ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) ছিলেন হযরত নূহ (আঃ)-এর সম্ভবত: এগারোতম অধঃস্তন পুরুষ। নূহ থেকে ইবরাহীম পর্যন্ত প্রায় ২০০০ বছরের ব্যবধান ছিল। হযরত ছালেহ (আঃ)-এর প্রায় ২০০ বছর পরে ইবরাহীমের আগমন ঘটে। ঈসা থেকে ব্যবধান ছিল ১৭০০ বছর অথবা প্রায় ২০০০ বছরের। তিনি ছিলেন ‘আবুল আম্বিয়া’ বা নবীগণের পিতা এবং তাঁর স্ত্রী ‘সারা’ ছিলেন ‘উম্মুল আম্বিয়া’ বা নবীগণের মাতা। তাঁর স্ত্রী সারার পুত্র হযরত ইসহাক্ব-এর পুত্র ইয়াকূব (আঃ)-এর বংশধর ‘বনু ইসরাঈল’ নামে পরিচিত এবং অপর স্ত্রী হাজেরার পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশে জন্ম নেন বিশ্বনবী ও শেষনবী হযরত মুহাম্মাদ(ছাল্লাল্লা-হু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। যাঁর অনুসারীগণ ‘উম্মতে মুহাম্মাদী’ বা ‘মুসলিম উম্মাহ’ বলে পরিচিত।
বাবেল হ’তে তিনি কেন‘আনে (ফিলিস্তীন) হিজরত করেন। সেখান থেকে বিবি সারা-র বংশজাত নবীগণের মাধ্যমে আশপাশে সর্বত্র তাওহীদের দাওয়াত বিস্তার লাভ করে। অপর স্ত্রী হাজেরার পুত্র ইসমাঈলের মাধ্যমে বায়তুল্লাহ ও তার আশপাশ এলাকায় তাওহীদের প্রচার ও প্রসার হয় এবং অবশেষে এখানেই সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমন ঘটে। এভাবে ইবরাহীমের দুই স্ত্রীর বংশজাত নবীগণ বিশ্বকে তাওহীদের আলোয় আলোকিত করেন। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর দেহসৌষ্ঠব ও চেহারা মুবারক পিতা ইবরাহীম (আঃ)-এর ন্যায় ছিল। যা তিনি মে‘রাজ থেকে ফিরে এসে উম্মতকে খবর দেন।[1]
আবুল আম্বিয়া ও সাইয়েদুল আম্বিয়া :
ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন ইহুদী-খৃষ্টান-মুসলমান সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পিতা। কেননা আদম (আঃ) হ’তে ইবরাহীম (আঃ) পর্যন্ত ১০/১২ জন নবী বাদে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত ১ লাখ ২৪ হাযার পয়গম্বরের প্রায় সকলেই ছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধর। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
إنَّ اللّهَ اصْطَفَى آدَمَ وَنُوْحاً وَآلَ إِبْرَاهِيْمَ وَآلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِيْنَ- (آل عمران ৩৩)-
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আদম, নূহ, আলে ইবরাহীম ও আলে ইমরানকে বিশ্ববাসীর উপরে নির্বাচিত করেছেন’ (আলে ইমরান ৩/৩৩)। এই নির্বাচন ছিল বিশ্ব সমাজে আল্লাহর তাওহীদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য। ইবরাহীম ছিলেন নবীগণের পিতা এবং পুত্র মুহাম্মাদ ছিলেন নবীগণের নেতা, এ বিষয়টি সর্বদা মুমিনের মানসপটে জাগরুক রাখার জন্য দৈনিক ছালাতের শেষ বৈঠকে পঠিত দরূদের মধ্যে ইবরাহীম ও মুহাম্মাদের উপরে এবং উভয়ের পরিবার বর্গের উপরে আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষণের জন্য দো‘আ করার বিধান রাখা হয়েছে। ইবরাহীমের বংশে বরকত হ’ল নবুঅত ও ঐশী কিতাবের বরকত এবং মুহাম্মাদের ও তাঁর বংশে বরকত হ’ল বিজ্ঞানময় কুরআন ও হাদীছ এবং তার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থার বরকত।
ইবরাহীম ও তাঁর বংশধর সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
وَوَهَبْنَا لَهُ إِسْحَاقَ وَيَعْقُوْبَ وَجَعَلْنَا فِيْ ذُرِّيَّتِهِ النُّبُوَّةَ وَالْكِتَابَ وَآتَيْنَاهُ أَجْرَهُ فِي الدُّنْيَا وَإِنَّهُ فِي الْآخِرَةِ لَمِنَ الصَّالِحِيْنَ- (العنكبوت ২৭)-
‘আমরা তাকে দান করলাম ইসহাক্ব ও ইয়াকূবকে এবং তার বংশধরগণের মধ্যে প্রদান করলাম নবুঅত ও কিতাব। তাকে আমরা দুনিয়াতে পুরষ্কৃত করলাম। নিশ্চয়ই পরকালে সে সৎ লোকদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আনকাবূত ২৯/২৭)।
অতঃপর শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيراً- (الأحزاب ২১)-
‘যারা আল্লাহ ও শেষদিবসের (অর্থাৎ আখেরাতে মুক্তির) আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক হারে স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের (মুহাম্মাদের) মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে’ (আহযাব ৩৩/২১)। অতঃপর তাঁর পরিবার সম্পর্কে বলা হয়েছে,
إِنَّمَا يُرِيْدُ اللهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيْراً-(الأحزاب ৩৩)-
‘হে নবী পরিবারের সদস্যগণ! আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র রাখতে’ (আহযাব ৩৩/৩৩)। শেষ যামানায় ইমাম মাহদী আসবেন হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর বংশধরগণের মধ্য হ’তে এ বিষয়ে বহু ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।[2] এইভাবে ইবরাহীম ও মুহাম্মাদের নাম পৃথিবীর শেষদিন পর্যন্ত দিকে দিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হ’তে থাকবে। ফালিল্লাহিল হাম্দ।নবী ইবরাহীম :
আদম, ইয়াহ্ইয়া, ঈসা প্রমুখ দু’তিন জনের ব্যতিক্রম বাদে নূহ (আঃ) সহ অন্যান্য সকল নবীর ন্যায় ইবরাহীমকেও আমরা ধরে নিতে পারি যে, তিনি ৪০ বছর বয়সে নবুঅত লাভ করেন। উম্মতে মুসলিমার পিতা হযরত ইবরাহীম (আঃ) পশ্চিম ইরাকের বছরার নিকটবর্তী ‘বাবেল’ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। এই শহরটি পরবর্তীতে সুলায়মান (আঃ)-এর সময়ে জাদুর জন্য বিখ্যাত হয় (বাক্বারাহ ২/১০২)।
এখানে তখন কালেডীয় (كلدانى ) জাতি বসবাস করত। তাদের একচ্ছত্র সম্রাট ছিলেন নমরূদ। যিনি তৎকালীন পৃথিবীতে অত্যন্ত উদ্ধত ও অহংকারী সম্রাট ছিলেন। তিনি প্রায় চারশো বছর রাজত্ব করেন এবং শেষ পর্যন্ত নিজে ‘উপাস্য’ হবার দাবী করেন।[3] আল্লাহ তারই মন্ত্রী ও প্রধান পুরোহিত ‘আযর’-এর ঘরে বিশ্বনেতা ও বিশ্ব সংস্কারক নবী ইবরাহীমকে মুখ্যত: কালেডীয়দের প্রতি প্রেরণ করেন। ইবরাহীমের নিজ পরিবারের মধ্যে কেবল সহধর্মিনী ‘সারা’ ও ভ্রাতুষ্পুত্র ‘লূত’ মুসলমান হন।
স্ত্রী ‘সারা’ ছিলেন আদি মাতা বিবি হাওয়ার পরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী মহিলা। তিনি ১২৭ বছর বয়সে ‘হেবরনে’ মৃত্যু ববণ করেন ও সেখানেই কবরস্থ হন।[4] সারার মৃত্যুর পরে ইবরাহীম ক্বানতূরা বিনতে ইয়াক্বতিন ও হাজূন বিনতে আমীন নামে পরপর দুজন নারীকে বিয়ে করেন এবং ৬+৫=১১টি সন্তান লাভ করেন।[5] তিনি প্রায় দু’শো বছর জীবন পান বলে কথিত আছে।
