি; ফাইন্নাহু লা ইয়াক্বি সাইয়্যিআহা ইল্লা আংতা।

অর্থ : হে আল্লাহ! আমাকে সর্বোত্তম কাজ ও উন্নত চরিত্র দান করো। কেননা তুমি ছাড়া অন্য কেউ তা দান করতে পারে না। এবং আমাকে অন্যায় কাজ ও খারাপ চরিত্র থেকে বাঁচাও। কেননা তুমি ছাড়া অন্য কেউ তা থেকে কাউকে বাঁচাতে পারে না। (নাসাঈ)

আল্ লাত্বিফু ঃআল্লাহর গুণবাচক নাম (اَللَّطِيْفُ) ‘আল-লাত্বিফু’-এর জিকিরের আমল ও ফজিলত তুলে ধরা হলো-
উচ্চারণ : ‘আল-লাত্বিফু’
অর্থ : ‘নিজের বান্দার ওপর কোমলতা প্রদর্শনকারী’

আল্লাহর ‍গুণবাচক নাম (اَلْعَدْلُ)-এর আমল

ফজিলত
>> যে ব্যক্তি অর্থ সংকটে পড়ে, অতি কষ্টে জীবন-যাপন করে বা অসুস্থতায় তার কেউ সেবা-শুশ্রূষা করে না অথবা তার কন্যা সন্তানের কেউ খোঁজ খবর নেয় না; ওই ব্যক্তি যেন উত্তম রূপে অজু করে দু’রাকাআত নামাজ পড়ে নিজের উদ্দেশ্য সাধনে আল্লাহ তাআলার পবিত্র গুণবাচক (اَللَّطِيْفُ) ‘আল-লাত্বিফু’ নামটি ১০০ বার পাঠ করে; তবে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তাঁর উদ্দেশ্য সম্পাদন করে দেবেন।

>> এমনিভাবে যে ব্যক্তি ছোট শিশু-বাচ্চাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন, রোগমুক্তি এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ পরিপূর্ণতার জন্য নিয়মিত আল্লাহ তাআলার পবিত্র গুণবাচক (اَللَّطِيْفُ) ‘আল-লাত্বিফু’ নামটি ১০০ বার পাঠ করা আবশ্যক।

অন্যের বিপদের দোয়া পাঠ ঃউচ্চারণ :
আলহামদু লিল্লাহিল্লাজি আ’ফানি মিম্মাবতালাকা বিহি, ওয়া ফাদ্‌দালানি আ’লা কাছিরিম মিম্মান খালাকা তাফদিলা।
অর্থ : সকল প্রশংসা সে আল্লাহর জন্য, যিনি তোমাকে বিপদ দ্বারা পরীক্ষায় নিপতিত করেছেন, তা হতে আমাকে নিরাপদ রেখেছেন এবং তার সৃষ্টির অনেকের চেয়ে আমাকে অনুগ্রহ করেছেন। (তিরমিজি)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে দুনিয়ার সব বিপদাপদে হিফাজত করুন। সবাইকে সব বিপদগ্রস্ত লোকদের কল্যাণে এগিয়ে আসার এবং দোয়া করার তাওফিক দান করুন। আমিন।


গুনাহ মাফের শ্রেষ্ঠ 5 টি আমল ঃ-পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন,

যারা কখনও কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেলে কিংবা মন্দ কাজে জড়িয়ে পড়ে। অতঃপর সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহ ছাড়া তাদের পাপ কে ক্ষমা করবেন? (সূরা আল-ইমরান: ১৩৫)।

রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, দয়াময় আল্লাহ তায়ালা রাতের বেলায় ক্ষমার হাত প্রসারিত করে ডাকতে থাকেন দিনের বেলায় গোনাহগারদের ক্ষমা করার জন্য। আর রাত্রিকালীন গোনাহগারদের মাফ করার জন্য দিনের বেলা  ক্ষমার হাত প্রসারিত করে ডাকতে থাকেন। এ অবস্থা পশ্চিম আকাশ থেকে সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। (সুনানে বায়হাকি : ১৬২৮১)।

তওবা ছাড়াও বিভিন্ন আমল দ্বারা গোনাহ মাফ হওয়ার কথা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।

এ ধরনের কয়েকটি আমল হলো_ প্রথম আমল- দ্বীনি মজলিসে বসা।

বোখারি শরিফে এসেছে, একদা রাসূলুল্লাহ (সা.) মসজিদে তালিমের মজলিসে ছিলেন। এ সময় তিনজন লোক এলো।

তাদের একজন মজলিসে ফাঁকা জায়গা দেখে বসে পড়ল আরেকজন ভিড় দেখে চলে গেল, অপরজন চলে যেতে লজ্জাবোধ করল এবং পেছনে বসল। রাসূল (সা.) আলোচনা শেষে বললেন, আমি তোমাদের তিন ব্যক্তির অবস্থা শোনাব। তাদের একজন আল্লাহর কাছে আশ্রয় নিয়েছে এবং আল্লাহ পাকও তাকে আশ্রয় দিয়েছেন। আরেকজন মজলিস থেকে চলে যেতে লজ্জাবোধ করল আল্লাহ তায়ালাও তাকে শাস্তি দিতে লজ্জাবোধ করলেন। আর তৃতীয় ব্যক্তি মজলিস থেকে বিমুখ হয়ে চলে গেল আল্লাহ পাকও তার থেকে বিমুখ হলেন। (বোখারি : ৬৬)।

দ্বিতীয় আমল নিদ্রা যাওয়ার সময় তিনবার পাঠ করা_ আস্তাগফিরুল্লাহাল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা হুওয়াল হাইয়ুল কাইয়ুমি ওয়া আতুবু ইলাইহি। সাহাবি আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি শয়নকালে তিনবার উপরোক্ত ইস্তেগফার পড়বে তার পাপরাশি সমুদ্রের ফেনা, আকাশের নক্ষত্ররাজি কিংবা মরুভূমির বালুকণা কিংবা দুনিয়ার দিনগুলোর পরিমাণ হলেও আল্লাহ পাক তা মাফ করে দেবেন। (তিরমিজি : ২৩০৪)।

তৃতীয় আমল প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর উপরোক্ত ইস্তিগফার তিনবার পাঠ করা। হজরত বারা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর তিনবার এ ইস্তিগফার পড়বে তার গোনাহগুলো মোচন করা হয়, যদিও সে জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করে থাকে। (তাবরানি : ১৪০০)।

চতুর্থ আমল প্রতিদিন ১০০ বার পাঠ করা_সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি দৈনিক উপরোক্ত তাসবিহ ১০০ বার পাঠ করবে তার পাপগুলো সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হলেও মাফ হয়ে যাবে।(বোখারি ও মুসলিম)।

পঞ্চম আমল নামাজে সূরা ফাতেহার পর আমিন বলা। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, ইমাম যখন সূরা ফাতেহা শেষ করে আমিন বলেন, তখন তোমরাও আমিন বলো। কেননা যার আমিন ফেরেশতাদের আমিনের সঙ্গে মিলে যাবে তার গোনাহগুলো মোচন হয়ে যাবে। (নাসায়ী : ১০০০)


১০টি বিপদ থেকে মুক্তি করবে এ সূরা গুলিঃ-১। সূরা ফতিহা আল্লাহর গজব হতে রক্ষার কারণ হয়।

২। সূরা ইয়াসীন কিয়ামতের দিন পিপার্সাত হওয়া থেকে রক্ষার মাধ্যম হবে।

৩। সূরা দুখান কিয়ামতের দিনের ভয়াল অবস্থা হতে রক্ষার মাধ্যম হবে।

৪। সূরা ওয়াকি’আ দরিদ্রতা হতে রক্ষার কারণ হয়।

৫। সূরা মূলক কবরের আযাব হতে রক্ষার মাধ্যম হবে।

৬। সূরা কাওসার শত্রুর অনিষ্ট হতে রক্ষার কারণ হয়।

৭। সূরা কাফিরুন মৃত্যুর সময় কুফরী হতে রক্ষার কারণ হয়।

৮। সূরা ইখলাস মুনাফিকী হতে রক্ষার কারণ হয়।

৯। সূরা ফালাক হিংসুকের হিংসার হতে রক্ষার কারণ হয়।

১০। সূরা নাস যাবতীয় ওয়াসাওয়াসা হতে রক্ষার কারণ।

 সালাতুল তাসবিহ এর ফ‌জিলতঃ

হযরত ইবনে আব্বাস(রাঃ) বলেন, রাসুল (সাঃ) হযরত ইবনে আব্বাস(রাঃ) কে বলেন, “হে আব্বাস, আমার চাচা আমি কি আপনাকে একটি দান বা বকশিশ দিব, আপনার সামনে একটি তফফা পেশ করব, আমি কি আপনাকে এমন একটি আমল বলে দিব যা পালন করলে আপনি ১০ টি উপকার লাভ করবেন অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা আপনার অতিত- ভবিষ্যতের, নতুন-পুরাতন, ভুলে বা জেনেশুনে, ছোট – বড়, গোপনে বা প্রকাশে করা সকল গুনাহ এ মাফ করে দিবেন।সেই আমল হল আপনি ৪রাকাত সালাতুল তাসবিহ আদায় করবেন।


আয়াতুল কুরসির ফজিলতঃ আবু হুরাইরাহ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে রমজানের জাকাতের প্রহরী নিযুক্ত করেন। আমার কাছে এক আগমনকারী এসে ওই মাল থেকে কিছু কিছু করে উঠিয়ে নিয়ে সে তার চাদরে জমা করতে থাকে। আমি তাকে ধরে ফেলি এবং বলি, তোমাকে আমি রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে নিয়ে যাব। সে বলল, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি খুবই অভাবী লোক। তখন আমি তাকে ছেড়ে দেই। সকালে রসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার রাতের বন্দী কী করেছিল? আমি বলি, হে আল্লাহর রসুল! সে তার ভীষণ অভাবের অভিযোগ করায় তার প্রতি আমার দয়া হয়, তাই আমি তাকে ছেড়ে দেই। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, সে তোমাকে মিথ্যা বলেছে। সে আবার আসবে। আমি রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কথায় বুঝলাম যে, সে সত্যিই আবার আসবে। আমি পাহারা দিতে থাকলাম। সে খাদ্য উঠাতে থাকল। আমি আবার তাকে ধরে ফেলে বললাম, তোমাকে আমি রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে নিয়ে যাব। সে আবার ওই কথাই বলল, আমাকে ছেড়ে দিন, আমি খুবই অভাবী।

তার প্রতি আমার দয়া হলো। কাজেই তাকে ছেড়ে দিলাম। সকালে আমাকে রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে আবু হুরায়রা! তোমার রাতের বন্দীটি কী করেছে? আমি বললাম, হে আল্লাহর রসুল! সে অভাবের অভিযোগ করায় আমি তাকে দয়া করে ছেড়ে দিয়েছি। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, সে তোমাকে মিথ্যা বলেছে। সে আবার আসবে। আমি আবার তৃতীয় রাতে পাহারা দেই। অতঃপর সে এসে খাদ্য উঠাতে থাকল। আমি তাকে বলি : এটাই তৃতীয়বার এবং এবারই শেষ। তুমি বারবার বলছ যে, আর আসবে না, অথচ আবার আসছ। সুতরাং তোমাকে আমি রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে নিয়ে যাব। তখন সে বলল, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আপনাকে এমন কতগুলো কথা শিখিয়ে দিচ্ছি যার মাধ্যমে আল্লাহ আপনার উপকার সাধন করবেন। আমি বললাম, ওইগুলো কি? সে বলল, ‘যখন আপনি বিছানায় শয়ন করবেন তখন আয়াতুল কুরসি শেষ পর্যন্ত পড়বেন। এতে মহান আল্লাহ আপনার রক্ষক হবেন এবং সকাল পর্যন্ত আপনার সামনে কোনো শয়তান আসতে পারবে না।’ তারা ভালো জিনিসের খুবই লোভী। অতঃপর (আবু হুরায়রা থেকে এ কথাগুলো শোনার পর) নবী করিম (সা.) বললেন, সে চরম মিথ্যাবাদী হলেও এটা সত্যই বলেছে। হে আবু হুরায়রা! তুমি তিন রাতে কার সঙ্গে কথা বলেছ তা কি জান? আমি বললাম, না। তিনি (সা.) বললেন, সে শয়দান। [সূত্র : সহি বোখারি, ফাতহুল বারী হা/২৩১১]


কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ দোয়াঃ

সকাল-সন্ধা তিন বার এই দোয়া পড়বেঃ
بِسْمِ اللهِ الّذِى لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَىْءٌ فِىْ الاَرْضِ وَلاَ فِى السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ
উচ্চারণঃ বিসমিলস্নাহিলস্নাযি লা ইয়াদুররম্ন মায়াস্ মিহী শাইউন ফিল আরদী ওয়া লা ফিস্সামায়ী ওয়া হুয়াস্সামীউল ‘আলীম।

সকাল-সন্ধা তিন বার এই দোয়া পড়বেঃ
اَعُوْذْ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ
উচ্চারণঃ আউযু বি কালীমাতিলস্নাহিত্ তাম্মাতি মিন শাররী মা খালাকা।

সকাল-সন্ধা তিন বার এই দোয়া পড়বেঃ
اَعُوْذْ بِاللهِ السَّمِيْعِ الْعَلِيْمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ
উচ্চারণঃ আউযু বিলস্নাহিস্ সামীয়ীল ‘আলীমি মিনাশ্ মাইতানির রাযীম।

সকাল সন্ধ্যায় তিন বার قُلْ هُوَ اللهُ শরীফ (সূরাঃ ইখলাস) এবং তিন বার قُلْ اَعُوْذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ (সূরাঃ ফালাক) পড়িবে, এবং তিন বার قُلْ اَعُوْذُ بِرَبِّ النَّاَسِ (সূরাঃ নাস) পড়িবে।

সকাল-সন্ধা এই দোয়াটিও বেশি বেশি পড়া যায়-
اللهُمَّ اِنِّى اَعُوْذُ بِكَ مِنَ الكَسَلِ وَالْحَرَمِ وَسُوْءِ الْكِبَرِ وفِتْنَةِ الدُّنْياَ وَ عَذاَبِ الْقَبْرِ
উচ্চারণঃ আলস্নাহুম্মা ইন্নী আউযুবিকা মিনাল কাসালি ওয়াল হারামী ওয়া সুইল কিবারি ওয়া ফিতনাতিদ্ দুনিয়া ওয়া আযাবিল কবরি।

ভোরে এই দোয়া পড়িবেঃ
اَصْبَحْنَا وَاَصْبَحَ الْمَلِكُ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ, اَلّلهُمَّ اِنِّىْ اَسْئَلُكَ خَيْرَ هذَا الْيَوْمِ وَفَتْحَه وَنَصْرَه وَنُوْرَه وَبَرَكَتَه وَهُدَاه وَاَعُوْذُبِكَ مِنْ شَرِّمَا فِيْه وَشَرِّمَا بَعْدَه-
উচ্চারণঃ আসবাহনা ওয়া আসবাহাল মালিকু লিলস্নাহি রাব্বীল আলামীন, আলস্নাহুম্মা ইন্নী আসআলূকা খাইরা হাযাল ইয়াওমি ওয়া ফাতহাহু ওয়া নাসরাহু ওয়া নূরাহু ওয়া হুদাহু ওয়া আউযুবিকা মিন শাররী মা ফিহি ওয়া শাররী মা বাদাহু।

এই দোয়াটিও সকাল সন্ধ্যায় পড়া যাবেঃ
اَللّهُمَّ بِكَ اَصْبَحْنَا وَبِكَ اَمْسَيْنَا وَبِكَ نَحْنَ وَبِكَ نَمُوْتُ وَاِلَيْكَ النُّشُوْرُ-
উচ্চারণঃ আলস্নাহুম্মা বিকা আসবাহনা ওয়া বিকা আমসাইনা ওয়া বিকা নাহয়া
দৈনিক সকাল সন্ধ্যা কম পক্ষে দশ বার করিয়া এই কালেমায়ে শাহাদাত অবশ্যই পরিবেঃ
لَا اِلهَ اِلّااللهُ وَحْدَه لَا شَرِيْكَ لَه – لَه الْمُلْكُ وَلَه الْحَمْدُ, وَهُوَ عَلى كُلِّ شَيْئٍ قَدِيْرٌ-
উচ্চারণঃ লা ইলাহা ইলস্নালস্নাহু ওয়াহদাহু লা শারীকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু, ওয়া হুয়া আলা কুলিস্ন শাইয়িন কাদীর।

এই তসবীহটি সকাল সন্ধ্যায় একশত বার করিয়া পরিবেঃ
سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِه, سُبْحَانَ اللهِ الْعَظِيْمِ*
উচ্চারণঃ সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী, সুবহানাল্লাহি আজীম।

খাবার খাওয়ার কিছু সুন্নত আমলঃ খানা সামনে আসলে এই দোয়া পড়বে –

اَللّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِيْما رَزَقْتَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা বারিকলানা ফিমা রাজাকতানা ওয়া কিনা আ‘জাবান নার।

খানা খাওয়ার শুরুতে এই দোয়া পড়বে-
بِسْمِ اللّهِ وَ عَلى بَرَكَةِ اللهِ
উচ্চারণঃ বিস্মিল্লাহি ও‘আলা বারাকাতিল্লাহ

খানার শুরুতে দোয়া পড়তে ভুরে গেলে খানার মাঝে স্মরণ আসার পর এই দোয়া পড়বে-
بِسْمِ اللهِ أَوَّلَه وَآخِرَه
উচ্চারণঃ বিসমিল্লাহি আউয়্যালাহু ওয়া আখীরাহ।

খানার শেষে এই দোয়া পড়বে –
اَلْحَمْدُ لِلّهِ الَّذِيْ اَطْعَمَنَا وَ سَقَانَا وَ جَعَلَنَا مِنَ الْمُسْلِمِيْن.
উচ্চারণঃ আলহামদুলিল্লাহিল্লাজী আতআ‘মানা ওয়া ছাক্বানা ওয়া জাআলানা মিনাল মুসলিমীন।

দাওয়াত খাওয়ার পর এই দোয়া পড়বে –
اَللّهُمَّ اَطْعِمْ مَنْ اَطْعَمَنِيْ وَ اَسْقِ مَنْ سَقَانِيْ
উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা আতঈম মান আত‘আামনী ওয়া আস্কী মান সাকানী।


রাতে ঘুমানোর পূর্বে আমল ঃরাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলিম যদি দুইটি কাজ নিয়মিত করতে পারে তাহলে জান্নাতে প্রবেশ করবে। কাজ দুইটি খুবই সহজ কিন্তু করার মানুষ খুব কম। প্রথমত, প্রত্যেক সালাতের পরে ১০ বার ‘সুবহানাল্লাহ’, ১০ বার ‘আল-হামদুলিল্লাহ ‘ ও ১০ বার ‘আল্লাহু আকবার’ বলবে। এতে ১৫০ বার জিহ্বার জিকর হবে এবং আল্লাহর কাছে আমলনামায় বা মিজানে ১৫০০ সাওয়াব হবে। দ্বিতীয়ত, বিছানায় শয়ন করার পরে ৩৪ বার ‘আল্লাহু আকবার’, ৩৩ বার ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ ও ৩৩ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ বলবে। এতে মুখে ১০০ বার ও মিজানে ১ হাজার বার হবে। রাসুল (সা.) আঙুলে গুনে গুনে তা দেখান। সাহাবিরা প্রশ্ন করেন, ‘এই দুইটি কর্ম সহজ হওয়া সত্ত্বেও পালনকারী কম কেন?’ তিনি উত্তরে বলেন, ‘কেউ শুয়ে পড়লে শয়তান এসে এগুলো বলার আগেই ঘুম পাড়িয়ে দেয়। সালাতের পরে এগুলো বলার আগেই তাকে তার বিভিন্ন কথা মনে করিয়ে দেয়।’ (আবু দাউদ, ইবনে হিব্বান, তারগিব)।

আয়াতুল কুরসি : বোখারি বর্ণিত হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি যে, কেউ রাতে বিছানায় শয়ন করার পরে আয়াতুল কুরসি পাঠ করলে সারা রাত আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে হেফাজত করা হবে এবং কোনো শয়তান তার কাছে আসতে পারবে না।

সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত : আবু মাসউদ (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যদি কেউ রাতে সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পাঠ করে তবে তা তার জন্য যথেষ্ট হবে।’ (বোখারি ও মুসলিম)।

সূরা কাফিরুন : নাওফাল আল-আশজায়ী (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে বলেছেন, তুমি সূরা ‘কাফিরুন’ পড়ে ঘুমাবে, এ শিরক থেকে তোমার বিমুক্তি।’ (তিরমিজি, আবু দাউদ)।

সূরা এখলাস : আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) তাঁর সাহাবিদের বললেন, ‘তোমরা কি পারবে না রাতে কোরআনের এক-তৃতীয়াংশ তেলাওয়াত করতে? বিষয়টি তাদের কাছে কষ্টকর মনে হলো। তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমাদের মধ্যে কে-ই বা তা পারবে? তখন তিনি বলেন, কুল হুআল্লাহু আহাদ সূরাটি কোরআনের এক-তৃতীয়াংশ।’ আবু দারদা (রা.) থেকে একই অর্থে আরেকটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। (বোখারি ও মুসলিম)।

সূরা এখলাস, ফালাক ও নাস একত্রে (তিনবার) : দুই হাত একত্র করে এ সূরাগুলো পাঠ করে হাতে ফুঁ দিয়ে হাত দুইটি যথাসম্ভব শরীরের সর্বত্র বুলানো- এভাবে তিনবার করতে হবে। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতি রাতে বিছানায় গমনের পরে তাঁর মোবারক দুইটি হাত একত্রিত করে তাতে ফুঁ দিতেন এবং তাতে উপরের তিনটি সূরা পাঠ করতেন। এরপর শরীরের যতটুকু স্থান সম্ভব দুই হাত দিয়ে মাসেহ করতেন। মাথা, মুখ ও শরীরের সামনের দিক থেকে শুরু করতেন। এভাবে তিনবার করতেন।’ (বোখারি)।

