Monday, 29 April 2019

শেখ সাদীর গল্প রাজি

মহানুভবতাঃ-এক বাদশার কথা শুনেছি। তিনি একজন অপরাধী কয়েদীকে হত্যা করার হুকুম দিয়েছিলেন। বেচারা নিরুপায় হয়ে বাদশাহকে গালি দিতে শুরু করল এবং অশ্লীল ভাষায় যাচ্ছেতাই বকতে লাগল। লোকে বলে থাকেঃ মানুষের মনে যখন বেঁচে থাকার আশা থাকে না তখন তার মনে যা কিছু থাকে তা বলতে দ্বিধাবোধ করে না।
বাদশাহ তাঁর এক মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেনঃ লোকটা এমন জোরে জোরে কি বলছে?
মন্ত্রীমহোদয় খুব দয়ালূ ও মহানুভব ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বললেনঃ লোকটা বলছেঃ যারা রাগ দমন করে এবং লোকদেরকে ক্ষমা করে, সেইসব লোকদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন।
একথা শুনে বাদশার হৃদয়ে দয়ার উদ্রেগ হলো এবং তার প্রাণদন্ড মওকুফ করে দিলেন। আর একজন মন্ত্রী যিনি প্রথমোক্ত মন্ত্রীর বিরোধী ছিলেন, প্রতিবাদ করে বললেনঃ আমাদের মত উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের পক্ষে পবিত্র রাজদরবারে সত্য বৈ মিথ্যা বলা সমীচীন নয়। অপরাধী বাদশা নামদারকে গালি দিচ্ছে এবং এমন সব অকথ্য কথা বলছে, যা কাউকে বলা যায় না।
মহান বাদশা সে কথায় কান দিলেন না; বরং বিরক্ত হয়ে বললেনঃ যে সত্য কথা তুমি বলেছ, তার চেয়ে ওর মিথ্যা কথা আমার কাছে বেশি ভালো লেগেছে, কেননা, ওর উদ্দেশ্য মহৎ। অর্থাৎ, একটা মূল্যবান জীবন রক্ষা করে তাকে সংশোধনের সুযোগ দেয়া।
জ্ঞানী লোকেরা বলে গেছেনঃ অশান্তি উতপাদনকারী সত্য কথার চেয়ে শান্তিকামী মিথ্যা কথা ঢের ভালো।
“ রাজারা করেন সবে
উপদেষ্টা করিতে যা’ বলেন;
মন্ত্রীদের উচিত নয়
ভালো ছাড়া মন্দ কিছু বলে। ”
শিক্ষাঃ প্রাণ রক্ষার ক্ষেত্রে মিথ্যা জায়েয। উভয়পক্ষের বিবাদ মিটানোর জন্য শরিয়ত মিথ্যা বলাকে বৈধ করেছেন। অশান্তি সৃষ্টিকারী সত্য কথার চেয়ে শান্তিকামী মিথ্যা কথা বলা ঢের ভালো।
বন্ধুর প্রেমে বন্ধু ঃ-একদা রাতের বেলায় আমার এক প্রিয় বন্ধু হঠাত এসে আমার সামনে হাজির। সে ছিল আমার পরম প্রিয়পাত্র। কালের কুটিল বিবর্তনে বহুদিন ধরে তার বিরহ বিচ্ছেদে আমি বিশেষভাবে বেদনাবোধ করছিলাম এবং অধীর আগ্রহে তার আগমন প্রতিক্ষায় প্রহর গুণছিলাম। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে প্রিয় পাত্রকে পাশে পেয়ে আনন্দে আত্নহারা হয়ে গেলাম এবং এত দ্রুত আসন ছেড়ে উঠে বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম যে, আমার আমার জামার আস্তিনের ঝাপটা লেগে আলোটা নিভে গেল।

বন্ধু! আমার পাশে বসেই আমাকে তিরষ্কার করতে শুরু করল।

বললঃ বন্ধু! আমাকে দেখেই আলো নিভিয়ে দিলে কারণ কি?