উল্লেখ্য যে, হযরত ইবরাহীম (আঃ) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ২৫টি সূরায় ২০৪টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।[6] নিম্নে আমরা আয়াত সমূহ থেকে নিয়ে সাধ্যতম সাজিয়ে কাহিনী আকারে পেশ করার চেষ্টা পাব ইনশাআল্লাহ।-
সামাজিক অবস্থা:
ইবরাহীমের আবির্ভাবকালীন সময়ে কালেডীয় সমাজ শিক্ষা ও সভ্যতায় শীর্ষস্থানীয় ছিল। এমনকি তারা সৌরজগত নিয়েও গবেষণা করত। কিন্তু অসীলা পূজার রোগে আক্রান্ত হয়ে তারা আল্লাহকে পাবার জন্য বিভিন্ন মূর্তি ও তারকা সমূহের পূজা করত। হযরত ইবরাহীম উভয় ভ্রান্ত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে প্রেরিত হন।
ইবরাহীম (আঃ)-এর দাওয়াত : মূর্তিপূজারী কওমের প্রতি-
সকল নবীর ন্যায় ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় কওমকে প্রথমে তাওহীদের দাওয়াত দেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
وََإِبْرَاهِيمَ إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاتَّقُوهُ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ، إِنَّمَا تَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ أَوْثَاناً وَتَخْلُقُونَ إِفْكاً إِنَّ الَّذِينَ تَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ لَا يَمْلِكُونَ لَكُمْ رِزْقاً فَابْتَغُوا عِندَ اللَّهِ الرِّزْقَ وَاعْبُدُوهُ وَاشْكُرُوا لَهُ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ-(العنكبوت ১৬-১৭)-
‘স্মরণ কর ইবরাহীমকে, যখন তিনি তার সম্প্রদায়কে বললেন, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁকে ভয় কর। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা বুঝ’। ‘তোমরা তো আল্লাহর পরিবর্তে কেবল প্রতিমারই পূজা করছ এবং মিথ্যা উদ্ভাবন করছ। তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত করছ, তারা তোমাদের রিযিকের মালিক নয়। কাজেই আল্লাহর নিকটে রিযিক তালাশ কর। তাঁর ইবাদত কর এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। তাঁরই নিকটে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে’ (আনকাবূত ৩৩/১৬-১৭)।
ইবরাহীম (আঃ) উক্ত দাওয়াতের মধ্যে কেবল আল্লাহর স্বীকৃতি কামনা করেননি। বরং স্বীকৃতির ফলাফল (ثمرة الإقرار) আশা করেছিলেন। অর্থাৎ তারা যেন আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে মান্য করে এবং কোন অবস্থায় তা লংঘন না করে। কেননা স্বীকৃতির বিপরীত কাজ করা তা লংঘন করার শামিল।পিতার প্রতি :
وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّهُ كَانَ صِدِّيْقاً نَّبِيًّا، إِذْ قَالَ لِأَبِيْهِ يَا أَبَتِ لِمَ تَعْبُدُ مَا لاَ يَسْمَعُ وَلاَ يُبْصِرُ وَلاَ يُغْنِي عَنكَ شَيْئاً، يَا أَبَتِ إِنِّي قَدْ جَاءنِيْ مِنَ الْعِلْمِ مَا لَمْ يَأْتِكَ فَاتَّبِعْنِيْ أَهْدِكَ صِرَاطاً سَوِيّاً، يَا أَبَتِ لاَ تَعْبُدِ الشَّيْطَانَ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلرَّحْمَنِ عَصِيّاً، يَا أَبَتِ إِنِّيْ أَخَافُ أَن يَمَسَّكَ عَذَابٌ مِّنَ الرَّحْمَن فَتَكُوْنَ لِلشَّيْطَانِ وَلِيّاً-(مريم ৪১-৪৫)-
‘তুমি এই কিতাবে ইবরাহীমের কথা বর্ণনা কর। নিশ্চয়ই তিনি ছিলেন সত্যবাদী ও নবী’(১৯/৪১)। ‘যখন তিনি তার পিতাকে বললেন, হে আমার পিতা! তুমি তার পূজা কেন কর, যে শোনে না, দেখে না এবং তোমার কোন উপকারে আসে না?(৪২)। ‘হে আমার পিতা! আমার কাছে এমন জ্ঞান এসেছে, যা তোমার কাছে আসেনি। অতএব তুমি আমার অনুসরণ কর। আমি তোমাকে সরল পথ দেখাব’(৪৩)। ‘হে আমার পিতা! শয়তানের পূজা করো না। নিশ্চয়ই শয়তান দয়াময়ের অবাধ্য’(৪৪)। ‘হে আমার পিতা! আমি আশংকা করছি যে, দয়াময়ের একটি আযাব তোমাকে স্পর্শ করবে, অতঃপর তুমি শয়তানের বন্ধু হয়ে যাবে’ (মারিয়াম ১৯/৪১-৪৫)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيْمُ لأَبِيْهِ آزَرَ أَتَتَّخِذُ أَصْنَاماً آلِهَةً إِنِّيْ أَرَاكَ وَقَوْمَكَ فِيْ ضَلاَلٍ مُّبِيْنٍ- (الأنعام ৭৪)-
‘স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম তার পিতা আযরকে বললেন, তুমি কি প্রতিমা সমূহকে উপাস্য মনে কর? আমি দেখতে পাচ্ছি যে, তুমি ও তোমার সম্প্রদায় স্পষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছ’ (আন‘আম ৬/৭৪)।
কিন্তু ইবরাহীমের এই প্রাণভরা আবেদন পিতা আযরের হৃদয় স্পর্শ করল না। রাষ্ট্রের প্রধান পুরোহিত এবং সম্রাটের মন্ত্রী ও প্রিয়পাত্র হওয়ায় সম্ভবত: বিষয়টি তার প্রেস্টিজ ইস্যু হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, وَإِذَا قِيلَ لَهُ اتَّقِ اللّهَ أَخَذَتْهُ الْعِزَّةُ بِالإِثْمِ فَحَسْبُهُ جَهَنَّمُ وَلَبِئْسَ الْمِهَادُ، ‘যখন তাকে বলা হয়, আল্লাহকে ভয় কর, তখন তার সম্মান তাকে পাপে স্ফীত করে। অতএব তার জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট। আর নিঃসন্দেহে তা হ’ল নিকৃষ্টতম ঠিকানা’ (বাক্বারাহ ২/২০৬)। বস্ত্ততঃ অহংকারীদের চরিত্র সর্বত্র ও সর্বযুগে প্রায় একই হয়ে থাকে।
পিতার জবাব :
পুত্রের আকুতিপূর্ণ দাওয়াতের উত্তরে পিতা বলল,قَالَ أَرَاغِبٌ أَنْتَ عَنْ آلِهَتِيْ يَا إِبْرَاهِيْمُ لَئِن لَّمْ تَنْتَهِ لَأَرْجُمَنَّكَ وَاهْجُرْنِيْ مَلِيًّا- (مريم ৪৬)- ‘হে ইবরাহীম! তুমি কি আমার উপাস্যদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ? যদি তুমি বিরত না হও, তবে আমি অবশ্যই পাথর মেরে তোমার মাথা চূর্ণ করে দেব। তুমি আমার সম্মুখ হ’তে চিরতরের জন্য দূর হয়ে যাও’ (মারিয়াম ১৯/৪৬)।
ইবরাহীমের জবাব:
পিতার এই কঠোর ধমকি শুনে পুত্র ইবরাহীম বললেন,
قَالَ سَلاَمٌ عَلَيْكَ سَأَسْتَغْفِرُ لَكَ رَبِّي إِنَّهُ كَانَ بِي حَفِيّاً، وَأَعْتَزِلُكُمْ وَمَا تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ وَأَدْعُو رَبِّي عَسَى أَلاَّ أَكُونَ بِدُعَاء رَبِّي شَقِيّاً- (مريم ৪৭-৪৮)-
‘তোমার উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক! আমি আমার পালনকর্তার নিকটে তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব। নিশ্চয়ই তিনি আমার প্রতি মেহেরবান’। ‘আমি পরিত্যাগ করছি তোমাদেরকে এবং আল্লাহ ব্যতীত যাদের তোমরা পূজা কর তাদেরকে। আমি আমার পালনকর্তাকে আহবান করব। আশা করি আমার পালনকর্তাকে আহবান করে আমি বঞ্চিত হব না’ (মারিয়াম ১৯/৪৭-৪৮)।পিতাকে ও নিজ সম্প্রদায়কে একত্রে দাওয়াত:
আল্লাহ বলেন,
وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ إِبْرَاهِيْمَ، إِذْ قَالَ لِأَبِيْهِ وَقَوْمِهِ مَا تَعْبُدُوْنَ، قَالُوْا نَعْبُدُ أَصْنَاماً فَنَظَلُّ لَهَا عَاكِفِيْنَ، قَالَ هَلْ يَسْمَعُونَكُمْ إِذْ تَدْعُوْنَ، أَوْ يَنْفَعُوْنَكُمْ أَوْ يَضُرُّوْنَ، قَالُوْا بَلْ وَجَدْنَا آبَاءنَا كَذَلِكَ يَفْعَلُوْنَ، قَالَ أَفَرَأَيْتُم مَّا كُنْتُمْ تَعْبُدُوْنَ، أَنتُمْ وَآبَاؤُكُمُ الْأَقْدَمُوْنَ، فَإِنَّهُمْ عَدُوٌّ لِّي إِلاَّ رَبَّ الْعَالَمِيْنَ، الَّذِيْ خَلَقَنِيْ فَهُوَ يَهْدِيْنِ، وَالَّذِيْ هُوَ يُطْعِمُنِيْ وَيَسْقِيْنِ، وَإِذَا مَرِضْتُ فَهُوَ يَشْفِيْنِ، وَالَّذِيْ يُمِيْتُنِيْ ثُمَّ يُحْيِيْنِ، وَالَّذِيْ أَطْمَعُ أَن يَّغْفِرَ لِيْ خَطِيئَتِيْ يَوْمَ الدِّيْنِ، رَبِّ هَبْ لِيْ حُكْماً وَأَلْحِقْنِيْ بِالصَّالِحِيْنَ، وَاجْعَل لِّيْ لِسَانَ صِدْقٍ فِي الْآخِرِيْنَ، َاجْعَلْنِيْ مِن وَّرَثَةِ جَنَّةِ النَّعِيْمِ، وَاغْفِرْ لِأَبِيْ إِنَّهُ كَانَ مِنَ الضَّالِّيْنَ، وَلاَ تُخْزِنِيْ يَوْمَ يُبْعَثُوْنَ، يَوْمَ لاَ يَنفَعُ مَالٌ وَّلاَ بَنُوْنَ، إِلاَّ مَنْ أَتَى اللهَ بِقَلْبٍ سَلِيْمٍ، وَأُزْلِفَتِ الْجَنَّةُ لِلْمُتَّقِيْنَ، وَبُرِّزَتِ الْجَحِيْمُ لِلْغَاوِيْنَ، وَقِيْلَ لَهُمْ أَيْنَ مَا كُنْتُمْ تَعْبُدُوْنَ، مِنْ دُوْنِ اللهِ هَلْ يَنْصُرُوْنَكُمْ أَوْ يَنْتَصِرُوْنَ، فَكُبْكِبُوْا فِيْهَا هُمْ وَالْغَاوُوْنَ، وَجُنُوْدُ إِبْلِيْسَ أَجْمَعُوْنَ، قَالُوْا وَهُمْ فِيْهَا يَخْتَصِمُوْنَ، تَاللهِ إِنْ كُنَّا لَفِيْ ضَلاَلٍ مُّبِيْنٍ، إِذْ نُسَوِّيْكُم بِرَبِّ الْعَالَمِيْنَ، وَمَا أَضَلَّنَا إِلاَّ الْمُجْرِمُوْنَ، َمَا لَنَا مِنْ شَافِعِيْنَ، وَلاَ صَدِيْقٍ حَمِيْمٍ، فَلَوْ أَنَّ لَنَا كَرَّةً فَنَكُوْنَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ، إِنَّ فِيْ ذَلِكَ لَآيَةً وَمَا كَانَ أَكْثَرُهُم مُّؤْمِنِيْنَ- (الشعراء ৬৯-১০৪)-
‘আর তাদেরকে ইবরাহীমের বৃত্তান্ত শুনিয়ে দিন’(শো‘আরা ২৬/৬৯)। ‘যখন সে স্বীয় পিতা ও সম্প্রদায়কে ডেকে বলল, তোমরা কিসের পূজা কর’?(৭০)। তারা বলল, আমরা প্রতিমার পূজা করি এবং সর্বদা এদেরকেই নিষ্ঠার সাথে আঁকড়ে থাকি’(৭১)। ‘সে বলল, তোমরা যখন আহবান কর, তখন তারা শোনে কি’?(৭২)। ‘অথবা তারা তোমাদের উপকার বা ক্ষতি করতে পারে কি’?(৭৩)। ‘তারা বলল, না। তবে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি, তারা এরূপই করত’(৭৪)। ইবরাহীম বলল, তোমরা কি তাদের সম্পর্কে ভেবে দেখেছ, যাদের তোমরা পূজা করে আসছ’?(৭৫)। ‘তোমরা এবং তোমাদের পূর্ববর্তী পিতৃপুরুষেরা’(৭৬)। ‘তারা সবাই আমার শত্রু, বিশ্ব পালনকর্তা ব্যতীত’(৭৭)। ‘যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আমাকে পথ প্রদর্শন করেছেন’ (৭৮)। ‘যিনি আমাকে আহার দেশ ও পানীয় দান করেন’ (৭৯)। ‘যখন আমি পীড়িত হই, তখন তিনিই আমাকে আরোগ্য দান করেন’(৮০)। ‘যিনি আমার মৃত্যু ঘটাবেন, অতঃপর পুনর্জীবন দান করবেন’ (৮১)। ‘আশা করি শেষ বিচারের দিন তিনি আমার ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে দিবেন’ (৮২)। ‘হে আমার পালনকর্তা! আমাকে প্রজ্ঞা দান কর এবং আমাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত কর’(৮৩)। ‘এবং আমাকে পরবর্তীদের মধ্যে সত্যভাষী কর’ (৮৪)। ‘তুমি আমাকে নে‘মতপূর্ণ জান্নাতের উত্তরাধিকারীদের অন্তর্ভুক্ত কর’(৮৫)। (হে প্রভু) ‘তুমি আমার পিতাকে ক্ষমা কর। তিনি তো পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত’(৮৬) (হে আল্লাহ) ‘পুনরুত্থান দিবসে তুমি আমাকে লাঞ্ছিত কর না’ (৮৭)। ‘যে দিনে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে আসবে না’ (৮৮) ‘কিন্তু যে ব্যক্তি সরল হৃদয় নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে’ (৮৯)। ‘(ঐ দিন) জান্নাত আল্লাহভীরুদের নিকটবর্তী করা হবে’(৯০)। ‘এবং জাহান্নাম বিপথগামীদের সামনে উন্মোচিত করা হবে’(৯১)। ‘(ঐ দিন) তাদেরকে বলা হবে, তারা কোথায় যাদেরকে তোমরা পূজা করতে’?(৯২) ‘আল্লাহর পরিবর্তে। তারা কি (আজ) তোমাদের সাহায্য করতে পারে কিংবা তারা কি কোনরূপ প্রতিশোধ নিতে পারে’? (৯৩)। ‘অতঃপর তাদেরকে এবং (তাদের মাধ্যমে) পথভ্রষ্টদেরকে অধোমুখী করে নিক্ষেপ করা হবে জাহান্নামে’(৯৪) ‘এবং ইবলীস বাহিনীর সকলকে’ (৯৫)। ‘তারা সেখানে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে বলবে’(৯৬) ‘আল্লাহর কসম! আমরা প্রকাশ্য ভ্রান্তিতে ছিলাম’(৯৭), ‘যখন আমরা তোমাদেরকে (অর্থাৎ কথিত উপাস্যদেরকে) বিশ্বপালকের সমতুল্য গণ্য করতাম’(৯৮)।‘আসলে আমাদেরকে পাপাচারীরাই পথভ্রষ্ট করেছিল’ (৯৯)। ‘ফলে (আজ) আমাদের কোন সুফারিশকারী নেই’ (১০০) ‘এবং কোন সহৃদয় বন্ধুও নেই’(১০১)। ‘হায়! যদি কোনরূপে আমরা পৃথিবীতে ফিরে যাবার সুযোগ পেতাম, তাহ’লে আমরা ঈমানদারগণের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম’(১০২)। ‘নিশ্চয়ই এ ঘটনার মধ্যে নিদর্শন রয়েছে। বস্ত্ততঃ তাদের অধিকাংশই বিশ্বাসী ছিল না’ (১০৩)। ‘নিশ্চয়ই আপনার পালনকর্তা পরাক্রান্ত ও দয়ালু’ (শো‘আরা ২৬/৬৯-১০৪)।তারকা পূজারীদের সাথে বিতর্ক :
মূর্তি পূজারীদের সাথে বিতর্কের পরে তিনি তারকাপূজারী নেতাদের প্রতি তাওহীদের দাওয়াত দেন। কিন্তু তারাও মূর্তি পূজারীদের ন্যায় নিজ নিজ বিশ্বাসে অটল রইল। অবশেষে তাঁর সাথে তাদের নেতাদের তর্কযুদ্ধ আবশ্যিক হয়ে পড়ে। কেউ কেউ বলেছেন, ইবরাহীমের কওমের লোকেরা একই সাথে মূর্তি ও তারকার পূজা করত। সেটাও অসম্ভব কিছু নয়।
পবিত্র কুরআনে এই তর্কযুদ্ধ একটি অভিনব ও নাটকীয় ভঙ্গিতে প্রকাশ করা হয়েছে, যাতে সহজে আরবীয় পাঠক হৃদয়ে রেখাপাত করে। কেননা হযরত ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন সমগ্র আরবের লোকদের পিতামহ। তাঁর প্রতি গোটা আরব জাতি সম্মান প্রদর্শন করত। অথচ তাদের পিতামহ যার বিরুদ্ধে জীবনভর লড়াই করলেন জাহিল আরবরা সেই সব শিরকে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল। যে কা‘বা গৃহকে ইবরাহীম (আঃ) নির্মাণ করেন এক আল্লাহর ইবাদতের জন্য। তারা সেখানেই মূর্তিপূজা শুরু করে দিয়েছিল। অথচ মুখে আল্লাহকে স্বীকার করত এবং ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আঃ)-এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করত। আজকের মুসলমানদের জন্য এর মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। কেননা তারাও মুখে আল্লাহকে স্বীকার করে এবং শেষনবীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করে। অথচ নিজেরা কবর পূজা ও স্থানপূজার শিরকে লিপ্ত রয়েছে। আল্লাহর বিধানের অবাধ্যতা ও তার পরিবর্তে নিজেদের মনগড়া বিধান সমূহের আনুগত্য তো রয়েছেই। এক্ষণে আমরা কুরআনে বর্ণিত ইবরাহীমের অপর বিতর্ক যুদ্ধটির বিবরণ পেশ করব।-