অজু অবস্থায় ঘুমাতে যাওয়া : ঘুমের জন্য অজু অবস্থায় শয়ন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাসনুন ইবাদত। রাসুলুল্লাহ (সা.) এজন্য বিশেষভাবে উৎসাহ প্রদান করেছেন এবং এ জন্য বিশেষ দুইটি পুরস্কারের সুসংবাদ প্রদান করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের দেহগুলোকে পবিত্র রাখবে, আল্লাহ তোমাদের পবিত্র করুন। যদি কোনো বান্দা অজু অবস্থয় ঘুমান, তবে তার পোশাকের মধ্যে একজন ফেরেশতা শুয়ে থাকেন। রাতে যখনই এ ব্যক্তি নড়াচড়া করে তখনই এ ফেরেশতা বলেন, ‘হে আল্লাহ আপনি এ ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দিন, কারণ সে অজু অবস্থায় ঘুমিয়েছে।’ (ইবনে হিব্বান, তাবারানি, সহিহুত তারগিব)। অন্য হাদিসে মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে কোনো মুসলিম যদি অজু অবস্থায় (আল্লাহর জিকরের ওপর) ঘুমায়, এরপর রাতে কোনো সময় হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে যায় এবং সে (ওই অবস্থায় শুয়ে শুয়ে) আল্লাহর কাছে তার জাগতিক বা পারলৌকিক কোনো কল্যাণ কামনা করে তবে আল্লাহ তাকে তার পার্থিত বস্তু দেবেনই।’ (আবু দাউদ, সহিহ তারগিব, নাসাঈ)। ঘুমের আগে অজু করে সম্ভব হলে ২/৪ রাকাত সালাত আদায় করে ঘুমাবেন। বিশেষত যারা শেষ রাতে তাহাজ্জুদের জন্য উঠতে পারবেন না বলে ভয় পাবেন, তারা ঘুমানোর আগে ২/৪ রাকাত ‘কিয়ামুল্লাইল’ আদায় করে ঘুমাবেন।


চারজন সর্বশ্রেষ্ঠ জান্নাতী নারীর কাহিনী

আল্লাহর রসুল (স) একবার চারটা দাগ কেটে সাহাবীদের (রা) জিজ্ঞেস করলেন
” তোমরা কি জানো এগুলো কি?” সাহাবিগণ উত্তর দিলেন ” আল্লাহ ও তাঁর রাসুল ভাল জানেন” ।
রসুল (স) বললেন ” সর্বশ্রেষ্ঠ চার জান্নাতি নারী হল
1-খাদিজাহ বিনতে খুআইলিদ,
2- ফাতিমাহ্ বিনতে মুহাম্মাদ(সা)
3- মারিয়াম বিনতে ইমরান ( ঈসা আর এর মা ) এবং
4-আসিয়াহ্ বিনতে মুযাহিম ( ফেরাউনের স্ত্রী) ।

খাদিজাহ (রা )হল প্রথম ব্যক্তি যিনি আল্লাহর রাসুলের প্রতি ইমান এনেছিলেন। কেন তাকে সর্বশ্রেষ্ঠ নারীদের একজন বলা হয়েছে? এটা কি তাঁর ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য?
নাকি তাঁর জ্ঞানের জন্য?
ঠিক কি কারণে তাঁকে এই উপাধি দেয়া হয়েছে তা নিয়ে আমাদের গভীর ভাবে চিন্তা করা দরকার।
বিশেষ করে আমাদের মা -বোনদের।
আমরা যদি এই চার মহীয়সী নারীর জীবন পর্যালোচনা করি তাহলে তাদের মধ্যে দুটি বিষয়ের মিল দেখি –
প্রথমত:
তাঁরা অত্যন্ত শক্তিশালী ইমানের অধিকারী ছিলেন। তাঁদের ইমান ছিল সর্বোচচ পর্যায়ের । এটা হল সেই রকম বিশ্বাস যাতে কোন ভাবেই চিড় বা ফাটল ধরানো যায়না।
যে অন্তরে বিশ্বাস আছে সে অন্তর চোখের দেখা, কানের শোনা কে উপেক্ষা করে তাঁর বিশ্বাসকে প্রাধান্য দেয়।
তাঁর কল্পনায় শুধুই থাকে বিশ্বাস । আর এঁদের সকলের ইমান যে বিশ্বাসের অনেক উঁচু পর্যায়ে ছিল ,এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

ফিরাউনের স্ত্রী , আসিয়াহ ( আ ) উদাহরণ ধরুন-
একজন মহিলা পৃথিবীতেে যা চাইতে পারে তার সবই তাঁর ছিল। আরামদায়ক জীবন, ধন সম্পদ, ধনী ও প্রভাবশালী স্বামী, ক্ষমতা, দাসদাসী, খাদেম। কিন্তু ইমানের স্বার্থে, আল্লাহর জন্য তিনি এর সবই পরিত্যাগ করতে রাজি ছিলেন।
তিনি বাস করতেন সে সময়ের সর্বোৎকৃষ্ট প্রাসাদে। কিন্তু তারপরও তিনি আল্লাহ সুবহানা তাআলার কাছে দুয়া করেছিলেন –
আর ঈমানদারদের ব্যাপারে ফেরাউনের স্ত্রীর উদাহরণ দিচ্ছেন –
যখন সে দোয়া করলো, ”
হে আমার রব, আমার জন্য তোমার কাছে জান্নাতে একটি ঘর বানিয়ে দাও …!
(66:11)
আমাদের বুঝতে হবে আসিয়াহ(আ) একটি অত্যন্ত বিষাক্ত পরিবেশে ছিলেন, যা ছিল সব দিক থেকেই ইমানের পরিপন্থী। আল্লাহর শত্রুদের সাথেই ছিল তাঁর বসবাস। কুফরি শক্তিকে উপেক্ষা করে নিজেকে আল্লাহর পথে অটুট রেখে তিনি ইমানের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন ।
আমরা অপর তিন জনের জীবন পর্যালোচনা করলেও একই রকম বলীয়ান ইমানের দৃষ্টান্ত দেখতে পাই।

তাদের মধ্যে দ্বিতীয় যে ব্যপারটি ছিল তা হলো-

তাঁরা সর্বশ্রেষ্ঠ মা।

মরিয়ম (আ ) বড় করেছিলেন ঈসা( আ)কে আর আসিয়াহ্ (আ)বড় করেছিলেন মুসা (আ)কে ।
মা খাদিজাহ (রা) কে আল্লাহ এত মর্যাদা দিয়েছেন তা কিন্তু এই জন্য নয় যে তিনি অনেক সফল ব্যবসায়ী ছিলেন।
বরং তিনি ছিলেন আল্লাহর রসুল মুহাম্মদ (স) এর অসাধারণ এক সহধর্মিণী। আল্লাহর রাসুলের (স) যখনি প্রয়োজন, তখনি তিনি পাশে পেয়েছিলেন খাদিজা (রা)কে ।
ইসলামের শিশু অবস্থায় সবচেয়ে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন মা খাদিজা ( রা)।
আল্লাহর রাসুল (স) নবুয়তের শুরুতে সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতিতে অবিচল সাহস আর প্রেরণা দিয়েছেন মা খাদিজাহ্ (রা)।রাসূল ( সা) কে একজন অভিভাবকের মতো আগলে রেখে হেরা গূহায় ধ্যান রত অবস্থায় কি অকৃত্রিম বন্ধুর মতো সেবা করেছেন সে ইতিহাস অনেকেরই জানা ।

আর ফাতিমা(রা) ছিলেন রসূল ( সা ) সবচেয়ে ছোট ও আদরের কন্যা এবং আমিরুল মু’মিনীন আলীর (রা) সহধর্মিণী।
আলী অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন। ঘরের কাজ করতে ফাতিমাকে(রা)কে অনেক কষ্ট পেতে হত।
আটা পিষতে পিষতে তাঁর কোমল হাতে কঠিন ক্ষত হয়ে গিয়েছিল । অথচ তিনি ছিলেন সর্ব শ্রেষ্ঠ রাসূল এবং তৎকালীন মদিনা ইসলামি রাষ্ট্রের কর্ণধারের সম্মানিত কন্যা!
একবার আলী (রা ) এর ইচ্ছায় তাঁরা আল্লাহর রাসুল (স) এর কাছে একজন ভৃত্য প্রার্থনা করলেন।
আল্লাহর রসুল (স) তাদের জবাবে বললেন আমি তোমাদের এরচেয়েও উত্তম কিছু শিখিয়ে দিচ্ছি।
তোমরা শুতে যাবার আগে 33 সুবহানাল্লাহ ,
33 বার আলহামদুলিললাহ এবং
34 আল্লাহু আকবর পড়বে ।
ফাতিমাকে আল্লাহর রাসুল (স) অত্যন্ত ভালবাসতেন।
তিনি বলেছিলেন ফাতিমা আমার দেহের অংশ,
সে যাতে খুশি হয় , আমিও তাতে খুশি হই। সে যাতে কষ্ট পায়, আমিও তাতে কষ্ট পাই। ফাতিমা(রা) ছিলেন আল্লাহর রাসুলের (সা) অত্যন্ত আদরের সন্তান।
তিনি পৃথিবীতেই জাননাতের সু- সংবাদ পেয়েছিলেন । তিনি হবেন জাননাতের নারীদের কর্ণধার! সুবহান আললাহ!
তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত একমাত্র তিনি ই ছিলেন তাঁর জীবিত সন্তান ।

আল্লাহর রাসুল (স) চাইলে ফাতিমা( রা)কে একজন কেন, দশ জন খাদেম দিতে পারতেন । কিন্তু তিনি তা না করে ফাতিমাকে(রা) কে উপদেশ দিলেন, ঘরের কাজ নিজের হাতে করে যেতে।
আর হয়তো এই কারণেই ফাতিমা (রা) হয়ে উঠলেন চার সর্বশ্রেষ্ঠ নারীদের একজন।
জ্ঞানের দিক থেকে যদিও মা আয়েশা (রা )খাদিজাহ(রা) ও ফাতেমার (রা )উপরে, কিন্তু মর্যাদার দিক থেকে উনি খাদিজাহ(রা) ও ফাতেমার(রা) সমকক্ষ ছিলন না।
আমাদের বোনেরা, আপনারা যখন আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করবেন তখন আপনাদের কিসের উপর বেশি প্রাধান্য দেয়া দরকার তা ঠিক করে নেবেন ।
তথাকথিত নারীবাদীরা আপনাদের কে জাগতিক ব্যপারে কিছুটা সাহায্য করলেও আখিরাতে জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা করতে পারবে না ।
হযরত ফাতেমা জাহরা (রাঃ) ছিলেন নারী ও পুরুষ তথা

গোটা মানব জাতির জন্য অসাধারণ ত্যাগ, বিশ্বস্ততা, অন্যায়ের ব্যাপারে

আপোসহীনতা, সততা, দানশীলতা, ধৈর্য, চারিত্রিক পবিত্রতা, আল্লাহর প্রতি

সন্তুষ্টিসহ অনেক মহান স্বর্গীয় গুণের আদর্শ। আর এ জন্যেই তাঁর উপাধি ছিল আস-সিদ্দিক্বা

বা সত্য-নিষ্ঠ, আল-মুবারাকাহ বা বরকতপ্রাপ্ত, আত-ত্বাহিরা বা পবিত্র, আল-মারজিয়া বা

আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, আয যাকিয়া বা সতী, আয জাহরা বা দ্যূতিময় প্রভৃতি।

স্নেহময়ী জননীর মত বিশ্বনবী (সাঃ)’র সেবা-যত্ন করা এবং বিপদের সময়

তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য মহীয়সী নারী ফাতিমা (রাঃ)’র অন্য একটি

নাম উম্মে আবিহা বা পিতার জননী। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁকে সকল

যুগের নারীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে উল্লেখ করেছেন এবং আল্লাহর দরবারে তাঁর বিশেষ

মর্যাদার কারণে তাঁকে দেখলে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করতেন।

মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ফাতেমা আমার দেহের অংশ, যা কিছু তাকে সন্তুষ্ট

করে তা আমাকে সন্তুষ্ট করে এবং যা কিছু আমাকে সন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও

সন্তুষ্ট করে, আর যা কিছু ফাতেমাকে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়,

আর যা আমাকে কষ্ট দেয়, তা আল্লাহকেও কষ্ট দেয়।

হযরত ফাতিমা (রাঃ) বেহেশতে সর্ব প্রথম প্রবেশ করবেন বলে বিশ্বনবী- সাঃ উল্লেখ করেছেন।



অনেক ইসলামী বর্ণনা অনুযায়ী পবিত্র কোরআনের সূরা কাওসার-এ

উল্লেখিত কাওসার বলতে হযরত ফাতেমা (রাঃ) কেই বোঝানো হয়েছে।

মক্কার কাফের ও মুশরিকরা যখন বিশ্বনবী (সাঃ)কে আবতার বা নির্বংশ বলে উপহাস করতো, এবং

রাসূলের ওফাতের পরই তার ধর্ম শেষ হয়ে যাবে বলে প্রচার করতো তখন এই সূরা নাজেল হয়।

এ সূরায় কাফেররাই নির্বংশ হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

হযরত ফাতিমা (রাঃ)’র মাধ্যমে রাসূলে পাক (সাঃ)’র বংশধারা আজো অব্যাহত রয়েছে।

অন্যদিকে নির্মূল হয়ে গেছে আবু লাহাব ও আবু জাহেলদের বংশধর।



হযরত ফাতিমা (রাঃ) ছিলেন বিশ্বনবী (সাঃ) ‘র আহলে বাইত বা পবিত্র

বংশধারায় জন্ম নেয়া মুসলমানদের ১১ জন ইমামের জননী।

বিশ্বনবী (সাঃ) ও স্বামী আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (রাঃ)’র পর এই ১১ জনই

ইসলামকে সব সংকট ও দূর্যোগের কবল থেকে রক্ষার তরী হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন।

এরই প্রমাণ দেখা যায় কারবালায় তাঁর পুত্র হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)ও এর আগে হযরত ইমাম

হাসান (রাঃ)’র নজিরবিহীন আত্মত্যাগে। মুসলমানদের নেতা হিসেবে ও বেহেশতী

যুবকদের সর্দার হিসেবে এই দুই মহাপুরুষকে গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন হযরত ফাতেমা (রাঃ)।

বিশ্বনবী (সাঃ) তাঁদেরকে নিজ সন্তান বলে উল্লেখ করতেন।
একজন পরিপূর্ণ আদর্শ মানুষ হিসেবে হযরত ফাতিমা (রাঃ)  এটা প্রমাণ করেছেন যে,

পরিপূর্ণতার শিখরে ওঠার জন্য নারী হওয়া বা পুরুষ হওয়া জরুরী কোনো শর্ত নয়।

তিনি জন্ম নিয়েছিলেন এমন এক যুগে যখন আরবরা নারীকে মনে করতো কেবল ভোগের সামগ্রী এবং

জাত্যাভিমানী আরবদের ঘরে কণ্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করলে তারা

অমর্যাদার ভয়ে কণ্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিত বা গোপনে মেরে ফেলতো ।

কিন্তু মহান আল্লাহ তার সর্বশেষ রাসূল ও সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের ঘরে একজন কন্যা

সন্তান পাঠিয়ে নারী জাতির জন্য অশেষ সম্মান ও মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন।
হযরত ফাতিমা (রাঃ) ছিলেন একজন আদর্শ জননী,একজন আদর্শ স্ত্রী বা গৃহিনী,একজন আদর্শ সমাজ-সেবিকা।

অর্থাৎ মুসলিম নারী যে শালীনতা বজায় রেখে জীবনের সবক্ষেত্রে

গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে তাঁর দৃষ্টান্ত দেখিয়ে গেছেন নবী-নন্দিনী।

আজকের যুগে যেসব মহিলা বা বুদ্ধিজীবী নারী-মুক্তির কথা ভাবছেন তাদের জন্য প্রকৃত আদর্শ হওয়া উচিত হযরত ফাতিমা (রাঃ)।



বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)’র ওফাতের পর খুব বেশি দিন বাঁচেন নি হযরত ফাতিমা (রাঃ)।

এ সময় ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও বাণীকে জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার

জন্য অসম-সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন নবী-নন্দিনী।

বিশ্বনবী (সাঃ)’র ওসিয়ত প্রচার এবং কিভাবে মুসলমানরা বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা

পাবে তা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন

বলে মনে করেন অনেক মুসলমান বিশেষজ্ঞ,ঐতিহাসিক ও আলেম।

তাদের মতে, ঐসব নির্যাতনের কারণেই তাঁকে অকালে শাহাদত বরণ করতে হয়েছে।

এমনকি অনেকে মনে করেন, তাঁর কবরও অবমাননার শিকার হতে পারে এমন

আশঙ্কায় তিনি তাকে গোপনে গভীর রাতে দাফন করতে বলেছিলেন স্বামী আমিরুল

মুমিনীন হযরত আলী (রাঃ) কে। আজো সকল শ্রেষ্ঠ গুণে গুণান্বিত এই মহিয়সী ও নীর্ভিক সংগ্রামী নারীর কবর অচিহ্নিত।

অন্যদিকে অন্য অনেক মুসলমান মনে করেন,

রাসূল (সাঃ)’র বিয়োগ-ব্যথায় শোকাকুল হযরত ফাতিমা (রাঃ) স্বাভাবিকভাবেই মারা গিয়েছিলেন

এবং তিনি কারো নির্যাতনের কারণে মারা যান নি।

যাই হোক্, হযরত ফাতিমা (রাঃ) মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ ও মুক্তির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন।

তাই মুক্তিকামী মুসলমানরা আজও কেবল তাঁর পবিত্র নাম স্মরণ করেই ইসলামের জন্য জীবন বিলিয়ে দিতে দ্বিধা বোধ করেন না।



হযরত ফাতিমা (রাঃ)’র সান্নিধ্য ও সেবা না পেলে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী(রাঃ)’র জীবনও

পুরোপুরি বিকশিত ও পরিপূর্ণতা লাভ করতো না। তাঁরা ছিলেন একে-অপরের প্রতি পুরোপুরি সন্তুষ্ট।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) হযরত ফাতিমা (রাঃ)-কে মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতা বলেও প্রশংসা করেছেন।

তিনি বলতেন,আমি যখনই বেহেশতের সুবাস পেতে চাইতাম তখনই কণ্যা ফাতেমার ঘ্রাণ নেই।

রাসূল (সাঃ)একবার প্রাণপ্রিয় কণ্যাকে বলেছিলেন, হে ফাতেমা! আল্লাহ তোমাকে নির্বাচিত করেছেন,

তোমাকে পরিপূর্ণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় সজ্জিত করেছেন এবং তোমাকে বিশ্বের নারীকূলের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।
হযরত ইমাম হাসান মুজতাবা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, একবার শুক্রবার রাতে

দেখলাম মা ফাতিমা (রাঃ) এবাদতে মগ্ন। একটানা রূকু ও আর সেজদায় থাকতে থাকতে ভোরের আলো ফুটে উঠলো।

আমি শুনতে পেলাম তিনি মুমিন নারী ও পুরুষের জন্য অনেক দোয়া করছেন,কিন্তু নিজের

জন্য কোনো দোয়াই করলেন না। আমি প্রশ্ন করলাম, মা, আপনি কেন নিজের জন্য দোয়া করলেন না,

যেভাবে অন্যরা দোয়া করে থাকে?তিনি জবাবে বললেন, হে আমার পুত্র! আগে প্রতিবেশির কথা ভাবতে হবে, এরপর নিজের ঘরের কথা … ।



আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করা ছাড়াও প্রায়ই

রোজা রাখা ও গরীব-দূঃখীকে অসাধারণ মাত্রায় দান-খয়রাত করা ছিল হযরত ফাতিমা (রাঃ) ’র একটি বড় বৈশিষ্ট্য।

জনসাধারণ বা কারো উদ্দেশ্যে যে কোনো বক্তব্য রাখার আগে দীর্ঘক্ষণ ধরে মহান

আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামতের কথা খুব সুন্দর ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায় তুলে ধরে আল্লাহর প্রশংসা করা ছিল তাঁর অন্য একটি বড় বৈশিষ্ট্য।

বিশ্বনবী (সাঃ)’র আহলে বাইতের অন্য সদস্যদের মত তিনিও কখনও অন্যায়ের সাথে আপোস করেন নি।

আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা বা সক্রিয় থাকার মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন আনন্দ।

হযরত ফাতিমা (রাঃ) বলেছেন, আল্লাহর সেবায় মশগুল হয়ে যে সন্তুষ্টি পাই তা

আমাকে অন্য সব সন্তুষ্টি বা আনন্দ থেকে বিরত রাখে এবং সব সময় মহান আল্লাহর

সুন্দর দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ রাখার প্রার্থণা ছাড়া আমার অন্য কোনো প্রত্যাশা নেই।
হযরত খাদিজাতুল কুবরা  রাদিয়াল্লাহু ঃ-নাম তাঁর খাদীজা। কুনিয়াত ‘উম্মু হিন্দ’ এবং লকব ‘তাহিরা’।

পিতা খুওয়াইলিদ, মাতা ফাতিমা বিনতু যায়িদ। জন্ম ‘আমুল ফীল’ বা হস্তীবর্ষের পনের বছর আগে মক্কা নগরীতে।

পিতৃ-বংশের উর্ধ পুরুষ কুসাঈ-এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর সা. নসবের সাথে তাঁর নসব মিলিত হয়েছে।

জাহিলী যুগেই পূতপবিত্র চরিত্রের জন্য ‘তাহিরা’ উপাধি লাভ করেন।

(আল–ইসাবা) রাসূলুল্লাহ সা. ও খাদীজার রা. মধ্যে ফুফু-ভাতিজার দূর সম্পর্ক ছিল।

এ কারণে, নবুওয়াত লাভের পর খাদীজা রা. রাসূলুল্লাহকে সা. তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবন

নাওফিলের কাছে নিয়ে গিয়ে বলেন, ‘আপনার ভাতিজার কথা শুনুন।’ সম্ভবতঃ বংশগত সম্পর্কের ভিত্তিতেই তিনি একথা বলেছিলেন।

পিতা খুওয়াইলিদ তৎকালীন আরব সমাজের বিশিষ্ট তাওরাত ও ইনজীল বিশেষজ্ঞ ওয়ারাকা ইবন নাওফিলকে

খাদীজার বর নির্বাচন করেছিলেন, কিন্তু কেন যে তা বাস্তবে রূপ লাভ করেনি সে সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা নীরব।

শেষ পর্যন্ত আবু হালা ইবন যারারাহ আত-তামীমীর সাথে তাঁর প্রথম বিয়ে হয়।

জাহিলী যুগেই তাঁর মৃত্যু হয়। আবু হালার মৃত্যুর পর ’আতীক বিন আবিদ আল-মাখযুমীর সাথে তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে হয়।

(শারহুল মাওয়াহিব, আল–ইসতিয়াব) তবে কাতাদার সূত্রে জানা যায়, তাঁর প্রথম স্বামী ’আতীক, অতঃপর আবু হালা।

ইবন ইসহাকও এ মত সমর্থন করেছেন বলে ইউনুস ইবন বুকাইর বর্ণনা করেছেন।

(আল ইসাবাঃ ৪/২৮১) তবে প্রথমোক্ত মতটি ইবন আবদিল বার সহ অধিকাংশের মত বলে ইবন হাজার উল্লেখ করেছেন।

খাদীজার পিতা খুওয়াইলিদ ইবন আসাদ ছিলেন ফিজার যুদ্ধে নিজ গোত্রের কমাণ্ডর।

তিনি ছিলেন বহু সন্তানের জনক। প্রথম পুত্র হিযাম।

এই হিযামের পুত্র প্রখ্যাত সাহাবী হাকীম জাহিলী যুগে মক্কার ‘দারুন নাদওয়ার’ পরিচালনভার লাভ করেছিলেন।