বললামঃ ভাই, দুটো কারণে আলো নিভিয়েছিঃ

প্রথম কারন এই যে, তুমি ভিতরে আসার সাথে সাথে আমার মনে হল সূর্য যেন উদয় হয়েছে। তোমার আলোকে ঘর ঝলমল করছে। কাজেই আলো রাখার প্রয়োজন নেই।

আর দ্বিতীয় কারনঃ আমার দুটো লাইন কবিতা মনে পড়ে গেলঃ

“যদি দেখ হাসি মাখা মুখে

প্রিয়জন ঘরে এলো।

তারে হাত ঘরে বসাও আদরে

আলোটা নিভিয়ে ফেলো।”

 শিক্ষাঃ মানুষ পুরনো বন্ধুকে পেয়ে আত্নহারা হয়ে যায়। পুরনো বন্ধুকে পেলে হারানো অনেক কথা হৃদয়পটে জেগে উঠে। মনে হয় যেন অমাবশ্যার রাতে আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে।
লাইলি ও মজনুর প্রেম কাহিনী ঃ-একদা আরব দেশে এক রাজদরাবারে লাইলী-মজনুর দুঃখময় ব্যর্থ প্রেমের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল ধনকুবের পুত্র কায়েস তার প্রচুর ধন-সম্পদ, বিদ্যা-বুদ্ধি ও সামাজিক মর্যাদা থাকা সত্ত্বেও একমাত্র লাইলীর প্রেমে পাগল হয়ে বলে-জংগএল বাস করেছে। একটা সামান্য নারীর অভাবে উন্মাত্ত হয়ে সে নিজের আত্ন-মর্যাদা, বুদ্ধি-বিবেচনা সবকিছু বিসর্জন দিয়ে বসেছে। সব কিছু শুনে বাদশা মজনুকে হাজির করলেন এবং খুব রকম তিরষ্কার করে বললেনঃ ওরে উন্মাদ! সৃষ্টির সেরা মানব সামাজে কি এমন ক্রটি পেলে যে, মানুষের সংশ্রব বর্জন করে তুমি জংগলের জীব-জানোয়ারের সঙ্গে জীবন-যাপন করা শুরু করেছ?
মজনু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে কেঁদে দিয়ে বললঃ
বন্ধুরা মোরে ভর্তসনা করে
কেন এত ভালোবাসি তারে
একবার তারে দেখিলে নজরে
দোষ কেহ দিত না আমারে
দেখিলে তোমার মুখ মুগ্ধ হত তার চোখ
যেই মোরে দেয় অপবাদ।
লেবুর বদলে হাত কাটিত সে নির্ঘাত দেখিত না মোর অপরাধ।
ক্রীতদাস ইউসুফের প্রেমে মাতোয়ারা হওয়ার দরুন মিশরের সম্ভ্রান্ত মহিলারা বিবি জুলেখার নিন্দা করত। হযরত ইউসুফকে তাদের সামনে হাজির করা হলে তার অতুলনীয় রূপ-সৌন্দর্য দর্শনে বিষ্ময়ে চেতনা হারা হয়ে লেবু কাটতে গিয়ে তারা নিজ নিজ হাতের আঙ্গুল কেটে ফেলে ছিল। তোমরাও যদি লাইলীর অপূর্ব সৌন্দর্য একবার দেখতে তা হলে প্রবাহিত রহস্য অনুধাবন করে আমার সপক্ষে সাক্ষ্য দিতে এবং আমাকে অযথা তিরষ্কার করতে না।
মজনুর মন্তব্য শুনে বাদশার মনে কৌতূহল হল। তাহলে লাইলীকে একবার দেখা দরকার। কত আকর্ষনীয় তার রূপলাবণ্য। যার মোহে একটি অমূল্য জীবন বিনষ্ট হতে যাচ্ছে। লাইলীকে রাজ সকাশে হাজির করার জন্য তখনই লোক পাঠান হলো। বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে অনুসন্ধানের পর পাওয়া গেল এবং রাজদরবারে এনে বসান হলো। খুব মনোযোগের সাথে বাদশা লাইলীর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন। কোন অসাধারণত্ব তার নজরে পড়লো না। বরং তার শাহী সৃষ্টিতে লাইলীর রূপ খুবই তুচ্ছ ও মামুলী মনে হল। কারণ তার চেয়ে অধিকতর রূপ-লাবণ্যবতী বহু মেয়ে তার দাসী বান্দীদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল।
মজনু তার প্রজ্ঞার আলোকে বাদশার মনোভাব বুজতে পেরে বললঃ
লাইলীর অতুলনীয় সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে হলে মজনুর মুগ্ধ নয়নের প্রয়োজন।
“ দয়া নাহি হয় কারো মোর বেদনায়,
ব্যথার দরদী মোর নাই কেহ হায়।
মোর মত ব্যথাহত পাইতাম যদি
কাষ্টসম জ্বলিতাম দেহে নিরবধি।”
শিক্ষাঃ যার মনে যার লাগে তারে কি আর ভোলা যায়। প্রেম এমন জিনিস যার দ্বারা উঁচু-নিচু, রাজা-প্রজা, দাস-দাসী, জাত-বর্ণে প্রভেদ করে না। চোখে যাকে ভালো লাগে সে যে জাতের হোক না কেন তাকে ছাড়া দুনিয়ার অন্য কেউ উত্তম নয়, প্রেমিকের চোখে প্রেমিকাকে যেভাবে দেখে অন্য মানুষ তাদেরকে সেভাবে দেখে না। কোন প্রেমিকা যদি কালো বা কুতসিতও হয়, প্রেমিকের চোখে সে সুন্দর।
কেমন ছাত্র তেমন শিক্ষকঃ- পাশ্চাত্য পরিভ্রমণকালে এক মক্তবে একজন শিক্ষক দেখেছিলাম। ওই ধরনের শিক্ষক আমি আর দেখিনি। লোকটা ছিল বেজায় বদমেজাজী, কর্কশভাষী, নির্দয়, অসামাজিক, কঠোর প্রকৃতির একটা ভয়াবহ মূর্তি। তার মুখের দিকে তাকালে মন বিরক্তিতে ভরে ওঠে, আলাপ করার আগ্রহ থাকে না। আর তার কুরআন শরীফ পড়ানো শুনলে মুসলমানের মনেও ভক্তির পরিবর্তে বিতৃষ্ণা জন্মে। একপাল কোমলমতি নিষ্পাপ ছাত্র-ছাত্রী তার নির্মম নির্যাতনের ভয়ে সদা সন্ত্রস্ত্র। কারো দিকে চেয়ে কেউ একটু মুচকি হাসবে বা একটা শব্দ করবে, তার জো নেই। তার মুখে তর্জন-গর্জন লেগেই আছে, আর তার বলিষ্ঠ নির্দয় হাত দুটো কারো কোমল মুখে চড়, কারো পিঠে বেত্রাঘাত অথবা কারো কান ধরে সজোরে মুচড়ে দেয়া প্রভৃতি শাসন কার্যে ব্যস্ত। সারা মক্তব গৃহটা যেন একটা বিভীষিকার কারাগার। এমন দৃশ্য আমার কঠিনমনে বড় বেদনাদায়ক মালুম হলো।