আল্লাহ বলেন,
وَكَذَلِكَ نُرِيْ إِبْرَاهِيْمَ مَلَكُوْتَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَلِيَكُوْنَ مِنَ الْمُوْقِنِيْنَ، فَلَمَّا جَنَّ عَلَيْهِ اللَّيْلُ رَأَى كَوْكَباً قَالَ هَـذَا رَبِّي فَلَمَّا أَفَلَ قَالَ لا أُحِبُّ الآفِلِيْنَ، فَلَمَّا رَأَى الْقَمَرَ بَازِغاً قَالَ هَـذَا رَبِّيْ فَلَمَّا أَفَلَ قَالَ لَئِن لَّمْ يَهْدِنِيْ رَبِّي لَأَكُوْنَنَّ مِنَ الْقَوْمِ الضَّآلِّيْنَ، فَلَمَّا رَأَى الشَّمْسَ بَازِغَةً قَالَ هَـذَا رَبِّيْ هَـذَا أَكْبَرُ فَلَمَّا أَفَلَتْ قَالَ يَا قَوْمِ إِنِّيْ بَرِيءٌ مِّمَّا تُشْرِكُوْنَ، إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِيْ فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ حَنِيْفاً وَّمَا أَنَاْ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ، وَحَآجَّهُ قَوْمُهُ قَالَ أَتُحَاجُّونِّي فِي اللهِ وَقَدْ هَدَانِ وَلاَ أَخَافُ مَا تُشْرِكُوْنَ بِهِ إِلاَّ أَن يَّشَآءَ رَبِّيْ شَيْئاً وَسِعَ رَبِّيْ كُلَّ شَيْءٍ عِلْماً أَفَلاَ تَتَذَكَّرُوْنَ، وَكَيْفَ أَخَافُ مَا أَشْرَكْتُمْ وَلاَ تَخَافُوْنَ أَنَّكُمْ أَشْرَكْتُمْ بِاللّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ عَلَيْكُمْ سُلْطَاناً فَأَيُّ الْفَرِيْقَيْنِ أَحَقُّ بِالأَمْنِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ، الَّذِيْنَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوْا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَـئِكَ لَهُمُ الأَمْنُ وَهُم مُّهْتَدُوْنَ- (الأنعام ৭৫-৮২)-
‘আমি এরূপভাবেই ইবরাহীমকে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের অত্যাশ্চর্য বস্ত্তসমূহ দেখাতে লাগলাম, যাতে সে দৃঢ়বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়’ (আন‘আম ৬/৭৫)। ‘অনন্তর যখন রাত্রির অন্ধকার তার উপরে সমাচ্ছন্ন হ’ল, তখন সে তারকা দেখে বলল যে, এটি আমার পালনকর্তা। অতঃপর যখন তা অস্তমিত হ’ল, তখন বলল, আমি অস্তগামীদের ভালবাসি না’ (৭৬)। ‘অতঃপর যখন চন্দ্রকে ঝলমল করতে দেখল, তখন সে বলল, এটি আমার পালনকর্তা। কিন্তু পরে যখন তা অস্তমিত হ’ল, তখন বলল, যদি আমার প্রতিপালক আমাকে পথ প্রদর্শন না করেন, তাহ’লে অবশ্যই আমি পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’ (৭৭)। ‘অতঃপর যখন উদীয়মান সূর্যকে ডগমগে দেখতে পেল, তখন বলল, এটিই আমার পালনকর্তা এবং এটিই সবচেয়ে বড়। কিন্তু পরে যখন তা ডুবে গেল, তখন বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যেসব বিষয়কে শরীক কর, আমি ওসব থেকে মুক্ত’ (৭৮)। ‘আমি আমার চেহারাকে ঐ সত্তার দিকে একনিষ্ঠ করছি, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (৭৯)। ‘(তখন) তার সম্প্রদায় তার সাথে বিতর্ক করল। সে বলল, তোমরা কি আমার সাথে আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্ক করছ? অথচ তিনি আমাকে সরল পথ দেখিয়েছেন। আর আমি ভয় করিনা তাদের, যাদেরকে তোমরা তাঁর সাথে শরীক কর, তবে আমার পালনকর্তা যদি কিছু (কষ্ট দিতে) চান। আমার প্রভুর জ্ঞান সবকিছুতেই পরিব্যপ্ত। তোমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবে না’? (৮০)। ‘কিভাবে আমি ঐসব বস্ত্তকে ভয় করব, যাদেরকে তোমরা তাঁর সাথে শরীক করেছ? অথচ তোমরা এ বিষয়ে ভয় পাওনা যে, তোমরা আল্লাহর সাথে এমন সব বস্ত্তকে শরীক করেছ, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তোমাদের প্রতি কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। এক্ষণে উভয় দলের মধ্যে কে বেশী নিরাপত্তা লাভের অধিকারী? যদি তোমরা জ্ঞানী হয়ে থাক’ (৮১)। ‘যারা ঈমান আনে এবং স্বীয় ঈমানকে শিরকের সাথে মিশ্রিত করে না, তাদের জন্যই রয়েছে নিরাপত্তা এবং তারাই হ’ল সুপথপ্রাপ্ত’ (আন‘আম ৬/৭৫-৮২)।ইবরাহীম মূর্তি ভাঙ্গলেন :
জ্ঞানীদের ইশারাই যথেষ্ট। কিন্তু মানুষ যখন কোন কিছুর প্রতি অন্ধভক্তি পোষণ করে, তখন শত যুক্তিও কোন কাজ দেয় না। ফলে ইবরাহীম ভাবলেন, এমন কিছু একটা করা দরকার, যাতে পুরা সমাজ নড়ে ওঠে ও ওদের মধ্যে হুঁশ ফিরে আসে। সাথে সাথে তাদের মধ্যে তাওহীদী চেতনার উন্মেষ ঘটে। সেমতে তিনি সম্প্রদায়ের কেন্দ্রীয় দেবমন্দিরে গিয়ে মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলার সংকল্প করলেন।
ইবরাহীম (আঃ)-এর সম্প্রদায় বছরের একটা বিশেষ দিনে উৎসব পালন করত ও সেখানে নানারূপ অপচয় ও অশোভন কাজ করত। যেমন আজকাল প্রবৃত্তি পূজারী ও বস্ত্তবাদী লোকেরা করে থাকে কথিত সংস্কৃতির নামে। এইসব মেলায় সঙ্গত কারণেই কোন নবীর যোগদান করা সম্ভব নয়। কওমের লোকেরা তাকে উক্ত মেলায় যোগদানের আমন্ত্রণ জানালো। কিন্তু তিনি অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে সেখানে যেতে অপারগতা প্রকাশ করলেন (ছাফফাত ৩৭/৮৯)। অতঃপর তিনি ভাবলেন, আজকের এই সুযোগে আমি ওদের দেবমন্দিরে প্রবেশ করে মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেব। যাতে ওরা ফিরে এসে ওদের মিথ্যা উপাস্যদের অসহায়ত্বের বাস্তব দৃশ্য দেখতে পায়। হয়তবা এতে তাদের অনেকের মধ্যে হুঁশ ফিরবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান জাগ্রত হবে ও শিরক থেকে তওবা করবে।
অতঃপর তিনি দেবালয়ে ঢুকে পড়লেন ও দেব-দেবীদের দিকে লক্ষ্য করে বললেন, (তোমাদের সামনে এত নযর-নেয়ায ও ভোগ-নৈবেদ্য রয়েছে)। অথচ ‘তোমরা তা খাচ্ছ না কেন? কি ব্যাপার তোমরা কথা বলছ না কেন? তারপর তিনি ডান হাতে রাখা (সম্ভবতঃ কুড়াল দিয়ে) ভীষণ জোরে আঘাত করে সবগুলোকে গুঁড়িয়ে দিলেন (ছাফফাত ৩৭/৯১-৯৩)। তবে বড় মূর্তিটাকে পূর্বাবস্থায় রেখে দিলেন, যাতে লোকেরা তার কাছে ফিরে যায় (আম্বিয়া ২১/৫৮)।
মেলা শেষে লোকজন ফিরে এল এবং যথারীতি দেবমন্দিরে গিয়ে প্রতিমাগুলির অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে গেল। ‘তারা বলাবলি করতে লাগল, এটা নিশ্চয়ই ইবরাহীমের কাজ হবে। কেননা তাকেই আমরা সবসময় মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে বলতে শুনি। অতঃপর ইবরাহীমকে সেখানে ডেকে আনা হ’ল এবং জিজ্ঞেস করল, أَأَنتَ فَعَلْتَ هَذَا بِآلِهَتِنَا يَا إِبْرَاهِيمُ؟ ‘হে ইবরাহীম! তুমিই কি আমাদের উপাস্যদের সাথে এরূপ আচরণ করেছ’? (আম্বিয়া ২১/৬২)।