দ্বিতীয় সন্তান হযরত খাদীজা। তৃতীয় সন্তান ‘আওয়াম’ প্রখ্যাত সাহাবী হযরত যুবাইরের রা. পিতা।

রাসূলুল্লাহর সা. ফুফু এবং হযরত হামযার আপন বোন হযরত সাফিয়্যা রা. ছিলেন ‘আওয়ামের’ স্ত্রী বা যুবাইরের রা. মা।

সাফিয়্যা ছিলেন খাদীজার ছোট ভাইয়ের বউ। চতুর্থ সন্তান হালা।

তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. মেয়ে হযরত যয়নাবের রা. স্বামী আবুল আস ইবন রাবী’র মা।

আবূল আ’স রাসূলুল্লাহর সা. বড় জামাই। পঞ্চম সন্তান রুকাইয়া।

পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে হিযাম, আওয়াম এবং রুকাইয়া ইসলামের আবির্ভাবের আগেই মারা যান।

হযরত খাদীজা ও হালা ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন।

খাদীজার পিতার মৃত্যু কখন হয়েছিল, সে সম্পর্কে মতভেদ আছে।

কেউ বলেছেন, ‘ফিজার’ যুদ্ধে মারা যান। ইমাম সুহাইলীর মতে ফিজার যুদ্ধের আগেই মারা যান।

তখন খাদীজার বয়স পঁয়ত্রিশ। কারো কারো মতে রাসূলুল্লাহর সা. বিয়ের পর তিনি মারা যান। (হায়াতুস সাহাবা– ২/৬৫২)।

পিতা বা স্বামীর মৃত্যু বা যে কোন কারণেই হোক কুরাইশ বংশের অনেকের মত খাদীজাও ছিলেন একজন বড় ব্যবসায়ী।

ইবন সা’দ তাঁর ব্যবসায় সম্পর্কে বলছেনঃ ‘খাদীজা ছিলেন অত্যন্ত সম্মানিত ও সম্পদশালী ব্যবসায়ী মহিলা।

তাঁর বাণিজ্য সম্ভার সিরিয়া যেত এবং তাঁর একার পণ্য কুরাইশদের সকলের পণ্যের সমান হতো।’

ইবন সা’দের এ মন্তব্য দ্বারা খাদীজার ব্যবসায়ের পরিধি উপলব্ধি করা যায়।

অংশীদারী বা মজুরী বিনিময়ে যোগ্য লোক নিয়োগ করে তিনি দেশ বিদেশে মাল কেনাবেচা করতেন।রাসূলুল্লাহ সা. তখন পঁচিশ বছরের যুবক। এর মধ্যে চাচা আবু তালিবের সাথে বা একাকী কয়েকটি বাণিজ্য সফরে গিয়ে ব্যবসায় সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছেন।

ব্যবসায়ে তাঁর সততা ও আমানতদারীর কথাও মক্কার মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।

সবার কাছে তিনি তখন আল-আমীন। তাঁর সুনামের কথা খাদীজার কানেও পৌঁছেছে।

বিশেষতঃ তাঁর ছোট ভাই-বউ সাফিয়্যার কাছে আল-আমীন মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে বহু কথাই শুনে থাকবেন।

হযরত খাদীজা একবার কেনাবেচার জন্য সিরিয়ায় পণ্য পাঠাবার চিন্তা করলেন।

যোগ্য লোকের সন্ধান করছেন।

এ প্রসঙ্গে ওয়াকিদী থেকে যারকানীর বর্ণনাঃ ‘আবু তালিব মুহাম্মাদকে সা. ডেকে বললেনঃ ভাতিজা! আমি একজন দরিদ্র মানুষ, সময়টাও খুব সঙ্কটজনক।

মারাত্মক দুর্ভিক্ষের কবলে আমরা নিপতিত। আমাদের কোন ব্যবসায় বা অন্য কোন উপায়-উপকরণ নেই। তোমার গোত্রের একটি বাণিজ্য কাফিলা সিরিয়া যাচ্ছে।

খাদীজা তাঁর পণ্যের সাথে পাঠানোর জন্য কিছু লোকের খোঁজ করছে। তুমি যদি তার কাছে যেতে, হয়তো তোমাকেই সে নির্বাচন করতো। তোমার চারিত্রিক নিষ্কলুষতা তার জানা আছে।

যদিও তোমার সিরিয়া যাওয়া আমি পছন্দ করিনে এবং ইয়াহুদীদের পক্ষ থেকে তোমার জীবনের আশঙ্কা করি, তবুও এমনটি না করে উপায় নেই।’ জবাবে রাসূল সা. বললেন, সম্ভবতঃ সে নিজেই লোক পাঠাবে।

আবু তালিব বললেনঃ হয়তো অন্য কাউকে সে নিয়োগ করে ফেলবে।

চাচা-ভাতিজার এ সংলাপের কথা খাদীজার কানে গেল। ‘তিনি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট লোক পাঠালেন।’ (টীকা, সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৮) উল্লেখ থাকে যে, কৈশোরে একবার রাসূল সা. চাচার সাথে সিরিয়া গিয়েছিলেন।

তখন পাদরী ‘বুহাইরা’ রাসূলুল্লাহ সা. সম্পর্কে আবু তালিবকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন্।

উপরোক্ত বর্ণনায় আবু তালিব সে দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।

খাদীজা লোক মারফত মুহাম্মাদের সা. কাছে প্রস্তাব পাঠালেন, তিনি যদি ব্যবসায়ের দায়িত্ব নিয়ে সিরিয়া যান, অন্যদের তুলনায় খাদীজা তাঁকে দ্বিগুণ মুনাফা দেবেন। মুহাম্মাদ সা. রাজী হলেন।



খাদীজার রা. পণ্য-সামগ্রী নিয়ে তাঁর বিশ্বস্ত দাস মায়সারাকে সঙ্গে করে মুহাম্মাদ সা. চললেন সিরিয়া।

পথে এক গীর্জার পাশে একটি গাছের ছায়ায় বসে আছেন তিনি। গীর্জার পাদ্রী এগিয়ে গেলেন মায়সারার দিকে।

জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘গাছের নিচে বিশ্রামরত লোকাটি কে?’ মায়সারা বললেনঃ ‘মক্কার হারামবাসী কুরাইশ গোত্রের একটি লোক।’ পাদ্রী বললেনঃ ‘এখন এই গাছের নীচে যিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি একজন নবী ছাড়া আর কেউ নন।’ ঐতিহাসিকরা এই পাদ্রীর নাম ‘নাসতুরা’ বলে উল্লেখ করেছেন। (টীকা, সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৮) তবে ইবন হাজার ’আসকালানী এই পাদ্রীর নাম ‘বুহাইরা’ বলেছেন। (আল–ইসাবাঃ ৪/২৮১) তিনি আরো বলেছেন, এই বাণিজ্য সম্ভার নিয়ে রাসূল সা. বসরার বাজারে গিয়েছিলেন। তাবারী ইবন শিহাব যুহরী থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. খাদীজার পণ্য নিয়ে সিরিয়া নয়, বরং ইয়ামনের এক হাবশী বাজারে গিয়েছিলেন। তবে সিরিয়া যাওয়ার বর্ণনাটাই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। (তারীখুল উম্মাহ আল ইসলামিয়া, মুহাম্মদ আল–খিদরী বেকঃ ১/৬৪)

রাসূলুল্লাহ সা. সিরিয়ার বাজারে পণ্যদ্রব্য বিক্রী করলেন এবং যা কেনার তা কিনলেন। তারপর মায়সারাকে সঙ্গে করে মক্কার পথে রওয়ানা হলেন। পথে মায়সারা লক্ষ্য করলেন, রাসূল সা. তাঁর উটের ওপর সওয়ার হয়ে চলেছেন, আর দু’জন ফিরিশতা দুপুরের প্রচণ্ড রোদে তাঁর ওপর ছায়া বিস্তার করে রেখেছে। এভাবে মক্কায় ফিরে খাদীজার পণ্য-সামগ্রী বিক্রী করলেন।

ব্যবসায়ে এবার দ্বিগুণ অথবা দ্বিগুণের কাছাকাছি মুনাফা হলো। বাড়ী ফিরে বিশ্বস্ত ভৃত্য মায়সারা তাঁর মনিব খাদীজার নিকট পাদ্রীর মন্তব্য এবং সফরের অলৌকিক ঘটনাবলী সবিস্তার বর্ণনা করলেন। (সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৯)

হযরত খাদীজা রা. ছিলেন এক বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমতি ভদ্র মহিলা। তাঁর ধন-সম্পদ, ভদ্রতা ও লৌকিকতায় মক্কার সর্বস্তরের মানুষ মুগ্ধ ছিল। অনেক অভিজাত কুরাইশ যুবকই তাঁকে সহধর্মিনী হিসেবে লাভ করার প্রত্যাশী ছিল।

তিনি তাদের সকলকে প্রত্যাখ্যান করেন। মায়সারার মুখে সবকিছু শুনে খাদীজা নিজেই রাসূলুল্লাহর সা. নিকট বিয়ের পয়গাম পাঠান। (সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৯)

বিয়ের প্রস্তাব কিভাবে এবং কেমন করে হয়েছিল সে সম্পর্কে নানা রকম বর্ণনা রয়েছে।

তবে খাদীজাই যে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহর সা. নিকট প্রস্তাবটি পেশ করেন সে ব্যাপারে সব বর্ণনা একমত।

একটি বর্ণনায় এসেছে, খাদীজা রা. নিজেই রাসূলুল্লাহর সা. সাথে কথা বলেন এবং তাঁর পিতার নিকট প্রস্তাবটি উত্থাপন করার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি অস্বীকৃতি জানান এই বলে যে, দারিদ্রের কারণে হয়তো খাদীজার পিতা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করবেন।

অবশেষে খাদীজার পিতা যখন অতিরিক্ত মদপান করে মাতাল অবস্থায় ছিলেন তখন খাদীজা নিজেই বিষয়টি তাঁর কাছে উত্থাপন করেন এবং সম্মতি আদায় করেন। কিন্তু সুস্থ হয়ে আবার তিনি বেঁকে বসেন। তবে খাদীজা পুনরায় তাঁর সম্মতি আদায় করেন। (হায়াতুস সাহাবা– ২/৬৫২) অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, হযরত ইয়ালার স্ত্রী ও খাদীজার বান্ধবী ‘নাফীসা বিনতু মানিয়্যা’ এ ব্যাপারে পুরো উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

তিনিই সর্বপ্রথম খাদীজার পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট এভাবে প্রস্তাব পেশ করেনঃ ‘আপনাকে যদি ধন-সম্পদ, সৌন্দর্য ও জীবিকার নিশ্চয়তার দিকে আহ্‌বান জানানো হয়, আপনি কি গ্রহণ করবেন? ….এ কথাগুলি ছিল হযরত খাদীজা সম্পর্কে।



কথা পাকাপাকি হয়ে গেল। নির্ধারিত তারিখে আবু তালিব, হামযাসহ রাসূলুল্লাহর সা. খান্দানের আরো কিছু ব্যক্তি খাদীজার বাড়ী উপস্থিত হলেন। খাদীজাও তাঁর খান্দানের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। সকলের উপস্থিতিতে আবু তালিব বিয়ের খুতবা পাঠ করলেন। সাহিত্যিক উৎকর্ষের দিক দিয়ে এ খুতবা জাহিলী যুগের আরবী-গদ্য সাহিত্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। পাঁচশ’ স্বর্ণমুদ্রা মোহর ধার্য হয়। খাদীজা নিজেই উভয় পক্ষের যাবতীয় খরচ বহন করেছিলেন। তিনি দুই উকিয়া সোনা ও রুপো রাসূলুল্লাহর সা. নিকট পাঠান এবং তা দিয়ে উভয়ের পোশাক ও ওয়ালীমার বন্দোবস্ত করতে বলেন। (হায়াতুস সাহাবা– ২/৬৫২) এভাবে হযরত খাদীজা হলেন ‘উম্মুল মুমিনীন’। এটা নবুয়াত প্রকাশের পনের বছর পূর্বের ঘটনা। সে সময় তাঁদের উভয়ের বয়স সম্পর্কে সীরাত বিশেষজ্ঞদের মতপার্থক্য থাকলেও সর্বাধিক সঠিক মতানুযায়ী রাসূলুল্লাহর সা. বয়স ছিল পঁচিশ এবং খাদীজার চল্লিশ।

বিয়ের পনের বছর পর হযরত নবী করীম সা. নবুওয়াত লাভ করেন। তিনি খাদীজাকে রা. সর্বপ্রথম এ বিষয়ে অবহিত করেন। পূর্ব থেকেই খাদীজা রাসূলুল্লাহর সা. নবী হওয়া সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন।

সহীহ বুখারীর ‘ওহীর সূচনা’ অধ্যায়ে একটি হাদীসে বিষয়টির বিস্তারিত আলোচনা এসেছে। হযরত আয়িশা রা. বলেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি প্রথম ওহীর সূচনা হয় ঘুমে সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। স্বপ্নে যা কিছু দেখতেন তা সকাল বেলার সূর্যের আলোর ন্যায় প্রকাশ পেত। তারপর নির্জনে থাকতে ভালোবাসতেন। খানাপিনা সঙ্গে নিয়ে হিরা গুহায় চলে যেতেন।

সেখানে একাধারে কয়েকদিন ইবাদতে মশগুল থাকতেন। খাবার শেষ হয়ে গেলে আবার খাদীজার কাছে ফিরে আসতেন। খাদ্যদ্রব্য নিয়ে আবার গুহায় ফিরে যেতেন। এ অবস্থায় একদিন তাঁর কাছে সত্যের আগমণ হলো।

ফিরিশতা এসে তাঁকে বললেনঃ আপনি পড়ুন।তিনি বললেনঃ ‘আমি তো পড়া-লেখার লোক নই।’ ফিরিশতা তাঁকে এমন জোরে চেপে ধরলেন যে তিনি কষ্ট অনুভব করলেন। ছেড়ে দিয়ে আবার বললেনঃ ‘পড়ুন’। তিনি আবারো বললেনঃ ‘আমি পড়া-লেখার লোক নই’। ফিরিশতা দ্বিতীয় ও তৃতীয়বারও তাঁর সাথে প্রথমবারের মত আচরণ করলেন।

অবশেষে বললেনঃ ‘পড়ুন’ আপনার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্তপিণ্ড থেকে….’ রাসূল সা. ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরলেন। খাদীজাকে ডেকে বললেনঃ ‘আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও, কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও।’ তিনি ঢেকে দিলেন। তাঁর ভয় দূর হয়ে গেল।

তিনি খাদীজার নিকট পুরো ঘটনা খুলে বললেন এবং নিজের জীবনের আশংকার কথা ব্যক্ত করলেন। খাদীজা বললেনঃ না, তা কক্ষণো হতে পারে না। আল্লাহর কসম, তিনি আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না।

আপনি আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ়কারী, গরীব-দুঃখীর সাহায্যকারী, অতিথিপরায়ণ ও মানুষের বিপদে সাহায্যকারী। অতঃপর খাদীজা রা. রাসূলুল্লাহকে সা. সংগে করে তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবন নাওফিলের নিকট নিয়ে যান। সেই জাহিলী যুগে তিনি খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। হিব্রু ভাষায় ইনজীল কিতাব লিখতেন। তিনি বৃদ্ধ ও দৃষ্টিহীন। খাদীজা রা. বললেনঃ ‘শুনুন তো আপনার ভাতিজা কি বলে।’ তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘ভাতিজা তোমার বিষয়টি কি?’ রাসূলুল্লাহ সা. পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন। শুনে ওয়ারাকা বললেনঃ ‘এতো সেই ‘নামূস’-আল্লাহ যাঁকে মুসার আ. নিকট পাঠিয়েছিলেন। আফসুস! সে দিন যদি আমি জীবিত ও সুস্থ থাকতাম, যেদিন তোমার দেশবাসী তোমাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে।’ রাসূলুল্লাহ সা. জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘এরা আমাকে দেশ থেকে বের করে দেবে? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, তুমি যা নিয়ে এসেছো, যখনই কোন ব্যক্তি তা নিয়ে এসেছে, সারা দুনিয়া তাঁর বিরোধী হয়ে গেছে। যদি সে সময় পর্যন্ত আমি বেঁচে থাকি, তোমাকে সব ধরণের সাহায্য করবো। (বুখারী, ১ম খণ্ড) এ ঘটনার অল্প কিছুদিনের মধ্যে ওয়ারাকার মৃত্যু হয়।

ইসলাম গ্রহণের পর হযরত খাদীজা তাঁর সকল ধন-সম্পদ তাবলীগে দ্বীনের লক্ষ্যে ওয়াকফ করেন। রাসূল সা. ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে আল্লাহর ইবাদাত এবং ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। সংসারের সকল আয় বন্ধ হয়ে যায়। সেই সাথে বাড়তে থাকে খাদীজার দুশ্চিন্তা। তিনি ধৈর্য ও সহনশীলতার সাথে সব প্রতিকূল অবস্থার মুকাবিলা করেন। আল–ইসতিয়াব গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, ‘মুশরিকদের প্রত্যাখ্যান ও অবিশ্বাসের কারণে রাসূল সা. যে ব্যথা অনুভব করতেন, খাদীজার কাছে এলে তা দূর হয়ে যেত। কারণ, তিনি রাসূলকে সা. সান্ত্বনা দিতেন, সাহস ও উৎসাহ যোগাতেন। তাঁর সব কথাই তিনি বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করতেন। মুশরিকদের সকল অমার্জিত আচরণ তিনি রাসূলুল্লাহর সা. কাছে অত্যন্ত হালকা ও তুচ্ছভাবে তুলে ধরতেন।’ (তাবাকাত– ৩/৭৪০)

নবুওয়াতের সপ্তম বছর মুহাররম মাসে কুরাইশরা মুসলমানদের বয়কট করে। তাঁরা ‘শিয়াবে আবু তালিবে’ আশ্রয় গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহর সা. সাথে খাদীজাও সেখানে অন্তরীণ হন। প্রায় তিনটি বছর বনী হাশিম দারুণ দুর্ভিক্ষের মাঝে অতিবাহিত করে। গাছের পাতা ছাড়া জীবন ধারণের আর কোন ব্যবস্থা তাদের ছিল না। স্বামীর সাথে খাদীজাও হাসি মুখে সে কষ্ট সহ্য করেন। এমন দুর্দিনে হযরত খাদীজা রা. নিজের প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন উপায়ে কিছু খাদ্য খাবারের ব্যবস্থা মাঝে মাঝে করতেন। তাঁর তিন ভাতিজা- হাকীম ইবন হিযাম, আবুল বুখতারী ও যুময়া ইবনুল আসওয়াদ- তাঁরা সকলে ছিলেন কুরাইশ নেতৃবর্গের অন্যতম। অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা বিভিন্নভাবে মুসলমানদের কাছে খাদ্যশস্য পাঠানোর ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। একদিন হাকীম ইবন হিযাম তাঁর চাকরের মাধ্যমে ফুফু খাদীজার রা. কাছে কিছু গম পাঠাচ্ছিলেন। পথে আবু জাহল বাধা দেয়। হঠাৎ আবুল বুখতারী সেখানে উপস্থিত হন। তিনি আবু জাহলকে বললেন, এক ব্যক্তি তাঁর ফুফুকে সামান্য খাদ্য পাঠাচ্ছে, তুমি তা বাধা দিচ্ছ? (সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৯২)

নামায ফরয হওয়ার হুকুম নাযিল হয়নি, হযরত খাদীজা রা. ঘরের মধ্যে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে সেই প্রথম থেকেই নামায আদায় করতেন। (তাবাকাত– ৮/১০) ইবন ইসহাক উল্লেখ করেছেন, একদিন আলী রা. দেখতে পেলেন, তাঁরা দু’জন অর্থাৎ নবী সা. ও খাদীজা রা. নামায আদায় করছেন। আলী রা. জিজ্ঞেস করলেনঃ মুহাম্মাদ, এ কি? রাসূল সা. তখন নতুন দ্বীনের দাওয়াত আলীর কাছে পেশ করলেন এবং একথা কাউকে বলতে নিষেধ করলেন। (হায়াতুস সাহাবা– ১/৭০) এ বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায়, উম্মাতে মুহাম্মাদীর সা. মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত খাদীজা রা. রাসূলুল্লাহর সা. সাথে নামায আদায়ের গৌরব অর্জন করেন।

আফীক আল-কিন্দী নামক এক ব্যক্তি কিছু কেনাকাটার জন্য মক্কায় এসেছিলেন। হযরত আব্বাসের রা. বাড়েতে অবস্থান করছিলেন তিনি। একদিন সকালে লক্ষ্য করলেন, এক যুবক কাবার কাছে এসে আসমানের দিকে তাকালো। তারপর কিবলামুখী হয়ে দাঁড়ালো। একজন কিশোর এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর এলো এক মহিলা। সেও তাদের দু’জনের পেছনে দাঁড়ালো। তারা নামায শেষ করে চলে গেল। দৃশ্যটি আফীক কিন্দী দেখলেন। আব্বাসকে তিনি বললেনঃ ‘বড় রকমের একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে।’ আব্বাস বললেনঃ ‘হ্যাঁ’ তিনি আরো বললেনঃ ‘এ নওজোয়ান আমার ভাতিজা মুহাম্মাদ।’ কিশোরটি আমার আরেক ভাতিজা আলী এবং মহিলাটি মুহাম্মাদের স্ত্রী। ….আমার জানামতে দুনিয়ায় তারা তিনজনই মাত্র এই নতুন ধর্মের অনুসারী।’ (তাবাকাতঃ ৮/১০–১১)

ইবনুল আসীর বলেন, এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মার ইজমা হয়েছে যে, হযরত খাদীজা রাসূলুল্লাহর সা. ওপর সর্বপ্রথম ঈমান আনেন। ইসলাম গ্রহণের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল পঞ্চাশ বছর। তাঁর ইসলাম গ্রহণের প্রভাব তাঁর পিতৃকুলের লোকদের ওপরও পড়ে। ইসলামের আবির্ভাবের সময় পিতৃকুল বনু আসাদ ইবন আবদিল উয্‌যার পনের জন্য বিখ্যাত ব্যক্তি জীবিত ছিলেন। তাঁদের দশজনই ইসলাম গ্রহণ করেন। অন্য পাঁচজন কাফির অবস্থায় বদর যুদ্ধে নিহত হন।

রাসূলুল্লাহর সা. সাথে পঁচিশ বছর দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করার পর নবুওয়াতের দশম বছরে দশই রামাদান পঁয়ষট্টি বছর বয়সে হযরত খাদীজা মক্কায় ইনতিকাল করেন। জানাযা নামাযের বিধান তখনো প্রচলিত হয়নি। সুতরাং বিনা জানাযায় তাঁকে মক্কার কবরস্তান জান্নাতুল মুয়াল্লায় দাফন করা হয়। হযরত নবী করীম সা. নিজেই তাঁর লাশ কবরে নামান। (আল–ইসাবাঃ ৪/২৮৩)