কিছু দিন পর শুনলাম, কি একটা অন্যায় অপরাধে, সেই শিক্ষককে উত্তম মাধ্যম দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তার স্থলে আর একজন ভাল শিক্ষক নিযুক্ত করা হয়েছে। বলাবাহুল্য, শুনে স্বভাবতই ভারী খুশি হলাম। নবাগত শিক্ষকটি ছিলেন পূর্বতন শিক্ষকের সম্পূর্ণ বিপরীত স্বভাবের। ইনি ছিলেন সরল স্বভাব, স্পষ্টভাষী, মধুর ব্যবহার, বিনয়ী ও মিশুক প্রকৃতির। বেহুদা কথা বলেন না কারো মনে ব্যথা পায় এমন কাজও করেন না। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে পুত্রবত স্নেহ করেন।

অল্পদিনের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের মন থেকে শিক্ষক ভীতি উধাও হয়ে গেল। এবং ওস্তাদিনের ফেরশতা স্বাভাবের সুযোগে ছাত্রদের মধ্যে দৈত্যসুলভ স্বভাব দেখা দিতে লাগল। একদল খেলাধুলায় মেতে উঠল আর একদল অপরের মাথায় শ্লেট ভেঙ্গে কুরুক্ষেত্র শুরু করে দিল। ওস্তাদজীর সীমাহীন ধৈর্য থাকার শাসন ক্ষমতা ছিল শিথিল। ফলে

শিক্ষার্থীরা নতুন পড়ালেখা তো ছেড়েই দিল। অধিকন্তু পুরনো পড়া যা ছিল, তাও বেমালুম ভূলে গেল। অবশেষে অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়াল যে, বিদ্যালয় আর বিদ্যালয় রইল না। মারামারি ও খেলার আড্ডায় পরিণত হল।