ইবরাহীম বললেন, بَلْ فَعَلَهُ كَبِيرُهُمْ هَذَا فَاسْأَلُوهُمْ إِنْ كَانُوا يَنْطِقُوْنَ- ‘বরং এই বড় মূর্তিটাই একাজ করেছে। নইলে এদেরকে জিজ্ঞেস কর, যদি তারা কথা বলতে পারে’ (আম্বিয়া ২১/৬৩)। সম্প্রদায়ের নেতারা একথা শুনে লজ্জা পেল এবং মাথা নীচু করে বলল, قَدْ عَلِمْتَ مَا هَؤُلاَء يَنْطِقُوْنَ- ‘তুমি তো জানো যে, এরা কথা বলে না’। ‘তিনি বললেন, قَالَ أَفَتَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَا لاَ يَنفَعُكُمْ شَيْئاً وَّلاَ يَضُرُّكُمْ- ‘তোমরা কি আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত কর, যা তোমাদের উপকারও করতে পারে না, ক্ষতিও করতে পারে না’ (আম্বিয়া ২১/৬৫-৬৬)। তিনি আরও বললেন,قَالَ أَتَعْبُدُونَ مَا تَنْحِتُونَ، وَالله خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْمَلُونَ- ‘তোমরা এমন বস্ত্তর পূজা কর, যা তোমরা নিজ হাতে তৈরী কর’? ‘অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে ও তোমাদের কর্মসমূহকে সৃষ্টি করেছেন’ (ছাফফাত ৩৭/৯৫-৯৬)।أُفٍّ لَّكُمْ وَلِمَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللهِ أَفَلاَ تَعْقِلُونَ- ‘ধিক তোমাদের জন্য এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমরা যাদের পূজা কর, ওদের জন্য। তোমরা কি বুঝ না’? (আম্বিয়া ২১/৬৭)।
তারপর যা হবার তাই হ’ল। যিদ ও অহংকারের বশবর্তী হয়ে সম্প্রদায়ের নেতারা ইবরাহীমকে চূড়ান্ত শাস্তি দেওয়ার পরিকল্পনা করল। তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, একে আর বাঁচতে দেওয়া যাবে না। শুধু তাই নয়, একে এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে মারতে হবে, যেন কেউ এর দলে যেতে সাহস না করে। তারা তাঁকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার প্রস্তাব গ্রহণ করল এবং সেটা বাদশাহ নমরূদের কাছে পেশ করল। সম্রাটের মন্ত্রী ও দেশের প্রধান পুরোহিতের ছেলে ইবরাহীম। অতএব তাকে সরাসরি সম্রাটের দরবারে আনা হ’ল।
নমরূদের সঙ্গে বিতর্ক ও অগ্নিপরীক্ষা :
ইবরাহীম (আঃ) এটাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে তাওহীদের দাওয়াত দেওয়ার সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করলেন। নমরূদ ৪০০ বছর ধরে রাজত্ব করায় সে উদ্ধত ও অহংকারী হয়ে উঠেছিল এবং নিজেকে একমাত্র উপাস্য ভেবেছিল। তাই সে ইবরাহীমকে জিজ্ঞেস করল, বল তোমার উপাস্য কে? নমরূদ ভেবেছিল, ইবরাহীম তাকেই উপাস্য বলে স্বীকার করবে। কিন্তু নির্ভীক কণ্ঠে ইবরাহীম জবাব দিলেন, رَبِّيَ الَّذِيْ يُحْيِـيْ وَيُمِيْتُ ‘আমার পালনকর্তা তিনি, যিনি মানুষকে বাঁচান ও মারেন’। মোটাবুদ্ধির নমরূদ বলল, أَنَا أُحْيِـيْ وَأُمِيْتُ ‘আমিও বাঁচাই ও মারি’। অর্থাৎ মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীকে খালাস দিয়ে মানুষকে বাঁচাতে পারি। আবার খালাসের আসামীকে মৃত্যুদন্ড দিতে পারি। এভাবে সে নিজেকেই মানুষের বাঁচা-মরার মালিক হিসাবে সাব্যস্ত করল। ইবরাহীম তখন দ্বিতীয় যুক্তি পেশ করে বললেন, فَإِنَّ اللهَ يَأْتِيْ بِالشَّمْسِ مِنَ الْمَشْرِقِ فَأْتِ بِهَا مِنَ الْمَغْرِبِ ‘আমার আল্লাহ সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে উদিত করেন, আপনি তাকে পশ্চিম দিক হ’তে উদিত করুন’। فَبُهِتَ الَّذِيْ كَفَرَ ‘অতঃপর কাফের (নমরূদ) এতে হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো’ (বাক্বারাহ ২/২৫৮)।
কওমের নেতারাই যেখানে পরাজয়কে মেনে নেয়নি, সেখানে দেশের একচ্ছত্র সম্রাট কেন পরাজয়কে মেনে নিবেন। যথারীতি তিনিও অহংকারে ফেটে পড়লেন এবং ইবরাহীমকে জ্বলন্ত হুতাশনে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার নির্দেশ জারি করলেন। সাথে সাথে জনগণকে ধর্মের দোহাই দিয়ে বললেন, حَرِّقُوهُ وَانصُرُوا آلِهَتَكُمْ إِنْ كُنتُمْ فَاعِلِيْنَ ‘তোমরা একে পুড়িয়ে মার এবং তোমাদের উপাস্যদের সাহায্য কর, যদি তোমরা কিছু করতে চাও’ (আম্বিয়া ২১/৬৮)। উল্লেখ্য যে, কুরআন কোথাও নমরূদের নাম উল্লেখ করেনি এবং সে যে নিজেকে ‘সর্বোচ্চ উপাস্য’ দাবী করেছিল, এমন কথাও স্পষ্টভাবে বলেনি। তবে ‘আমিও বাঁচাতে পারি ও মারতে পারি’ (বাক্বারাহ ২/২৫৮) তার এই কথার মধ্যে তার সর্বোচ্চ অহংকারী হবার এবং ইবরাহীমের ‘রব’-এর বিপরীতে নিজেকে এভাবে উপস্থাপন করায় সে নিজেকে ‘সর্বোচ্চ রব’ হিসাবে ধারণা করেছিল বলে প্রতীয়মান হয়। প্রধানত: ইস্রাঈলী বর্ণনাসমূহের উপরে ভিত্তি করেই ‘নমরূদ’-এর নাম ও তার রাজত্ব সম্পর্কে জানা যায়। কুরআন কেবল অতটুকুই বলেছে, যতটুকু মানব জাতির হেদায়াতের জন্য প্রয়োজন।
যুক্তিতর্কে হেরে গিয়ে নমরূদ ইবরাহীম (আঃ)-কে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার হুকুম দিল। অতঃপর তার জন্য বিরাটাকারের আয়োজন শুরু হয়ে গেল। আল্লাহ বলেন, وَأَرَادُوْا بِهِ كَيْداً فَجَعَلْنَاهُمُ الْأَخْسَرِيْنَ، ‘তারা ইবরাহীমের বিরুদ্ধে মহা ফন্দি অাঁটতে চাইল। অতঃপর আমরা তাদেরকেই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত করে দিলাম’ (আম্বিয়া ২১/৭০)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, فَجَعَلْنَاهُمُ الْأَسْفَلِينَ، ‘আমরা তাদেরকে পরাভূত করে দিলাম’ (ছাফফাত ৩৭/৯৮)।
অতঃপর ‘একটা ভিত নির্মাণ করা হ’ল এবং সেখানে বিরাট অগ্নিকুন্ড তৈরী করা হ’ল। তারপর সেখানে তাকে নিক্ষেপ করা হ’ল’ (ছাফফাত ৩৭/৯৭)। ছহীহ বুখারীতে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপের সময় ইবরাহীম (আঃ) বলে ওঠেন, حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ، ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’।[9]
একই প্রার্থনা শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) করেছিলেন, ওহোদ যুদ্ধে আহত মুজাহিদগণ যখন শুনতে পান যে, আবু সুফিয়ান মক্কায় ফিরে না গিয়ে পুনরায় ফিরে আসছে মদীনায় মুসলিম শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য, তখন ‘হামরাউল আসাদে’ উপনীত তার পশ্চাদ্ধাবনকারী ৭০ জন আহত ছাহাবীর ক্ষুদ্র দল রাসূলের সাথে সমস্বরে বলে উঠেছিল حَسْبُنَا اللّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيْلُ، ‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’ ঘটনাটি কুরআনেও বর্ণিত হয়েছে’।[10] এভাবে পিতা ইবরাহীম ও পুত্র মুহাম্মাদের বিপদ মুহূর্তের বক্তব্যে শব্দে শব্দে মিল হয়ে যায়। তবে সার্বিক প্রচেষ্টার সাথেই কেবল উক্ত দো‘আ পাঠ করতে হবে। নইলে কেবল দো‘আ পড়ে নিষ্ক্রিয় বসে থাকলে চলবে না। যেমন ইবরাহীম (আঃ) সর্বোচ্চ পর্যায়ে দাওয়াত দিয়ে চূড়ান্ত বিপদের সময় এ দো‘আ করেছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিরোধী পক্ষের সেনাপতি আবু সুফিয়ানের পশ্চাদ্ধাবনের পরেই উক্ত দো‘আ পড়েছিলেন।