হযরত খাদীজা রা. ওয়াফাতের অল্প কিছুদিন পর রাসূলুল্লাহর সা. বিশেষ হিতাকাঙ্ক্ষী চাচা আবু তালিব মারা যান। অবশ্য আল-ইসতিয়াবের একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে, আবু তালিবের মৃত্যুর তিনদিন পর খাদীজা ইনতিকাল করেন। বিপদে-আপদে এ চাচাই রাসূলুল্লাহকে সা. নানাভাবে সাহায্য করতেন। রাসূলুল্লাহর সা. দুই নিকটাত্মীয়ের ওয়াফাতের কারণে মুসলিম উম্মাহ্‌র নিকট এ বছরটি ‘আমুল হুয্‌ন’ বা শোকের বছর নামে অভিহিত হয়েছে।

হযরত খাদীজা রা. ছিলেন বহু সন্তানের জননী। প্রথম স্বামী আবু হালার ঔরসে হালা ও হিন্দ নামে দু’ছেলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা উভয়ে ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। হিন্দ বদর মতান্তরে উহুদ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন প্রাঞ্জলভাষী বাগ্মী। উটের যুদ্ধে আলীর রা. পক্ষে শাহাদাত বরণ করেন। দ্বিতীয় স্বামী ’আতীকের ঔরসে হিন্দা নাম্মী এক মেয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনিও ইসলাম গ্রহণ করে সাহাবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। (শারহুল মাওয়াকিব, আল–ইসতিয়াব, হাশিয়া, সীরাতু ইবন হিশাম– ১/১৮৭) অবশ্য অন্য একট বর্ণনা মতে প্রথম পক্ষে তাঁর তিনটি সন্তান জন্মলাভ করেন। দুই ছেলে- হিন্দ ও হারিস। হারিসকে এক কাফির কাবার রুকনে ইয়ামনীর নিকট শহীদ করে ফেলে। এক কন্যা যয়নাব। আর দ্বিতীয় পক্ষের কন্যাটির কুনিয়াত ছিল উম্মু মুহাম্মাদ। (দাখিরা–ই–মা’রিফ–ই–ইসলামিয়া)

হযরত রাসূলে কারীমের সা. পবিত্র ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন তাঁর ছয় সন্তান। প্রথম সন্তান হযরত কাসিম। অল্প বয়সে মক্কা শরীফে ইনতিকাল করেন। তাঁর নাম অনুসারে রাসূলুল্লাহর সা. কুনিয়াত হয় আবুল কাসিম। মৃত্যুর পূর্বে তিনি হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটা শিখেছিলেন। দ্বিতীয় সন্তান হযরত যয়নাব। তৃতীয় সন্তান হযরত আবদুল্লাহ। তিনি নবুওয়াত প্রাপ্তির পর জন্মলাভ করেছিলেন, তাই ‘তাইয়্যেব ও তাহির’ লকব লাভ করেন। অল্প বয়সে ইনতিকাল করেন। চতুর্থ সন্তান হযরত রুকাইয়া। পঞ্চম সন্তান হযরত উম্মু কুলসুম। ষষ্ঠ সন্তান হযরত ফাতিমা রা.। উল্লেখ্য যে, ইবরাহীম ছিলেন হযরত মারিয়ার গর্ভজাত সন্তান।

হযরত খাদীজা রা. সন্তানদের খুব আদর করতেন। আর্থিক সচ্ছলতাও ছিল। উকবার দাসী সালামাকে মজুরীর বিনিময়ে সন্তানদের দেখাশোনার জন্য নিয়োজিত করেছিলেন।

হযরত নবী কারীমের সা. পবিত্র স্ত্রীগণের মধ্যে হযরত খাদীজার স্থান সর্বেোচ্চে। তিনি প্রথম স্ত্রী, চল্লিশ বছর বয়সে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে বিয়ে হয়। তাঁর জীবদ্দশায় নবী করীম সা. আর কোন বিয়ে করেননি। হযরত ইবরাহীম ছাড়া রাসূলুল্লাহর সা. সব সন্তানই তার গর্ভে পয়দা হয়েছেন।

উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজার ফজীলত ও মর্যাদা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি, আরবের সেই ঘোর অন্ধকার দিনে কিভাবে এক মহিলা নিঃসঙ্কোচে রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াতে বিশ্বাস স্থাপন করছেন। তাঁর মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ও সংশয় নেই। সেই ওহী নাযিলের প্রথম দিনটি, ওয়ারাকার নিকট গমন এবং রাসূলুল্লাহর সা. নবী হওয়া সম্পর্কে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা- সবকিছুই গভীরভাবে ভেবে দেখার বিষয়। রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াত লাভের পূর্ব থেকে খাদীজা যেন দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন- তিনি নবী হবেন। তাই জিবরাঈলের আগমণের পর ক্ষণিকের জন্যও তার মনে কোন রকম ইতস্ততঃভাব দেখা দেয়নি। এতে তাঁর গভীর দূরদৃষ্টি ও তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নবুওয়াত লাভের পূর্বে ও পরে সর্বদাই তিনি রাসূলুল্লাহকে সা. সম্মান করেছেন, তাঁর প্রতিটি কথা বিশ্বাস করেছেন। পঁচিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে মুহূর্তের জন্যও তাঁর মনে কোন প্রকার সন্দেহ দানা বাঁধতে পারেনি। সেই জাহিলী যুগেও তিনি ছিলেন পূতঃপবিত্র। কখনো মূর্তিপূজা করেননি। নবী করীম সা. একদিন তাঁকে বললেনঃ ‘আমি কখনো লাত-উযযার ইবাদত করবো না।’ খাদীজা বলেছিলেনঃ লাত-উয্‌যার কথা ছেড়ে দিন। তাদের প্রসঙ্গই উত্থাপন করবেন না। (মুসনাদে আহমাদ– ৪/২২২)

নবুওয়াতে মুহাম্মাদীর সা. ওপর প্রথম বিশ্বাস স্থাপনকারী এবং তাঁর সাথে প্রথম সালাত আদায়কারীই শুধু তিনি নন।

সেই ঘোর দুর্দিনে ইসলামের জন্য তিনি যে শক্তি যুগিয়েছেন চিরদিন তা অম্লান হয়ে থাকবে।

ইসলামের সেই সূচনা লগ্নে প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. পরামর্শ দাত্রী।

রাসূলুল্লাহর সা. সাথে বিয়ের পর সমস্ত সম্পদ তিনি স্বামীর হাতে তুলে দেন। যায়িদ বিন হারিসা ছিলেন তাঁর প্রিয় দাস। তাকেও তিনি স্বামীর হাতে তুলে দেন। রাসূলুল্লাহ সা. যায়িদকে বেশী ভালোবাসতেন, তাই তাঁকে খুশী করার জন্য তাকে আযাদ করে দেন।



মক্কার একজন ধনবতী মহিলা হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজ হাতে স্বামীর সেবা করতেন। একবার তিনি বরতনে করে রাসূলুল্লাহর সা. জন্য কিছু নিয়ে আসছিলেন।

হযরত জিবরীল আ. রাসূলকে সা. বললেন, ‘আপনি তাঁকে আল্লাহ তা’আলা ও আমার সালাম পৌঁছিয়ে দিন।’ (বুখারী)

হযরত রাসূলে করীম সা. প্রিয়তমা স্ত্রী খাদীজার রা. স্মৃতি তাঁর মৃত্যুর পরও ভোলেননি।

তাঁর মৃত্যুর পর বাড়ীতে যখনই কোন পশু জবেহ হতো, তিনি তালাশ করে তাঁর বান্ধবীদের ঘরে ঘরে গোশত পাঠিয়ে দিতেন।

হযরত আয়িশা বলেনঃ যদিও আমি খাদীজাকে রা. দেখিনি, তবুও তাঁর প্রতি আমার ঈর্ষা হতো। অন্য কারো বেলায় কিন্তু এমনটি হতো না। কারণ, নবী কারীম সা. সবসময় তাঁর কথা স্মরণ করতেন।’

মাঝে মাঝে হযরত আয়িশা রা. রাসূলুল্লাহকে সা. রাগিয়ে তুলতেন।

রাসূল সা. বলতেনঃ ‘আল্লাহ আমার অন্তরে তাঁর ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন।’

হযরত খাদীজার রা. ওয়াফাতের পর তাঁর বোন হালা একবার রাসূলে কারীমের সা. সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলেন।

রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর কণ্ঠস্বর শুনেই বলে উঠলেন ‘হালা এসেছো’? রাসূলুল্লাহর সা. মানসপটে তখন খাদীজার স্মৃতি ভেসে উঠেছিল।

আয়িশা রা. বলে ফেললেন, ‘আপনি একজন বৃদ্ধার কথা মনে করছেন যিনি মারা গেছেন।

আল্লাহ তার চেয়ে অনেক উত্তম স্ত্রী আপনাকে দান করেছেন।’

জবাবে নবী কারীম সা. বললেনঃ ‘কক্ষনো না।

মানুষ যখন আমাকে মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে, সে তখন আমাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে।

সবাই যখন কাফির ছিল, তখন সে মুসলমান। কেউ যখন আমার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি, তখন সে আমাকে সাহায্য করেছে। তাঁর গর্ভেই আমার সন্তান হয়েছে।’ আমরা মনে করি হযরত খাদীজার মূল্যায়ন এর চেয়ে আর বেশী কিছু হতে পারে না।



হযরত খাদীজার ফজীলাত সম্পর্কে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছেঃ ধরাপৃষ্ঠের সর্বোত্তম নারী মরিয়ম বিনতু ইমরান ও খাদীজা বিনতু খুওয়াইলিদ। হযরত জিবরাঈল আ. বসে আছেন রাসূলুল্লাহর সা. কাছে। এমন সময় খাদীজা আসলেন। জিবরাইল আ. রাসূলুল্লাহকে সা. বললেন, ‘তাঁকে মণি-মুক্তার তৈরী একটি বেহেশতী মহলের সুসংবাদ দিন।’ (বুখারী)।


হযরত আছিয়া  ঃ-দুনিয়াতে জান্নাতের সুসংবাদ পাওয়া  চারজন রমণীর মধ্যে হযরত আছিয়া  অন্যতম ।তিনি ছিলেন ফেরাউনের স্ত্রী।  আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন—

وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا لِّلَّذِينَ آمَنُوا اِمْرَأَةَ فِرْعَوْنَ إِذْ قَالَتْ رَبِّ ابْنِ لِي عِندَكَ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ وَنَجِّنِي مِن فِرْعَوْنَ وَعَمَلِهِ وَنَجِّنِي مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ

মুমিনদের জন্যে ফেরাউন-পত্নীর দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। সে বললঃ হে আমার পালনকর্তা! আপনার সন্নিকটে জান্নাতে আমার জন্যে একটি গৃহ নির্মাণ করুন, আমাকে ফেরাউন ও তার দুস্কর্ম থেকে উদ্ধার করুন এবং আমাকে যালেম সম্প্রদায় থেকে মুক্তি দিন।–সুরা—আততাহরীম, আয়াত ১১।

মুসলিম নারীদের জন্য চির বরণীয় ও অনুসরণীয় এক ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন আছিয়া। সবুজ শ্যামলিমায় ঘেরা সুউচ্চ প্রাসাদের আলীশান মহলে তিনি বসবাস করতেন। সবুজ বৃক্ষের তলদেশে প্রাসাদের গা ঘেষে নীল দরিয়ার স্বচ্ছ পানি বয়ে চলত অবিরাম। এমন সব নেয়ামত ও আয়েশের মাঝেও আছিয়া ছলেন অতৃপ্ত, অস্থির। তাহলে কোন সে পিপাসায় তিনি কাতর ছিলেন? কিসের অভাবে ছটফট করতেন তিনি?

আল্লাহ পাকের কাছে আছিয়া কাতর দুয়া করেছিলেন—তিনি যেন তাঁর স্বামীর দুঙ্কর্ম থেকে তাঁকে হেফাজত করেন। তাঁর জুলুমবাজ কওমের হাত থেকে রেহাই দেন তাঁকে। তিনি আরো বলেছিলেন, তাঁর স্বামীর পৃষ্ঠপোষকতায় যে পাপের রাজ্য কায়েম হয়েছে, সেখান থেকে বের হতে তিনি উদগ্রীব হয়ে পড়েছেন। অথচ এক সময় তিনি স্বামীর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। হৃদয়জুড়ে ছিল তাঁর ভালবাসা। তাহলে তাঁর এ অভিযোগের প্রেক্ষাপট কী?

ফেরাউন তাঁর সুউচ্চ রাজপ্রাসাদ, সুদূর বিস্তৃত সাম্রাজ্যে অপ্রতিদ্বন্ধি বাদশাহ ছিল। সে ছিল ভীষণ কঠোর প্রকৃতির ও পাষাণ দিল। নির্বিচারে প্রজাসাধারণের উপর সে জুলুম করত। অত্যাচারে জর্জরিত করত তাদের। ফেরাউন স্বেচ্ছাচারিতার চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। অত্যন্ত অহংকার ও গর্ব করে বেড়াত সে। বনী ইসরাঈল ছিল তাঁর অবৈধ অত্যাচারের নিশানা। তারা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে অত্যন্ত কষ্টের ভেতর দিয়ে ফেরাউনি রাজ্যে জীবন যাপন করছিল । বিপদ মুসিবতে ধৈর্য ধরা ছাড়া তাদের কিছুই করার ছিল না।

একদিন রাজদুরবারের প্রধান জ্যোতিষী ফেরাউনের কাছে এসে বলল—বাদশাহ নামদার। অচিরেই বনী ইসরাঈলের মাঝে একজন সন্তান জম্ম নিবে। তাঁর হাতে আপনার সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য। জ্যোতিষীর এ সংবাদ বনী ইসরাঈলের উপর অত্যাচারের আগুনে ঘি ঢেলে দিল। ফেরাউনের পাষণ্ডতা উথলে উঠলো। জ্যোতিষীর এ অসহনীয় কথায় তাঁর উন্মত্ততা বেড়ে গেল কয়েকগুণ। নিজেকে একটু প্রবোধ দেয়ার জন্য, মনটাকে একটু সুস্থির করার জন্য বনী ইস্প্রাঈলের উপর জুলুমের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। সে তাদের নবজাতক পুত্র সন্তানদের ধীরে ধীরে নৃশংসভাবে হত্যা করতে লাগল। তবে শুধু কন্যা সন্তানদের জীবিত রাখত। অবশেষে আল্লাহ পাক বনী ইসরাঈলের ভাগ্য লিখনে পরিবর্তন আনলেন। তাদের পর্যাপ্ত শক্তি ও ক্ষমতা দান করলেন। ফলে ফেরাউন যে বিভীষিকার আশংকা করত, তা স্বচক্ষে দেখতে বাধ্য হয় সে।লোমহর্ষক এ ঘটনার শুরুটা খুবই অম্লমধুর । ফেরাউনের রাজপ্রাসাদের অনতিদূরে ছোট্ট এক ঝুপড়িতে ইউহানিব নাম্নী এক মহিলা বাস করতেন। তাঁর গর্ভধারণের সময় ঘনিয়ে এলে নিজগৃহের এক কোণায় তিনি আবদ্ধ হয়ে রইলেন। প্রসব বেদনা শুরু হলে তিনি মেয়েকে বললেন যাও, জলদি একজন ধাত্রী ডেকে নিয়ে আস। মেয়ে ধাত্রী ডেকে আনল। ইউহানিবের ঘরে একটি সুন্দর ফুটফুটে পুত্রসন্তান ভূমিষ্ট হল। তিনি ফেরাউনের নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার কথা করে ভয় ও আতংকে শিউরে উঠলেন। নিজেকেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এই নিষ্পাপ ফুলের মত শিশুকে কি মেরে ফেলা হবে? ছেলের প্রতি ভালবাসায় তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলেন। সিংস্র ফেরাউনের হিংস্রহাত থেকে বাঁচতে একাধারে তিন মাস গৃহভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকলেন তিনি। এজন্য ইউহানিব প্রতিটি মুহূর্তেই চিন্তা ও আতংকের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করতেন। নিজের প্রতি নয়, ছেলে মূসার প্রতি ভয় ও ভালবাসায় তিনি গভীর চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তবে আল্লাহ পাক তাঁর সহায় ছিলেন। তিনি তাঁকে নির্দেশ দিলেন, এ শিশুটির জন্য একটি কাঠের সিন্দুক তৈরি কর। তারপর তাঁকে সিন্দুকের ভেতর ভরে নীল দরিয়ায় ভাসিয়ে দাও। আর তোমার মেয়েকে সিন্দুকের অনুসরণ করে নীল নুদের পার দিয়ে চক্কর দিতে বল। এ ঐশী আদেশ পেয়ে মুসা জননীর চিত্ত প্রশান্ত হল। মন থেকে সব ডর—ভয় মুছে গিয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন তিনি। সুন্দর একটি সিন্দুক বানানো হল। ইউহানিব নয়নের মণি মুসাকে সেখানে রেখে দিয়ে মেয়েকে বললেন, সিন্দুকটি মাথায় করে নীল নদের ঘাটে নিয়ে যাও। চতুর মেয়ে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কাজ সম্পন্ন করল। ইউহানিব সন্তান সমেত সিন্দুকটি নীল নুদে ভাসিয়ে দিলেন। প্রবাহমান নদীর ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে সিন্দুকটা নাচতে নাচতে এগিয়ে চলল। সন্তানকে আল্লাহর হাতে সঁপে দিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে মা জননী ঘরে ফিরলেন। মেয়েকে পাঠিয়ে দিলেন সিন্দুকের পেছনে পেছনে। নদীর ফস্রোতে ভাসতে ভাওতে সিন্দুকটি ফেরাউনের মর্মর নির্মিত সুদৃশ্য সিঁড়ির গোড়ায় এসে থামল। ফেরাউনের স্ত্রী, কন্যা, সেবিকারা এখানে বসেই নদীর শীতল হাওয়ায় গা জুড়াত। প্রাসাদের এক খিড়কি দিয়ে আছিয়া এ সিন্দুকটি দেখতে পেলেন। বাচ্ছাসহ সিন্দুকটি উপরে তুলে আনা হল। ফেরাউনের সিপাহী ও প্রহরীরা আশাপাশেই ছিল। তাদের সবার হাতেই শিশু হননের যাবতীয় অস্ত্র ও হাতিয়ার উন্মুখ হয়ে রয়েছে। তাদের কাজই ছিল, বনী ইসরাঈলের ঘরে কোন নবজাতকের সন্ধান পেলে তাঁকে বধ করে নীল নদে সেই লাশটা ভাসিয়ে দিবে কিংবা দূরের কোন মরু উপত্যকায় ফেলে আসবে। শিশুটিকে প্রথম দর্শনেই ফেরাউনের মনে একটি ভালবাসা জেগে উঠল। কিন্তু তাঁর আশ পাশের লোকেরা শিশুটিকে হত্যা কুরে ফেলতে তাঁকে নানাভাবে উত্তেজিত করতে লাগল। কেউ একজন বলেও ফেলল, মহারাজ! সিন্দুকে বাচ্ছা রেখে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া আসলে আপনার বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র। জ্যোতিষীর কথা অনুযায়ী হতে পারে এই বাচ্ছাটিই আপনার রাজ্য পতনের কারণ হবে। তাদের এই কথোপকথনের মাঝে আছিয়া এক কদম সামনে এসে বললেন,

وَقَالَتِ امْرَأَتُ فِرْعَوْنَ قُرَّتُ عَيْنٍ لِّي وَلَكَ لَا تَقْتُلُوهُ عَسَى أَن يَنفَعَنَا أَوْ نَتَّخِذَهُ وَلَدًا وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ

এ শিশু আমার ও তোমার নয়নমণি, তাকে হত্যা করো না। এ আমাদের উপকারে আসতে পারে অথবা আমরা তাকে পুত্র করে নিতে পারি। প্রকৃতপক্ষে পরিণাম সম্পর্কে তাদের কোন খবর ছিল না।–সুরা কাসাস, আয়াত ৯।

আছিয়া স্বামীর কাছে এ শিশুটির ব্যাপারে তাঁর সাধারণ হুকুম বলবৎ না করার জন্য উপর্যুপরি অনুরোধ করতে লাগ্লেন। প্রত্যাশা নিয়ে তিনি বললেন, হতে পারে এ শিশু বড় হয়ে আমার একান্ত বাধ্যগত হবে আর আমরা তাঁকে আমাদের সন্তানরূপে গ্রহণ করবো। এক পর্যায়ে ফেরাউন তাঁর কোথা মেনে নিল। রাজপ্রাসাদে মূসা তখন ফেরাউনের পুত্রবৎ হয়ে গেল। মানস সন্তানের প্রতি অগাধ ভালবাসায় আছিয়ার দিল টইটম্বুর। আনন্দের দোলায় তিনি দুলতে লাগলেন।প্রাসাদের লোকেরা এ শিশুর জন্য একজন ধাত্রী খুঁজতে লাগল। হাজার হলেও এতো এখন রাজপুত্র। আর ফেরাউন তো শুধু বাদশাই নয়। প্রজাসাধারণের স্বকল্পিত প্রভুও সে। কাজেই চতুর্দিক থেকে ধাত্রীদের আগমন্ব প্রাসাদ ভরে উঠলো। ফেরাউন ও আছিয়া বাচ্ছার জন্য একজন যুৎসই ধাত্রীর জন্য প্রতীক্ষমান। কিন্তু রজোপ্রাসাদে আগত কোন মহিলার স্তনই মুখে নিচ্ছে না বাচ্চাটি। প্রধানমন্ত্রী হাসান তাঁর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি মেলে ধ্রল চারদিকে। ইত্যবসরে মূসার সহোদরা বোন সামনে এগিয়ে এসে বলল আমি একজন ধাত্রীর সন্ধান দিতে পারি তোমাদের, আশা করা যায় এ বাচ্চা তাঁর দুধ পান করবে। বাচ্চাটির অবিরাম কান্না আমার মনে খুবকরুণ হয়ে বিঁধছে, তাই আমি তোমাদের সাহায্যে এগিয়ে এলাম। অন্যথায় এতে আমার কোন গরজ নেই। আছিয়া বললেন—জলদি গিয়ে তাঁকে নিয়ে আস, দেখছো না সে কেমন জোরে জোরে চিৎকার করছে। ক্ষুধার তাড়নায় মুখটা একেবারে পাংশু হয়ে গেছে ছেলেটির। মেয়েটি বলল আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না রাণী মা! আমি এক্ষুণি তাঁকে নিয়ে হাজির হচ্ছি।

মূসার বোন মারিয়াম দৌড়ে মায়ের কাছে গেল। মাকে বলল—আম্মা!সসুসংবাদ শুনুন। তাঁকে নিয়ে অবাক কাণ্ড ঘটে গেছে। মূসা আগত কোন মহিলার দুধই পান করছে না। সকলেই হতাশ হয়ে ফিরে গেছে। আমি তাদেরকে আপনার কথা বলে এসেছি। চলুন, চলুন জলদি চলুন।