“যে শিক্ষম স্নেহবসে ছাড়িবে শাসন

তার হাতে মাটি হবে ছাত্রের জীবন।”

সপ্তাহ দুই পরে আবার সেই পথ দিয়ে যাচ্ছি-দেখি সেই সাবেক শিক্ষক আবার সগৌরবে তার সাবেক আসন দখল করে জেঁকে বসেছেন। তার দুর্দান্ত প্রতাপে মক্তব গৃহ নিরব, নিস্তব্ধ। ভয়ে ভয়ে সবাই নিজ সবক ইয়াদে ব্যস্ত। ক্ষোভ ও বিরক্তিতে মনটা ভরে উঠল। মুখে বললামঃ আবার কেন ইবলিশকে ফেরশতাদের ওস্তাদ বানান হয়েছে। একজন বিজ্ঞ বহুদর্শী বৃদ্ধ আমার কথা শুনে হেসে দিয়ে বললেনঃ মা-বাবার স্নেহ চুম্বনের চেয়ে ওস্তাদের বেত্রাঘাত উত্তম। শোনেন নি?

“এক রাজা দিয়েছিল পুত্রকে স্কুলে

সোনার প্লেট কিনে দিল তার কোলে

সোনার হরফে লেখা ছিল পাশে তার

পিতৃ স্নেহ হতে, ভাল গুরুর অত্যাচার।”

শিক্ষাঃ যেমন ছাত্র তেমন শিক্ষা গুরু না হলে শিক্ষার মান বৃদ্ধি পায় না। ছাত্র যদি বেয়াদব বা দুষ্টু প্রকৃতির হয় তবে কড়া নজরের শিক্ষক প্রয়োজন। দুষ্টু ছেলেদের গরম মেজাজের শিক্ষক না হলে লেখাপড়া হয় না। ভদ্র, নরম প্রকৃতির ওস্তাদের কাছে দুষ্টু ছেলেদের লেখাপড়া হয় না। তাদের ভদ্রতা ও ধৈর্য্যের কাছে তারা হয়ে উঠে বেয়াদব ও উচ্ছৃঙ্খল।
নাস্তিকের সাথে বহস:- একবার এক খোদাদ্রোহী নাস্তিকের সাথে একজন নির্ভরযোগ্য বিজ্ঞ আলেমের

বাহাছ হয়েছিল। নাস্তিকের সাথে তর্কযুদ্ধে না পেরে আলেম সাহেব পরাজয় স্বীকার করেন

এবং পিছপা হয়ে ফিরে আসেন।

এক ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞেস করলঃ হুজুর! আপনি এদেশের অদ্বিতীয় আলেম। কুরআন,

হাদিস, মানতিক, ইলমে কালাম প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে এত দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও একজন

ধর্মদ্রোহীর সাথে যুক্তিতর্কে হেরে গেলেন। কারণ কি?

তিনি উত্তর দিলেনঃ বাবা আমার ইলম কুরআন, হাদীস এবং বুযুর্গানে দ্বীনদের সিদ্ধান্ত থেকে

হাসিল করেছি। এ সবের কোনটাই সে বিশ্বাস করে না এবং মানেও না। সে যখন ধর্মের মূল্যবান মন্তব্য মন দিয়ে শোনে না, তখন তার বাজে বক্তব্য শুনে আমার কি লাভ।

“কুরআন-হাদিসে নাই বিশ্বাস যার,

উত্তর না দেওয়াটাই উত্তম তার।”

শিক্ষাঃ নির্ভরযোগ্য কোন বিজ্ঞ আলেমের উচিত নয় মূর্খ ও নাস্তিকের সাথে বাহাছ করা। যারা কুরআন ও হাদিস বুঝে না তাদের সাথে অযথা কথা কাটাকাটি করে লাভ নেই।

No comments:

Post a Comment

কোরআনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

০১) প্রশ্নঃ পবিত্র কুরআনুল কারীমে কতটি সূরা আছে? উত্তরঃ ১১৪টি। ০২) প্রশ্নঃ পবিত্র কুরআনের প্রথম সূরার নাম কি? উত্তরঃ সূরা ফাতিহা। ০৩) প্রশ্ন...