বস্ত্ততঃ এই কঠিন মুহূর্তের পরীক্ষায় জয়লাভ করার পুরস্কার স্বরূপ সাথে সাথে আল্লাহর নির্দেশ এল قُلْنَا يَا نَارُ كُونِيْ بَرْداً وَّسَلاَماً عَلَى إِبْرَاهِيمَ، ‘হে আগুন! ঠান্ডা হয়ে যাও এবং ইবরাহীমের উপরে শান্তিদায়ক হয়ে যাও’ (আম্বিয়া ২১/৬৯)। অতঃপর ইবরাহীম মুক্তি পেলেন।
অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইবরাহীম (আঃ) ফিরে আসেন এবং এভাবে আল্লাহ কাফিরদের সমস্ত কৌশল বরবাদ করে দেন। এরপর শুরু হ’ল জীবনের আরেক অধ্যায়।কেন‘আনের জীবন :
জন্মভূমি বাবেল শহরে জীবনের প্রথমাংশ অতিবাহিত করার পর হিজরত ভূমি শামের কেন‘আনে তিনি জীবনের বাকী অংশ কাটাতে শুরু করেন। তাঁর জীবনের অন্যান্য পরীক্ষা সমূহ এখানেই অনুষ্ঠিত হয়। কিছু দিন অতিবাহিত করার পর এখানে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ। মানুষ সব দলে দলে ছুটতে থাকে মিসরের দিকে। মিসর তখন ফেরাঊনদের শাসনাধীনে ছিল। উল্লেখ্য যে, মিসরের শাসকদের উপাধি ছিল ‘ফেরাঊন’। ইবরাহীম ও মূসার সময় মিসর ফেরাঊনদের শাসনাধীনে ছিল। মাঝখানে ইউসুফ-এর সময়ে ২০০ বছরের জন্য মিসর হাকসূস (الهكسوس ) রাজাদের অধীনস্থ ছিল। যা ছিল ঈসা (আঃ)-এর আবির্ভাবের প্রায় ২০০০ বছর আগেকার ঘটনা’।[13]
মিসর সফর :
দুর্ভিক্ষ তাড়িত কেন‘আন হ’তে অন্যান্যদের ন্যায় ইবরাহীম (আঃ) সস্ত্রীক মিসরে রওয়ানা হ’লেন। ইচ্ছা করলে আল্লাহ তাঁর জন্য এখানেই রূযী পাঠাতে পারতেন। কিন্তু না। তিনি মিসরে কষ্টকর সফরে রওয়ানা হ’লেন। সেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল এক কঠিন ও মর্মান্তিক পরীক্ষা এবং সাথে সাথে একটি নগদ ও অমূল্য পুরষ্কার।
ঐ সময় মিসরের ফেরাঊন ছিল একজন নারী লোলুপ মদ্যপ শাসক। তার নিয়োজিত লোকেরা রাস্তার পথিকদের মধ্যে কোন সুন্দরী মহিলা পেলেই তাকে ধরে নিয়ে বাদশাহকে পৌঁছে দিত। যদিও বিবি ‘সারা’ ঐ সময় ছিলেন বৃদ্ধা মহিলা, তথাপি তিনি ছিলেন সৌন্দর্য্যের রাণী। মিসরীয় সম্রাটের নিয়ম ছিল এই যে, যে মহিলাকে তারা অপহরণ করত, তার সাথী পুরুষ লোকটি যদি স্বামী হ’ত, তাহ’লে তাকে হত্যা করে মহিলাকে নিয়ে যেত। আর যদি ভাই বা পিতা হ’ত, তাহ’লে তাকে ছেড়ে দিত। তারা ইবরাহীমকে জিজ্ঞেস করলে তিনি সারাকে তাঁর ‘বোন’ পরিচয় দিলেন। নিঃসন্দেহে ‘সারা’ তার ইসলামী বোন ছিলেন। ইবরাহীম তাকে আল্লাহর যিম্মায় ছেড়ে দিয়ে ছালাতে দাঁড়িয়ে গেলেন ও আল্লাহর নিকটে স্বীয় স্ত্রীর ইয্যতের হেফাযতের জন্য আকুলভাবে প্রার্থনা করতে থাকলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহ নিশ্চয়ই তার স্ত্রীর ইয্যতের হেফাযত করবেন।
সারাকে যথারীতি ফেরাঊনের কাছে আনা হ’ল। অতঃপর পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
فلمَّا دَخلتْ سارةُ على الْمَلِكِ قامَ إليها فأَقبلتْ تتوضأُ و تُصَلىِّ وتقولُ: أللَّهم إِنْ كنتَ تعلمُ أَنِّي آمنتُ بِكَ وبرسولكَ وأَحْصنتُ فَرْجِي إلا على زوجي فلا تُسلِّطْ علىَّ الكافرَ ু رواه البخارىُّ و أحمد بإِسنادٍ صحيحٍ-
‘যখন সারা সম্রাটের নিকটে নীত হ’লেন এবং সম্রাট তার দিকে এগিয়ে এল, তখন তিনি ওযূ করার জন্য গেলেন ও ছালাতে রত হয়ে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করে বললেন, হে আল্লাহ! যদি তুমি জেনে থাক যে, আমি তোমার উপরে ও তোমার রাসূলের উপরে ঈমান এনেছি এবং আমি আমার একমাত্র স্বামীর জন্য সতীত্ব বজায় রেখেছি, তাহ’লে তুমি আমার উপরে এই কাফিরকে বিজয়ী করো না’।[14]
সতীসাধ্বী স্ত্রী সারার দো‘আ সঙ্গে সঙ্গে কবুল হয়ে গেল। সম্রাট এগিয়ে আসার উপক্রম করতেই হাত-পা অবশ হয়ে পড়ে গিয়ে গোঙাতে লাগলো। তখন সারাহ প্রার্থনা করে বললেন, হে আল্লাহ! লোকটি যদি এভাবে মারা যায়, তাহ’লে লোকেরা ভাববে আমি ওকে হত্যা করেছি’। তখন আল্লাহ সম্রাটকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু শয়তান আবার এগিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে আবার মরার মত পড়ে রইল।
এভাবে সে দুই অথবা তিনবার বেহুঁশ হয়ে পড়লো আর সারা-র দো‘আয় বাঁচলো। অবশেষে সে বলল, তোমরা আমার কাছে একটা শয়তানীকে পাঠিয়েছ। যাও একে ইবরাহীমের কাছে ফেরত দিয়ে আসো এবং এর খেদমতের জন্য হাজেরাকে দিয়ে দাও। অতঃপর সারাহ তার খাদেমা হাজেরাকে নিয়ে সসম্মানে স্বামী ইবরাহীমের কাছে ফিরে এলেন’(ঐ)। এই সময় ইবরাহীম ছালাতের মধ্যে সারার জন্য প্রার্থনায় রত ছিলেন। সারা ফিরে এলে তিনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। আল-হামদুলিল্লাহ! যে আল্লাহ তাঁর বান্দা ইবরাহীমকে নমরূদের প্রজ্জ্বলিত হুতাশন থেকে বাঁচিয়ে এনেছেন, সেই আল্লাহ ইবরাহীমের ঈমানদার স্ত্রীকে ফেরাঊনের লালসার আগুন থেকে কেন বাঁচিয়ে আনবেন না? অতএব সর্বাবস্থায় যাবতীয় প্রশংসা কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য।কেন‘আনী জীবনের পরীক্ষা সমূহ :
১ম পরীক্ষা: দুর্ভিক্ষে পতিত হয়ে মিসর গমন : কেন‘আনী জীবনে তাঁর প্রথম পরীক্ষা হ’ল কঠিন দুর্ভিক্ষে তাড়িত হয়ে জীবিকার সন্ধানে মিসরে হিজরত করা। এ বিষয়ে পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে।
২য় পরীক্ষা: সারাকে অপহরণ : মিসরে গিয়ে সেখানকার লম্পট সম্রাট ফেরাঊনের কুদৃষ্টিতে পড়ে স্ত্রী সারাকে অপহরণের মর্মান্তিক পরীক্ষা। এ বিষয়ে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
৩য় পরীক্ষা: হাজেরাকে মক্কায় নির্বাসন : মিসর থেকে ফিরে কেন‘আনে আসার বৎসরাধিককাল পরে প্রথম সন্তান ইসমাঈলের জন্ম লাভ হয়। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তিনি শিশু সন্তান ও তার মা হাজেরাকে মক্কার বিজন পাহাড়ী উপত্যকায় নিঃসঙ্গভাবে রেখে আসার এলাহী নির্দেশ লাভ করেন। বস্ত্ততঃ এটা ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক পরীক্ষা। এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিম্নরূপ:
হযরত ইবরাহীম (আঃ) যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে শিশু পুত্র ইসমাঈল ও তার মাকে মক্কায় নির্বাসনে রেখে আসার নির্দেশ পান, তখনই তার অন্তরে বিশ্বাস জন্মেছিল যে, নিশ্চয়ই এ নির্দেশের মধ্যে আল্লাহর কোন মহতী পরিকল্পনা লুক্কায়িত আছে এবং নিশ্চয়ই তিনি ইসমাঈল ও তার মাকে ধ্বংস করবেন না।
অতঃপর এক থলে খেজুর ও এক মশক পানি সহ তাদের বিজনভূমিতে রেখে যখন ইবরাহীম (আঃ) একাকী ফিরে আসতে থাকেন, তখন বেদনা-বিস্মিত স্ত্রী হাজেরা ব্যাকুলভাবে তার পিছে পিছে আসতে লাগলেন। আর স্বামীকে এর কারণ জিজ্ঞেস করতে থাকেন। কিন্তু বুকে বেদনার পাষাণ বাঁধা ইবরাহীমের মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুলো না। তখন হাজেরা বললেন, আপনি কি আল্লাহর হুকুমে আমাদেরকে এভাবে ফেলে যাচ্ছেন? ইবরাহীম ইশারায় বললেন, হ্যাঁ। তখন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে অটল বিশ্বাস ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে হাজেরা বলে উঠলেন, إذَنْ لايُضَيِّعُنَا اللهُ ‘তাহ’লে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না’। ফিরে এলেন তিনি সন্তানের কাছে। দু’একদিনের মধ্যেই ফুরিয়ে যাবে পানি ও খেজুর। কি হবে উপায়? খাদ্য ও পানি বিহনে বুকের দুধ শুকিয়ে গেলে কচি বাচ্চা কি খেয়ে বাঁচবে। পাগলপরা হয়ে তিনি মানুষের সন্ধানে দৌঁড়াতে থাকেন ছাফা ও মারওয়া পাহাড়ের এ মাথা আর ও মাথায়। এভাবে সপ্তমবারে তিনি দূর থেকে দেখেন যে, বাচ্চার পায়ের কাছ থেকে মাটির বুক চিরে বেরিয়ে আসছে ঝর্ণার ফল্গুধারা, জিব্রীলের পায়ের গোড়ালি বা তার পাখার আঘাতে যা সৃষ্টি হয়েছিল। ছুটে এসে বাচ্চাকে কোলে নিলেন অসীম মমতায়। স্নিগ্ধ পানি পান করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। হঠাৎ অদূরে একটি আওয়ায শুনে তিনি চমকে উঠলেন। উনি জিবরীল। বলে উঠলেন, لا تخافوا الضَّيعةَ، إنَّ هذا بيتُ الله يَبْنى هذا الغلامُ و أبوه وإن الله لايُضيعُ أهلَه- ‘আপনারা ভয় পাবেন না। এখানেই আল্লাহর ঘর। এই সন্তান ও তার পিতা এ ঘর সত্বর পুনর্নির্মান করবেন। আল্লাহ তাঁর ঘরের বাসিন্দাদের ধ্বংস করবেন না’। বলেই শব্দ মিলিয়ে গেল’।৪র্থ পরীক্ষা: খাৎনা করণ :
ইবরাহীমের প্রতি আদেশ হ’ল খাৎনা করার জন্য। এসময় তাঁর বয়স ছিল অন্যূন ৮০ বছর। হুকুম পাওয়ার সাথে সাথে দেরী না করে নিজেই নিজের খাৎনার কাজ সম্পন্ন করলেন।[21] বিনা দ্বিধায় এই কঠিন ও বেদনাদায়ক কাজ সম্পন্ন করার মধ্যে আল্লাহর হুকুম দ্রুত পালন করার ও এ ব্যাপারে তাঁর কঠোর নিষ্ঠার প্রমাণ পাওয়া যায়।
খাৎনার এই প্রথা ইবরাহীমের অনুসারী সকল ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে আজও চালু আছে। বস্ত্ততঃ খাৎনার মধ্যে যে অফুরন্ত কল্যাণ নিহিত রয়েছে, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীগণ তা অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেছেন। এর ফলে খাৎনাকারীগণ অসংখ্য অজানা রোগ-ব্যাধি হ’তে মুক্ত রয়েছেন এবং সুস্থ জীবন লাভে ধন্য হয়েছেন। এটি মুসলিম এবং অমুসলিমের মধ্যে একটি স্থায়ী পার্থক্যও বটে।
৫ম পরীক্ষা: পুত্র কুরবানী :
একমাত্র শিশু পুত্র ও তার মাকে মক্কায় রেখে এলেও ইবরাহীম (আঃ) মাঝে-মধ্যে সেখানে যেতেন ও দেখা-শুনা করতেন। এভাবে ইসমাঈল ১৩/১৪ বছর বয়সে উপনীত হ’লেন এবং পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার উপযুক্ত হ’লেন। বলা চলে যে, ইসমাঈল যখন বৃদ্ধ পিতার সহযোগী হ’তে চলেছেন এবং পিতৃহৃদয় পুরোপুরি জুড়ে বসেছেন, ঠিক সেই সময় আল্লাহ ইবরাহীমের মহববতের কুরবানী কামনা করলেন। বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র নয়নের পুত্তলী ইসমাঈলের মহববত ইবরাহীমকে কাবু করে ফেলল কি-না, আল্লাহ যেন সেটাই যাচাই করতে চাইলেন। ইতিপূর্বে অগ্নিপরীক্ষা দেবার সময় ইবরাহীমের কোন পিছুটান ছিল না। কিন্তু এবার রয়েছে প্রচন্ড রক্তের টান।
দ্বিতীয়তঃ অগ্নি পরীক্ষায় বাদশাহ তাকে বাধ্য করেছিল। কিন্তু এবারের পরীক্ষা স্বেচ্ছায় ও স্বহস্তে সম্পন্ন করতে হবে। তাই এ পরীক্ষাটি ছিল পূর্বের কঠিন অগ্নি পরীক্ষার চেয়ে নিঃসন্দেহে কঠিনতর। সূরা ছাফফাত ১০২ আয়াত হ’তে ১০৯ আয়াত পর্যন্ত এ বিষয়ে বর্ণিত ঘটনাটি নিম্নরূপ:
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِن شَآءَ اللهُ مِنَ الصَّابِرِينَ- (الصافات ১০২)-
‘যখন (ইসমাঈল) পিতার সাথে চলাফেরা করার মত বয়সে উপনীত হ’ল, তখন (ইবরাহীম) তাকে বললেন, হে আমার বেটা! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবহ করছি। এখন বল তোমার অভিমত কি? সে বলল, হে পিতা! আপনাকে যা নির্দেশ করা হয়েছে, আপনি তা কার্যকর করুন। আল্লাহ চাহেন তো আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত দেখতে পাবেন’ (ছাফফাত ৩৭/১০২)।
ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, মক্কা থেকে বের করে ৮ কি: মি: দক্ষিণ-পূর্বে মিনা প্রান্তরে নিয়ে যাওয়ার পথে বর্তমানে যে তিন স্থানে হাজীগণ শয়তানকে পাথর মেরে থাকেন, ঐ তিন স্থানে ইবলীস তিনবার ইবরাহীম (আঃ)-কে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল। আর তিনবারই ইবরাহীম (আঃ) শয়তানের প্রতি ৭টি করে কংকর নিক্ষেপ করেছিলেন।[22] সেই স্মৃতিকে জাগরুক রাখার জন্য এবং শয়তানের প্রতারণার বিরুদ্ধে মুমিনকে বাস্তবে উদ্বুদ্ধ করার জন্য এ বিষয়টিকে হজ্জ অনুষ্ঠানের ওয়াজিবাতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখানেই অনতিদূরে পূর্ব দিকে ‘মসজিদে খায়েফ’ অবস্থিত।
অতঃপর পিতা-পুত্র আল্লাহ নির্দেশিত কুরবানগাহ ‘মিনায়’ উপস্থিত হ’লেন। সেখানে পৌঁছে পিতা পুত্রকে তাঁর স্বপ্নের কথা বর্ণনা করলেন এবং পুত্রের অভিমত চাইলেন। পুত্র তার অভিমত ব্যক্ত করার সময় বললেন, ‘ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ছবরকারীদের অন্তর্ভুক্ত দেখতে পাবেন’। ইনশাআল্লাহ না বললে হয়ত তিনি ধৈর্য ধারণের তাওফীক পেতেন না। এরপর তিনি নিজেকে ‘ছবরকারী’ না বলে ‘ছবরকারীদের অন্তর্ভুক্ত’ বলেছেন এবং এর মাধ্যমে নিজের পিতা সহ পূর্বেকার বড় বড় আত্মোৎসর্গকারীদের মধ্যে নিজেকে শামিল করে নিজেকে অহমিকা মুক্ত করেছেন। যদিও তাঁর ন্যায় তরুণের এরূপ স্বেচ্ছায় আত্মোৎসর্গের ঘটনা ইতিপূর্বে ঘটেছিল বলে জানা যায় না। আল্লাহ বলেন,