ইউহানিব বলতে লাগলেন, আমার প্রচন্ড ভয় হচ্ছে, যদি তারা কোনভাবে বুঝে ফেলেয়ামি তাঁর মা, তাহলে কী হবে? কিন্তু আমার তো আর তর সইছে না। সেই কখন থেকে যে অবিরাম দুধ ঝরে পড়ছে।মারয়াম বলল, আম্মা! তাড়াতাড়ি চলুন, আমাদের অনেক দেরি হয়্ব যাচ্ছে। তারা উভয়ে রাজপ্রাসাদে রওয়ানা হলেন। সেখানে পৌঁছে দেখলেন মূসার কান্নার আওয়া উচ্ছে উঠে গেছে। আছিয়া তাঁকে কোলে তুলে হেলিয়ে দুলিয়ে প্রবোধ দিচ্ছে আর আদর করছে। কিন্তু কান্না থামছে না কিছুতেই। ইউহানিব তাঁর কাছে গিয়ে বললেন—রাণী মা! একে আমার কাছে দিন। আছিয়া মারয়ামকে লক্ষ্য করে বললেন—এই ক্লি সেই ধাত্রী? মারয়াম বলল জি হ্যাঁ—রাণী মা ! আপনি নিশ্চিন্তে বাচ্ছাকে তাঁর হাতে দিন। মনে হচ্ছে অবশ্যই সে এর দুধ পান করবে এবং কান্নাও বন্ধ করবে। ইউহানিব বাচ্ছাকে কোলে নিতেই সে নীরব হয়ে গেল। তাঁর চোখে ফুটে উঠল একটি খুশীর ঝিলিক। নিতান্ত শান্ত ভঙ্গিতে সে তাঁর দুধ পান করতে লাগল। পাশে দাঁড়ানো আছিয়ার খুশি আর ধরে না। প্রশান্তির একটি নিঃশ্বাস ছাড়লেন তিনি। কিন্তু চতুর ফেরাউনের মনের ভেতর একটি সন্দেহ দানা বেঁধে উঠল।

ফেরাউন তাঁকে জিজ্ঞেস করল আচ্ছা, বলতো কে তুমি? এ বাচ্ছা আর সব মহিলা থেকে মুখ থেকে মুখ ফিরিয়ে তোমার দিধই বা কেন মুখে নিল? ইউহানিব বললেন আসলে আমার পেশাই হচ্ছে দুধ পান করানো। আমার দুধ বড়ই সুমিষ্ট ও সুপেয়। সব ধরণের শিশুরাই আগ্রহ ভরে আমার দুধ পান করে। আর যে একবার আমার দুধ খায় সে অন্যদের দুধ মুখেই নিতে চায় না। ফেরাউন প্রধানমন্ত্রী হামানের দিকে ইশারা করে বলল এ মহিলার ভাতা দ্বিগুণ করে দাও আর তাঁর থাকার সুবন্দোবস্ত করে দাও। মূসা জননী এসব কথা শুনে এবং পুরিস্থিতির অনুকূলতা অনুভব করে অত্যন্ত খুশী হলেন। আল্লাহ পাকের ওয়াদা যে এত দ্রুত বাস্তবায়িত হবে, তা তিনি ভাবতেই পারেননি।

আছিয়া তাঁকে বললেন—তুমি আমাদের এই প্রাসাদেই অবস্থান করো। আমি তোমার থাকার জন্য মনোরম একটি কামরা এবং উপযোগী খাবার—দাবারের ব্যবস্থা করে দিব। ইউহানিব বললেন—রাণী মা! আপনাকে অনেক অনেক শুকরিয়া। আমি চাচ্ছি এ বাচ্ছাকে আমার ঘরেই দুধ পান করাবো। সেখানকার পুঅরিবেশ খুব মনোরম। আর আমিও অবলীলায় সেখানে চলা—ফেরা করতে পারবো। এ বাচ্চারও বোধহয় কোন কষ্ট হবে না। আছিয়া বললেন—তোমার যা ইচ্ছে তা করো। মূসা জননী সন্তান নিয়ে ঘরে ফিরলেন। আল্লাহর শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতায় মুখর হয়ে উঠলেন তিনি। তিনিই তো তাঁর দিলে প্রশান্তি দিয়েছেন। মনের অস্থিরতা দূর করেছেন । আর আদরে দুলালকে তাঁর কোলেই ফিরিয়ে দিয়েছেন। খুব বেশি আওময় তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়নি। আদরে যত্নে মা ছেলেকে লালন পালন করতে লাগলেন। আছিয়ার যখনই বাচ্ছাটিকে দেখতে মন চাইত তিনি কাউকে পাঠিয়ে তাঁকে রাজপ্রাসাফে নিয়ে আসতেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে তৃপ্তি ভরে দেখতেন। একটু একটু করে মূসা হাঁটুতে ভর দিয়ে চলতে শিখলেন। কখনো কখনো দু—পায়ে ভর করে থাকতেন কিছুক্ষণ। ভাঙ্গা ভাঙ্গা করে অল্প—সল্প কথাও বলতেন মাঝে মধ্যে। যখনই আছিয়া মুসার সাথে একটু আমোদ—আহ্লাদ করতেন সে অত্যধিক আনন্দিত হয়ে উঠত। তবে আর কোন মহিলার সামনে সে এতটা আনন্দিত, এতটা অকৃত্রিম হত না।কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের সিঁড়িতে পদার্পণ করলেন মূসা। আছিয়ার হৃদয় কন্দরে স্নেহের বৃক্ষটি এখন পত্র পল্লবে সুশোভিত। মানস পুত্র মুসাকে না দেখে থাকতে পারেনা তিনি। দুগ্ধপানের মেয়াদ শেষ হতেই মূসাকে রাজপ্রাসাদে দিয়ে গিয়েছিলেন ইউহানিব। জ্যোতিষীর কথা শুনে ফেরাউনের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া নিষ্ঠুরতা তাঁর চোখের সামনে ছিল অহেতুক ঝামেলা এড়িয়ে চলাই সমীচীন মনে করেছেন তিনি। কিন্তু ফেরাউন জানত না, তাঁর গৃহেই আগ্নেয়গিরির এক ভয়ঙ্গকর লাভা বিস্ফোরিত হওয়ার জন্য ধীরে ধীরে স্ফীত হচ্ছে।

খোদাকে পরিত্যাগ করে হামানসহ যারা ফেরাউনের সামনে সেজদায় লুটিয়ে পড়ত, আছিয়া সাদের প্রতি ভীষণ রুষ্ট ছিলেন। ভীতি ও ভক্তি নিয়ে তারা অসম্ভব সব উপাধিতে ভূষিত করত ফেরাউনকে। এগুলো দেখে আছিয়া সিমাহীন অস্থির হয়ে উঠতেন। তাঁর স্বামী যখন অহংকারে মদমত্ত হয়ে বলত আমিই তোমাদের ভমহান প্রভু; তিনি মনে মনে বলতেন, হায়রে কপাল! কোন শয়তানের পাল্লায় যে পড়েছি। এ অন্ধ অহমিকায় আর কতকাল সে ডুবে থাকবে। কিসের নেশায় সে এ মহা মুসিবতকে বরণ করে নিচ্ছে? ফেরাউনের স্বকল্পিত প্রভুত্বকে প্রচন্ড ভাবে ঘৃণা করতেন তিনি।

তাঁর ভক্তদের ভাঁড়ামিপূর্ণ কার্যকলাপ দেখে দূর থেকে শুধু আফসোস করে বলতেন—সবগুলো একেকটা উম্মাদ।

হৃদয়ের মনিকোঠায় মূসাকে ধারণ করতেন আছিয়া। প্রগাঢ় ভালবাসায় ভরিয়ে রাখতেন তাঁকে। হঠাৎ একদিন একটি লোক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে তাঁকে সংবাদ দিল মূসা জনৈক কিবতীকে হত্যা করে ফেলেছে। স্বগোষ্ঠীয়       এক লোকের পক্ষাবলম্বন করেই এ কাজটা সে করেছে। আছিয়ার কন্যাদের সেবা করত যারা, তাদের একজনের স্বামী হিজকীল এসে তাঁকে জানালেন, শহরে দুজন লোক ঝগড়া করছিল। একজন মূসার স্বগোত্রীয় অপরজন কিবতী। কিবতী লোকটির বিরুদ্ধে অপরজন মূসার সহযোগিতা চাইলে মূসা তাঁকে প্রচন্ড ঘুষি মারে। আর এতেই লোকটির ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যায়। আছিয়া মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথাগুলো শুনছিলেন, হঠাৎ দূর থেকে ফেরাউনের ক্রোধান্বিত চিৎকারে তিনি সচকিত হয়ে উঠলেন। তাঁর বিকট আওয়াজে প্রাসাদ যেন কাঁপতে লাগল। কোথায় মূসা? এখনো কেন তাঁকে বন্দী করা হচ্ছে না। সিপাহী! ঐ কুলাঙ্গারকে এক্ষুণি আমার সামনে হাজির কর। আমি নিহত কিবতীর প্রতিশোধ নিতে চাই। এক্ষুণি। পরিস্থিতির ভয়াবহতায় আছিয়া খুব শংকিত হয়ে উঠলেন। মূসার প্রতি উৎকন্ঠায় তাঁর প্রাণ ব্যাকুল হয়ে উঠল। অনন্ত অসীম পরমসত্তার কাছে মিনতির দু’হাত তুলে ধরলেন তিনি। ভক্তি গদগদ কণ্ঠে মহান মা;বুদের কাছে তিনি মুসার কল্যাণের জন্য প্রার্থনা শুরু করে দিলেন। ইলাহী! মূঊসাকে ফেরাউন আর তাঁর সাঙ্গপাঙ্গাদের অনিষ্ট থেকে তুমি হেফাজত করো। তাদের বর্বরতা থেকে তুমি নিরাপদ রাখো।

হিজকীল সেখান থেকে চলে গেলেন। নিজের স্বভাবশুদ্ধতার বদৌলতে তিনিও এক আল্লাহয় বিশ্বাস করতেন এবং দাম্ভিক ফেরাউনের প্রভুত্বকে প্রত্যাখ্যান করতেন। দ্রুত মূসার কাছে গিয়ে তাঁকে সর্তক করে দিয়ে তিনি বললেন—

وَجَاء رَجُلٌ مِّنْ أَقْصَى الْمَدِينَةِ يَسْعَى قَالَ يَا مُوسَى إِنَّ الْمَلَأَ يَأْتَمِرُونَ بِكَ لِيَقْتُلُوكَ فَاخْرُجْ إِنِّي لَكَ مِنَ النَّاصِحِينَ

হে মূসা, রাজ্যের পরিষদবর্গ তোমাকে হত্যা করার পরমর্শ করছে। অতএব, তুমি বের হয়ে যাও। আমি তোমার হিতাকাঙ্ক্ষী।–সুরা কাসাস, আয়াত ২০।

মূসা হিজকীলের কথা আমলে নিয়ে তখনই ফেরাউনবাহিনী থেকে আত্মরক্ষার জন্য একদিকে পালিয়ে গেলেন। হিজকীল প্রাসাদে ফিরে এসে দেখলেন আছিয়া মূসার জীবনাশংকায় কম্পমান। তিনি কিছুটা নিচু আওয়াজে বললেন—রাণী মা! আর ভয়ের কোন কারণ নেই। আমি মূসা পর্যন্ত সব কোথা পৌঁছে দিয়েছি এবং আসন্ন বিপদ সম্পর্কেও সর্তক করেছি ত্তাকে। শহর ছেড়ে দূরে কোথাও—যেখানে ফেরাউনের সিপাহীরা তাঁর নাগাল পাবে না। চলে যাওয়ার জন্য সুপারিশ করেছি আমি। আছিয়া বললেন—মহান প্রভুর শুকরিয়া। তিনি মূসাকে ফেরাউনের হিংস্রতা ও নিষ্ঠুরতা থেকে হেফাজত করুন। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতি আমাকে কুড়ে কুড়ে খাবে। সে তো আমার সন্তান সমতুল্য। আমার কোলে পিঠেই সে বড় হয়ে উঠেছে। তাঁকে ছাড়া আমি থাকব কেমন করে? আচ্ছা একটু খোঁজ নিয়ে দেখ না সে কোথায় গেছে। হিজকীল বললেন, রাণী মা! আসুন! মহিমান্বিত স্রষ্টার কাছে আমরা তাঁর কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করি।

একে একে কয়েক বছর কেটে গেল। মূসা আর মিসরে ফিরে এলেন না। মূসাকে এক নজর দেখার অধীর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আছিয়া প্রায় নিরাশ হয়ে গেলেন। কারো কাছে মূসার কোনো সংবাদ নেই। সবাই যেন মূসাকে ভুলে গেল। সময় গড়িয়ে চলল। ফেরাউন ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের মুনে বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গেল যে, মূসা কস্মিনকালেও আর ফিরে আসবে না। তবে কয়েক বছর মূসা ঠিকই ফিরে এলেন। এবার তিনি আল্লাহ পাকের একজন নবী ও পয়গম্বর হয়ে এলেন। মূসা (আঃ) হকের দাওয়াত আর খোদায়ী শিক্ষার মহা সওগাত নিয়ে এলেন। আল্লাহ পাক তাঁকে ফেরাউনের কাছে এ দাওয়াত নিতে যেতে বলেছেন। যার অসহনীয় অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মানবেতর জীবন—যাপন করছে বনী ইসরাঈলের লোকগুলো। জীবনে ন্যূনতম অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে পরাধীনতার শৃংখলে তারা আষ্টে পৃষ্ঠে বাঁধা। তাদের মুক্তির পয়গাম নিয়েই মূসা (আঃ) এসেছেন। নীল দরিয়ার জোয়ার ভাটা আসে কিন্তু উদ্ধত ফেরাউনের নির্মম নিষ্ঠুরতায় কোন ভাটা নেই। মানুষকে মাবুদ বানানো দুরাচার কিবতীদের লাগামহীন উস্কানীতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে ফেরাউন। এ পাগলা ঘোড়াকে নিবৃত্ত করার জন্যই ইনসাফেরচাবুক নিয়ে মূসা (আঃ) এলেন। কিন্তু অনাকাঙ্গিত সেই কিবতী হত্যা স্মৃতিটি তাঁর মনে একতি ভয় ধরিয়ে দিল। প্রভুর শরণাপন্ন হয়ে তিনি বললেন

“পরওয়ারদেগার! আমি তাদের এক ব্যক্তিকে (অনিচ্ছায়) হত্যা করেছিলাম। আমি আশংকা করছি, তারাও আমাকে হত্যা করে ফেলবে। আল্লাহ পাক তাঁকে আশ্বস্ত করলেন, এবার তিনি আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে বললেন,

সহযোগীদের সত্য বিনাশী ষড়যন্ত্র আমি বরদাশত করতে পারি।

আমার যাবতীয় কাজ আসান করে দিন। সব বাঁধা বিপত্তিকে নস্যাৎ করে দিয়ে দাওয়াতের পথকে সুগম করে দিন।


হযরত মারিয়াম আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঃ-মারিয়াম বিনতে ইমরান, যিনি ঈসা (আঃ)-এর কুমারী মাতা ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যাকে জান্নাতের শ্রেষ্ঠ চারজন মহিলার অন্যতম হিসাবে বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি বলেন,
أفضلُ نساءِ أهلِ الجنتِ خديجتُ بنتِ خُوَيْلدِ وفاطمةُ بنتِ محمدٍ ومريمُــــــــــــ
‘জান্নাতবাসী মহিলাগণের মধ্যে সেরা হ’লেন চারজন: খাদীজা বিনতে খুওয়ালিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ, মারিয়াম বিনতে ইমরান এবং আসিয়া বিনতে মুযাহিম, যিনি ফেরাঊনের স্ত্রী’।[2]
মারিয়ামের জন্ম ও লালন-পালন :
মারিয়ামের জন্ম ও লালন-পালন সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
إِذْ قَالَتِ امْرَأَةُ عِمْرَانَ رَبِّ إِنِّي نَذَرْتُ لَكَ مَا فِيْ بَطْنِيْ مُحَرَّراً فَتَقَبَّلْ مِنِّي إِنَّكَ أَنتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ- فَلَمَّا وَضَعَتْهَا قَالَتْ رَبِّ إِنِّي وَضَعْتُهَا أُنثَى وَاللهُ أَعْلَمُ بِمَا وَضَعَتْ وَلَيْسَ الذَّكَرُ كَالأُنثَى وَإِنِّي سَمَّيْتُهَا مَرْيَمَ وِإِنِّي أُعِيْذُهَا بِكَ وَذُرِّيَّتَهَا مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ- فَتَقَبَّلَهَا رَبُّهَا بِقَبُولٍ حَسَنٍ وَأَنبَتَهَا نَبَاتاً حَسَناً وَكَفَّلَهَا زَكَرِيَّا، كُلَّمَا دَخَلَ عَلَيْهَا زَكَرِيَّا الْمِحْرَابَ وَجَدَ عِندَهَا رِزْقاً قَالَ يَا مَرْيَمُ أَنَّى لَكِ هَـذَا قَالَتْ هُوَ مِنْ عِندِ اللهِ إنَّ اللهَ يَرْزُقُ مَنْ يََّشَآءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ- (آل عمران ৩৫-৩৭)-
‘যখন ইমরানের স্ত্রী বলল, হে আমার প্রভু! আমার গর্ভে যা রয়েছে তাকে আমি তোমার নামে উৎসর্গ করলাম সবার কাছ থেকে মুক্ত হিসাবে। অতএব আমার পক্ষ থেকে তুমি তাকে কবুল করে নাও। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আলে ইমরান ৩৫)। ‘অতঃপর সে যখন তাকে প্রসব করল, তখন বলল, হে প্রভু! আমি তো কন্যা সন্তান প্রসব করেছি! অথচ আল্লাহ ভাল করেই জানেন, সে কি প্রসব করেছে। (আল্লাহ সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,) এই কন্যার মত কোন পুত্রই যে নেই। আর আমি তার নাম রাখলাম ‘মারিয়াম’। (মারিয়ামের  মা  দো‘আ  করে  বলল,  হে  আল্লাহ!)  আমি তাকে ও তার সন্তানদেরকে তোমার আশ্রয়ে সমর্পণ করছি, অভিশপ্ত শয়তানের কবল হ’তে’ (৩৬)। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তার প্রভু তাকে উত্তমভাবে গ্রহণ করে নিলেনএবং তাকে প্রবৃদ্ধি দান করলেন সুন্দর প্রবৃদ্ধি। আর তিনি তাকে যাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে সমর্পণ করলেন। (অতঃপর ঘটনা হ’ল এই যে,) যখনই যাকারিয়া মেহরাবের মধ্যে তার কাছে আসতেন, তখনই কিছু খাদ্য দেখতে পেতেন। তিনি জিজ্ঞেস করতেন, মারিয়াম! এসব কোথা থেকে তোমার কাছে এল? মারিয়াম বলত, ‘এসব আল্লাহর নিকট থেকে আসে। নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিযিক দান করে থাকেন’ (আলে ইমরান ৩/৩৫-৩৭)।
উল্লেখ্য যে, আল্লাহর নামে উৎসর্গীত সন্তান পালন করাকে তখনকার সময়ে খুবই পুণ্যের কাজ মনে করা হ’ত। আর সেকারণে মারিয়ামকে প্রতিপালনের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। ফলে লটারীর ব্যবস্থা করা হয় এবং আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর বয়োবৃদ্ধ নবী হযরত যাকারিয়া (আঃ) মারিয়ামের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন (আলে ইমরান ৩/৪৪)।
ঈসার জন্ম ও লালন-পালন :
এভাবে মেহরাবে অবস্থান করে মারিয়াম বায়তুল মুক্বাদ্দাসের খিদমত করতে থাকেন। সম্মানিত নবী ও মারিয়ামের বয়োবৃদ্ধ খালু যাকারিয়া (আঃ) সর্বদা তাকে দেখাশুনা করতেন। মেহরাবের উত্তর-পূর্বদিকে সম্ভবতঃ খেজুর বাগান ও ঝর্ণাধারা ছিল। যেখানে মারিয়াম পর্দা টাঙিয়ে মাঝে-মধ্যে পায়চারি করতেন। অভ্যাসমত তিনি উক্ত নির্জন স্থানে একদিন পায়চারি করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ মানুষের বেশে সেখানে জিবরাঈল উপস্থিত হন। স্বাভাবিকভাবেই তাতে মারিয়াম ভীত হয়ে পড়েন। এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ:
وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ مَرْيَمَ إِذِ انتَبَذَتْ مِنْ أَهْلِهَا مَكَاناً شَرْقِيًّا- فَاتَّخَذَتْ مِن دُونِهِمْ حِجَاباً فَأَرْسَلْنَا إِلَيْهَا رُوحَنَا فَتَمَثَّلَ لَهَا بَشَرًا سَوِيًّا- قَالَتْ إِنِّي أَعُوذُ بِالرَّحْمَن مِنكَ إِن كُنتَ تَقِيًّا- قَالَ إِنَّمَا أَنَا رَسُولُ رَبِّكِ لِأَهَبَ لَكِ غُلاَمًا زَكِيًّا- قَالَتْ أَنَّى يَكُونُ لِي غُلاَمٌ وَلَمْ يَمْسَسْنِي بَشَرٌ وَلَمْ أَكُ بَغِيًّا- قَالَ كَذَلِكِ قَالَ رَبُّكِ هُوَ عَلَيَّ هَيِّنٌ وَلِنَجْعَلَهُ آيَةً لِلنَّاسِ وَرَحْمَةً مِّنَّا وَكَانَ أَمْرًا مَّقْضِيًّا- (مريم ১৬-২১)-
(হে মুহাম্মাদ!) ‘আপনি এই কিতাবে মারিয়ামের কথা বর্ণনা করুন। যখন সে তার পরিবারের লোকজন হ’তে পৃথক হয়ে পূর্বদিকে একস্থানে আশ্রয় নিল’ (মারিয়াম ১৬)। ‘অতঃপর সে তাদের থেকে আড়াল করার জন্য পর্দা টাঙিয়ে নিল। অতঃপর আমরা তার নিকটে আমাদের ‘রূহ’ (অর্থাৎ জিব্রীলকে) প্রেরণ করলাম। সে তার কাছে গিয়ে পূর্ণাঙ্গ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল’ (১৭)। ‘মারিয়াম বলল, আমি তোমার থেকে করুণাময় আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যদি তুমি আল্লাহভীরু হও’ (১৮)। ‘সে বলল, আমি তো কেবল তোমার প্রভুর প্রেরিত। এজন্য যে, আমি তোমাকে একটি পবিত্র পুত্র সন্তান দান করে যাব’ (১৯)। ‘মারিয়াম বলল, কিভাবে আমার পুত্র সন্তান হবে? অথচ কোন মানুষ আমাকে স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণী নই’ (২০)। ‘সে বলল, এভাবেই হবে। তোমার পালনকর্তা বলেছেন, এটা আমার জন্য সহজ ব্যাপার এবং আমরা তাকে (ঈসাকে) মানবজাতির জন্য একটা নিদর্শন ও আমাদের পক্ষ হ’তে বিশেষ অনুগ্রহরূপে পয়দা করতে চাই। তাছাড়া এটা (পূর্ব থেকেই) নির্ধারিত বিষয়’ (মারিয়াম ১৯/১৬-২১)। অতঃপর জিব্রীল মারিয়ামের মুখে অথবা তাঁর পরিহিত জামায় ফুঁক মারলেন এবং তাতেই তাঁর গর্ভ সঞ্চার হ’ল (আম্বিয়া ২১/৯১; তাহরীম ৬৬/১২)। অন্য আয়াতে একে ‘আল্লাহর কলেমা’ (بِكَلِمَةٍ مِنْهُ) অর্থাৎ ‘কুন্’ (হও) বলা হয়েছে (আলে ইমরান ৩/৪৫)।অতঃপর আল্লাহ বলেন,
فَحَمَلَتْهُ فَانتَبَذَتْ بِهِ مَكَانًا قَصِيًّا- فَأَجَاءهَا الْمَخَاضُ إِلَى جِذْعِ النَّخْلَةِ قَالَتْ يَا لَيْتَنِي مِتُّ قَبْلَ هَذَا وَكُنتُ نَسْيًا مَّنْسِيًّا- فَنَادَاهَا مِنْ تَحْتِهَا أَلاَّ تَحْزَنِي قَدْ جَعَلَ رَبُّكِ تَحْتَكِ سَرِيًّا- وَهُزِّيْ إِلَيْكِ بِجِذْعِ النَّخْلَةِ تُسَاقِطْ عَلَيْكِ رُطَبًا جَنِيًّا- فَكُلِيْ وَاشْرَبِيْ وَقَرِّيْ عَيْنًا فَإِمَّا تَرَيِنَّ مِنَ الْبَشَرِ أَحَدًا فَقُولِيْ إِنِّيْ نَذَرْتُ لِلرَّحْمَنِ صَوْماً فَلَنْ أُكَلِّمَ الْيَوْمَ إِنسِيًّا- (مريم ২২-২৬)-
‘অতঃপর মারিয়াম গর্ভে সন্তান ধারণ করল এবং তৎসহ একটু দূরবর্তী স্থানে চলে গেল’ (মারিয়াম ২২)। ‘এমতাবস্থায় প্রসব বেদনা তাকে একটি খর্জুর বৃক্ষের মূলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। তখন সে বলল, হায়! আমি যদি এর আগেই মারা যেতাম এবং আমি যদি মানুষের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতাম’ (২৩)। ‘এমন সময় ফেরেশতা তাকে নিম্নদেশ থেকে (অর্থাৎ পার্শ্ববর্তী নিম্নভূমি থেকে) আওয়ায দিয়ে বলল, তুমি দুঃখ করো না। তোমার পালনকর্তা তোমার পাদদেশে একটি ঝর্ণাধারা সৃষ্টি করেছেন’ (২৪)। ‘আর তুমি খর্জুর বৃক্ষের কান্ড ধরে নিজের দিকে নাড়া দাও, তা থেকে তোমার দিকে সুপক্ক খেজুর পতিত হবে’ (২৫)। ‘তুমি আহার কর, পান কর এং স্বীয় চক্ষু শীতল কর। আর যদি কোন মানুষকে তুমি দেখ, তবে তাকে বলে দিয়ো যে, আমি দয়াময় আল্লাহর জন্য ছিয়াম পালনের মানত করেছি। সুতরাং আমি আজ কারু সাথে কোন মতেই কথা বলব না’ (মারিয়াম ১৯/২২-২৬)।
উল্লেখ্য যে, ইসলাম-পূর্ব কালের বিভিন্ন শরী‘আতে সম্ভবতঃ ছিয়াম পালনের সাথে অন্যতম নিয়ম ছিল সারাদিন মৌনতা অবলম্বন করা। হযরত যাকারিয়া (আঃ)-কেও সন্তান প্রদানের নিদর্শন হিসাবে তিন দিন ছিয়ামের সাথে মৌনতা অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে ঐ অবস্থায় ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলার অবকাশ ছিল (মারিয়াম ১৯/১০-১১)। একইভাবে মারিয়ামকেও নির্দেশ দেওয়া হ’ল (মারিয়াম ১৯/২৬)।

Monday, 29 April 2019

শেখ সাদীর গল্প রাজি

মহানুভবতাঃ-এক বাদশার কথা শুনেছি। তিনি একজন অপরাধী কয়েদীকে হত্যা করার হুকুম দিয়েছিলেন। বেচারা নিরুপায় হয়ে বাদশাহকে গালি দিতে শুরু করল এবং অশ্লীল ভাষায় যাচ্ছেতাই বকতে লাগল। লোকে বলে থাকেঃ মানুষের মনে যখন বেঁচে থাকার আশা থাকে না তখন তার মনে যা কিছু থাকে তা বলতে দ্বিধাবোধ করে না।
বাদশাহ তাঁর এক মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেনঃ লোকটা এমন জোরে জোরে কি বলছে?
মন্ত্রীমহোদয় খুব দয়ালূ ও মহানুভব ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বললেনঃ লোকটা বলছেঃ যারা রাগ দমন করে এবং লোকদেরকে ক্ষমা করে, সেইসব লোকদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন।
একথা শুনে বাদশার হৃদয়ে দয়ার উদ্রেগ হলো এবং তার প্রাণদন্ড মওকুফ করে দিলেন। আর একজন মন্ত্রী যিনি প্রথমোক্ত মন্ত্রীর বিরোধী ছিলেন, প্রতিবাদ করে বললেনঃ আমাদের মত উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের পক্ষে পবিত্র রাজদরবারে সত্য বৈ মিথ্যা বলা সমীচীন নয়। অপরাধী বাদশা নামদারকে গালি দিচ্ছে এবং এমন সব অকথ্য কথা বলছে, যা কাউকে বলা যায় না।
মহান বাদশা সে কথায় কান দিলেন না; বরং বিরক্ত হয়ে বললেনঃ যে সত্য কথা তুমি বলেছ, তার চেয়ে ওর মিথ্যা কথা আমার কাছে বেশি ভালো লেগেছে, কেননা, ওর উদ্দেশ্য মহৎ। অর্থাৎ, একটা মূল্যবান জীবন রক্ষা করে তাকে সংশোধনের সুযোগ দেয়া।
জ্ঞানী লোকেরা বলে গেছেনঃ অশান্তি উতপাদনকারী সত্য কথার চেয়ে শান্তিকামী মিথ্যা কথা ঢের ভালো।
“ রাজারা করেন সবে
উপদেষ্টা করিতে যা’ বলেন;
মন্ত্রীদের উচিত নয়
ভালো ছাড়া মন্দ কিছু বলে। ”
শিক্ষাঃ প্রাণ রক্ষার ক্ষেত্রে মিথ্যা জায়েয। উভয়পক্ষের বিবাদ মিটানোর জন্য শরিয়ত মিথ্যা বলাকে বৈধ করেছেন। অশান্তি সৃষ্টিকারী সত্য কথার চেয়ে শান্তিকামী মিথ্যা কথা বলা ঢের ভালো।
বন্ধুর প্রেমে বন্ধু ঃ-একদা রাতের বেলায় আমার এক প্রিয় বন্ধু হঠাত এসে আমার সামনে হাজির। সে ছিল আমার পরম প্রিয়পাত্র। কালের কুটিল বিবর্তনে বহুদিন ধরে তার বিরহ বিচ্ছেদে আমি বিশেষভাবে বেদনাবোধ করছিলাম এবং অধীর আগ্রহে তার আগমন প্রতিক্ষায় প্রহর গুণছিলাম। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে প্রিয় পাত্রকে পাশে পেয়ে আনন্দে আত্নহারা হয়ে গেলাম এবং এত দ্রুত আসন ছেড়ে উঠে বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম যে, আমার আমার জামার আস্তিনের ঝাপটা লেগে আলোটা নিভে গেল।

বন্ধু! আমার পাশে বসেই আমাকে তিরষ্কার করতে শুরু করল।

বললঃ বন্ধু! আমাকে দেখেই আলো নিভিয়ে দিলে কারণ কি?

বললামঃ ভাই, দুটো কারণে আলো নিভিয়েছিঃ

প্রথম কারন এই যে, তুমি ভিতরে আসার সাথে সাথে আমার মনে হল সূর্য যেন উদয় হয়েছে। তোমার আলোকে ঘর ঝলমল করছে। কাজেই আলো রাখার প্রয়োজন নেই।

আর দ্বিতীয় কারনঃ আমার দুটো লাইন কবিতা মনে পড়ে গেলঃ

“যদি দেখ হাসি মাখা মুখে

প্রিয়জন ঘরে এলো।

তারে হাত ঘরে বসাও আদরে

আলোটা নিভিয়ে ফেলো।”

 শিক্ষাঃ মানুষ পুরনো বন্ধুকে পেয়ে আত্নহারা হয়ে যায়। পুরনো বন্ধুকে পেলে হারানো অনেক কথা হৃদয়পটে জেগে উঠে। মনে হয় যেন অমাবশ্যার রাতে আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে।
লাইলি ও মজনুর প্রেম কাহিনী ঃ-একদা আরব দেশে এক রাজদরাবারে লাইলী-মজনুর দুঃখময় ব্যর্থ প্রেমের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল ধনকুবের পুত্র কায়েস তার প্রচুর ধন-সম্পদ, বিদ্যা-বুদ্ধি ও সামাজিক মর্যাদা থাকা সত্ত্বেও একমাত্র লাইলীর প্রেমে পাগল হয়ে বলে-জংগএল বাস করেছে। একটা সামান্য নারীর অভাবে উন্মাত্ত হয়ে সে নিজের আত্ন-মর্যাদা, বুদ্ধি-বিবেচনা সবকিছু বিসর্জন দিয়ে বসেছে। সব কিছু শুনে বাদশা মজনুকে হাজির করলেন এবং খুব রকম তিরষ্কার করে বললেনঃ ওরে উন্মাদ! সৃষ্টির সেরা মানব সামাজে কি এমন ক্রটি পেলে যে, মানুষের সংশ্রব বর্জন করে তুমি জংগলের জীব-জানোয়ারের সঙ্গে জীবন-যাপন করা শুরু করেছ?
মজনু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে কেঁদে দিয়ে বললঃ
বন্ধুরা মোরে ভর্তসনা করে
কেন এত ভালোবাসি তারে
একবার তারে দেখিলে নজরে
দোষ কেহ দিত না আমারে
দেখিলে তোমার মুখ মুগ্ধ হত তার চোখ
যেই মোরে দেয় অপবাদ।
লেবুর বদলে হাত কাটিত সে নির্ঘাত দেখিত না মোর অপরাধ।
ক্রীতদাস ইউসুফের প্রেমে মাতোয়ারা হওয়ার দরুন মিশরের সম্ভ্রান্ত মহিলারা বিবি জুলেখার নিন্দা করত। হযরত ইউসুফকে তাদের সামনে হাজির করা হলে তার অতুলনীয় রূপ-সৌন্দর্য দর্শনে বিষ্ময়ে চেতনা হারা হয়ে লেবু কাটতে গিয়ে তারা নিজ নিজ হাতের আঙ্গুল কেটে ফেলে ছিল। তোমরাও যদি লাইলীর অপূর্ব সৌন্দর্য একবার দেখতে তা হলে প্রবাহিত রহস্য অনুধাবন করে আমার সপক্ষে সাক্ষ্য দিতে এবং আমাকে অযথা তিরষ্কার করতে না।
মজনুর মন্তব্য শুনে বাদশার মনে কৌতূহল হল। তাহলে লাইলীকে একবার দেখা দরকার। কত আকর্ষনীয় তার রূপলাবণ্য। যার মোহে একটি অমূল্য জীবন বিনষ্ট হতে যাচ্ছে। লাইলীকে রাজ সকাশে হাজির করার জন্য তখনই লোক পাঠান হলো। বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে অনুসন্ধানের পর পাওয়া গেল এবং রাজদরবারে এনে বসান হলো। খুব মনোযোগের সাথে বাদশা লাইলীর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন। কোন অসাধারণত্ব তার নজরে পড়লো না। বরং তার শাহী সৃষ্টিতে লাইলীর রূপ খুবই তুচ্ছ ও মামুলী মনে হল। কারণ তার চেয়ে অধিকতর রূপ-লাবণ্যবতী বহু মেয়ে তার দাসী বান্দীদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল।
মজনু তার প্রজ্ঞার আলোকে বাদশার মনোভাব বুজতে পেরে বললঃ
লাইলীর অতুলনীয় সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে হলে মজনুর মুগ্ধ নয়নের প্রয়োজন।
“ দয়া নাহি হয় কারো মোর বেদনায়,
ব্যথার দরদী মোর নাই কেহ হায়।
মোর মত ব্যথাহত পাইতাম যদি
কাষ্টসম জ্বলিতাম দেহে নিরবধি।”
শিক্ষাঃ যার মনে যার লাগে তারে কি আর ভোলা যায়। প্রেম এমন জিনিস যার দ্বারা উঁচু-নিচু, রাজা-প্রজা, দাস-দাসী, জাত-বর্ণে প্রভেদ করে না। চোখে যাকে ভালো লাগে সে যে জাতের হোক না কেন তাকে ছাড়া দুনিয়ার অন্য কেউ উত্তম নয়, প্রেমিকের চোখে প্রেমিকাকে যেভাবে দেখে অন্য মানুষ তাদেরকে সেভাবে দেখে না। কোন প্রেমিকা যদি কালো বা কুতসিতও হয়, প্রেমিকের চোখে সে সুন্দর।
কেমন ছাত্র তেমন শিক্ষকঃ- পাশ্চাত্য পরিভ্রমণকালে এক মক্তবে একজন শিক্ষক দেখেছিলাম। ওই ধরনের শিক্ষক আমি আর দেখিনি। লোকটা ছিল বেজায় বদমেজাজী, কর্কশভাষী, নির্দয়, অসামাজিক, কঠোর প্রকৃতির একটা ভয়াবহ মূর্তি। তার মুখের দিকে তাকালে মন বিরক্তিতে ভরে ওঠে, আলাপ করার আগ্রহ থাকে না। আর তার কুরআন শরীফ পড়ানো শুনলে মুসলমানের মনেও ভক্তির পরিবর্তে বিতৃষ্ণা জন্মে। একপাল কোমলমতি নিষ্পাপ ছাত্র-ছাত্রী তার নির্মম নির্যাতনের ভয়ে সদা সন্ত্রস্ত্র। কারো দিকে চেয়ে কেউ একটু মুচকি হাসবে বা একটা শব্দ করবে, তার জো নেই। তার মুখে তর্জন-গর্জন লেগেই আছে, আর তার বলিষ্ঠ নির্দয় হাত দুটো কারো কোমল মুখে চড়, কারো পিঠে বেত্রাঘাত অথবা কারো কান ধরে সজোরে মুচড়ে দেয়া প্রভৃতি শাসন কার্যে ব্যস্ত। সারা মক্তব গৃহটা যেন একটা বিভীষিকার কারাগার। এমন দৃশ্য আমার কঠিনমনে বড় বেদনাদায়ক মালুম হলো।

কিছু দিন পর শুনলাম, কি একটা অন্যায় অপরাধে, সেই শিক্ষককে উত্তম মাধ্যম দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তার স্থলে আর একজন ভাল শিক্ষক নিযুক্ত করা হয়েছে। বলাবাহুল্য, শুনে স্বভাবতই ভারী খুশি হলাম। নবাগত শিক্ষকটি ছিলেন পূর্বতন শিক্ষকের সম্পূর্ণ বিপরীত স্বভাবের। ইনি ছিলেন সরল স্বভাব, স্পষ্টভাষী, মধুর ব্যবহার, বিনয়ী ও মিশুক প্রকৃতির। বেহুদা কথা বলেন না কারো মনে ব্যথা পায় এমন কাজও করেন না। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে পুত্রবত স্নেহ করেন।

অল্পদিনের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের মন থেকে শিক্ষক ভীতি উধাও হয়ে গেল। এবং ওস্তাদিনের ফেরশতা স্বাভাবের সুযোগে ছাত্রদের মধ্যে দৈত্যসুলভ স্বভাব দেখা দিতে লাগল। একদল খেলাধুলায় মেতে উঠল আর একদল অপরের মাথায় শ্লেট ভেঙ্গে কুরুক্ষেত্র শুরু করে দিল। ওস্তাদজীর সীমাহীন ধৈর্য থাকার শাসন ক্ষমতা ছিল শিথিল। ফলে

শিক্ষার্থীরা নতুন পড়ালেখা তো ছেড়েই দিল। অধিকন্তু পুরনো পড়া যা ছিল, তাও বেমালুম ভূলে গেল। অবশেষে অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়াল যে, বিদ্যালয় আর বিদ্যালয় রইল না। মারামারি ও খেলার আড্ডায় পরিণত হল।

“যে শিক্ষম স্নেহবসে ছাড়িবে শাসন

তার হাতে মাটি হবে ছাত্রের জীবন।”

সপ্তাহ দুই পরে আবার সেই পথ দিয়ে যাচ্ছি-দেখি সেই সাবেক শিক্ষক আবার সগৌরবে তার সাবেক আসন দখল করে জেঁকে বসেছেন। তার দুর্দান্ত প্রতাপে মক্তব গৃহ নিরব, নিস্তব্ধ। ভয়ে ভয়ে সবাই নিজ সবক ইয়াদে ব্যস্ত। ক্ষোভ ও বিরক্তিতে মনটা ভরে উঠল। মুখে বললামঃ আবার কেন ইবলিশকে ফেরশতাদের ওস্তাদ বানান হয়েছে। একজন বিজ্ঞ বহুদর্শী বৃদ্ধ আমার কথা শুনে হেসে দিয়ে বললেনঃ মা-বাবার স্নেহ চুম্বনের চেয়ে ওস্তাদের বেত্রাঘাত উত্তম। শোনেন নি?

“এক রাজা দিয়েছিল পুত্রকে স্কুলে

সোনার প্লেট কিনে দিল তার কোলে

সোনার হরফে লেখা ছিল পাশে তার

পিতৃ স্নেহ হতে, ভাল গুরুর অত্যাচার।”

শিক্ষাঃ যেমন ছাত্র তেমন শিক্ষা গুরু না হলে শিক্ষার মান বৃদ্ধি পায় না। ছাত্র যদি বেয়াদব বা দুষ্টু প্রকৃতির হয় তবে কড়া নজরের শিক্ষক প্রয়োজন। দুষ্টু ছেলেদের গরম মেজাজের শিক্ষক না হলে লেখাপড়া হয় না। ভদ্র, নরম প্রকৃতির ওস্তাদের কাছে দুষ্টু ছেলেদের লেখাপড়া হয় না। তাদের ভদ্রতা ও ধৈর্য্যের কাছে তারা হয়ে উঠে বেয়াদব ও উচ্ছৃঙ্খল।
নাস্তিকের সাথে বহস:- একবার এক খোদাদ্রোহী নাস্তিকের সাথে একজন নির্ভরযোগ্য বিজ্ঞ আলেমের

বাহাছ হয়েছিল। নাস্তিকের সাথে তর্কযুদ্ধে না পেরে আলেম সাহেব পরাজয় স্বীকার করেন

এবং পিছপা হয়ে ফিরে আসেন।

এক ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞেস করলঃ হুজুর! আপনি এদেশের অদ্বিতীয় আলেম। কুরআন,

হাদিস, মানতিক, ইলমে কালাম প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে এত দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও একজন

ধর্মদ্রোহীর সাথে যুক্তিতর্কে হেরে গেলেন। কারণ কি?