فَلَمَّا أَسْلَمَا وَ تَلَّهُ لِلْجَبِينِ، وَنَادَيْنَاهُ أَن يَّآ إِبْرَاهِيْمُ، قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَالِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِيْنَ، إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلآءُ الْمُبِيْنُ، وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيْمٍ، وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِيْنَ، سَلاَمٌ عَلَى إِبْرَاهِيْمَ- (الصافات ১০৩-১০৯)-
‘অতঃপর (পিতা-পুত্র) উভয়ে যখন আত্মসমর্পণ করল এবং পিতা পুত্রকে উপুড় করে শায়িত করল’। ‘তখন আমরা তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহীম’! ‘তুমি তোমার স্বপ্ন সত্যে পরিণত করেছ। আমরা এভাবেই সৎকর্মশীলগণের প্রতিদান দিয়ে থাকি’। ‘নিশ্চয়ই এটি একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা’। ‘আর আমরা তার পরিবর্তে একটি মহান যবহ প্রদান করলাম’ ‘এবং আমরা এ বিষয়টি পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম’। ‘ইবরাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হৌক’ (ছাফফাত ৩৭/১০৩-১০৯)।আদমের পাঁচটি শ্রেষ্ঠত্ব :
(১) আল্লাহ তাকে নিজ দু’হাতে সৃষ্টি করেছেন (ছোয়াদ ৩৮/৭৫)। (২) আল্লাহ নিজে তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দিয়েছেন (ছোয়াদ ৩৮/৭২)। (৩) আল্লাহ তাকে সকল বস্ত্তর নাম শিক্ষা দিয়েছেন (বাক্বারাহ ২/৩১)। (৪) তাকে সিজদা করার জন্য আল্লাহ ফেরেশতাদের নির্দেশ দিয়েছেন (বাক্বারাহ ২/৩৪)। (৫) আদম একাই মাত্র মাটি থেকে সৃষ্ট। বাকী সবাই পিতা-মাতার মাধ্যমে সৃষ্ট (সাজদাহ ৩২/৭-৯)।
ইবলীসের অভিশপ্ত হওয়ার কারণ ছিল তার ক্বিয়াস। সে আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে যুক্তি পেশ করে বলেছিল, ‘আমি আদমের চাইতে উত্তম। কেননা আপনি আমাকে আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি দয়ে’ (হিজর ২৯)। মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন বলেন, اول من قاس ابليس ‘প্রথম ক্বিয়াস করেছিল ইবলীস’। হাসান বছরীও অনুরূপ বলেছেন।[12]
নারী জাতি পুরুষেরই অংশ এবং তার অনুগত :
সিজদা অনুষ্ঠানের পর আল্লাহ আদমের জুড়ি হিসাবে তার অবয়ব হ’তে একাংশ নিয়ে অর্থাৎ তার পাঁজর হ’তে তার স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি করলেন[13] মাটি থেকে সৃষ্ট হওয়া আদমের নাম হ’ল ‘আদম’ এবং জীবন্ত আদমের পাঁজর হ’তে সৃষ্ট হওয়ায় তাঁর স্ত্রীর নাম হ’ল ‘হাওয়া’ (কুরতুবী)। অতঃপর তাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বললেন, ‘তোমরা দু’জন জান্নাতে বসবাস কর ও সেখান থেকে যা খুশী খেয়ে বেড়াও। তবে সাবধান! এই গাছটির নিকটে যেয়ো না। তাহ’লে তোমরা সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (বাক্বারাহ ২/৩৫)। এতে বুঝা যায় যে, ফেরেশতাগণের সিজদা কেবল আদমের জন্য ছিল, হাওয়ার জন্য নয়। দ্বিতীয়তঃ সিজদা অনুষ্ঠানের পরে আদমের অবয়ব থেকে হাওয়াকে সৃষ্টি করা হয়, পূর্বে নয়। তিনি পৃথক কোন সৃষ্টি ছিলেন না। এতে পুরুষের প্রতি নারীর অনুগামী হওয়া প্রমাণিত হয়। আল্লাহ বলেন, ‘পুরুষেরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল’ (নিসা ৪/৩৪)। অতঃপর বহিষ্কৃত ইবলীস তার প্রথম টার্গেট হিসাবে আদম ও হাওয়ার বিরুদ্ধে প্রতারণার জাল নিক্ষেপ করল। সেমতে সে প্রথমে তাদের খুব আপনজন বনে গেল এবং নানা কথায় তাদের ভুলাতে লাগল। এক পর্যায়ে সে বলল, ‘আল্লাহ যে তোমাদেরকে ঐ গাছটির নিকটে যেতে নিষেধ করেছেন, তার কারণ হ’ল এই যে, তোমরা তাহ’লে ফেরেশতা হয়ে যাবে কিংবা তোমরা এখানে চিরস্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাবে’ (আ‘রাফ ৭/২০)। সে অতঃপর কসম খেয়ে বলল যে, আমি অবশ্যই তোমাদের হিতাকাংখী’ (ঐ, ২১)। ‘এভাবেই সে আদম ও হাওয়াকে সম্মত করে ফেলল এবং তার প্রতারণার জালে আটকে গিয়ে তারা উক্ত নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল আস্বাদন করল। ফলে সাথে সাথে তাদের গুপ্তাঙ্গ প্রকাশিত হয়ে পড়ল এবং তারা তড়িঘড়ি গাছের পাতা সমূহ দিয়ে তা ঢাকতে লাগল। আল্লাহ তাদেরকে ডেকে বললেন, আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষ থেকে নিষেধ করিনি এবং বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? (ঐ, ২২) তখন তারা অনুতপ্ত হ’য়ে বলল, قَالاَ رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ- ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা নিজেদের উপর যুলুম করেছি। যদি আপনি আমাদের ক্ষমা না করেন, তবে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’ (২৩)। ‘আল্লাহ তখন বললেন, তোমরা (জান্নাত থেকে) নেমে যাও। তোমরা একে অপরের শত্রু। তোমাদের অবস্থান হবে পৃথিবীতে এবং সেখানেই তোমরা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত সম্পদরাজি ভোগ করবে’ (২৪)। তিনি আরও বললেন যে, ‘তোমরা পৃথিবীতেই জীবনযাপন করবে, সেখানেই মৃত্যুবরণ করবে এবং সেখান থেকেই তোমরা পুনরুত্থিত হবে’ (আ‘রাফ ৭/২০-২৫)।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ইবলীসের কথায় সর্বপ্রথম হাওয়া প্রতারিত হন। অতঃপর তার মাধ্যমে আদম প্রতারিত হন বলে যে কথা চালু আছে কুরআনে এর কোন সমর্থন নেই। ছহীহ হাদীছেও স্পষ্ট কিছু নেই। এ বিষয়ে তাফসীরে ইবনু জারীরে ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে যে বর্ণনা এসেছে, তা যঈফ।[14] দ্বিতীয়তঃ জান্নাত থেকে অবতরণের নির্দেশ তাদের অপরাধের শাস্তি স্বরূপ ছিলনা। কেননা এটা ছিল তওবা কবুলের পরের ঘটনা। অতএব এটা ছিল হয়তবা তাকে শিষ্টাচার শিক্ষা দানের জন্য। বরং সঠিক কথা এই যে, এটা ছিল আল্লাহর পূর্ব নির্ধারিত ও দূরদর্শী পরিকল্পনারই অংশ। কেননা জান্নাত হ’ল কর্মফল লাভের স্থান, কর্মের স্থান নয়। তাছাড়া জান্নাতে মানুষের বংশ বৃদ্ধির সুযোগ নেই। এজন্য দুনিয়ায় নামিয়ে দেওয়া যরূরী ছিল।
প্রথম বার আদেশ দানের পরে পুনরায় স্নেহ ও অনুগ্রহ মিশ্রিত আদেশ দিয়ে বললেন, ‘তোমরা সবাই নেমে যাও’। অতঃপর পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফা হওয়ার (বাক্বারাহ ২/৩০; ফাত্বির ৩৫/৩৯) মহান মর্যাদা প্রদান করে বললেন, ‘তোমাদের নিকটে আমার পক্ষ থেকে হেদায়াত অবতীর্ণ হবে। যারা তার অনুসরণ করবে, তাদের জন্য কোন ভয় বা চিন্তার কারণ থাকবে না। কিন্তু যারা তা প্রত্যাখ্যান করবে ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে, তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী এবং সেখানে তারা অনন্তকাল ধরে অবস্থান করবে’ (বাক্বারাহ ২/৩৮-৩৯)।
No comments:
Post a Comment