তিনি উত্তর দিলেনঃ বাবা আমার ইলম কুরআন, হাদীস এবং বুযুর্গানে দ্বীনদের সিদ্ধান্ত থেকে

হাসিল করেছি। এ সবের কোনটাই সে বিশ্বাস করে না এবং মানেও না। সে যখন ধর্মের মূল্যবান মন্তব্য মন দিয়ে শোনে না, তখন তার বাজে বক্তব্য শুনে আমার কি লাভ।

“কুরআন-হাদিসে নাই বিশ্বাস যার,

উত্তর না দেওয়াটাই উত্তম তার।”

শিক্ষাঃ নির্ভরযোগ্য কোন বিজ্ঞ আলেমের উচিত নয় মূর্খ ও নাস্তিকের সাথে বাহাছ করা। যারা কুরআন ও হাদিস বুঝে না তাদের সাথে অযথা কথা কাটাকাটি করে লাভ নেই।

হযরত আলী রাঃ জীবনী

নাম ও বংশ পরিচয়:
নাম আলী, পিতার নাম আবু তালিব, মাতার নাম: ফাতিমা বিনতে আসাদ। ৬০০ খৃষ্টাব্দে তিনি মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন হযরত মুহাম্মদ সা. এর চাচাত ভাই। তার ডাক নাম আবু তোরাব ও আবুল হাসান।

ইসলাম গ্রহণ ও মদীনায় গমন:
রাসূল সা. এর নবুওয়াতের শুরুতেই হযরত আলী রা. ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন আলী রা. এর বয়স ছিল মাত্র দশ বছর। বালকদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি আর্থিকভাবে অসচ্ছল থাকলেও অসি ও মসি দ্বারা ইসলামের প্রচুর খিদমত করেছেন। তিনিও মাহানবীর সাথে কুরাইশদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। তিনিই সেই সৌভাগ্যবান সাহাবী আল্লাহর নবী হিজরত করার সময় যাকে মক্কায় তার আমানত আদায়ের জন্য রেখে যান। জীবনের মায়া ত্যাগ করে তিনি নবীজির বিছানায় শুয়ে ছিলেন। আর সবাই তার এই নবীপ্রেম দেখে আশ্চর্য হলো। পরবর্তীতে তিনিও মদীনায় হিজরত করেন। তার আগে তিনি নবীজির কাছে সবার গচ্ছিত আমানত ও পাওনা মিটিয়ে দেন।

আদর্শ ও চরিত্র:
মুসলিম জাহানের চতুর্থ খলীফা হযরত আলী রা. আল্লাহ ও তার রাসূলের একনিষ্ট প্রেমিক ছিলেন। দৃঢ় বিশ্বাসী, রণক্ষেত্রে সাহসী, ব্যক্তিগত আচরণে নম্র, আলোচনা ও বিচারকার্যে ছিলেন সুবিজ্ঞ। নিজের ভিতর ইসলামী গুণাবলীর মহান আদর্শ তিনি স্থাপন করেছিলেন নিজের ভিতর। ছিলেন নবীর প্রায় প্রতিটি যুদ্ধে তার বিশ্বস্ত সঙ্গি। পূর্ববর্তী খলীফাদের সহৃদ পরামর্শদাতা। মোটকথা, তিনি ছিলেন নবীর আদর্শ ও চরিত্রের রঙ্গে পুরো রঙ্গিণ ছিলেন।

আলী রা. এর বিবাহ:
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. হযরত আলী রা. এর সাথে নিজের আদরের কন্যা হযরত ফাতেমা রা. কে বিবাহ দেন। তাদের পরবর্তী দাম্পত্য জীবন ছিলো অত্যন্ত সুমধুর। হযরত ফাতেমার গর্ভে হাসান, হুাসাইন ও মুহসিন নামে তিনজন ছেলে এবং জয়নব ও উম্মে কলসুম নামে দুজন কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। মুহসিন ছোটকালেই ইন্তেকাল করেন। পরবর্তীতে হাসান হুসাইনের দ্বারাই তাদের ব্বংশ বিস্তৃত হয়। আর তারাই ইতিহাসে সৈয়দ নামে পরিচিত।

হযরত আলী রা. এর জ্ঞানের গভীরতা:
আলী রা. ছিলেন অসাধারণ আল্লাহ প্রদত্ব জ্ঞানের অধিকারী। স্মৃতিশক্তি ও জ্ঞান গরিমায় ভরপুর ছিলেন এই নবী জামাতা। কুরআন, হাদীস, কাব্য, দর্শণ ও আইনশাস্রে ছিল তার সর্বিক বিচরণ। নাহু শাস্রের প্রবক্তাও এই মুরতাযা। ছিলেন তাফসীরকারক। ফতোয়ার কাজও করতেন নবীর যামানায়। ওহি লিখকও ছিলেন এই খলীফা। লিখে শেষ করা যাবেনা তার জ্ঞান কীর্তি। কারণ নবী সা. নিজে বলেছেন, আমি জ্ঞানের নগরী আর আলী তার দরজা।

বীরত্ব ও সাহসিকতা:
ইসলামের জন্য হযরত আলী রা. এর অবদান ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তার সসীম শক্তি ও বীরত্বকে ইসলামের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। রাসূল সা. এর জীবনে প্রায় সব যুদ্ধেই তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং প্রতিটি যুদ্ধে তিনি তার শৌর্যবির্যের পরিচয় দেন। বদরের যুদ্ধে তিনি মহানবী সা. এর পতাকা বহন করেন। এ যুদ্ধে তিনি কুরাইশদের বিখ্যাত বীর আমর ইবন আবুদ্দোজা কে পরাজিত ও নিহত করে। এ সময় বীরত্বের জন্য তিনি মহানবী সা. এর কাছ হতে জুলফিকার তরবারি লাভ করেছিলেন। এমনি ভাবে তিনি উহুদ, খন্দক, খায়বার যুদ্ধে শত্রুকে পরাজিত করে বিখ্যাত কামুস দূর্গ জয় করে অসাধারণ সৌর্য বীর্য প্রদর্শন করেন। তার বীরত্বে সন্তুষ্ট হয়ে মহানবী সা. তাকে আসাদুল্লাহ বা আল্লাহর বাঘ উপাধিাতে ভূষিত করেন।

হযরত আলী রা. শাহাদাত:
বিদ্রোহী খারেজীগণ হযরত আলী মুআবিয়া ও আমর ইবনুল আস রা. কে ইসলামের শান্তি শৃঙ্খলা বিনাসের কারণ বলে দায়ী করে। তাই তারা এ তিনজনকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে। সেমতে কুফা, দামেষ্ক ও ফুসতাত প্রত্যেকে নিজ নিজ মসজিদ হতে বের হওয়ার পথে তাদেরকে শেষ করে দেয়ার ইচ্ছা করে আততায়ীরা। সৌভাগ্যক্রমে আমর ইবনুল আস সেদিন অনুপস্থিত ছিলেন। মুআবিয়া রা. আততায়ীর হাতে আহত হলেও প্রাণে বেচে যায়। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা! আবদুর ইবনে মুলজামের খঞ্জরের আঘাতে হযরত আলী রা. গুরুতর আহত হন। সেই আঘাতেই ৬৬১ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জানুয়ারী তিনি শাহাদাত লাভ করেন। আর এই মাহান খলীফার মৃত্যুর সাথে সাথেই সীরাতে মুস্তাকীমের উপর প্রতিষ্ঠিত খোলাফায়ে রাশেদীনের পবিত্র খেলাফতের পরিসমাপ্তি ঘটে।

হযরত ওসমান রাঃ জীবনী

নাম উমসান, কুনিয়াত আবু আমর, আবু আবদিল্লাহ, আবু লায়লা এবং লকব যুন-নূরাইন । (তাবাকাত ৩/৫৩) পিতা আফফান, মাতা আরওয়া বিনতে কুরাইশ । কুরাইশ বংশের উমাইয়্যা শাখার সন্তান । তাঁর উর্ধ পুরুষ আবদে মান্নাফে গিয়ে রাসূল (সাঃ) এর নসবের সাথে তাঁর নসব মিলিত হয়েছে । খুলাফায়ে রাশেদার তৃতীয় খলীফা । তাঁর নানী বায়দা বিন্তু আবদিল মুত্তলিব রাসূল (সাঃ) ফুফু । জন্ম হস্তীসনের ছ’বছর পরে ৫৭৬ খৃষ্টাব্দে । (আল-ইসতিয়াব) এ হিসাবে রাসূলে কারীম (সাঃ) থেকে তিনি ছয় বছর ছোট । তবে তাঁর জন্মসন সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে । ফলে শাহাদাতের সময় তাঁর বয়স কত ছিল সে সম্পর্কে অনুরূপ মত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় । কোন কোন বর্ণনা মতে, তাঁর জন্ম হয় তায়েফে । (ফিতনাতুল কুবরা, ডঃ তোহা হুসাইন)

হযরত উসমান (রাঃ) ছিলেন মধ্যমাকৃতির সুঠাম দেহের অধিকারী । মাংসহীন গন্ডদেশ, ঘন দাড়ি, উজ্জল ফর্সা, ঘন কেশ, বুক ও কোমর চওরা, কান পর্যন্ত ঝোলানো যুলফী, পায়ের নলা মোটা, পশম ভরা লম্বা বাহু, মুখে বসন্তের দাগ, মেহেদী রঙ্গের দাড়ি এবং স্বর্ণখচিত দাঁত ।

হযরত উসমানের জীবনের প্রাথমিক অবস্থা অন্যান্য সাহাবীর মত জাহিলী যুগের অন্ধকারেই রয়ে গেছে । তাঁর ইসলামপূর্ব জীবন এমনভাবে বিলীন হয়েছে যেন ইসলামের সাথেই তাঁর জন্ম । ইসলাম পূর্ব জীবনের বিশেষ কোন তথ্য ঐতিহাসিকরা আমাদের কাছে পৌঁছাতে পারেননি ।

হযরত উসমান ছিলেন কুরাইশ বংশের অন্যতম কুষ্টিবিদ্যা বিশারদ । কুরাইশদের প্রাচীন ইতিহাসেও ছিল তাঁর গভীর জ্ঞান । তাঁর প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা, সৌজন্য ও লৌকিকতাবোধ ইত্যাদি গুনাবলীর জন্য সব সময় তাঁর পাশে মানুষের ভীড় জমে থাকতো । জাহিলী যুগেও কোন অপকর্ম তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি । লজ্জা ও প্রখর আত্মমর্যাদাবোধ ছিল তাঁর মহান চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট । যৌবনে তিনি অন্যান্য অভিজাত কুরাইশদের মত ব্যবসা শুরু করেন । সীমাহিন সততা ও বিশ্বস্ততার গুনে ব্যবসায়ে অসাধারণ সাফল্য লাভ করেন । মক্কার সমাজে একজন বিশিষ্ট ধণী ব্যবসায়ী হিসাবে ‘গনী’ উপাধি লাভ করেন ।

হযরত উসমানকে ‘আস-সাবেকুনাল আওয়ালুন’, ‘আশারায়ে মুবাশশরা’ এবং সেই ছয় জন শ্রেষ্ঠ সাহাবীর মধ্যে গণ্য করা হয় যাঁদের প্রতি রাসূলে করীম (সাঃ) আমরণ খুশী ছিলেন । আবু বকর সিদ্দীকের সাথে তাঁর গভীর সম্পর্ক ছিল । তাঁরই তাবলীগ ও উৎসাহে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন । মক্কার আরো অনেক নেতৃবৃন্দের আচরণের বিপরীত হযরত উসমান রাসুল (সাঃ) নবুওয়াতের সূচনা পর্বেই তার দাওয়াতে সাড়া দেন এবং আজীবন জান-মাল ও সহায় সম্পত্তি দ্বারা মুসলমানদের কল্যাণব্রতী ছিলেন । হযরত উসমান (রাঃ) বলেনঃ ‘আমি ইসলাম গ্রহণকারী চারজনের মধ্যে চতুর্থ’ । ইবন ইসহাকের মতে, আবু বকর, আলী এবং যায়িদ বিন হারিসের পরে ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি হযরত উসমান ।

হযরত উসমানের ইসলাম গ্রহণের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সীরাত লেখক ও মুহাদ্দীসগণ যেসব বর্ণনা দিয়েছেন তার সারকথা নিম্নরূপঃ

কেউ কেউ বলেন, তাঁর খালা সু’দা ছিলেন সে যুগের একজন বিশিষ্ট ‘কাহিন’ বা ভবিশ্যদ্বক্তা । তিনি নবী করীম (সাঃ) সম্পর্কে উসমানকে কিছু কথা বলেন এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনার জন্য উৎসাহ দেন । তারই উৎসাহে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন । (আল ফিতনাতুল কুবরা) পক্ষান্তরে ইবন সা’দ সহ আরো অনেকে বর্ণনা করেনঃ হযরত উসমান সিরিয়া সফরে ছিলেন । যখন তিনি ‘মুয়ান ও যারকার’ মধ্যবর্তী স্থানে বিশ্রাম করছিলেন তখন তন্দ্রালু অবস্থায় এক আহবানকারীকে বলতে শুনলেন, ওহে ঘুমন্ত ব্যক্তিরা, তাড়াতাড়ি কর । আহমেদ নামের রাসূল মক্কায় আত্মপ্রকাশ করেছেন । মক্কায় ফিরে এসে শুনতে পেলেন ব্যাপারটি সত্য । অতঃপর আবু বকরের আহবানে ইসলাম গ্রহণ করেন । (তাবাকাতঃ ৩/৫৫)

হযরত উসমান যখন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তখন তাঁর বয়স তিরিশের উপরে । ইসলাম র্পূব যুগেও আবু বকরের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল । প্রায় প্রতিদিনই আবু বকরের বাড়ীতে যাতায়াত ছিল । একদিন হযরত আবু বকর (রাঃ) তাঁর সামনে ইসলাম পেশ করলেন । ঘটনাক্রমে রাসূল (সাঃ) ও তখন সে পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন । তিনি বললেনঃ উসমান, জান্নাতের প্রবেশকে মেনে নাও । আমি তোমাদের এবং আল্লাহর সকল মাখলুকের প্রতি তাঁর রাসূল হিসেবে এসেছি । একথা শুনার সাথে সাথে তিনি ইসলাম কবুল করেন । হযরত উসমানের ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর খালা সু’দা তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি কাসীদা রচনা করেছিলেন ।

হযরত উসমানের সহোদর আমীনা, বৈপিত্রীয় ভাই বোন ওয়ালীদ, খালিদ, আম্মারা, উম্মে কুলসুম সবাই মুসলমান হয়েছিলেন । তাঁদের পিতা উকবা ইবন আবী মুয়ীত ।দারু কুতনী বর্ণনা করেছেন, উম্মে কুলসুম প্রথম পর্বের একজন মুহাজির । বলা হয়েছে তিনিই প্রথম কুরাইশ বধূ যিনি রাসূল (সাঃ) হাতে বাইয়াত করেন । হযরত উসমানের অন্য ভাই-বোন মক্কা বিজয়ের সময় ইসলাম গ্রহণ করেন ।

ইসলাম গ্রহণের পর কুরাইশদের একজন সম্মানিত ব্যক্তি হওয়া সত্বেও তাঁকে ইসলামের শত্রুদের লাঞ্ছনা শিকার হতে হয় । তাঁর চাচা হাকাম ইবন আবিল আস তাঁকে রশি দিয়ে বেঁধে বেদম মার দিত । সে বলতো, একটা নতুন ধর্ম গ্রহণ করে তুমি আমাদের বাপ-দাদার মুখে কালি দিয়েছ । এ ধর্ম ত্যাগ না করা পর্যন্ত তোমাকে ছাড়া হবে না । এতে হযরত উসমানের ঈমান একটুও টলেনি । তিনি বলতেনঃ তোমাদের যা ইচ্ছে কর, এ দ্বীন আমি কক্ষণো ছাড়তে পারবো না । (তাবাকাতঃ ৩/৫৫)

হযরত উসমান ইসলাম গ্রহণের পর রাসুল (সাঃ) নিজ কণ্যার ‘রুকাইয়্যাকে’ তাঁর সাথে বিয়ে দেন । হিজরী দ্বিতীয় সনে মদীনায় রুকাইয়্যার ইন্তিকাল হলে রাসূল (সাঃ) তার দ্বিতীয় কন্যা উম্মে কুলসুমকে তাঁর সাথে বিয়ে দেন । এ কারণে তিনি ‘যুন-নূরাইন’ বা দুই জ্যোতির অধিকারী উপাধি লাভ করেন ।

রুকাইয়্যা ছিলেন হযরত খাদীজার (রাঃ) গর্ভজাত সন্তান । তাঁর প্রথম শাদী হয় উতবা ইবনে আবু লাহাবের সাথে এবং উম্মে কুলসুমের শাদী হয় আবু লাহাবের দ্বিতীয় পুত্র উতাইবার সাথে । আবু লাহাব ছিল আল্লাহর নবীর কট্টর দুশমন । পবিত্র কুরআনের সূরা লাহাব নাযিলের পর আবু লাহাব ও তার স্ত্রী উম্মে জামীল (হাম্মা লাতাল হাতাব) তাদের পুত্রদ্বয়কে নির্দেশ দিল মুহাম্মদের কন্যাদ্বয়ের তালাক দেওয়ার জন্য । তারা তালাক দিল । অবশ্য ইমাম সুয়ূতী মনে করেন, ইসলাম গ্রহণের পূর্বেই রুকাইয়্যার সাথে উসমানের শাদী হয় । উপরোক্ত ঘটনার আলোকে সুয়ূতীর মতটি গ্রহণযোগ্যে মনে হয় না ।

নবুওয়াতের পঞ্চম বছরের মক্কার মুশরিকদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রথম যে দলটি হাবশায় হিজরাত করেছিলেন তাঁদের মধ্যে উসমান ও তারঁ স্ত্রী রুকাইয়্যা ছিলেন । হযরত আনাস (রাঃ) বলেনঃ ‘হাবশায় মাটিতে প্রথম হিজরাতকারী উসমান ও তাঁর স্ত্রী নবী দুহিতা রুকাইয়্যা ।’ রাসূল (সাঃ) দীর্ঘদিন তাঁদের দু’জনের কুশল জিজ্ঞেস করেন । সে সংবাদ দেয়, ‘আমি দেখেছি, রুকাইয়্যা গাধার ওপর সওয়ার হয়ে আছে এবং উসমান গাধাটি তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে । রাসূল (সাঃ) তাঁর জন্য দু’আ করেন আল্লাহ তার সহায় হোন । লূতের (আঃ) পর উসমান আল্লাহর রাস্তায় পরিবার পরিজনসহ প্রথম হিজরতকারী ।(আল-ইসাবা) হাবশা অবস্থানকালে তাঁদের সন্তান আব্দুল্লাহ জন্মগ্রহন করে এবং এ ছেলের নাম অনুসারে তাঁর কুনিয়াত হয় আবু আবদুল্লাহ । হিজরী ৪র্থ সনে আব্দুল্লাহ মারা যান । রুকাইয়্যার সাথে তাঁর দাম্পত্য জীবন খুব সুখের হয়েছিল । লোকেরা বলাবলি করতো কেউ যদি সর্বোত্তম জুটি দেখতে চায়, সে যেন উসমান ও রুকাইয়্যাকে দেখে ।

হযরতউসমান বেশকিছুদিন হাবশায় অবস্থানকরেন।অতঃপর মক্কায়ফিরে আসেন এই গুজব শুনে যে, মক্কায় নেতৃবৃন্দ ইসলাম গ্রহন করেছে।রাসূল্লাহর (সাঃ) মদীনায় হিজরাতের পর আবার তিনি মদীনায় হিজরাত করেন এভাবে তিনি ‘যুলহিজরাতাইন’- দুই হিজরাতের অধিকারী হন। হযরত ’উসমানের সহোদরা আমীনা, বৈপিত্রীয় ভাই বোন ওয়ালীদ, খালীদ, আম্মারা, উম্মু কুলসুম সবাই মুসলমান হয়েছিলেন। তাঁদের পিতা উকবা ইবন আবী মুয়ীত। দারু কুত্‌নী বর্ণনা করেছেন, উম্মু কুলসুম প্রথম পর্বের একজন মুহাজির।

বলা হয়েছে তিনিই প্রথম কুরাইশ বধূ যিনি রাসূলুল্লাহর সা. হাতে বাইয়াত করেন। হযরত ’উসমানের অন্য ভাই-বোন মক্কা বিজয়ের সময় ইসলাম গ্রহণ করেন।



ইসলাম গ্রহণের পর কুরাইশদের একজন সম্মানিত ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে ইসলামের শত্রুদের লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। তাঁর চাচা হাকাম ইবন আবিল ’আস তাঁকে রশি দিয়ে বেঁধে বেদম মার দিত।

সে বলতো, একটা নতুন ধর্ম গ্রহণ করে তুমি আমাদের বাপ-দাদার মুখে কালি দিয়েছ। এ ধর্ম ত্যাগ না করা পর্যন্ত তোমাকে ছাড়া হবে না। এতে হযরত ’উসমানের ঈমান একটু টলেনি। তিনি বলতেনঃ তোমাদের যা ইচ্ছে কর, এ দ্বীন আমি কক্ষণো ছাড়তে পারবো না। (তাবাকাতঃ ৩/৫৫)



হযরত উসমান ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহ সা. নিজ কন্যা ‘রুকাইয়্যাকে’ তাঁর সাথে বিয়ে দেন। হিজরী দ্বিতীয় সনে মদীনায় রুকাইয়্যার ইনতিকাল হলে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর দ্বিতীয় কন্যা উম্মু কুলসুমকে তাঁর সাথে বিয়ে দেন।

এ কারণে তিনি ‘যুন-নূরাইন’- দুই জ্যোতির অধিকারী উপাধি লাভ করেন।

রুকাইয়্যা ছিলেন হযরত খাদীজার রা. গর্ভজাত সন্তান।

তাঁর প্রথম শাদী হয় উতবা ইবন আবী লাহাবের সাথে এবং উম্মু কুলসুমের শাদী হয় আবু লাহাবের দ্বিতীয় পুতু ’উতাইবার সাথে। আবু লাহাব ছিল আল্লাহর নবীর কট্টর দুশমন। পবিত্র কুরআনের সূরা লাহাব নাযিলের পর আবু লাহাব ও তার স্ত্রী উম্মু জামীল (হাম্মা লাতাল হাতাব) তাদের পুত্রদ্বয়কে নির্দেশ দিল ‍মুহাম্মাদের কন্যাদ্বয়কে তালাক দেওয়ার জন্য। তারা তালাক দিল।

অবশ্য ইমাম সুয়ূতী মনে করেন, ইসলাম গ্রহণের পূর্বেই রুকাইয়্যার সাথে উসমানের শাদী হয়।

উপরোক্ত ঘটনার আলোকে সুয়ূতির মতটি গ্রহণযোগ্য মনে হয় না।

নবুওয়াতের পঞ্চম বছরে মক্কার মুশরিকদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রথম যে দলটি হাবশায়

হিজরাত করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ’উসমান ও তাঁর স্ত্রী রুকাইয়্যাও ছিলেন। হযরত আনাস রা. বলেনঃ ‘হাবশার মাটিতে প্রথম হিজরাতকারী উসমান ও তাঁর স্ত্রী নবী দুহিতা রুকাইয়্যা।’ রাসূল সা. দীর্ঘদিন তাঁদের কোন খোঁজ-খবর না

পেয়ে ভীষণ উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েন। সেই সময় এক কুরাইশ মহিলা হাবশা থেকে মক্কায় এলো।

তার কাছে রাসূল সা. তাঁদের দু’জনের কুশল জিজ্ঞেস করেন। সে সংবাদ দেয়, ‘আমি দেখেছি, রুকাইয়্যা গাধার ওপর সওয়ার হয়ে আছে এবং ’উসমান গাধাটি তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাসূল সা. তাঁর জন্য দু’আ করেনঃ আল্লাহ তার সহায় হোন।

লূতের আ. পর ’উসমান আল্লাহর রাস্তায় পরিবার পরিজনসহ প্রথম হিজরাতকারী। (আল–ইসাবা) হাবশা অবস্থানকালে তাঁদের সন্তান আবদুল্লাহ জন্মগ্রহণ করে এবং এ ছেলের নাম অনুসারে তাঁর কুনিয়াত হয় আবু আবদিল্লাহ।

হিজরী ৪র্থ সনে আবদুল্লাহ মারা যান। রুকাইয়্যার সাথে তাঁর দাম্পত্য জীবন খুব সুখের হয়েছিল।

লোকেরা বলাবলি করতো কেউ যদি সর্বোত্তম জুটি দেখতে চায়, সে যেন উসমান ও রুকাইয়্যাকে দেখে।

হযরত উসমান বেশ কিছু দিন হাবশায় অবস্থান করেন।

অতঃপর মক্কায় ফিরে আসেন এই গুজব শুনে যে, মক্কার নেতৃবৃন্দ ইসলাম গ্রহণ করেছে।

রাসূলুল্লাহর সা. মদীনায় হিজরাতের পর আবার তিনি মদীনায় হিজরত করেন। এভাবে তিনি ‘যুল হিজরাতাইন’- দুই হিজরাতের অধিকারী হন।

একমাত্র বদর ছাড়া সকল যুদ্ধে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. সাথে অংশগ্রহণ করেছেন।

রাসূল সা. যখন বদর যুদ্ধে রওয়ানা হন, হযরত রুকাইয়্যা তখন রোগ শয্যায়।

রাসূলের সা. নির্দেশে হযরত ’উসমান পীড়িত স্ত্রীর সেবার জন্য মদীনায় থেকে যান। বদরের বিজয়ের খবর যেদিন মদীনায় এসে পৌঁছুলো সেদিনই হযরত রুকাইয়্যা ইনতিকাল করেন।

রাসূল সা. উসমানের জন্য বদরের যোদ্ধাদের মত সওয়াব ও গনীমতের অংশ ঘোষণা করেন। (তাবাকাতঃ ৩/৫৬) এ হিসেবে পরোক্ষভাবে তিনিও বদরী সাহাবী।



রুকাইয়্যার ইনতিকালের পর রাসূল সা. রুকাইয়্যার ছোট বোন উম্মু কুলসুমকে উসমানের সাথে বিয়ে দেন হিজরী তৃতীয় সনে।

একটি বর্ণনায় জানা যায়, আল্লাহর নির্দেশেই রাসূল সা. উম্মু কুলসুমকে ’উসমানের সাথে বিয়ে দেন।

হিজরী নবম সনে উম্মু কুলসুমও নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। উম্মু কুলসুমের মৃত্যুর পর রাসূল সা. বলেনঃ ‘আমার যদি তৃতীয় কোন মেয়ে থাকতো তাকেও আমি ’উসমানের সাথে বিয়ে দিতাম।’ (হায়াতু ’উসমানঃ রিজা মিসরী) হযরত ’উসমান উহুদের যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু সেই মুষ্টিমেয় কিছু যোদ্ধাদের মত রাসূলুল্লাহর সাথে অটল থাকতে পারেননি। অধিকাংশ মুজাহিদদের সাথে তিনিও ময়দান ছেড়ে চলে যান। অবশ্য আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য ক্ষমা ঘোষাণো করেছেন। পরবর্তী সকল যুদ্ধেই অন্যসব বিশিষ্ট সাহাবীদের মত অংশগ্রহণ করেছেন।

রাসূল সা. তাবুক অভিযানের প্রস্তুতির ঘোষণা দিলেন। মক্কা ও অন্যান্য আরব গোত্রসমূহেও ঘোষণা দিলেন এ অভিযানে অংশগ্রহণের জন্য। ইসলামী ফৌজের সংগঠন ও ব্যায় নির্বাহের সাহায্যের আবেদন জানালেন। সাহাবীরা ব্যাপকভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। আবু বকর তাঁর সকল অর্থ রাসূলের হাতে তুলে দিলেন। ’উমার তাঁর মোট অর্থের অর্ধেক নিয়ে হাজির হলেন।

আর এ যুদ্ধের এক তৃতীয়াংশ সৈন্যের যাবতীয় ব্যয়ভার উসমান নিজ কাঁধে তুলে নিলেন। তিনি সাড়ে নয় শ’ উট ও পঞ্চাশটি ঘোড়া সরবরাহ করেন। ইবন ইসহাক বলেন, তাবুকের বাহিনীর পেছনে হযরত উসমান এত বিপুল অর্থ ব্যয় করেন যে, তাঁর সমপরিমাণ আর কেউ ব্যয় করতে পারেনি। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, তাবুকে রণপ্রস্তুতির জন্য উসমান কোরচে করে এক হাজার দীনার নিয়ে এসে রাসূলুল্লাহর কোলে ঢেলে দেন।

রাসূল সা. খুশীতে দীনারগুলি উল্টে পাল্টে দেখেন এবং বলেনঃ ‘আজ থেকে ’উসমান যা কিছুই করবে, কোন কিছুই তার জন্য ক্ষতিকর হবেনা।’ এভাবে অধিকাংশ যুদ্ধের প্রস্তুতির সময় তিনি প্রাণ খুলে চাঁদা দিতেন।

একটি বর্ণনায় এসেছে, তাবুকের যুদ্ধে তাঁর দানে সন্তুষ্ট হয়ে রাসূল সা. তাঁর আগে-পিছের সকল গুনাহ মাফের জন্য দু’আ করেন এবং তাঁকে জান্নাতের ওয়াদা করেন। (আল–ফিতনাতুল কুবরা)। হুদাইবিয়ার ঘটনা। রাসূল সা. ’উমারকে ডেকে বললেনঃ তুমি মক্কায় যাও। মক্কার নেতৃবৃন্দকে আমাদের আগমণের উদ্দেশ্য অবহিত কর। ’উমার বিনীতভাবে বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! কুরাইশদের কাছ থেকে আমার  জীবনের আশঙ্কা করছি।

আপনি জানেন তাদের সাথে আমার দুশমনি কতখানি। আমি মনে করি উসমানই এ কাজের উপযুক্ত। রাসূল সা. ’উসমানকে ডাকলেন। আবু সুফিয়ান ও অন্যান্য কুরাইশ নেতৃবৃন্দের নিকট এ পয়গামসহ উসমানকে পাঠালেন যে, আমরা যুদ্ধ নয়, বরং ‘বাইতুল্লাহর’ যিয়ারতের উদ্দেশ্যে এসেছি।

রাসূলুল্লাহর সা. পয়গাম নিয়ে উসমান মক্কায় পৌঁছলেন। সর্ব প্রথম আবান ইবন সাঈদ ইবন আস- এর সাথে তাঁর দেখা হয়। আবান তাঁকে নিরাপত্তা দেন। আবানকে সঙ্গে করে তিনি কুরাইশ নেতৃবৃন্দের সাথে দেখা করে রাসূলুল্লাহর সা. পয়গাম পৌঁছে দেন।

তারা ’উসমানকে বলেন, তুমি ইচ্ছে করলে ‘তাওয়াফ’ কতে পার। কিন্তু ’উসমান তাদের এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন, আল্লাহর রাসূল সা. যতক্ষণ ‘তাওয়াফ’ না করেন, আমি ‘তাওয়াফ’ করতে পারিনে। কুরাইশরা তাঁর এ কথায় ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে আটক করে।

কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, ’উসমানকে তারা তিনদিন আটক করে রাখে।

এ দিকে হুদাইবিয়ায় মুসলিম শিবিরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে উসমানকে শহীদ করা হয়েছে।

রাসূল সা. ঘোষণা করলেন ’উসমানের রক্তের বদলা না নিয়ে আমরা প্রত্যাবর্তন করবো না।

রাসূল সা. নিজের ডান হাতটি বাম হাতের ওপরে রেখে বলেনঃ হে আল্লাহ, এ বাইয়াত ’উসমানের পক্ষ থেকে। সে তোমার ও তোমার রাসূলের কাজে মক্কায় গেছে। হযরত ’উসমান মক্কা থেকে ফিরে এসে বাইয়াতের কথা জানতে পারেন।

তিনি নিজেও রাসূলুল্লাহর হাতে বাইয়াত করেন। ইতিহাসে এ ঘটনা বাইয়াতু রিদওয়ান, বাইয়াতুশ শাজারা ইত্যাদি নামে খ্যাত হয়েছে।

পবিত্র কুরআনে এ বাইয়াতের প্রশংসা করা হয়েছে।

রাসূলুল্লাহর ওফাতের পর যখন আবু বকরের হাতে বাইয়াত নেওয়া হচ্ছিল উসমান সংবাদ পেয়ে খুব দ্রুত সেখানে যান এবং আবু বকরের হাতে বাইয়াত করেন। মৃত্যুকালে আবু বকর ’উমারকে রা. খলীফা মনোনীত করে যে অঙ্গীকার পত্রটি লিখে যান, তার লিখক ছিলেন ’উসমান। খলীফা ’উমারের রা. হাতে তিনিই সর্বপ্রথম বাইয়াত করেন।

হযরত ’উমার রা. ছুরিকাহত হয়ে যখন মৃত্যু শয্যায়, তাঁর কাছে দাবী করা হলো পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের জন্য।

কিন্তু তিনি ইতস্ততঃ করে বললেনঃ আমি যদি খলিফা বানিয়ে যাই, তবে তার দৃষ্টান্ত অবশ্য আছে, যেমনটি করেছেন আমার থেকেও এক উত্তম ব্যক্তি, অর্থাৎ আবু বকর রা. আর যদি না-ও বানিয়ে যাই তারও দৃষ্টান্ত আছে। যেমনটি করেছিলেন আমার থেকেও এক উত্তম ব্যক্তি, অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সা.। তিনি আরো বললেনঃ আবু ’উবাইদা জীবিত থাকলে তাকেই খলীফা বানিয়ে যেতাম।

আমার রব আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলতাম, আপনার নবীকে আমি বলতে শুনেছি, তিনি এই উম্মাতের আমীন বা পরম বিশ্বাসী ব্যক্তি। যদি আবু হুজাইফার আযাদকৃত দাস সালেমও আজ জীবিত থাকতো, তাকেও খলীফা বানিয়ে যেতে পারতাম, আমার রব জিজ্ঞেস করলে বলতাম,, আপনার নবীকে আমি বলতে শুনেছি, সালেম বড় আল্লাহ-প্রেমিক। এক ব্যক্তি তখন বললো, আবদুল্লাহ ইবন উমার তো আছে। তিনি বলে উঠলেন, আল্লাহ তোমার অমঙ্গল করুন। কসম আল্লাহর, আমি আল্লাহর কাছে এমনটি চাই না। . খিলাফতের এ দায়িত্বের মধ্যে যদি ভালো কিছু থাকে, আমার বংশের থেকে আমি তা লাভ করেছি। আর যদি তা মন্দ হয় তাও আমরা পেয়েছি। উমারের বংশের এক ব্যক্তির হিসাব নিকাশই এজন্য যথেষ্ট।

আমি আমার নিজের নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি, আমার পরিবারবর্গকে মাহরূম করেছি। কোন পুরস্কারও নয় এবং কোন তিরস্কারও নয় এমনভাবে যদি আমি কোন মতে রেহাই পাই, নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করবো।

যখন একই কথা তাঁর কাছে আবার বলা হলো, তিনি আলীর রা. দিকে ইঙ্গিত বললেন, তোমাদেরকে হকের ওপর পরিচালনার তিনিই যোগ্য। তবে আমি জীবিত ও মৃত উভয় অবস্থায় এ দায়িত্ব বহন করতে রাজী নই।

তোমাদের সামনে এই একটি দল আছেন, যঁদের সম্পর্কে রাসূল সা. বলেছেন, তাঁরা জান্নাতের অধিবাসী। তাঁরা হলেন- আবদে মান্নাফের দুই পুত্র আলী ও উসমান, রাসূলের সা. দুই মাতুল আবদুর রাহমান ও সা’দ, রাসূলের সা. হাওয়ারী ও ফুফাতো ভাই যুবাইর ইবনুল আওয়াম এবং তালহা তাঁদের যে কোন একজনকে খলীফা নির্বাচিত করবে।

তাঁদের যে কেউ খলীফা নির্বাচিত হলে তোমরা তাঁকে সাহায্য করবে, তাঁর সাথে সুন্দর আচরণ করবে। তিনি যদি তোমাদের কারো ওপর কোন দায়িত্ব অর্পণ করেন, যথাযথভাবে তোমরা তা পালন করবে।

হযরত ’উমার উল্লেখিত দলটির সদস্যদের ডেকে বললেন, আপনাদের ব্যাপারে আমি ভেবে দেখিছি। আপনারা জনগণের নেতা ও পরিচালক। খিলাফতের দায়িত্বটি আপনাদের মধ্যেই থাকা উচিত।

আপনাদের প্রতি সন্তুষ্ট অবস্থায় রাসূল সা. ইনতিকাল করেছেন। আপনারা ঠিক থাকলে জনগণের ব্যাপারে আমার কোন ভয় নেই। তবে আপনাদের পারস্পরিক বিবাদকে আমি ভয় করি। জনগণ তাতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়বে।

তারপর তিনি নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর তিন দিন তিন রাত্রি।

মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদকে বলরেন, আমাকে কবরে শায়িত করার পর এই দলটিকে একত্র করবে এবং তাঁরা তাদের মধ্য থেকে একজনকে নির্বাচন করবে। সুহায়িবকে বললেনঃ তিন দিন তুমি নামাযের জামায়াতের ইমামতি করবে।

আলী, উসমান, সা’দ, ’আবদুর রাহমান, যুবাইর ও তালহার কাছে যাবে, যদি তালহা মদীনায় থাকে (তালহা তখন মদীনার বাইরে ছিলেন)। তাদেরকে এক স্থানে সমবেত করবে। আবদুল্লাহ ইবন উমারকেও হাজির করবে।

তবে খিলাফতের কোন হক তার নেই। তাঁদের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবে। তাঁদের পাঁচজন যদি কোন একজনের ব্যাপারে একমত হয় এবং একজন দ্বিমত পোষণ করে, তরবারি দিয়ে তার কল্লা কেটে ফেলবে।

আর যদি চারজন একমত হয় এবং দু’জন অস্বীকার করে, তবে সে দু’জনের কল্লা উড়িয়ে দেবে। আর যদি তিনজন করে দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়, আবদুল্লাহন বিন ’উমার যে পক্ষ সমর্থন করবে তারা তাদের মধ্য থেকে একজনকে নির্বাচন করবে। অন্য পক্ষ যদি আবদুল্লাহ বিন ’উমারের সিদ্ধান্ত না মানে, তাহলে আবদুর রাহমান বিন ’আউফ যে দিকে থাকবে তোমরা সে দিকে যাবে।

বিরোধীরা যদি জনগণের সিদ্ধান্ত না মানে তাহলে তাদেরকে মানাতে বাধ্য করবে।

হযরত ’উমারকে দাফন করার পর মিকদাদ বিন আসওয়াদ শূরার সদস্যদের মিসওয়ার ইবনুল মাখরামা মতান্তরে হযরত আয়িশার হুজরায় একত্র করলেন। তাঁরা পাঁচজন। তালহা তখনো মদীনার বাইরে। তাঁদের সাথে যুক্ত হলেন আবদুল্লাহ বিন ’উমার। বাড়ীর দরজায় প্রহরী নিয়োগ করা হলো আবু তালহাকে। বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা ও তুমুল বাক-বিতণ্ডা হলো। এক পর্যায়ে আবদুর রাহমান বললেনঃ তোমাদের মধ্যে এমন কে আছ, যে তার দাবী ত্যাগ করতে পার এবং তোমাদের উত্তম ব্যক্তিকে নির্বাচনের দায়িত্ব আমার ওপর অর্পণ করতে পার? আমি আমার খিলাফতের দাবী ত্যাগ করছি। হযরত ’উসমান সর্বপ্রথম এ প্রস্তাবে রাজী হয়ে আবদুর রাহমানের হাতে তাঁর ক্ষমতা ন্যস্ত করলেন। তারপর অন্য সকলে তাঁর অনুসরণ করলেন। এভাবে খলীফা নির্বাচনের গোটা দায়িত্বটি আবদুর রাহমানের ওপর এসে বর্তায়।

হযরত আবদুর রাহমান দিনরাত রাসূলুল্লাহর সা. অন্যসব সাহাবী, মদীনায় অবস্থানরত সকল সেনা-অফিসার, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গসহ সকল স্তরের জনপ্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করলেন। কখনো ব্যক্তিগতভাবে, কখনো সম্মিলিতভাবে। প্রায় সকলেই হযরত উসমানের পক্ষে তাদের মতামত ব্যক্ত করলেন।

যেদিন সকালে ’উমার-নির্ধারিত সময় সীমা শেষ হবে, সে রাতে আবদুর রাহমান এলেন মাখরামার বাড়ীতে। তিনি প্রথমে যুবাইর ও সা’দকে ডেকে মসজিদে নববীর সুফ্‌ফায় বসে এক এক করে তাঁদের সাথে কথা বললেন, এভাবে ’উসমান ও আলীর সাথেও সুবহে সাদিক পর্যন্ত একান্তে আলাপ করেন।

এদিকে মসজিদে নববী লোকে পরিপূর্ণ। শেষ সিদ্ধান্তটি শোনার জন্য সবাই ব্যাকুল। ফজরের নামাযের পর সমবেত মদীনাবাসীদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত এক ভাষণের পর আবদুর রাহমান খলীফা হিসেবে হযরত ’উসমানের নামটি ঘোষণা করেন এবং তাঁর হাতে বাইয়াত করেন। তারপরই হযরত আলীও বাইয়াত করেন। অতঃপর সমবেত জনমণ্ডলী হযরত ’উসমানের হাতে বাইয়াত করেন। হিজরী ২৪ সনের ১লা মুহাররম সোমবার সকালে তিনি খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। (তারীখুল উম্মাহ আল–ইসলামিয়্যাহ, খিদরী বেক)।হযরত ’উসমান অত্যন্ত দক্ষতার সাথে খিলাফতের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। খিলাফতের প্রথম পর্যায়ে তাঁর বিরুদ্ধে তেমন অভিযোগ শোনা যায়না। তবে শেষের দিকে বসরা, কুফা, মিসর প্রভৃতি অঞ্চল থেকে তাঁর বিরুদ্ধে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠতে থাকে। মূলতঃ এ অসন্তোষ সৃষ্টির পশ্চাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে পরাজিত ইয়াহুদী শক্তি। ধীরে ধীরে তারা সংঘবদ্ধভাবে বিদ্রোহী হয়ে উঠে এবং মদীনার খলীফার বাসভবন ঘেরাও করে। এই বিদ্রোহীদের মধ্যে কোন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ছিল না।

তারা খলীফাকে হত্যার হুমকি দিয়ে পদত্যাদ দাবী করে।

খলীফার বাসগৃহের খাদ্য ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। মসজিদে নামায আদায়ে বাধা সৃষ্টি করে। এক পর্যায়ে তারা খলীফার বাড়ীতে ঢুকে পড়ে এবং রোযা অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াতরত বয়োবৃদ্ধ খলীফাকে হত্যা করে।

(ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) এ ঘটনা সংঘটিত হয় হিজরী ৩৫ সনের ১৮ জিলহজ্জ, শুক্রবার আসর নামাযের পর। রাসূলের সা. ওফাত ও হযরত উসমানের শাহাদাতের মধ্যে ২৫ বছরের ব্যবধান।

বারো দিন কম বারো বছর তিনি খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন।

জান্নাতুল বাকীর ‘হাশশে কাওকাব’ নামক অংশে তাঁকে দাফন করা হয়।

মাগরিব ও ঈশার মাঝামাঝি সময়ে তাঁর দাফন কার্য সমাধা হয়। যুবাইর ইবন মুতঈম রা. তাঁর জানাযার ইমামতি করেন। কাবুল থেকে মরক্কো পর্যন্ত বিশাল খিলাফতের কর্ণধারের জানাযায় মাত্র সত্তরজন লোক অংশগ্রহণ করেছিলেন।

মৃত্যুকালে তাঁর বয়স কত হয়েছিল সে সম্পর্কে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে ৮২ থেকে ৯০ বছরের মধ্যে ছিল। (আল–ফিত্‌নাতুল কুবরা)

খলীফা উসমান বিদ্রোহীদের দ্বারা ঘেরাও হওয়ার পর ইচ্ছা করলে তাদের নির্মূল করতে পারতেন।

অন্য সাহাবীরা সেজন্য প্রস্তুতও ছিলেন। কিন্তু হযরত উসমান নিজের জন্য কোন মুসলমানের রক্ত ঝরাতে চাননি।

তিনি চাননি মুসলমানদের মধ্যে রক্তপাতের সূচনাকারী হতে। প্রকৃতপক্ষে এমন এক নাজুক মুহূর্তে হযরত উসমান রা. যে কর্ম-পদ্ধতি অবলম্বন করেন তা একজন খলীফা ও একজন বাদশার মধ্যে যে পার্থক্য তা স্পষ্ট করে তোলে।

তাঁর স্থলে যদি কোন বাদশাহ হতো, নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে যেকোন কৌশল প্রয়োগ করতে দ্বিধাবোধ করতো না। তাতে যত ক্ষতি বা ধ্বংসই হোক না কেন। কিন্তু তিনি ছিলেন খলীফা রাশেদ। নিজের জীবন দেওয়াকে তুচ্ছ মনে করেছেন।

তবুও যেন এমন সম্মান বিনষ্ট না হতে পারে যা একজন মুসলমানের সবকিছু থেকে প্রিয় হওয়া উচিত।’ (খিলাফত ও মুলুকিয়্যাতঃ আবুল আ’লা মওদূদী)

ইসলামের জন্য হযরত ’উসমানের অবদান মুসলিম জাতি কোন দিন ভুলতে পারবে না। ইসলামের সেই সংকটকালে আল্লাহর রাস্তায় তিনি যেভাবে খরচ করেছেন, অন্য কোন ধনাঢ্য মুসলমানের মধ্যে তার কোন নজীর নেই। তিনি বিস্তর অর্থের বিনিময়ে ইয়াহুদী মালিকানাধীন ‘বীরে রুমা’- কূপটি খরীদ করে মদীনার মুসলমানদের জন্য ওয়াক্‌ফ করেন। বিনিময়ে রাসূল সা. তাঁকে জান্নাতের অঙ্গীকার করেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যিনি একদিন ‘বীরে রুমা’ ওয়াক্‌ফ করে মদীনাবাসীদের পানি-কষ্ট দূর করেছিলেন, তাঁর বাড়ীতেই সেই কূপের পানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সেই ঘেরাও অবস্থায় একদিন তিনি জানালা দিয়ে মাথা বের করে মদীনাবাসীদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, রাসূলুল্লাহর সা. নির্দেশে আমিই বীরে রুমা খরীদ করে সর্বসাধারণের জন্য ওয়াক্‌ফ করেছি। আজ সেই কূপের পানি থেকেই তোমরা আমাকে বঞ্চিত করছো। আমি আজ  পানির অভাবে ময়লা পানি দিয়ে ইফতার করছি।

হযরত উসমানের ফজীলাত ও মর্যাদা সম্পর্কে রাসূল সা. হতে যত হাদীস বর্ণিত হয়েছে তার সারকথাঃ তিনি রাসূলুল্লাহর সা. অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। রাসূলুল্লাহর নিকটতম ব্যক্তিদের মধ্যে তাঁর বিশেষ স্থান ছিল। রাসূল সা. বার বার তাঁকে জান্নাতের খোশখবর দিয়েছেন।

নবী সা. বলেছেনঃ ‘প্রত্যেক নবীরই বন্ধু থাকে, জান্নাতে আমার বন্ধু হবে উসমান।’ (তিরমিযী) হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমার বলেনঃ নবীর সা. সময়ে মুসলমানরা আবু বকর, ’উমার ও উসমানকে সকলের থেকে অধিক মর্যাদাবান মনে করতেন। তা ছাড়া অন্য কোন সাহাবীকে বিশেষ কোন মর্যাদা দেওয়া হতো না।

হযরত উসমান রা. রাসূলুল্লাহর সা. সময়ে ‘কাতিবে অহী’- অহী লিখক ছিলেন। সিদ্দীকী ও ফারুকী যুগে ছিলেন পরামর্শদাতা। প্রতিবছরই তিনি হজ্জ আদায় করতেন। তবে যে বছর শহীদ হন, ঘেরাও থাকার কারণে হজ্জ আদায় করতে পারেননি।

সারা বছরই রোযা রাখতেন। সারা রাত ইবাদতে কাটতো। এক রাকআতে একবার কুরআন শরীফ খতম করতেন। রাতে কারও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতেন না। রাতে চাকরদের খিদমাত গ্রহণ করতেন না। তিনি ছিলেন অত্যন্ত লাজুক।

কোরআনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

০১) প্রশ্নঃ পবিত্র কুরআনুল কারীমে কতটি সূরা আছে? উত্তরঃ ১১৪টি। ০২) প্রশ্নঃ পবিত্র কুরআনের প্রথম সূরার নাম কি? উত্তরঃ সূরা ফাতিহা। ০৩) প্রশ্ন...